মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রেনিসেব নীল নদের ওপারে তাকিয়ে ছিল।

খানিকটা দূরে অস্পষ্ট থেকে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠা তার  দুই ভাই ইয়ামোস ও সোবেকের কথা সে শুনতে পাচ্ছিল। খেতের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বাঁধ আরো শক্ত করা দরকার কি না সে ব্যাপারে তারা কথা বলছিল। বরাবরের মতো এখনও সোবেকের কণ্ঠস্বর ছিল গনগনে ও আত্মবিশ্বাসী।  সে সবসময় সহজে অথচ জোরালোভাবে নিজের মতামত প্রকাশে অভ্যস্ত ছিল। ইয়ামোসের কণ্ঠস্বর নিচু ধরনের ও দোদুল্যমান শোনাচ্ছিল, যাতে সন্দেহ ও উদ্বেগ প্রবল হয়ে উঠেছিল। তার চরিত্রে সবসময়ই এক ধরনের উৎকণ্ঠা বা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যেত। সে ছিল পরিবারের বড় ছেলে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মালিকানাধীনগুলোতে কৃষি জমিগুলো তদারকির ক্ষমতা তার আয়ত্তে থাকত। ইয়ামোস ছিল ধীরস্থির, বিচক্ষণ এবং কোনো কাজের ব্যাপারে বাধা না থাকলেও তা খুঁজে দেখা তার স্বভাবে ছিল। সে ছিল ভারিক্কি গড়নের ধীরগতির মানুষ, যার কিছুই সোবেকের সুদর্শন চেহারা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিলত না।

রেনিসেব বেশ মনে করতে পারে যে ছোটবেলা থেকেই সে তার বড় ভাইদের এ ধরনের তর্ক করতে শুনত। এ স্মৃতি হুট করেই তার মনে একধরনের নিরাপত্তা জাগিয়ে তুলত- সে নিজের বাড়িতে আবার এসেছে। হ্যা, সে বাড়িতে এসেছে...

যদিও সে আরেকবার শীর্ণ ঝলমলে নীল নদের দিকে তাকিয়েছিল, তার বিদ্রোহ ও বেদনা আবারও বেড়েছিল। কেয়, তার তরুণ সুদর্শন স্বামী মারা গিয়েছিল ...  হাসিভরা মুখ ও বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী কেয়ের ছবি রেনিসেবের মনে ভাসছিল। সে মৃতের রাজ্যে দেবতা অসিরিসের কাছে চলে গিয়েছিল। আর সে, কেয়ের প্রিয় ও ভালোবাসার স্ত্রী রেনিসেব একাই রয়ে গিয়েছিল। তারা আট বছর সংসার করেছে- যখন রেনিসেব কেয়ের কাছে যায় বিয়ের পর, সে প্রায় বাচ্চা মেয়ে- আর এখন সে বিধবা হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে কেয়ের বাচ্চা টেটিকে নিয়ে।

এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এ জায়গা ছেড়ে কখনো কোথাও যায়নি...

সে সেই ভাবনায় মগ্ন হয়েছিল...

সে ঐ আট বছরের কথা ভুলে যাবে- যা অচিন্তনীয় সুখ আর প্রবল বেদনা ও ক্ষতিতে মোড়ানো।

হ্যা, ভুলে যাবে, তার মনে এসব ভাবনা আর জায়গা পাবে না।  সে আবার হয়ে সমাধিসৌধের পুরোহিত ইমহোটেপের চিন্তামুক্ত, নির্মল মেয়ে। স্বামী ও ভাইয়ের ভালোবাসা আসলে নির্দয়তার ব্যাপার, মধুরতার আড়ালে যা তাকে শুধু প্রতারিতই করেছে। তার মনে পড়ে তামাটে রঙের বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী হাসিমাখা মুখের সেই মানুষটিকে- মাদুলি বেঁধে সুরক্ষিত করে, ব্যান্ডেজে মুড়ে যাকে কবর দেয়া হয়েছে অন্য এক ভুবনে যাত্রার জন্য। কেয় আর এ জগতে নেই- নীলনদে নৌকা চালাতে এবং মাছ ধরতে এবং  রোদের মধ্যে হাসতে, যখন রেনিসেব  নৌকার ভেতর ছোট টেটিকে নিজের কোলের ভাঁজে জড়িয়ে সামনের দিকে বসাত আর তার দিকে পেছনে ফিরে হাসত ...

রেনিসেব ভাবছিল:

আমি এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না। আমি বাড়িতে এসেছি। সবকিছু আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। এখন আমাকেও আগের মতোই হতে হবে। সব আবার আগের মতো হবে। টেটি ইতোমধ্যে সেসব ভুলেও গেছে। সে এখানকার অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাসছে, খেলছে।

রেনিসেব  হঠাৎ করে ঘুরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল,  তখন বোঝা বহনকারী কয়েকটি গাধাকে নদীতীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে শস্যক্ষেত ও সংলগ্ন বাড়িঘর পেরিয়ে প্রবেশপথ দিয়ে উঠোনে চলে এল। উঠোনটি ছিল বেশ আরামদায়ক। সেখানে কৃত্রিম লেক ছিল, যার চারপাশ করবী ও জুঁই ফুলের গাছে শোভিত আর এর পাড় সারি সারি ডুমুরগাছের ছায়ায় ঢাকা ছিল। টেটি ও অন্য বাচ্চারা সেখানে খেলছিল, তাদের গলার আওয়াজ বেশ জোরে স্পষ্টভাবে তার কানে এল। লেকের একদিকে আলাদা সীমানাচিহ্নিত  ছোট একটি জায়গা ছিল। বাচ্চারা এর ভেতরে-বাইরে বারবার আসা-যাওয়া করছিল। রেনিসেব খেয়াল করেছিল যে টেটি কাঠের একটি সিংহ নিয়ে খেলছিল, যেটির মুখ দড়ি দিয়ে টানলে খোলে ও বন্ধ হয়। এটি এমন একটি খেলনা, যেটি সে ছোটবেলায় ভালোবাসত।  সে আবারো নিশ্চিন্তমনে ভাবল “আমি বাড়িতে এসেছি ...” এখানকার কিছুই বদলায়নি; আগে যেমন ছিল সব এখনো তেমনই আছে। এখানে জীবন নিরাপদ, আগের মতোই প্রাণবস্ত। টেটি এখন বাচ্চা এবং সে  এ বাড়ির অন্য মায়েদের একজন যারা ঘরের দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী, কিন্তু  সবটা মিলে এ জায়গাটি আগের মতোই রয়ে গেছে।

একটি বাচ্চা যে বলটি নিয়ে খেলছিল, সেটি তার পায়ের কাছে গড়িয়ে এল। রেনিসেব সেটি তুলে নিয়ে হাসিমুখে তার দিকে ছুঁড়ে দিল।

রেনিসেব উজ্জ্বল রঙা থামঘেরা বারান্দা দিয়ে ঢুকে বাড়ির ভেতরে যায় ঠিক মাঝের বিশাল ঘরটি পেরিয়ে, যেটির দেয়ালজোড়া পর্দাগুলো পদ্মফুল ও পপি ফুলের সাজে শোভিত ছিল। এটি পেরিয়ে তবেই বাড়ির অন্দরমহল।

ক্রমে জোরালো হতে থাকা কণ্ঠস্বরগুলো তার কানে ধাক্কা খাচ্ছিল আর তাই সে আবার থেমে গিয়েছিল, আনন্দের আভাস সেসব গলার স্বরে যেন মিশে গিয়েছিল। সাতিপি ও কাইট বরাবরের মতোই তর্ক করছিল। সাতিপির চড়া ও কর্কশ ধরনের হুমকিদায়ক গলা কি কখনো ভোলা যায়! সাতিপি রেনিসেবের বড়ভাই ইয়ামোসের স্ত্রী, লম্বা ও বলশালী, উচ্চকণ্ঠের মহিলা, যার চেহারায় কমনীয়তা প্রায় ছিলই না আর যে আদেশ দিতেই বরাবর অভ্যস্ত! সে প্রচলিত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাগুলি দেখাতে ওস্তাদ ছিল, চাকরবাকরদের নাস্তানাবুদ করত, সবকিছুতেই দোষ খুঁজত, কড়া মেজাজ আর হুমকি ধামকির পাশাপাশি জাঁকালো ব্যক্তিত্ব ফলিয়ে অসম্ভবকেও সে সম্ভব করে তুলত। সবাই তার খরজিভকে ভয় পেত বিধায় তার আদেশ দৌড়ে পালন করত। ইয়ামোসের যদিও তার দৃঢ়চেতা ও জেদি স্বভাবের স্ত্রীর প্রতি ভালোলাগা ছিলই, তবু সে স্ত্রীর গালাগাল শুনতে এতটাই প্রস্তুত ছিল, যা রেনিসেবকেও  প্রায়ই ক্ষিপ্ত করত।

সাতিপির উচ্চকণ্ঠে বলে চলা বাক্যবাণের বিরতি ঘটলে শুধু তবেই কাইটের বাধাপ্রাপ্ত শান্ত গলা শোনা যেত। সুদর্শন সোবেকের স্ত্রী কাইট দেখতে চওড়া গড়নের সাদাসিধা ধরনের মহিলা ছিল। নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়েই যেন তার দিনদুনিয়া গুজরান হতো, অন্য কোনো বিষয়ে বা আলাপে তার আগ্রহ কখনো প্রকাশিত হত না। কাইট জা সাতিপির সঙ্গে নিত্যদিনের তর্কে বেশ সহজেই  বুঝিয়ে দিত সে কোন দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে চাইছে। সে তার আচরণে ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনোটাই প্রকাশ করত না, নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না।  সোবেকের সঙ্গে তার স্ত্রীর বোঝাপড়া নিবিড় ছিল এবং সে তার যাবতীয় বিষয়াদি নিয়েই কাইটের সঙ্গে অনায়াসে আলাপ করত। সে বুঝতে পারত যে তার স্ত্রী আলাপের জন্য প্রস্তুত, তাদের বোঝাপড়ায় সম্মতি ও মতবিরোধ দুটোই ছিল এবং তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হত না। কেননা কাইটের  মনে ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ ও তাদের দেখাশোনার ব্যাপারে একধরনের উৎকণ্ঠা সবসময়ই বিরাজ করত।

“এটা একধরনের জুলুম, আমাকে তা বলতেই হবে,” সাতিপি খেঁকিয়ে ওঠে। “যদি ইয়ামোসের একটি ইঁদুরের সাহসও থাকে, সে তা এক মুহূর্তের জন্য বরদাস্ত করবে না! কে এখন এ বাড়ির কর্তা, ইমহোটেপের অনুপস্থিতিতে? ইয়ামোস! কাজেই ইয়ামোসের স্ত্রী হিসেবে ভালো মাদুর ও বালিশগুলো বেছে নেয়ার প্রথম সুযোগ আমারই প্রাপ্য! ঐ জলহস্তীমুখো কালো চাকরটাকে অবশ্যই আমি দেখে নেবো ...”

কাইটের ভারী, উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়:

“না, না, আমার সোনামাণিক, তোমার পুতুলের চুলগুলো খেয়ো না। দেখো, এখানে এর চেয়েও ভালো কিছু আছে - একটি মিষ্টি- বাহ, কত মজা ...”

“দেখ কাইট, তোমার দেখছি ভদ্রতা বলে কিছুই জানা নেই; এমনকি আমি কি বলছি তাও তুমি কানে তুলছো না - জবাবে কিছু বলছো না - তোমার ব্যবহার আসলেই অসভ্যদের মতো।”

“ঐ নীল বালিশটা সবসময় আমারই ছিল ... আহা, ছোট আঙ্কের দিকে দেখো, সে হাঁটতে চেষ্টা করছে ...”

“তুমি তোমার বাচ্চাদের মতোই নির্বোধ, কাইট। এবং সেটা একটা ভালো ব্যাপার! কিন্তু তুমি সেটি চাইলেই পাবে না। এটা আমারই হবে, তোমাকে স্পষ্ট বলছি।”

 রেনিসেব কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ তার পেছনে শুনতে পায়। সে চটজলদি ঘুরেই পেছনে বাড়ির পুরনো পরিচারিকা হেনেটকে দেখে বিরক্ত হয়। হেনেটের পাতলা গড়নের মুখে বরাবরের মতো অর্ধহাসির ভঙ্গিটি লেপ্টে ছিল।

”কিছুই তেমন বদলায়নি, তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু ভাবছ, রেনিসেব, সে বলল। “আমরা কীভাবে যে সাতিপির ঐ হেঁড়ে গলা সহ্য করি,  জানি না! কাইট অবশ্যই পরে এর জবাব দিতে পারে। আমরা কেউই তেমন ভাগ্যবান নই। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি, তোমার বাবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, এ বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের পাশাপাশি খাওয়া পড়ার বন্দোবস্ত করার জন্য। আহ! তোমার বাবা সত্যিই একজন ভালো মানুষ। এবং আমিও সেজন্য যা করা উচিত, সাধ্যমতো তা করতে চেষ্টা করি। আমি সবসময় কাজেই ব্যস্ত থাকি - কখনো এখানে, কখনো ওখানে - এর বিনিময়ে আমি কখনো ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করি না। তোমার স্নেহময়ী মা আজ বেঁচে থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। তিনি আমার প্রশংসা করতেন। যেন বোনের মতোই আপন ছিলাম আমরা! তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেছি ‘বাচ্চাদের দেখে রেখো, হেনেট ’, মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন। আর আমিও তাকে যে কথা দিয়েছিলাম, তা এখনও পালন করে চলেছি, তোমাদের সবার দেখাশোনার জন্যই, এবং বিনিময়ে ধন্যবাদটুকুও চাইনি। সেজন্য প্রশ্নও তুলিনি এমনকি তা পাইওনি! আমি শুধু সবাইকে সাহায্য করতেই চেয়েছি আর তা-ই যথেষ্ট ছিল। সে রেনিসেবের বগলের নিচ দিয়ে প্রায় পিছলেই যেন ভেতরের কামরায় ঢুকে পড়ে।

“ঐ বালিশগুলো সম্পর্কে, আমাকে কিছু বলতেই হবে সাতিপি কিছু মনে করো না। আমি শুনেছিলাম সোবেক বলছিল-” রেনিসেব সরে যায় সেখান থেকে। হেনেটের প্রতি তার পুরনো বিরক্তি আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল। এটা খুবই পরিতাপের ব্যাপার যে বাড়ির সবাই হেনেটকে অপছন্দ করে। ঘ্যানঘ্যানে গলায় নিজের অনর্গল প্রশংসা এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে সে কদর্য পরিতৃপ্তি পেত।

“যা হোক, ভালোই,” রেনিসেব ভাবছিল, “কেন নয়?” এটাই সে ভেবেছিল, এভাবেই হেনেট মজা পেতে চায়! তার জন্য জীবন তবে উপভোগ্য - এটা ঠিক যে সে যেন সব কাজ থেকে ছিটকে পড়েছিল আর এবং কেউই তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল না। তুমি কখনোই হেনেটের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারো না- রেনিসেব নিজের বিবেচনার প্রতি নিবিড় মনোযোগ সহকারে এটাই ভাবছিল যে এর ফলে তার মনে উদারতা অনুভূত হচ্ছিল। সে ভাবছিল, হেনেট হচ্ছে সেসব মানুষের একজন যাদের নিয়তিই নির্দিষ্ট থাকে অন্যদের প্রতি সমর্পণে এবং তাদের প্রতি কেউ নিবেদিত নয়। সে দেখতে কুশ্রী ও স্বভাবে নির্বোধ ধরনের হলেও বেশ ভালোই জানত যে বাড়িতে কখন কী ঘটে চলেছে। নিঃশব্দে তার পা ফেলে হাঁটা, তার অতি খাড়া কানজোড়া এবং দ্রুত ঘুরিয়ে ফেলা চোখজোড়া মিলেমিশে এমন অবস্থা সৃষ্টি করত যে  কেউই তার কাছ থেকে বেশিক্ষণ কোনো কিছু আড়াল করতে পারত না।

কখনো বা সে নিজের এই পটুতায় নিজেই অভিভূত হত -অন্য সময়ে সে একজন থেকে দ্রুত আরেকজনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করত এবং আনন্দের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার লাগানো কথার ফল খুঁটিয়ে পরখ করত।

বাড়ির লোকজন বারবার ইমহোটেপের কাছে গিয়ে হেনেটকে বাড়িছাড়া করার অনুনয় জানালেও সে এসব ব্যাপারে কখনো কর্ণপাত করত না। বাড়িতে সেই ছিল একমাত্র ব্যক্তি, যে হেনেটকে পছন্দ করত। ইমহোটেপের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিদান হেনেট এতটা বিশ্বস্তভাবে পরিশোধ করত যে পরিবারটির অন্য সকলের কাছে তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল।

রেনিসেব সেখানে অনিশ্চিতভাবে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তার ভাবীদের তীব্র কোলাহল তার কানে বাজছিল, যা হেনেটের দৌরাত্ম্যে আগুনের মতো গনগনে আঁচ ছড়াচ্ছিল। কাজেই রেনিসেব সেই জায়গা ছেড়ে তার দাদীমা এশার ছোট কামরায় ধীর পায়ে হাজির হয়েছিল। সেখানে এশার পাশে অল্পবয়সী কালো দুটি দাসীও ছিল। তারা তাকে লিনেনের জামাকাপড় দেখাচ্ছিল আর সে সেগুলো দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদেরকে মৃদু বকাঝকা করছিল।

হ্যা, এসবই আগের মতো আছে। রেনিসেব সবই দেখছিল, শুনছিল। বৃদ্ধা এশা খানিকটা বুড়িয়ে গিয়েছিল, এটুকুই তার কাছে নতুন মনে হয়েছিল। কিন্তু এশার কণ্ঠস্বর এবং কথা বলার ভঙ্গি আগের মতোই রয়েছে, একের পর এক ঠিক সেভাবেই, যেভাবে আট বছর আগে এ বাড়ি ছেড়ে রেনিসেব চলে যাবার আগেও এশা বলত...

রেনিসেব সেখান থেকেও সরে এল। বৃদ্ধা দাদী বা দাসী দুটি তাকে খেয়াল করেনি। অল্প সময় নিয়ে সে রান্নাঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে হাঁস ঝলসানোর ঘ্রাণ, হরদম আলাপ, হাসাহাসি, বকাঝকা-টিপ্পনির আমেজ যথারীতি ছিল, সবজি রান্না করার প্রস্তুতিও যথারীতি চলছিল।

রেনিসেব চোখজোড়া অর্ধেক বন্ধ রেখে সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এখান থেকে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল বাড়ির কোথায় কী হচ্ছে! রান্নাঘরের হট্টগোল, বৃদ্ধা এশার তীক্ষ্ম গলা, সাতিপির বাঁজখাই কণ্ঠ এবং কাইটের অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরের পাল্টা জবাব। সবকিছু মিলে যেন নারীকণ্ঠের অদ্ভুত জগাখিচুড়ি - আলাপ, হাসিঠাট্টা, অভিযোগ, বকাঝকা, উল্লাসে ফেটে পড়া...

এবং হঠাৎ করেই রেনিসেবের এ পরিবেশটা যেন গুমোট লাগছিল, চারপাশটা যেন নারীদের খবরদারিতে বড্ড আঁটোসাঁটো। নারীরা স্বভাবে বরাবর কোলাহলমুখরা! তারা অন্তঃপুরের বাসিন্দা - কখনোই শান্ত ও স্থির নয়, সর্বদাই বকবক করছে, উচ্চকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে, - অন্য কিছুই যেন তাদের করার নেই!

এবং কেয় নৌকায় বসা অবস্থায় মাছের দিকে নীরবে লক্ষ্য রাখছিল হাতে বর্শা ধরে...

এই অবিচ্ছিন্ন হট্টগোলের লেশমাত্র সেই স্মৃতিতে ছিল না।

রেনিসেব দ্রুত বাড়ির বাইরে আবার চলে গেল, যদিও সেখানে ছিল স্পষ্ট নীরবতা। সে ফসলের মাঠ থেকে সোবেককে ফিরতে দেখে। ইয়ামোসকে দূর থেকে সমাধিসৌধের দিকে যেতে দেখা গেল।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চুনাপাথরের টিলাসংলগ্ন পথটি ধরে এগিয়ে যায় সমাধিসৌধের দিকে। এটি ছিল মহান মেরিপাথার সমাধি, যেটি দেখাশোনার ভার ছিল তার বাবা ইমহোটেপের। সমাধিসৌধটি দেখাশোনার জন্য যা অনুগ্রহপূর্বক দান করা হয়েছে, সবই এ জমিদারি ও কৃষি জমির অংশ। ইমহোটেপ কোথাও গেলে সমাধিসৌধ দেখাশোনার ভার ইয়ামোসের ওপর বর্তায়।

যখন রেনিসেব ধীরে ধীরে খাড়া পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠছিল, ইয়ামোসের সঙ্গে হোরিকে পরামর্শ করতে দেখা গেল। হোরি হলো তার বাবার ব্যবসায়িক বন্দোবস্তের হিসাবরক্ষক। সমাধিসৌধ সংলগ্ন যে গুহায় উপহার নিবেদন করা হয়, তার পাশের ছোট একটি পাথুরে গুহায় তারা বসেছিল।

হোরির হাঁটুর ওপর একটি প্যাপিরাস বিছানো ছিল এবং দুজনেই এটির ওপর ঝুঁকে ছিল।

দুজনই রেনিসেবকে সেখানে দেখে মৃদু হাসল।  সে তাদের পাশেই ছায়ায় বসল। রেনিসেব বরাবর ইয়ামোসের ভক্ত। ইয়ামোস স্বভাবে শান্ত, রেনিসেবের প্রতি মমতা তার মনে প্রবল। হোরিও ছোট রেনিসেবকে আপনজনের মতো দয়ালুভাবে দেখত, কখনো বা তাকে খেলনা বানিয়ে দিত।  কিশোরী বয়সে যখন সংবেদনশীল ও লম্বা আঙুলের অধিকারী  রেনিসেব বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল বিয়ের পর, হোরি তখন ধীরস্থির এক যুবক। রেনিসেব এতদিন পর তাকে এখানে দেখে ভাবছিল, যদিও হোরির বয়স বেড়েছে, তবু সে দেখতে প্রায় আগের মতোই আছে। যে স্মিত হাসিটি সে রেনিসেবকে উপহার দিল, তাও তার স্মৃতিতে আগের মতোই মনে হয়েছিল।

ইয়ামোসে ও হোরি নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল:

“ছোট ভাই আইপির সঙ্গে তিয়াত্তর বস্তা বার্লি ...”

“তাহলে মোট দুইশত ত্রিশ বস্তাা আর এর মধ্যে একশ বিশ হলো বার্লি।”

“হ্যা, কিন্তু এখানের কাঠের দাম রয়েছে, এবং তেলের বিনিময়ে ফসল পরিশোধ করা হয়েছে ...

তাদের আলাপ চলছিল। রেনিসেব তন্দ্র্াচ্ছন্নভাবে সেখানে বসে থাকলেও তাদের অস্পষ্ট আলাপ তার কানে আসছিল। একটু পর ইয়ামোস প্যাপিরাসের টুকরোটি গোলাকারভাবে মুড়িয়ে হোরির হাতে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

রেনিসেব নীরবতাকে সঙ্গী করে সেখানে বসে রইল।

এবার সে গোলাকারভাবে মোড়ানো একটি প্যাপিরাস হাতে নিয়ে জানতে চাইল, “এটা কি আমার বাবা পাঠিয়েছে?”

হোরি মাথা ঝাঁকায়।

“কী লেখা আছে এতে?” সে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

রেনিসেব প্যাপিরাসটি মেলে ধরে এবং এতে দাগানো চিহ্নগুলো তার নিষ্পন্দ চোখজোড়ায় অর্থহীন মনে হয়।

মৃদু হেসে হোরি তার কাঁধ ঝুঁকিয়ে প্যাপিরাসের লেখায় আঙুল ছুঁয়ে তা পড়তে থাকে। এ চিঠিটি পেশাদার চিঠি লেখক হেরাক্লোপোলিশের চিঠি লেখার অলংকরণ অনুসরণে বিন্যস্ত হয়েছে:

“এই জমিদারির তদারককারী, পুরোহিত ইমহোটেপ বলছি: যারা বহুকাল যাবত স্বস্তিতে বেঁচে থাকে, তোমাদের অবস্থাও তেমনই হোক। প্রভু হেরিসাফ, হেরাক্লোপোলিশের প্রভু এবং ও অন্য সব দেবতা তোমাদের মঙ্গল করুন। দেবতা পিতাহ তোমাদের হৃদয় আনন্দে ভরিয়ে দিন, যারা দীর্ঘদিন বাঁচে তাদের মতো। ছেলে তার মাকে বলছে, পুরোহিত তার মা এশাকে বলছে. তুমি কেমন আছো? নিরাপদ ও সুস্থ আছো তো? গার্হস্থ্য জীবন উপভোগ করছ তো? আমার ছেলে ইয়ামোস, তুমি জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যময় প্রাচুর্যে ভরপুর তো?  আমার জমি যথাসাধ্য কাজে লাগাবে। জমির কাছ থেকে যতটা সম্ভব কশে আদায় করো, প্রয়োজনে জমি খনন কনে কাজের ভেতর আকণ্ঠ ডুবে থাকো। যদি জানতে পারি যে তুমি কঠোর পরিশ্রমী, তবে তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব প্রভুর কাছে।” রেনিসেব হাসে।

“বেচারা ইয়ামোস! সে কঠোর পরিশ্রম করে, তাতে আমার মোটেই সন্দেহ নেই।”

বাবার উৎসাহব্যঞ্জক প্রাণবন্ত ভাবটি যেন রেনিসেবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে- এর পাশাপাশি ইমহোটেপের জমকালো, খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল, অবিরাম নির্দেশনাসম্বলিত চেহারাটিও পাশেই ছিল।

হোরি উঠে দাঁড়ায়:

“আমার ছেলে আইপির দিকে খেয়াল রাখবে। আমার কানে এসেছে, সে নাকি অসন্তুষ্ট। আরো খেয়াল রাখবে, সাতিপি যেন হেনেটের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। শণ ও তেল সম্পর্কে চিঠি লিখে জানাতে ভুলবে না। আমার জমির উৎপাদিত ফসল নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আমার বিষয়াদি ভালোভাবে দেখাশোনা করবে কারণ এজন্য তোমাকেই আমি দায়ী করব। আমার জমি বানে ভাসলে তোমার ও সোবেকের কপালে শনি আছে।”

“বাবা আগের মতোই আছে” রেনিসেব সুখী গলায় বলে। “সবসময় ভাবে যে সে না থাকলে কিছুই ঠিকঠাক চলবে না।”

সে প্যাপিরাসটি গোলাকারভাবে গুছিয়ে বলতে থাকে:

“সবকিছুই আগের মতো আছে ...”

হোরি জবাব দেয় না।

সে এক টুকরো প্যাপিরাস নিয়ে লিখতে শুরু করে। রেনিসেব অলস ভঙ্গিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। সে পড়তে খুব আগ্রহী ছিল।

স্বপ্নের ঘোরে সে বলে চলেছিল:

“এটা জানা বেশ মজার মনে হয়, কীভাবে প্যাপিরাসে লিখতে হয়। কেন সবাই লিখতে শেখে না?”

“এর প্রয়োজন নেই।”

“প্রয়োজনীয় নয়, সম্ভবত, কিন্তু এটা শেখা আনন্দের হবে।”

“তোমার তাই মনে হয়, রেনিসেব কী এমন ভিন্নতা ঘটবে তোমার ক্ষেত্রে?”

 রেনিসেব অল্প সময় নিল এর জবাব দিতে। তারপর ধীরে বলল:

“তুমি যখন এ প্রশ্ন কর, এর জবাবে কী বলতে হবে আমার সত্যিই জানা নেই, হোরি”

হোরি বলে, “এখন আসলে অল্প সংখ্যক লেখককে দিয়েই একটি বড় প্রদেশের কাজ দিব্যি চলে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এমন দিন আসবে, যখন সারা মিশরে লেখকদের বিরাট বাহিনী থাকবে। আমরা মিশরের স্বর্ণোজ্জ্বল আমলের শুরুর দিকে আছি।”

“এটা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাপার” রেনিসেব বলে।

হোরি ধীরে বলে, “আমি নিশ্চিত নই।”

“কেন তুমি নিশ্চিত নও?”

“কারণ রেনিসেব এটা খুব সহজ বা তেমন পরিশ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার নয় - দশ বস্তা বার্লির বা একশ গবাদি পশুর বা দশটি ক্ষেতের ফসলের হিসাব লিখে রাখা - এবং যখন এসব লেখা হবে, তখন হয়ত মনে হতে পারে যে সব তো ঠিকই আছে। কাজেই তখন হিসাব লেখকরা ও কেরানিরা যখন ঐসব জমির চাষাদের কাছে আসে এবং যারা জমিতে বার্লি বোনে এবং গবাদি পশু চড়ায়, তাদের কাছে এলে হিসাব লেখকদের মনে হতে পারে যে কৃষি জমি ও উৎপাদিত বার্লি এবং গবাদি পশু  সবই বাস্তবে আছে - এগুলো প্যাপিরাসের ওপর নিছক কালির চিহ্ন নয়। এবং যখন সব দলিল-দস্তাবেজ এবং হিসাব লেখা প্যাপিরাস নষ্ট হয়ে যাবে, হিসাব লেখকরা শঙ্কিত নাও হতে পারে এজন্য যে চাষারা জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায় ও কাটে, তারা বিতাড়িত হলেও মিশর দিব্যি বাঁচবে। কারণ জমি, ফসল ও গবাদি পশু থেকে যাবে।”

রেনিসেব গভীর মনোযোগ দিয়ে হোরির কথা শুনছিল। সে এবার ধীরগলায় বলে “আমি এবার বুঝতে পারছি, তুমি কি বলতে চাও। তুমি যা চোখে দেখো ও ছুঁতে পারো, সেগুলোই প্রকৃত বস্তু ... লেখার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন যে ‘আমার দুইশত চল্লিশ বস্তা বার্লি আছে’ মানে তোমার এর চেয়ে কম পরিমাণ বার্লি নেই। তার মানে একজন চাইলেই মিথ্যা লিখতে পারে।”

হোরি রেনিসেবের গুরুগম্ভীর মুখের দিকে তাকায়। সে হঠাৎই বলে ওঠে:

“তুমি আমার খেলনা সিংহটা মেরামত করে দিয়েছিলে, অনেক আগে। মনে পড়ে?”

“হ্যা, দিব্যি মনে আছে, রেনিসেব।”

“টেটি এখন ওটা দিয়ে খেলে ... সেই সিংহটাই”।

খানিক থেমে সে আবার বলে,

“কেয় যখন অসিরিসের কাছে চলে যায়, আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি আবার বাড়িতে ফিরে এসেছি এবং আমি আবার সুখী হব এবং কষ্টের সেই স্মৃতি ভুলে যাব - কারণ এখানে সবকিছুই আগের মতো আছে। কিছুই যেন বদলে যায়নি।”

“তুমি সত্যিই তাই মনে কর?”

রেনিসেব সতর্কভাবে তার দিকে তাকায়।

“তুমি কি বলতে চাও, হোরি?”

“আমার মনে হয় সবসময়ই বদল ঘটছে। আট বছর আদতে আট বছরই।

“কিছই বদলায়নি এখানে।” রেনিসেব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

“তাহলে পরিবর্তন তো হতেই হবে।”

রেনিসেব সতর্কভাবে বলে ওঠে

“না, না, আমি চাই সবকিছু আগের মতোই থাকুক।”

“কিন্তু তুমি নিজেই তো আগের সেই রেনিসেব আর নও, যে তার স্বামী কেয়ের কাছে চলে গিয়েছিলে।”

“হ্যা, আমি আগের মতোই আছি। আর যদি তা না-ও হয়, তবে আবার আগের মতোই হব।”

হোরি মাথা নাড়ে।

“তুমি পেছনে ফিরে যেতে পারো না, রেনিসেব। এটা অনেকটা আমার দেয়া হিসাবের মতো। যেমন - আমি একটা কিছুর অর্ধেক নিচ্ছি, এর সঙ্গে সিকিভাগ যোগ করছি, তারপর দশ ভাগের এক ভাগ এবং তারপর বিশ ভাগের চার ভাগ - এবং সবশেষে, তুমি দেখতোই পাচ্ছো, এটা পরিমাপে অন্য কিছু হবে, সবমিলিয়ে।”

“কিন্তু আমি আগের সেই রেনিসেবই।”

“কিন্তু রেনিসেব ইতোমধ্যে সময়ের ¯্রােতে ভেসে আরো নতুন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই সে সবসময়ই আরো ভিন্ন মানুষ।”

“না, না। তুমি আগের সেই হোরিই আছো।”

“তুমি তা ভাবতে পারো। কিন্তু ব্যাপারটা আদতে তা নয়।”

“হ্যা, তাই। ইয়ামোস আগের মতোই যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তেমনি উদ্বিগ্ন। সাতিপি তাকে আগের মতোই একইভাবে গালমন্দ করছে এবং সাতিপির সঙ্গে কাইটের মাদুর বা বিছানা নিয়ে কথা কাটাকাটি আগের মতোই যথারীতি চলছে। আমি যখন ফিরে যাব, দেখব যে তারা যথারীতি হাসাহাসি করছে, যেন সবচেয়ে ভালো বন্ধু! হেনেট এখনো চুপিসারে কান পেতে অন্যের কথা শোনে এবং তার হাহাকার ও ভক্তি আগের মতোই আছে এবং আমার দাদীও তার ছোট দাসীটিকে বকাঝকা করে, লিনেনের জামাকাপড় তদারকির ব্যাপারে। এসবই আগে থেকে দেখা আর বাবা বাড়ি ফিরে এলে যথারীতি হৈচৈ হবে এবং তিনিও অভিযোগ করবেন, “তুমি এটা এখনো করোনি কেন?” এবং “তোমার এটা করা উচিত ছিল”। তখন ইয়ামোসে উদ্বিগ্ন হবে এবং সোবেক হাসবে আর গর্ব করবে এবং বাবার উস্কানিতে সে ইচড়ে পাকা হবে। তার বয়স মাত্র ষোল আর আট বছর থেকেই সে আস্কারা পেয়ে বিগড়াতে শুরু করেছে। এসব কিছুই আগের মতো যথারীতি চলছে, কিছুই বদলাবে না!” একনাগাড়ে গড়গড় করে বলা কথা সে থামায়।

হোরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুভাবে বলে:

“তুমি বুঝতে পারছ না, রেনিসেব। একটি শয়তান বাইরে থেকে এসে আক্রমণ করলে সারা পৃথিবী তা দেখে। কিন্তু অন্য ধরনের পচনও আছে, যা ভেতর থেকে সংক্রমণ ঘটায়, যার কোনো লক্ষণ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এটা দিনের পর দিন অল্প অল্প করে বাড়ে, শেষ পর্যন্ত ফলটি পচে যায় -  খেলে রোগ হয়।”

রেনিসেব তার দিকে তাকায়। সে প্রায় আনমনেই বলে যায়, যেন সে রেনিসেবকে নয়, বরং বিড়বিড় করে নিজেকেই বলছিল।

রেনিসেব আর্তনাদ করে ওঠে:

“ তুমি এসব কী  বলছ, হোরি? তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।”

“আমি নিজেই ভীত।”

“কিন্তু তুমি কী বোঝাতে চাও? কোন শয়তানের ব্যাপারে তুমি বললে?”

হোরি রেনিসেবের দিকে তাকায় এবং হঠাৎকরেই হাসে।

“বাদ দাও রেনিসেব, আমি কী বলেছি সেসব! যেসব রোগ শস্যখেতে হানা দেয়, সেগুলো নিয়েই ভাবছিলাম।”

রেনিসেব এতক্ষণে মুক্তি পায়।

“আমি আনন্দিত। আমি ভাবছিলাম - আমি জানি না আসলে কী ভাছিলাম”

   

রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক

রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণা ও নজরুল-সাহিত্যের গবেষণায় অবদান রাখায় রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী অধ্যাপক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে এবং রবীন্দ্রসংগীত-চর্চায় অবদানের জন্য অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসাকে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হবে।

এতে আরও বলা হয়, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানাকে নজরুল পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে। আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হবে।

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;