পাকিস্তান: সংঘাতে বিপন্ন জনপদ

চলছে ‘খুনের বদলা খুন’!



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
পাকিস্তানের দাঙ্গা, ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের দাঙ্গা, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একই ধর্মের অনুসারী হয়েও পারত পক্ষে, শিয়ারা সুন্নিদের এবং সুন্নিরা শিয়াদের মসজিদে প্রার্থনার্থে গমন করে না। কিছু কিছু স্পর্শকাতর ও উত্তেজক পরিস্থিতিতে শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরের পাড়া, মহল্লা, এলাকা এড়িয়ে চলাচল করে। নিরাপত্তার খাতিরে এমন আচরণ করা হয় উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই।

বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে পার্থক্য আছে। উভয় সম্প্রদায়ের আলেম ও নেতৃবৃন্দ শিয়া-সুন্নি বিয়ের বিরোধিতা করেন। হারাম বা নিষিদ্ধ না বলা হলেও পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিয়েকে উভয় সম্প্রদায়ই নিরুৎসাহিত করে।

পরিচিতি ও ব্যক্তির নামকরণের ক্ষেত্রেও শিয়া-সুন্নি পার্থক্য রয়েছে। সুন্নিদের নাম সাধারণ মুসলিম নামের আদলে রাখা হলেও শিয়ারা এক্ষেত্রে বিশেষ বিশিষ্টপূর্ণ। শিয়াদের মধ্যে আলী, হাসান, হোসাইন, জাফর, আব্বাস, জাফরি, রেজা, রিজভি, নকভি, আলাভি, জায়েদ ইত্যাদি নাম ব্যাপকভাবে রাখার প্রচলন আছে।

তবে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে এবং চেহারা ও আকৃতিগত কাঠামোতে একমাত্র 'হাজারা' জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ছাড়া অন্য শিয়াদেরকে সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। হাজারাদের মধ্যে মঙ্গোলিয়-তুর্কিস্থানি চেহারা ও গড়ন দৃশ্যমান হওয়ায় কেবল তাদেরকেই অপরাপর পাকিস্তানিদের চেয়ে আলাদা করা যায়।

ইসলামাবাদ রাজধানী হলেও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি, যেখানে ২০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। সেখানে শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীর আলাদা অবস্থান স্পষ্টভাবেই চোখে দেখা যায়। করাচির স্থানীয় সিন্ধি-মুহাজির (ভারত প্রত্যাগত বিহারি) দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মতো শিয়া-সুন্নি সমস্যাও একটি প্রকট সমস্যা।

করাচির শিয়ারা মূলত ‘হাজারা শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা মহানগরের বিশেষ বিশেষ কিছু এলাকায় বসবাস করে। করাচির আব্বাস টাউন, হোসেইন হাজারা ঘাট, মুঘল হাজারা ঘাট, রিজভিয়া, আনকোলি, ডিএইচএ গিজরি, পাক কলোনি ও মাঙ্গোপির এলাকাগুলো শিয়া বসতি রূপে চিহ্নিত। করাচির জনসংখ্যার সিংহভাগ মুহাজিরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিয়া রয়েছে।

আন্তঃমুসলমান বিবাদের বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শিয়া-সুন্নি সংঘাতটি বেশ পুরনো সমস্যা। যদিও বর্তমানে পাকিস্তান থেকে সিরিয়া, ইয়েমেন পর্যন্ত শিয়া-সুন্নি লড়াই বিস্তৃতি লাভ করেছে, যার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র এবং ইরানের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েকটি ধাপে শিয়া-সুন্নি বৈরিতা বাড়তে বাড়তে চরম আত্মঘাতী ও মারাত্মক রক্তাক্ত আকার ধারণ করেছে।

পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ১৯৭৯ সালে, যখন ইরানের শিয়াপন্থীরা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের ৯০৯ কিলোমিটারের সীমান্ত এবং পাকিস্তানের প্রচুর শিয়ার বসবাস থাকায় ইরান বিপ্লবের প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। ইরানের বৈপ্লবিক মতাদর্শে শিয়ারা নানা ক্ষেত্রে সংগঠিত হতে থাকে, যা সংখ্যাগুরু সুন্নিরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

Pakistan Clash

শিয়া উত্থানের এমন সময় পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী, কট্টর সুন্নি মতাবলম্বী সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউল হক সুন্নিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। সৌদি আরবও পাকিস্তানে শিয়া উত্থান ঠেকাতে সুন্নিদের সাহায্য করে।

উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সে সময় প্রচুর অর্থ বিদেশ থেকে আসে। যা দিয়ে প্রচার-প্রচারণা, সংগঠন গড়ে তোলা ও বই-পুস্তক প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে 'পেট্রোডলার' শব্দটি তখন জোরেশোরে শোনা যায়। তখন ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য নানা দল, গ্রুপ ও ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে মাঠে নামানো হয়।

এ সময় শিয়া ও সুন্নিদের অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠে এবং এগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও কার্যক্রম গ্রহণ করে। কোনও কোনও সংগঠন স্বাভাবিক কাজের বদলে উগ্র ও জঙ্গি ভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে মাঠে নামে। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন আকারে উত্তেজনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

প্রায় একই সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করলে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় মুসলিম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যার নেতৃত্বে ছিল সুন্নি মুজাহিদরা। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মুজাহিদদের শিয়া গোষ্ঠী ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’কে ইরান সমর্থন করে এবং সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মেরুকরণ হয়।

আফগানিস্তানকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মুজাহিদ গ্রুপগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল পাকিস্তান। প্রশিক্ষণ ও লোক সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মুজাহিদরা পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শিয়া ও সুন্নি মুজাহিদ গ্রুপগুলো নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের রিক্রুট করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়। তারা যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে মতাদর্শিক দিক দিয়ে প্রভাবিত করে। ফলে পাকিস্তানেও শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের সময়ও বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি মেরুকরণের প্রভাব পাকিস্তানে দেখা যায়। আরো পরে, পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে আফগানিস্তানে তালেবান প্রাধান্য বৃদ্ধির সময়কালে।

তখন পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে যেতে সুন্নি তালেবানরা সীমান্তবর্তী শিয়া গ্রামগুলোকে কৌশলগত কারণে দখল করে। শিয়ারাও নিজেদের আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র হয়। পরিণতিতে আন্তঃলড়াই হতাহতের রক্তাক্ত পথে তীব্র বিবাদে রূপ নেয়। এমনকি, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেক্টারিয়ান ক্ল্যাশ বা গোত্রীয় সংঘাত শহর-বন্দরে বসবাসকারী শিয়া-সুন্নিদের নাগরিক সমাজের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন: জন্ম থেকে সংঘাতের চারণভূমি

   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;