পাকিস্তান: সংঘাতে বিপন্ন জনপদ

জন্ম থেকে সংঘাতের চারণভূমি



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
পাকিস্তানের একটি সংঘর্ষ, ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের একটি সংঘর্ষ, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকেই সামরিক শাসন ও জাতিগত শোষণ-সংঘাতের উত্তপ্ত চারণভূমি। দেশটি এখন ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত জনপদে রূপ নেওয়ায় বিক্ষত জনগণ, বিপন্ন পুরো দেশ।

আন্তঃমুসলিম সংঘাতের ধারায় শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা-হামলা নিত্য চলছে সে দেশে। যে সংঘাতের রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ জীবনে দগদগে ক্ষতের মতো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যে ক্ষত দেশের নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে তলানিতে নিয়ে এসেছে।

কাগজে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হলেও বাস্তব পরিস্থিতি পাকিস্তানকে পরিণত করেছে শিয়া-সুন্নি মতাবলম্বী মুসলিম জনগোষ্ঠীর চলমান সংঘাতের বিপন্ন জনপদে। বর্তমানে পাকিস্তান হলো সংঘাত কবলিত অনিরাপদ দেশের মধ্যে বিশ্বতালিকার শীর্ষে।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছর পর ১৯৫৩ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় কারণে। তারপর সমাজে ধর্মীয় সংঘাতের পেছন পেছন রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রবল সামরিক শাসন ক্রমেই পাকিস্তানের রাজনীতির গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ ও গ্রাস করে।

ফলে জন্ম থেকেই ধর্মীয় সংঘাত পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বিবেচিত হচ্ছে, যে হুমকি দেশটির গণতান্ত্রিক গতিকেও সামরিক আঘাতের মাধ্যমে রুদ্ধ করেছে এবং সামাজিক জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

Pakistan Clash

যদিও পাকিস্তানের ৯৫% ভাগ মানুষই মুসলমান (যাদের মোট সংখ্যা ২০৭৮ মিলিয়ন), তথাপি শান্তি ও সৌহার্দ্য দেশটিতে অনুপস্থিত। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে। মুসলমান জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ সুন্নি মতাবলম্বী হলেও পাকিস্তানে শিয়া মতাবলম্বী মুসলমানদের শতকরা হিসাবটি কখনোই স্পষ্ট নয়।

সরকারি তথ্য ও অন্যান্য পরিসংখ্যানে পাকিস্তানে শিয়াদের শতকরা হার কখনো ১০%, আবার কখনো ২৫% ভাগ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এই যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর শিয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস পাকিস্তানে। বিশ্বের মানচিত্রে ইরানের পর পাকিস্তানেই সবচেয়ে বেশি শিয়ার বসবাস করে বলে পরিসংখ্যানের হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে। পাকিস্তানি শিয়াদের বড় অংশটি ‘ইসনে আশারি’ বা ‘বারো ইমামপন্থী’। এছাড়াও পাকিস্তানে নেযারি ইসমাঈলি, হাজারা, দাউদি বোহরা, সোলেইমানি বোহরা, আলাভি প্রভৃতি উপ-সম্প্রদায়ের শিয়া মতাবলম্বী রয়েছে।

পাকিস্তানে বসবাসকারী সবগুলো জাতিগত, ভাষাগত, উপজাতিগত জনগোষ্ঠীতেই শিয়া সম্প্রদায়ের লোক দেখতে পাওয়া যায়। তার মানে হলো, বিষয়টি এমন নয় যে, বিশেষ বিশেষ জাতি বা ভাষা বা অঞ্চলগত গোষ্ঠীতে শিয়ারা সীমাবদ্ধ রয়েছে। বরং পাকিস্তানের সকল জাতি ও গোষ্ঠীতেই কম-বেশি হলেও শিয়া মতের বিশ্বাসী মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শিয়ারা পাকিস্তানের জাতির পিতা বা ‘কায়েদে আজম’ নামে খ্যাত মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে তাদের শিয়া সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করে।

পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও উল্লেখযোগ্য ও ক্ষমতাবান শিয়া সদস্যের কমতি নেই। মূলত সংখ্যালঘু হলেও পাকিস্তানের শিয়ারা মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের সঙ্গে ক্ষমতা ও স্বার্থগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সক্ষমতা রাখে। কিছু কিছু সেক্টরে শিয়ারা বরং সুন্নিদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

শিয়ারা পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও দেশটির চারটি প্রদেশের কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তবে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত সায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গিলগিট বেল্টিস্তানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এলাকাটি বেলুচিস্তান প্রদেশ সংলগ্ন ও ইরানের সীমানা ঘেঁষা। ইরানের সংখ্যাগুরু শিয়া নাগরিকদের সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব এ অঞ্চলে রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য শিয়া বসতি রয়েছে খাইবার পাখতুন খাওয়া অঞ্চলের পেশোয়ার, কোহাট, হাঙ্গু, দারা ইসমাঈলি খান শহরে। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলটির আগের নাম ছিল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ। ফেডারেল শাসিত উপজাতি এলাকা খুররম ও ওরাকজাঈ এজেন্সিতেও শিয়ারা উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করে।

Pakistan Clash

তাছাড়া বেলুচিস্তান প্রদেশের কোয়েটা ও মাকরান সমুদ্রতটে শিয়া বসতি রয়েছে। পাঞ্জাবের কেন্দ্র ও দক্ষিণাঞ্চল শিয়া অধ্যুষিত। সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শিয়াদের উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষত সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ শহরে ভারতের গুজরাত থেকে দেশভাগের সময় অভিবাসী মেমন ও দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া মতের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়।

পাকিস্তানের অধিকাংশ বড় শহর, যেমন করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, মুলতান, জঙ্গ ও সারগোদায় পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত শিয়া বসতি রয়েছে। শিয়ারা একটু আলাদা ও নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে বসবাস করলেও সাধারণ সামাজিক জীবনে সুন্নিদের সঙ্গে দৃশ্যমান কোনও বৈপরীত্যের মুখোমুখি হতে চায় না। তারপরেও শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে পৃথক মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব আড়াল করা সম্ভব হয় না।

পোশাক, পরিচ্ছদ, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং বিশ্বাসগত দিক থেকে শিয়া-সুন্নি প্রভেদ লক্ষ্যণীয়। শিয়াদের প্রিয় রং কালো, যাতে কারবালার ময়দানে ঈমামের শোকের প্রতিফলন ঘটেছে। সুন্নিরা পছন্দ করে সবুজ রং। শিয়া ও সুন্নিদের আলাদা মসজিদ আছে, সেখানে তারা নিজ নিজ পদ্ধতিতে ধর্ম পালন করেন।

শিয়াদের সমজিদ সংলগ্ন ইমামবাড়া একটি আলাদা স্থান যেখানে শিয়ারা মিলিত ও আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়। সুন্নিদের প্রার্থনাস্থলে এমন কোনও স্থানের অস্তিত্ত্ব নেই। শিয়ারা কারবালার হত্যাকাণ্ডের শোকাবহ স্মৃতিতে পুরো মহররম মাসেই তাজিয়া, মার্সিয়া ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শোক পালন করে, যা সুন্নিরা পালন করে না।

   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;