রাজধানীর রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষিকা শাহানা সুলতানা। প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবনে শতশত শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া শাহানা সুলতানার জীবনে সঙ্গী না পাওয়ার আক্ষেপ। মানুষ গড়ার এই কারিগরের তিন দশকে মাসিক বেতন মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে একজন সাধারণ শ্রমিকের মাসিক আয় যেখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, সেখানে নামমাত্র বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বিদ্যালয় মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিও পেলেও তিনি পাচ্ছেন না সেটা। তাকে বঞ্চিত করার অভিযোগ ওঠেছে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে। তবে প্রধান শিক্ষক নিজেকে ‘নিরীহ’ দাবি করে সব অভিযোগ করছেন অস্বীকার।
জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাবা নওয়াব আলী মাস্টার ‘রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সুলতানাসহ পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সুলতানা ছিলেন ওই সময়ে নিয়োগ পাওয়া একমাত্র নারী শিক্ষিকা। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫ সালে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে অদ্যাবধি পাঠদান করছেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকালে সকল শিক্ষকদের আশ্বস্ত করা হয় এমপিও হলে সবাইকে দেওয়া হবে। কিন্তু বারবার বাদ পড়ছেন নারী শিক্ষিকা শাহানা সুলতানা।
অভিযোগ ওঠেছে, প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সুলতানার ২০ বছর পরে নিয়োগ পাওয়া অন্য এক জুনিয়র শিক্ষককে এমপিও পাইয়ে দেওয়ার জন্য বারবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে আসছেন। যদিও এমপিও দেওয়ার শর্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান শুরুর সময়ে যথাযথ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এমপিও পাওয়ার যোগ্য হবেন।
২০২২ সালে এমপিওভুক্ত হয় রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুল। এরপর স্কুলের পিওনও এমপিও পেলেও কেবল বাদ পড়েছেন সুলতানা। ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নানাভাবে সুলতানার এমপিও পাওয়ার আবেদনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ ওঠেছে প্রধান শিক্ষক শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে।
স্কুল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক সুবিধা ও স্থানীয় হওয়ায় সহকারী এক জুনিয়র শিক্ষককে এমপিও পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। অথচ সহকারী শিক্ষিকা সুলতানা ও প্রধান শিক্ষক শহীদুল্লাহ একই বছর নিয়োগ পান। ১৯৯৫ সালে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির বোর্ড সভায় তাদের নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। এমপিওভুক্তি শুরু হওয়ায় সুলতানার নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে, যদিও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্তে ওঠে এসেছে সুলতানার নিয়োগ যথাযথ ও নিয়ম মেনেই হয়েছে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের কাছে এমপিওভুক্ত না হওয়া ও ইচ্ছাকৃতভাবে নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন শাহানা সুলতানা।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুলে বিরতিহীনভাবে সহকারী শিক্ষক পদে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২২ সালে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক শাহানা সুলতানাকে বাদ দিয়ে চাকরিতে তার থেকে প্রায় ১৯ বছরের জুনিয়র একজন শিক্ষককে এমপিও ভুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়ের এমপিও ভুক্তির পর সরকার নির্ধারিত জনবল কাঠামো বিধান অনুযায়ী এমপিও যাচাইবাছাই কমিটি এমপিওভুক্তির যোগ্য হিসাবে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের পর ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রথমবার প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিও আবেদন পাঠান। কিন্তু সেখানে বাদ দেওয়া হয় সুলতানার নাম। এভাবে একে একে ২০২৩ সালেই তিন বার এই শিক্ষিকার নাম বাদ দিয়ে আবেদন পাঠানো হয়। আর প্রতিবারই আবেদন ফিরিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘ ২৯ বছর চাকরি করলেও এখনো নামমাত্র পারিশ্রমিক পাচ্ছেন শাহানা সুলতানা। চাকরি করলেও পরিবারের সহায়তায় চলতে হচ্ছে জানিয়ে এই শিক্ষিকা বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি চাকরি করছি। প্রধান শিক্ষক ও আমি একই সঙ্গে ১৯৯৫ সালের বোর্ড সভায় নিয়োগ পাই। কিন্তু ২০২২ সালে এমপিও চালু হওয়ায় আমাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বারবার আবেদন করেও আমার এমপিও পাচ্ছি না। কারণ প্রধান শিক্ষক আমার নাম বাদ দিয়ে আমার ২০ বছর পরে নিয়োগ পাওয়া অন্য এক শিক্ষকের নাম পাঠাচ্ছেন।
শিশু-কিশোরদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিলেও নিজের ঘরে আলো নেই মন্তব্য করে এই শিক্ষিকা বলেন, ১৯৯৩ সালে আমি অনার্স পাস করি। সেই সময়ে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আলী মাস্টার আমাকে ডেকে এনে চাকরি দেন। কারণ সেই সময়ে অনার্স পাস কোনো নারী শিক্ষিকা পাচ্ছিলেন না। মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করি। এখন আমি একজন মধ্যবয়স্ক নারী। সেই সময়ে আমিসহ পাঁচজন নিয়োগ পেয়েছিলাম। তখন থেকে নামমাত্র পারিশ্রমিকে চাকরি করে এসেছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিল যে, এমপিওভুক্ত হলে বেতন বাড়বে। কিন্তু এখনো আমি মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে কী হয়? আমি চাকরিজীবী হলেও চলতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের টাকায়। এরচেয়ে কষ্টের কী আছে!
এদিকে সুলতানাকে এমপিওভুক্তিতে সুযোগ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকে ‘নিরীহ’ দাবি করে রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এটা নিয়ে অনেক কথা। অনেক বিধি, মন্ত্রণালয়, থানা শিক্ষা অফিস আছে। তাদের প্রশ্ন করেন। আমি নিরীহ মানুষ আমাকে করেন কেন? স্কুল সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে, তাদের কাছে প্রশ্ন করেন।
সুলতানার কাগজ না পাঠিয়ে এক জুনিয়র শিক্ষকের আবেদনের কাগজ বারবার পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমাকে এই প্রশ্ন কোইরেন না। আমি তাকে নিয়োগও দিইনি। এরমধ্যে আমি নাই। আমাকে মাফ করেন। আমি নিরীহ মানুষ। মাফ চাই।’
এদিকে সিনিয়র শিক্ষককে বাদ দিয়ে জুনিয়র শিক্ষকের এমপিও ভুক্তির একই আবেদন বারবার পাঠানোর কারণে বিরক্ত সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চল কার্যালয়।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা অঞ্চলের জেলা শিক্ষা অফিসের উপ-পরিচালক আব্দুল খালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমার যথাযথ কারণ জানতে থানা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে একটি কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছি। তারা ব্যাখ্যা দিলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারব।