অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি না থাকায় হুমকির মুখে কৃষি

, জাতীয়

তরিকুল ইসলাম সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:34:46

স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ ও অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি না থাকায় আমদানিকৃত খাদ্যশষ্য ও বীজ দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলা ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও বিতরণসহ ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমিতে ক্রমবর্ধমান বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বাংলাদেশের কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অন্যের সংস্থানের জন্য একদিকে বিদেশ থেকে কৃষি পণ্য সামগ্রী আমদানি করা হচ্ছে, অন্যদিকে শস্য বীজও আমদানি করতে হচ্ছে। বাজারে দেশীয় বীজের সরবরাহ একেবারেই কম। আগে হাট বাজারে দেশি শস্যের বীজ মিললেও এখন তা দুষ্প্রাপ্য। দেশীয় উৎপাদনে চাহিদা মেটাতে না পেরে চায়না, ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, মিশরসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ও কৃষিপণ্য আমদানি করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আমরা আমাদের প্রয়োজনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষি পণ্য আমদানি করলেও আগত কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের নমুনা সংগ্রহ ও প্রাপ্ত নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে ছাড়পত্র প্রদানের বিষয়টি সব সময় গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে বিদেশ থেকে ফসলের নানা ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগজীবাণু দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বালাইয়ের আক্রমণে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কে বলেন, আমরা সবসময় পরিবেশের কথা চিন্তা করে কাজ করি। কৃষিজ পণ্য বা বীজ আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে নিরোধ কেন্দ্রের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। তা না হলে নানা ধরনের রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা অনেক সময়ে ফসলে নতুন পোকা বা ফসলের রোগ দেখি যা আমাদের ছোট সময়ে দেখিনি। অনেক সময়ে বিদেশ থেকে আনা বীজে ফসল না হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিদেশি কোনো কৃষিজ পণ্য আমদানি আগেই পণ্যগুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্যোগকালীন প্রয়োজন হয় খাদ্য বা কৃষি পণ্য আমদানির। তাছাড়া সব ফসল, ফল-মূল জলবায়ুজনিত কারণে আমাদের দেশে উৎপাদন সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় কৃষি পণ্য আমদানির। উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন সর্তকতার। পণ্য আমদানিতে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা না হলে বিদেশ থেকে ফসলের নানা ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগজীবাণু দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বালাইয়ের আক্রমণে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

কৃষিমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পৃথিবীর সব দেশেই কৃষি পণ্য আমদানি ও রফতানির কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে বর্তমানে মোট ৩০টি বন্দরে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫টি বন্দরে (বেনাপোল, হিলি, বুড়িমারি, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়) বীজ পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। বাকি ২৫টির অধিকাংশইর এ সার্ভিসটি নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আমদানিকৃত পণ্যের সাথে পরিবাহিত হয়ে ধ্বংসাত্মক পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের জীবাণু দেশের অভ্যন্তরে বা আমাদের দেশ থেকে অন্যান্য দেশে অনুপ্রবেশ ও বিস্তার রোধ করার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বা প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন। বাংলাদেশে আমদানি ও রফতানি প্রায় ৯২ শতাংশ সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বিদেশ থেকে আগত কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের নমুনা সংগ্রহ ও প্রাপ্ত নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে ছাড়পত্র প্রদানের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলেই কেবলমাত্র ছাড়পত্র দিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং) উপপরিচালক (আমদানি) মুহাম্মদ লিয়াকত হোসেন খান বলেন, আমদানির দুটি পর্যায়ে আমরা কাজ করি একটি খাদ্য শস্য, অন্যটি বীজ। তবে প্রতিটি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমরা আমদানিকারকেরদের কিছু শর্ত দিয়ে থাকি যা তাদের অবশ্যই মানতে হয়। সকল ক্ষেত্রেই আমরা সকলকে পণ্য বা বীজ বাধ্যতামূলক ভিউমিগেশন (ধোঁয়ার মাধ্যমে জীবানু মুক্ত) করার পরে জাহাজকে বা পবিহনের জন্য তুলতে হয়। আমাদের দেশে আসলে বন্দর এলাকার নমুনা সংগ্রহ করে তার (তিনদিন সংরক্ষণ) কালচার করে। পরীক্ষায় উন্নিত হলে পণ্য ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়। ল্যাবরেটরির মান বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর নেননি। তবে এটা সত্য আমাদের সব কেন্দ্র সকল সুবিধা নেই। ৫টি কেন্দ্র বীজ পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

সূত্র জানায়, সীমিত কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, শস্য চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেও বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গত অর্থবছরে এক কোটি ৮৬ লাখ মেট্রিক টন উদ্ভিদ ও উদ্ভিজাত পণ্য আমদানি করতে হয়েছে যা মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেও ছিল মাত্র এর অর্ধেকেরও কম। তাছাড়া যে পরিমাণে আমরা পণ্য আমদানি করি তার মাধ্যমে যেকোন পণ্য দিয়ে বা যেকোন ভাবে বিদেশ থেকে ফসলের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর বালাই দেশে প্রবেশ করে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। গমের ব্লাস্টের কারণে উৎপাদন কমেছে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন আবার ভুট্টার ফল অর্মি ওয়ার্ম প্রবেশের মাধ্যমে আশানুরূপ ভুট্টার ফলন পাওয়ার সম্ভবনা কম।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাক সবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শাক-সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রফতানির এক বিশাল সম্ভবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এখনো অর্গানিক ফার্মিং/ কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রথাগতভাবে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক, সার ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। আর কনট্রাক্ট ফার্মিং ছাড়াই কৃষিজাত এই সব পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত তাতে কি কি ইনপুট (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) কি মাত্রায় কখন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শাক সবজি সংগ্রহ করে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কোনো ল্যাবরেটরি না থাকায় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য এম.আর.এল অথবা একসেপটেবল ডেইলি ইনটেক (এডিআই) মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোন অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি নাই। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র এবং ইন্টারন্যাশনাল প্লান্ট প্রটেকশন কনভেনশন (আইপিপিসি) এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড আর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এর বিধি বিধান অনুসরণ করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। এ বিধি-বিধান অনুসরণ করার জন্য পৃথিবীর সকল দেশই আলাদাভাবে স্বতন্ত্র স্বাধীন সংস্থা সৃষ্টি করেছে যা বাংলাদেশে হয়নি। ফলে বাংলাদেশে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম গতি লাভ করছে না। উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করা হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি, কৃষিজাত পণ্য আমদানি-রফতানিতে ও প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন কাযক্রমে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি না থাকায় যে কোনো সময় অজানা বিদেশি ধ্বংসাত্মক রোগজীবাণু প্রবেশ করে খাদ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।

ঢাকার শ্যামপুরস্থ কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ একটি ল্যাবরেটরি রয়েছে। সেটাকে আন্তর্জাতিক মানের করার কাজ চলছে বলে জানাগেছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর