ফ্যাশনেবল-স্টাইলিস্ট রাজনীতিবিদ অরুণ জেটলির ব্র্যান্ডপ্রীতি

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 20:08:20

রাজনীতিতে মেধা ও দক্ষতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনযাপনে ফ্যাশন ও স্টাইলের স্বাক্ষর রেখেছেন সদ্য প্রয়াত ভারতীয় রাজনীতিবিদ অরুণ জেটলি। দিল্লিতে জন্ম নেওয়া ও নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণকারী অরুণ জেটলির জীবনচর্চায় ছিল রুচি ও আভিজাত্যের ছাপ। পোশাক ও নিত্য ব্যবহার্য্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে তিনি হাল ফ্যাশনের আধুনিক স্টাইলের অনুসারী ছিলেন। বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডের বাছাই করা পণ্যসমূহ নিজের জন্য পছন্দ করতেন তিনি।

বলে রাখা সঙ্গত যে, ভারতের রাজনীতিতে ফ্যাশন ও স্টাইলের অনুসরণ নতুন নয়। আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির দুই দিকপাল জিন্না ও নেহেরু বিশেষ পছন্দের পোশাক ও সেরা দোকানের জিনিস বেছে নিতেন। অবশ্য সেটা ব্র্যান্ড আইটেমের যুগ ছিল না। ফলে তারা দেশ-বিদেশের নামজাদা সরবরাহকারীর কাছ থেকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য নানা পণ্য সামগ্রী সংগ্রহ করতেন।

ফ্যাশন ও স্টাইলের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে নাম করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র রাজবংশের সদস্য রাজনীতিবিদ মাধব রাও সিন্ধিয়া ও তার বোন বসুন্ধরা রাজে। আরেকজনের নাম এক্ষেত্রে বহুলভাবে উচ্চারিত। তিনি হলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের এককালের অধিনায়ক, পাঞ্জাবের পাতিয়ালার পার্শ্ববর্তী পতৌদির নবাব মনসুর আলি খান। যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর, বোম্বের নামকরা বাঙালি নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের স্বামী এবং বলিউড নায়ক সাইফ আলি খানের পিতা।

অরুণ জেটলির মৃত্যুর পর তার অন্তরঙ্গ জীবনের যে বর্ণিল চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তিনি অবধারিত ভাবে স্থান করে নিতে চলেছেন ফ্যাশন, স্টাইল ও ব্র্যান্ডের জগতেও। তুলনামূলকভাবে প্রাচীনপন্থী, ধর্মাশ্রয়ী ও রক্ষণশীল রাজনীতির মুখপাত্র হয়েও তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন আধুনিক ভাবমূর্তিতে। চলনে, বলনে, পোষাকে সেই রুচি, আভিজাত্য ও স্বাতন্ত্রিকতার ছাপ দেখা গেছে অরুণ জেটলির আইনজীবী পেশা ও রাজনীতির কেরিয়ারে।

অরুণ জেটলি ব্যবহার করতেন বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডের দামি ও অত্যাধুনিক সামগ্রী। ঘড়ি, কলম, জামা, জুতা, টাওয়েল ইত্যাদি তিনি বেছে নিতেন বিশ্বসেরা ব্র্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে। সর্ব-সাম্প্রতিক ও উচ্চমানের ব্র্যান্ডের প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ। তাকে বলা হতো ‘হাই-অ্যান্ড ব্র্যান্ড’ প্রেমিক।

রাজনীতিতে এসে যখন তিনি নিয়মিত কুর্তা আর পায়জামা পড়তেন একটি হাতাকাটা কোটের সমন্বয়ে, তখনও গ্রীষ্মে পিওর কটন আর শীতে সেগুলো পশমিনা কাপড়ে তৈরি করা হতো। তার আগে, আইনজীবী পেশাকালে তিনি লন্ডনের বেসপোক শার্ট এবং জন লবের তৈরি কারুশিল্পময় জুতার চেয়ে নিম্নমানের কিছুই পড়তেন না।

 

অরুণ জেটলির পাঁচ দশকের লম্বা রাজনৈতিক কেরিয়ারের ঘনিষ্ঠজনেরা তার ব্যবহার্য্য সামগ্রীর বিরাট তালিকার কথা জানিয়েছেন, যে তালিকা এতো লম্বা যে, শেষ হওয়ার নয়। তার কর্মক্ষেত্রের সবাই জানতো ব্র্যান্ডপ্রীতি আর ফ্যাশন ও স্টাইলের দিক থেকে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। নিজের এই অভ্যাসের কথা অরুণ জেটলি লুকিয়ে রাখতেন না। তার প্রকাশ্য তৎপরতায় সেগুলো লক্ষ্য করা যেতো। ঘড়ি, কলম, জামা, জুতা, তোয়ালের ক্ষেত্রে নামকরা ব্র্যান্ডের প্রতি তার সহজাত আকর্ষণ ছিল অত্যন্ত তীব্র ও প্রখর। তার সংগ্রহেও ছিল নামকরা, দামি ব্র্যান্ডের বহু জিনিস। তিনি ব্যবহার করতেন পিটেক ফিলিপস নির্মিত ঘড়ি, মন্ট ব্ল্যাঙ্ক-এর কলম, বেসপোক ব্র্যান্ডের শার্ট এবং জন লবের তৈরি কারুশিল্পময় জুতা।

অরুণ জেটলি এতোটাই অগ্রসর ও অত্যাধুনিক ছিলেন যে, যখন অধিকাংশ ভারতীয়ই ওমেগা ব্র্যান্ডের ঘড়ি কেনার কথাও চিন্তা করতে পারতেন না, তখন তিনি নিজের কব্জিতে অবলীলায় পিটেক ফিলিপস-এর ঘড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার ছিল উল্লেখ করার মতো মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কোম্পানির কলম, জামাওয়ার ব্র্যান্ডের টাওয়েল, রুমাল, টাই। মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কোম্পানি নতুন ধরনের কোনও কলম বাজারে ছাড়লেই সেটা নিজের জন্য সংগ্রহ করতেন অরুণ জেটলি। এমনকি, যেদিন কলমটি বাজারে রিলিজ করা হতো, সেদিনই তা নিয়ে নিতেন তিনি।

লেখক-সাংবাদিক কুমকুম চাড্ডা ‘দ্যা মেরিগোল্ড স্টোরি’ নামে যে বই রচনা করেছেন, তাতে অরুণ জেটলিকে নিয়ে রয়েছে একটি আস্ত অধ্যায়। ‘অরুণ জেটলি: দ্য পিড পিপার’ নামের সেই অধ্যায়ে অরুণ জেটলির কেতা-দুরস্ত জীবনযাপনের আদ্যোপান্ত রয়েছে। রয়েছে তার ব্র্যান্ডপ্রীতি, ফ্যাশন সচেতনতা ও স্টাইলের প্রতি আগ্রহের কথাও।

ব্র্যান্ড সচেতনতা অরুণ জেটলির জীবনের আগাগোড়াই উপস্থিত ছিল। রাজনীতিতে এসেও তিনি সেটা পরিত্যাগ করতে পারেন নি। তার আইনজীবী পুত্র রোহানের জন্য তিনি প্রথম যে জুতো জোড়া কিনেছিলেন, সেগুলোও ছিল স্যালভাটরে ফেরাগামো নামের নামকরা ইতালীয় লাক্সারি ব্র্যান্ডের। মন্ত্রী পরিষদেও তার চেয়ে লেটেস্ট ও সর্বাধুনিক ল্যাপটপ নিয়ে অন্য কেউ কাজ করতেন না।

অরুণ জেটলির এই ফ্যাশনেবল-স্টাইলিস্ট জীবনধারা ও ব্র্যান্ডপ্রীতি সবাই জানতেন। কিন্তু কেউ এই ব্যয়বহুল জীবনের কোনও সমালোচনা করার সুযোগ পেতেন না। কারণ তিনি নিজের উপার্জন ও ব্যয়ের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করতেন। আইনজীবী হিসাবে তার অফিসকে তিনি এতোটাই নিয়মতান্ত্রিক করেছিলেন যে, কোনও মক্কেলের পক্ষে টাকা নিয়ে দর কষাকষি বা হেনস্তা হওয়ার সুযোগ ছিল না। তার অফিসের কর্মচারীরাও নানা বাহানায় ক্লায়েন্টের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেতেন না। তিনি সবার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং সেমতে টাকা জমা দেওয়ার জন্য হিসাবরক্ষক রেখেছিলেন।

মন্ত্রী হিসাবেও অরুণ জেটলি ব্যক্তিগত জীবন ও আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা দেখিয়েছেন। একবার নৈনিতালে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি একদল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে তাদের থাকা-খাওয়ার যাবতীয় খরচ তিনি কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করে নিজের পকেট থেকে চুকিয়ে দিয়েছিলেন।

 

আরেক বার, তিনি তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী, লন্ডনে একটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তার ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি পাঠায়। তিনি সেই গাড়ি হোটেলের দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজে ভাড়া করা গাড়িতে চলাফেরা করেছিলেন।

অরুণের স্ত্রী, জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক অর্থমন্ত্রীর মেয়ে সঙ্গীতা নিজের স্বামী সম্পর্কে গর্ব করে বলেছিলেন, ‘অরুণ নিজের সততা, স্বচ্ছতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সব অর্জন করেছে। কেউ তাকে হাতে তুলে কিছুই দেয় নি।’

অরুণ জেটলির ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে বহু সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমালোচনা থাকলেও তিনি ছিলেন ব্যক্তি-মানুষ হিসাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। অতুলনীয় জনসংযোগ ক্ষমতা ও মোহনীয় দক্ষতার অধিকারী অরুণ রাজনৈতিক কারণে অনেকের সঙ্গে লড়াই করতেও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কখনোই নষ্ট হতে দেন নি। রাজনীতিতে তার উচ্চরুচি ও উন্নত সাংস্কৃতিক বোধ বিদ্যমান সংঘাত ও হানাহানি প্রবণ পরিবেশে বিরল ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

যে কারণে তার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে সবাই ভিড় করেছেন দিল্লির গ্রেটার কৈলাসে অবস্থিত অরুণ জেটলির বাড়িতে। চরম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে তার বৈরিতা এমন হয়েছিল যে, উভয়ের মধ্যে কথা বলা ও মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। কিন্তু অরুণ জেটলির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পুত্র রাহুলকে নিয়ে ছুটে আসেন সোনিয়া। এখানেই অরুণ জেটলির ব্যক্তিত্বের সাফল্য নিহিত।

রাজনৈতিক কেরিয়ারের চকচকে ইমেজের মতো ব্যক্তিজীবনেও অরুণ জেটলি সবাইকে মোহিত করেছিলেন তার ফ্যাশন, স্টাইল, ব্র্যান্ডপ্রীতির দ্বারা। রুচি ও আভিজাত্যের দীপ্তিতে ভারতীয় রাজনৈতিক ঘরানায় রেখেছিলেন মেধার স্বাক্ষর এবং দারুণ সফলভাবে সম্ভব করে তুলেছিলেন নিজের আলোকিত ও সুশোভন উপস্থিতি।

অরুণ জেটলির মৃত্যুতে মেধাবী নেতা এবং সুস্নিগ্ধ-সুসজ্জিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাজনীতিবিদের অভাব ভারতের রাজনীতিতে অনুভূত হবে, যে অভাব খুব সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না।

আরও পড়ুন: অরুণ জেটলি: ভারতীয় রাজনীতির মেধাবী পুরুষ

এ সম্পর্কিত আরও খবর