অগ্রণী ব্যাংকে মান্ধাতার আমলের সেবা

ব্যাংক বীমা, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 22:43:04

চেক হাতে নিয়ে, পাশ দিয়ে যাওয়া আরেক সহকর্মীকে দাঁড় করালেন। জানতে চাইলেন ১০ লাখ টাকা এফডিআর করলে কেমন কি। একজন গ্রাহককে যে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন সে কথা মনে হয় ভুলেই গেলেন সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) মৌসুমী আক্তার।

অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার ক্যাশের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সব আলাপই শোনা যাচ্ছিল। কয়েক মিনিট ধরে এফডিআরের খুঁটি-নাটি যেনো তারপর চেকের দিকে মনযোগ দিলেন। কম্পিউটারে দেখে বললেন, আপনার চেকটি ইস্যু করা হয়নি। তাহলে চেকটা পেলাম কিভাবে! মৌসুমী আক্তার বললেন, যে শাখায় আপনার অ্যাকাউন্ট (অগ্রণী ব্যাংক প্রেস ক্লাব শাখা) সেখানে গিয়ে ঠিক করে আনেন।

তাকে জানালাম এখন ব্যাংক আওয়ার শেষের দিকে আর সংশ্লিষ্ট শাখায় যাওয়া সময় সাপেক্ষ বিষয়। আপনিও ফোনে যাচাই করতে পারেন। এবার পরামর্শ দিলেন, ফোন দিয়ে চেকটি ইস্যু করিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রেস ক্লাব শাখার ফোন নম্বর জানা নেই বলতেই অবাক হওয়ার পালা।

মৌসুমী আক্তার পরামর্শ দিলেন অনলাইনে সার্চ দেন পেয়ে যাবেন। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনার কম্পিউটারেও তো সার্চ দিতে পারেন, সামনেতো কম্পিউটার রয়েছে। ধড়াস জবাব দিলেন, আপনি অনলাইনে সার্চ দেন। অথচ তখন তার হাতে অঢেল সময়, কাউন্টারে আর কোন গ্রাহকও নেই।

এ কথা বলেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মৌসুমী আক্তারের পেছনে বসা একজন তরুণ অফিসার বিষয়টি খেয়াল করছিলেন। তিনি বললেন, আমি দেখছি ফোন নম্বর দিতে পারি কি না। খুঁজে বের করে কাগজে টুকে ওই নারী অফিসারকে দিলেন। তিনি তখন নম্বরটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার শাখায় (যে শাখায় হিসাব রয়েছে) কথা বলেন, তারা চেক বইটা ইস্যু করে দিক। তাকে বললাম আপনিও ফোন দিয়ে যেনে নিতে পারেন। তাহলেতো একসঙ্গে দুই কাজ হয় আপনার।


ভদ্র মহিলার এক কথা, আপনি ফোন দিয়ে চেক ইস্যু করে নিয়ে তারপর আসেন। অগত্যা প্রেস ক্লাব শাখায় ফোন দিতে হলো। সেখান থেকে ১০ মিনিট সময় চেয়ে বলা হলো, ভুলে মনে হয় চেকটি ইস্যু করা হয়নি। আপনি অপেক্ষায় থাকেন, আমরা ইস্যু করে দিচ্ছি।

প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাংক ভুল করে একজন গ্রাহকের চেক ইস্যু দেখায়নি। সেজন্য গ্রাহক কেনো দুর্ভোগ পোহাবে। আর প্রধান শাখায় তারই ব্যাংকের অন্য একটির শাখার নম্বর নেই, এটি কি করে হয়। প্রধান শাখার কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট শাখায় ফোন দিয়ে এক মুহুর্তেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে নিতে পারেন। তিনি সেটা করতে গরজ দেখা গেলো না। তার কম্পিউটার সার্চ দিয়েও নম্বর বের করলেন না।

অথচ মৌসুমী আক্তারের মাথার ওপর গ্লাসে প্ল্যাকার্ড লেখা রয়েছে, গ্রাহকের সন্তুষ্টিই আমাদের সন্তুষ্টি। এই যদি হয় সেবার নমুনা তাহলে গ্রাহক সন্তুষ্ট হবে কিভাবে। এমনিতেই সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের প্রধান শাখার সার্ভিসের নমুনা যদি এই হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কেনো অগ্রণী ব্যাংকে যাবে। আর যদি সাধারণ গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রাহকের পায়ের নাগালেই অনেক বেসরকারি ব্যাংক, যাদের আন্তরিক সার্ভিসের ধারের কাছেও নেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উপরের দিকে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। এখন প্রতিযোগিতার বাজার, মানুষ যেখানে সেবা ভালো পাবে সেখানেই যাবে।

মানুষ এখন আর আগের সেই মান্ধাতার আমলের সেবায় সন্তুষ্ট না। তারা এখন মুহুর্তেই তার কাজটি শেষ করতে চান। আগে খবর নেওয়ার জন্য চিঠির অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো। এখন পৃথিবীর অপরপ্রান্তে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা সেরে নিচ্ছেন মুহুর্তেই। আর অগ্রণী ব্যাংকের মৌসুমী আক্তাররা নিজের ব্যাংকের আরেকটি শাখা সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। শুধু তাই না নিজের কম্পিউটার ঘেটে একটি ফোন নম্বর দিতে যার রাষ্ট্রের অনীহা। আবার গ্রাহককে দাঁড় করিয়ে রেখে ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় মগ্ন থাকছেন, যা ব্যাংকিং সেবা বিধিমালায় সম্পূর্ণ বর্হিভূত।

গতবছর প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত, বিতরণকৃত ঋণসহ ব্যবসায়িক পরিধিও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য সুদৃঢ় না হয়ে আরও ভঙ্গুর হয়েছে। ২০২১ সালে সুদ খাতে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৭৪৪ কোটি টাকা। ওই বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৯৯২ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতিও রাখতে পারেনি অগ্রণী ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে ৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ব্যাংকটির। অথচ তাদের অফিসাররা যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন গ্রাহকদের সঙ্গে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে তাদের সঞ্চিতিতে আরও ধ্বংসের শঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বার্তা২৪কম-কে বলেছেন, ব্যাংকগুলোতে হরহামেশা এ রকম গ্রাহক হয়রানির ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকগুলোর কাজই হচ্ছে গ্রাহক সেবা প্রদান করা, সেবা দিতে না পারলে বুঝতে হবে তারা কাজটি করছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লোকেরা ব্যাংকে ওন করে না। ওনারা মনে করেন মাস গেলে বেতন ঠিকই পাবেন। লাভ লোকসানে তার কোন যায় আসে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে দেখার কথা তারাও কোন ভূমিকা পালন করছে না। এতে দিন দিন সেবার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেবায় যে দুরাবস্থা চলছে তার উদাহরণ ওইসব ঘটনা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর