বদনাম কেন শুধু বোবা আম-বালিশের?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 10:31:53

গত ২২ মে যাত্রাবাড়ীতে পনের টন আম রাসায়নিকে পাকানোর অভিযোগে ট্রাক দিয়ে পিষে এবং ১৯ মে তারিখে এক হাজার একশ’ মণ আমকে বিষাক্ত হিসেবে অভিযুক্ত করে বুলডোজার দিয়ে পিষে ভর্তা করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা।

এছাড়া প্রায়ই সরকারি জমিতে অবৈধভাবে তৈরি দালান, দোকান-পাট, বাড়িঘর, স্থাপনা ইত্যাদি এমনকি ফেনসিডিলের বোতল বুলডোজার দিয়ে পিষে দেওয়া হয়। অধিকন্তু বিভিন্ন অভিযানে উদ্ধারকৃত ইয়াবাকে বুলডোজার দিয়ে পিষে পিষে ফেলা হয়। এইসব জড় পদার্থের আর্তনাদ কারো প্রাণে আঘাত করে না। কারণ এরা সবাই বোবা, এদের কারোরই প্রান নেই, তাই নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষাও নেই। তাই এদরকে সাড়ম্বরে জনসন্মুখে মৃত্যুদণ্ড দিলেও এরা মরে না। এসব দ্রব্য নবজীবন নিয়ে বার বার ফিরে আসে!

এ ধরনের অপরাধ মোকাবেলায় এদের সৃষ্টির উৎসমুখে পূর্বাহ্নেই সরকারি প্রতিরোধ কর্মসূচি কার্যকর থাকলে বেচারা ফল, ফেনসিডিল ও ইয়াবাকে বুলডোজার দিয়ে বারবার পিষে ভর্তা করতে হতো না। এগুলো আর্থ-সামাজিক অসুখ। এর সাথে সমাজের বহু মানুষের বিশেষ স্বার্থ জড়িত থাকে বিধায় শুধু বুলডোজার লাগিয়ে প্রতিকার কর্মসূচি দিয়ে এ অসুখ সাময়িকভাবে কমানো গেলেও নির্মূল করা দুরুহ।

ক’দিন ধরে রূপপুর পারমাণবিক প্রজেক্টের কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে তুলার বালিশকে অতি বেশি দামে অবৈধভাবে বদনাম দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রজেক্টের কেনাকাটায় বালিশ একটি রূপক মাত্র। দেশে কোন প্রজেক্টে কত টাকায় এরকম কোটি কোটি বালিশের মূল্য সমপরিমাণ টাকার অপচয় করা হয়, তা সংবাদ মাধ্যমে আসে না অথবা সেগুলোর খোঁজ করা এখানে বাতুলতা মাত্র।

দেশে এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম। তাই একটি বালিশের দামে এগার মন ধান কিনতে পাওয়া যায়। এক মণ ধান দিয়ে এক কেজি গরুর মাংসও কেনা যায় না। ক’দিন পর হয়তো ধান নিয়ে এই নাজুক অবস্থা থাকবে না। আমরা জানি, পণ্য বিনিময়ের যুগে টাকার অভাব ছিল। তখনকার দিনে কানাকড়িরও অনেক মূল্য ছিল। শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। তবুও সেসময় কিছু অভাবী মানুষ শালুক-গুগলি খেয়ে দিনাতিপাত করেছে।

এখন বাজারে মোটা হাইব্রিড ধানের দাম কিছুটা কম। তার পরেও এই সস্তা ধান কেনার সামর্থ বহু প্রান্তিক মানুষের নেই। দেশে মোট দিনমজুর ও ভিক্ষুকের সংখ্যা ও যাকাত প্রার্থীর সংখ্যার দিকে তাকালে এ অবস্থা সহজে অনুমেয়। আজকাল ভিক্ষুক ও যাকাত প্রার্থীরা শহুরে অনেক বিলাসবহুল বাসা-বাড়ির ফটকের সামনে ভিড়তে পারে না। দারোয়ানরা আগেই তাদেরকে তাড়িয়ে দেবার নির্দেশনা পেয়ে সে দায়িত্বটি ভালভাবে পালন করে। আর যাদের বাসার দরজায় ঘেঁষার সুযোগ পায় প্রতি সকালে তাদের মুহুর্মুহু কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে বিরক্ত হওয়ার কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন বৈ কি। এর কারণ হলো- সমাজে সমাজে মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য ও ব্যয়ের ফুটানি। যা থেকে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কিছু চতুর লোকেরা বোবা বালিশের ওপর বদনাম বা বেচারা অপরিপক্ব আমের ওপর বুলডোজার চাপিয়ে দিয়ে নিষ্পেষণ কবার হঠকারী ঘটনা ঘটানোর মত বিষয়।

হতাশা অপরাধের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষের মনে ক্রমাগত ব্যথা ও হতাশা অপরাধ প্রবণতার জন্ম নেয়। এই অপরাধ প্রবণতার সূতিকাগার সমাজের চেপে রাখা বোবা কান্নাগুলো থেকে দিনরাত উৎসারিত হতে থাকে। তাই মানুষের মনের রোগ না সারিয়ে সারা বছর বুলডোজার দিয়ে পিষে আম-ফল ভর্তা করা হলেও ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।

এক শ্রেণির মানুষের রক্তে মেশা লাগামহীন দুর্নীতি, জালিয়াতি, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের নীতি, রাতের ভোটের সুফল-কুফল ও জবাবদিহিতাকেও এখানে খাটো করে দেখার উপায় নেই বলে অনেকে মনে করেন। ভারতে এত বড় নির্বাচন হলেও মানুষ ভোট দিতে পেরেছে। ভারতের মানুষ ভোট প্রদানের সিস্টেমকে তেমন দোষারোপ করছেন না। তাই রাহুল গান্ধী নিজ আসন আমিথিতে হেরে গেলেও আক্ষেপ না করে এবং কাল বিলম্ব না করেই নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আর আমাদের দেশে ভোট শেষ হবার কয়েক মাস গত হয়ে গেলেও বিরোধী পক্ষ থেকে সেরকম সুবাতাস নেই। তফাৎটা এখানেই। এজন্য সমাজের অনেক সাধারণ বিষয়গুলো থেকেই হতাশা ও সেগুলো থেকে অপরাধবোধ জন্ম নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বরং আমাদের সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে, সন্দেহ বেড়েছে-বেড়েছে প্রতিহিংসা। যে কোন সমাজে অস্থিরতা, সন্দেহ ও প্রতিহিংসা বিরাজমান থাকলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মানুষ নৈতিকতাকে অগ্রাহ্য করে এবং সামাজিক অপরাধগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাইতো দুর্নীতিকে নীতি মনে করা, দুধে পানি মেশানো, খাদ্যে ফরমালিন মেশানো, অপরের ফলের বাগান কেটে সাবাড় করে দেয়া, অপরিপক্ব ফলে বিষ মাখানো, মাছের পুকুরে বিষ ঢেলে দেওয়া ইত্যাদি কঠিন, নির্মম ও নিষ্ঠুর অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। এগুলোর ইন্ধনদাতারাও নিষ্ঠুর প্রকৃতির এবং সমাজের হোমরা-চোমড়া। এদের বিরুদ্ধে সহজে কোনো অভিযোগ করা যায় না। করলেও এরা নিমিষেই ঘুষ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে এসে আবার নিরীহদের ওপর চড়াও হয়।

আরও পড়ুন: অপরিপক্ব ৫০ মণ ল্যাংড়া আম জব্দ-নষ্ট

তাইতো আজকাল গ্রামের সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষটিও যৎসামান্য সরকারি সেবা পেতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বেশি ঘুষ দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যারা তা দিতে অপারগ তারা নিরুপায়, সমাজের অসহায় শ্রেণি। সুতরাং সাধারণ নিরীহ অসহায় মানুষ বোবা বালিশের মত গুমরে গুমরে কাঁদে আর অভিশাপ দেয়। তাদের এই অভিশাপগুলোর কোনো স্বাভাবিক সুরাহা না হলে হয়তো সেজন্যই একদিন সেগুলো সামজিক বিপর্যয় হিসেবে সমাজের সকলের উপরে বোঝা হিসেবে নেমে আসে। সেটাকে কেউ বলেন প্রাকৃতিক, কেউ নিয়তি, কেউবা বলেন সামাজিক বিপর্যয়। এর বিপরীতে ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক যে কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হোক না কেন, এটাই ঐশী শিক্ষা।

অর্থাৎ, মানুষ অন্তর থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলে অপরাধী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আমাদের সমাজে বড় অপরাধীদের বুক ফুলিয়ে চলার ঔদ্ধ্যত্ব দেখে দেখে ছোট অপরাধীরা উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে আমাদের খাদ্যে ভেজাল, ওষুধ-পথ্যে ভেজাল, পরীক্ষায় নকল, নিয়োগে অনিয়ম, অফিসে স্বাভাবিক পন্থায় কোনো কাজ করার উপায় নেই। এর প্রধান কারণ- রক্তে মেশা অভাবনীয় দুর্নীতি আমাদের বড় থেকে ছোটদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেড়েছে।

আরও পড়ুন: আমের আড়তে অভিযান, ৪০০ মণ আম জব্দ

এর নেপথ্যের নায়ক কে বা কারা? তাদের চেহারাটাও তো টিভি অথবা পত্রিকায় দেখতে পাওয়া দুষ্কর। এই ভেজাল কাজে যারা জড়িতদের মানসিকতাকে বুলডোজার দিয়ে পিষে ভর্তা না করে বেচারা ফল, ফেনসিডিল ও ইয়াবাকে বুলডোজার দিয়ে বারবার পিষে ভর্তা করতে হয় কেন?

আমাদের রক্তে মেশা দুর্নীতি বড়দের থেকে শিখে ছোটদের তথা সর্বস্তরের মানুষের ব্যক্তিগত নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমে বারবার লোকদেখানো জবাবদিহিতা প্রদর্শন করলেও মূল অপরাধীদেরকে স্পর্শ করতে ভয় পায়- এসব দায়িত্বরত ভীরু কারা? এরা এবং এদের নেপথ্যের নায়কদের কি সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক জবাবদিহিতা নেই?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর