কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৭)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার শত্রুদের উপস্থিতিতে

[পূর্ব প্রকাশের পর] দাশদের তের বছরের কন্যা রাচেল খুব ভয় পেয়েছিল। তার বাবামা আমাদের প্রতিজ্ঞা করান, যেন আমাদের কোথাও চলে যেতে হলে আমরা তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাই।

সেই সোমবার বিকালে আমাদের গির্জার দুই তরুণ সদস্য স্টিফেন ও পল (যাকে আমরা সবসময় তার ডাকনামে বাবলা বলে ডাকতাম) প্রবল গোলাগুলির মধ্যেই গা বাঁচিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়। পাকিস্তানি প্লেনগুলো উড়ছিল মাথার উপরে, আর সর্বত্র আগুনের শিখাসমূহ উৎক্ষিপ্ত হচ্ছিল আকাশের দিকে। ছেলেদুটো গোলাগুলি একটু কমার অপেক্ষা করে, তারপর ফাঁক বুঝে দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়। আমি তাদেরকে আর আসতে বারণ করি।

আমরা বিকাল সাড়ে চারটায় আবার একত্র হই বাইবেল পাঠ ও প্রার্থনা করার জন্য। আমরা তা শেষ করা মাত্রই একটা গোটা পরিবার এসে আমাদের দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়। তারা এমন একটা এলাকা থেকে আসে, যেখানে আমরা গোটা পাড়াকে আগুনে জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি। এই পরিবারটি বাড়ির ভেতরে রেডিও শুনছিল, যখন একটা গোলা এসে ঢোকে জানালা দিয়ে। গুলির হাত থেকে বাচঁতে গিয়ে তরুণী বধূটি পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলে। আমরা তাকে ব্যথা কমানোর অষুধ দিয়ে, বাঁশের কঞ্চি দুই ভাগ করে তার হাতের দুদিকে রেখে কাপড় জড়িয়ে শক্ত করে বেঁধে দিই।

সে-রাতে রান্না শেষ করে খাবার খাওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। আমরা তখন বসার ঘরের মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকি দরজাটা একটু ফাঁক করে, যেন কিছুটা বাতাস আসে। সময় কাটানোর জন্য আমরা বাইবেলের শ্লোক আওড়াই স্মৃতি থেকে। সেগুলো বাংলায় বলতে গিয়ে দ্রুত আমাদের ভাণ্ডার শেষ হয়ে যায়, এবং বাচ্চারাও ত্বরিতে পালিয়ে যায়। তারপর আমরা ‘আমি যা বলি তা ইংরেজিতে বলো’ খেলাটা খেলতে চেষ্টা করি। আমরা আস্তে আস্তে একটা ইংরেজি বাক্য বলি, আর বাচ্চারা সেটা শুনে তার প্রতিধ্বনি করে। আমরা ’ওপেন দ্য ডোর, শাট দ্য ডোর’ করার মধ্যেই দিদিমা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন।

“তোমরা দরজা বন্ধ করতে চাচ্ছো কেন? এখানে তো প্রচণ্ড গরম,” তিনি অভিযোগ করেন, আমরা কী করছিলাম সেটা না বুঝেই।

আমরা হাসিতে ভেঙে পড়ি এবং সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই, পাছে আমাদের হাসির শব্দ বাইরে রাস্তার কোনো ট্রিগার-সুখী সৈন্যের কানে চলে যায়।

আমরা যার যার বরাদ্দকৃত ঘরে যাই, কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারি না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, শেলিংয়ের শব্দ বাড়ির বেশি কাছে চলে এলে, আমরা আমাদের ঘর ছেড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে বসবার ঘরে চলে আসব, যেটাকে আমাদের ‘বম্ব শেল্টার’ হিসাবে ঠিক করা হয়েছিল। আসবাবগুলোকে দেয়ালের পাশে সারবেঁধে রেখে বালিশ, কুশন, কম্বল দিয়ে সব জানালা ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। ঘরটা বেশ একটা আরামদায়ক কুঠুরি হয়ে উঠেছিল, যদিও তার মধ্যে চোদ্দজন লোকের উপস্থিতিতে একে খুব একটা আরামের মনে হচ্ছিল না আর। আমাদের কুকুর চিত্রা বারান্দায় ছিল, কিন্তু মর্টার শেলের হিসহিস শব্দ তার কানে গিয়ে আঘাত করছিল, এবং প্রতিবার গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত দরজা খুলে আমরা তাকেও ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিই।

সারা মেয়েটি মেঝের ঠিক মাঝখানে শুয়ে ছিল, তার হাতগুলো উঁচু করে শূন্যে তোলা। সে একটা নিয়ম করে সেগুলোকে নাড়াচ্ছিল, মশা তাড়ানোর উদ্দেশ্যে। চিত্রা তার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে, তার পাশে গিয়ে শোয়, পিঠে ভর করে, তারই মতো চার হাত-পা শূন্যে মেলে দিয়ে। আমরা মোমবাতির মৃদু আলোয় এই যুগলের দিকে চেয়ে হাসিতে ফেটে পড়ি। আমাদের সেই হাসির হল্লা সবাইকে শান্ত করে এবং আমরা যার যার মতো হয় ঘুমে ঢলে পড়ি, অথবা মশাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যুদ্ধে অবতীর্ণ হই।

সকালের দিকে বিদ্যুৎ আসে, এবং তাতে মাথার ওপরের বিশাল ঘূর্ণ্যমান ফ্যানটি মশাদের তাড়িয়ে দিলে আমরা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারি। কিন্তু পাছে আমরা বেশিক্ষণ আরামে ঘুমিয়ে ফেলি, তাই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায় ফের: ভারী কামান ও মর্টারের গোলার বিকট শব্দ শোনা যেতে থাকে পুনরায়।

হাতভাঙা মহিলাটি সকালে ফেরত আসেন। বোঝা গেল তিনি আমাদের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্যটাই ধরতে পারেননি, কেননা স্নান করার সময় তিনি তাঁর হাতের ব্যান্ডেজ ও বাঁধুনিটি খুব যত্ন করে খুলে রেখেছিলেন। আমরা আবার শুরু করি, এবার তিনটি কাঠি এবং মজবুত টেপের সাহায্য নিয়ে। আমরা তাঁর স্বামীকে বলি তাঁকে মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে প্লাস্টারের ব্যবস্থা করতে, কিন্তু তিনি জানতেন যে, সেখানে তখন কোনো চিকিৎসারই বন্দোবস্ত ছিল না। তাকে তাই আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

আমরা যখন একটু দিবানিদ্রা দিয়ে আমাদের ঘুমের ঘাটতিটুকু পুষিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম ঠিক তখনই দুপুর দুটো নাগাদ, নির্মল আমাদেরকে ঘুম থেকে তুলে জানায় যে, পাকসেনারা আমাদের বাসার সামনের পাহাড়ে ভারী কামান-বন্দুক বসাচ্ছে। আড়াইটার দিকে তারা একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় পাকিস্তানি পতাকা টাঙায়। একই সঙ্গে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর দুটো বিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়, একবার গোত্তা খেয়ে দু’দুটো বোমাও ফেলে যায়। তাদের লক্ষ্য ছিল শহরের উপকণ্ঠের রেডিও স্টেশনখানি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম এটা নিয়ে, কেননা রেডিও স্টেশনটির একেবারে কাছেই ছিল গাড়িঘোড়া ও ট্রেনচলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কালুরঘাট সেতু, এবং আমাদের মালুমঘাট হাসপাতালে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাখানি।

পাকিস্তানি পতাকা দেখে ছাত্র ও অন্যান্য তরুণেরা পাহাড়ে চড়ে দেখতে গিয়েছিল এটা আসলে কাদের শিবির। কেউ ভেবেছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরাই বুঝি কৌশল হিসাবে এটা ব্যবহার করছিল, অন্যেরা সৈন্যদের ভাঙা বাংলা শুনে বুঝতে পেরেছিল তারা বাঙালি নয়।

জব্বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এরা সেই সৈন্যই যারা সামনের রাস্তা দিয়ে আসাযাওয়া করা লোকজনের ওপর গুলি ছুড়ছিল। আমাদের বাসায় যে আহত বাঙালি সৈন্যরা আসছিল চিকিৎসার জন্য সেটা তারা নাকি ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। আমাদের বাসার মাত্র পাঁচশ গজ দূরে অবস্থান নেওয়া তারা যদি সত্যি সত্যি পাঞ্জাবি সৈন্য হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বিপদ আছে বৈকি। সে বুঝতে পারছিল আমাদের এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।

তবে ইতোমধ্যে বেলা পড়ে আসাতে বাড়ি ছাড়ার জন্য সেটা ঠিক অনুকূল সময় ছিল না। রিড ও নির্মল পেছনের গলি দিয়ে রিডের বাসায় যায়। রিড বাস্তবে সাদাপোশাকে কোনো পাঞ্জাবি কিনা, লোকেদের এরকম ফিসফিসানি শুনে তিনি বাংলায় কথা বলা শুরু করেন। তিনি যাওয়ার পথে বারবার থেমে চেনা অচেনা সবার সঙ্গেই কথাবার্তা বলেন। তিনি কথাবার্তার মাঝে খুব কৌশলে এটাও জানান দিতে থাকেন যে, তিনি একজন আমেরিকান নাগরিক। বাসায় গিয়ে তার পেছনখোলা ল্যান্ডরোভার গাড়িতে তেল আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখেন রিড এবং ব্যাটারি চার্জ দেবার তারটাও জায়গামতো লাগিয়ে নেন।

সেই সন্ধ্যার বাইবেল পাঠ খুব জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যখন আমরা শত্রুর পাহাড়ের নিচে বসে আবৃত্তি করি, “আপনি শত্রুর উপস্থিতিতেই আমাদের টেবিলে খাবার তুলে দেন।” এবং টেবিলখানি সত্যিই পূর্ণ ছিল ঘরে বানানো রুটিসহ হরেকরকম খাবারে, যা রান্না করা হয়েছিল আমাদের সানবিম বৈদ্যুতিক কড়াইয়ে।

সে-রাতে আমাদের যার যার ঘরেই থাকতে পেরেছিলাম আমরা, যদিও দূর থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছিল ঠিকই। অবশ্য কোনো কারণে আমরা সবাই খুব অস্থির ও উদ্বিগ্ন ছিলাম সবাই; তবে রিড নন, তিনি দিনের বেলায় মশা ঢোকার সবগুলো ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এবং রাতে খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন।

সকালের নাস্তার পরপরই জব্বার ও রিড আমাদের প্রস্থানের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমাদের হাতে বেশি টাকা ছিল না এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা কাউকে না জানিয়ে বেরিয়েও যেতে পারছিলাম না। দুইজনকে তো একমাইল হেঁটে গিয়ে একটা রিকশা নিতে হয়েছিল, যার চালক পাঞ্জাবি সৈন্য অধ্যুষিত এলাকার ভেতর দিয়ে রিকশা নিয়ে যেতে রাজি হয়ে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছিল।

আমাদের বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে তাঁরা দেখেন, সেটা একুশজনের একটা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে, যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এমন সব লোকের। জন সরকার, এই সেন্টারেরই কর্মী ও বাসিন্দা, সে এই পুরো দলের দায়িত্ব নেয়, এবং প্রবল নৈরাজ্যের মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


সেই মুহূর্তের উত্তেজনার কারণ হিসাবে জন ব্যাখ্যা করে বলে, গতকাল রাতে তাদের দুই অতিথি গুর্‌গানসের বাড়িতে যাবার জন্য বেরিয়ে তখন পর্যন্ত ফিরে আসেনি। জন আমাদের চার্চের আরো কয়েকজনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা জানত। পাঞ্জাবি সৈন্যরা ঢোকার পর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করা খ্রিস্টান নার্সরা সবাই চলে গিয়েছিল। কয়েকজন এমনকি ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে হেঁটেই রওনা হয়ে গিয়েছিল, পঁচিশ মাইল দূরের চন্দ্রঘোনা মিশনারি হাসপাতালের উদ্দেশে।

বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারটি তখন পর্যন্ত ছিল মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, কিন্তু পাঞ্জাবিরা দ্রুত এগুচ্ছিল তার দিকে। গুর্‌গানস ও বাকি বিদেশিরা যে-অঞ্চলে ছিলেন সেটা অবশ্য তাদের দখলে ছিল। সেজন্যই আমাদের সেন্টারের বাঙালিরা ভেবেছিল জব্বারের পক্ষে নো ম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে পাঞ্জাবি এলাকায় ঢোকাটা নিরাপদ হবে না। তত্ত্বগতভাবে রিডের অবশ্য দুই এলাকাতেই নিরাপদ থাকার কথা।

দুপুরের মধ্যে ফিরে না এলে, জব্বার যেন বাকিদের কাছে ফেরত যায়, এই নির্দেশনা দিয়ে রিড একাই বেরিয়ে গেলেন। আধা মাইল মতো হাঁটার পর তিনি একটা বড় চৌরাস্তায় গিয়ে পৌঁছান। এর একদিকে চিটাগাং মেডিকেল কলেজ, আরেক পাশে প্রবর্তক পাহাড়ের ওপর হিন্দু অনাথাশ্রম, আর এই দুই রাস্তার মিলনস্থলে আমাদের বাজার-সদাইয়ের দোকান। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা রিডকে থামিয়ে জেরা করে, এবং তাকে আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে সামনে না বাড়ার নির্দেশ দেয়। “আমরা একটা অভিযান চালাচ্ছি এখানে,” তারা ব্যাখ্যা করে।

এই অপেক্ষার মধ্যেই এক জার্মান অভিবাসী এসে যোগ দেন রিডের সঙ্গে। মুদি দোকানের পেছনেই তাঁর বাসা, এবং তিনি ঢাকায় গিয়ে উদ্ধারকারী বিমান ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাঙালি যোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধের বর্ণনা দেন এবং জানান যে, এর মাধ্যমে মেডিকেল কলেজের সব গুরুত্বপূর্ণ পাহাড় পাকিস্তানিরা তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।

এই অপেক্ষার মধ্যেই রিড দেখেন পাকিন্তানি সেনারা আশেপাশের দোকানপাটে ঢুকে তাদের ইচ্ছামতো জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। একজন উর্দুভাষী লোক তাদেরকে মিনতি করে জিনিসপত্র লুট না করতে, কিন্তু তারা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৪)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;