কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৪)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ : আলম খোরশেদ
বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈশ্বর আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন

[পূর্ব প্রকাশের পর] প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় যেন বারুদে অগ্নিসংযোগ করা হলো। সংঘর্ষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে।

এক রাতে আমাদের গির্জার এক পুরোহিত আরেকটি গির্জাপরিবারের জন্য বিছানা, বালিশ, কাঁথা ইত্যাদি চাইতে এলো। তিনি আমাদের বলেন যে, বোমা আর মলোটোভ ককটেল বানানোর সময় বিস্ফোরণে তাদের পাহাড়ের পুরো ওপরের অংশটা জ্বলেপুড়ে গিয়েছিল।

পাকিস্তানি সেনারা ’দুর্বৃত্তদের’ (যারাই তাদের বিরোধিতা করত তাদেরকেই তারা দুর্বৃত্ত আখ্যা দিত) কব্জা করার জন্য অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানিরা স্বীকার করে যে, হাঙ্গামা থামাতে গিয়ে তারা ১৭২ জন মানুষকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। লন্ডন অবজার্ভার পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি অবশ্য এই সংখ্যাটিকে কেবল ঢাকা শহরেই ২০০০ বলে উল্লেখ করেন।

এইসব প্ররোচনা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে। বরং, ৭ই মার্চ, জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি জনসাধারণকে আহ্বান করেন কেন্দ্রীয় কোষাগারে কোনো খাজনা কিংবা কর জমা না দিতে এবং কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা না করতে। তিনি রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ থামানোরও আদেশ দেন। বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যেকার দাঙ্গা ও সংঘর্ষ থামানোর জন্য তিনি এমনকি এটাও ঘোষণা করেন যে, “বাংলাদেশের অধিবাসী সবাই বাঙালি।”

দাঙ্গা এক পর্যায়ে থামে। ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতায় পুলিশ কাজে যেতে অস্বীকার করলেও, অইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং রাস্তায় যানবাহনের চলাচল অব্যাহত থাকে।

ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চকে জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসার তারিখ হিসাবে নির্ধারণ করেন। শেখ মুজিব তাঁর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদানে নিম্নোক্ত শর্তাবলি আরোপ করেন:

• সামরিক শাসন রদ করতে হবে।
• সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।
• দেশের প্রধান শহরগুলোতে সামরিক বাহিনীর হাতে বাঙালি হত্যার তদন্ত করতে হবে।
• নবনির্বাচিত সাংসদদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

অসহযোগিতা আন্দোলন কার্যত দেশের বেসামরিক শাসনভার শেখ মুজিবের হাতেই অর্পণ করে, যদিও তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তখনও, যা পূর্ব পাকিস্তানে অব্যাহত সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও, বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় ও মধ্যস্থতাসভায় তাঁর অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিভাত হচ্ছিল। অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতির পর্যালোচনায় এটা প্রতীয়মান ছিল যে, এইসব শান্তিআলোচনা স্রেফ লোকদেখানো ছিল; একটা সর্বাত্মক সামরিক দমনপীড়ন চালানোর জন্য যথেষ্টসংখ্যক সৈন্য আনতেই আসলে এই অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ।

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বার্ষিক ফিল্ড কাউন্সিল মিটিংয়ের সময় আমরা অনেকটা সময় ব্যয় করি আপৎকালীন সময়ের নানাবিধ পরিকল্পনা করে।

আমাদের মিশনটি দলগত কাজে বিশ্বাস ও তার চর্চাও করে। আমরা যে-কোনো সমস্যা বা পরিস্থিতিতে একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। তবে এটা ছিল একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতি। অমরা অনুভব করি যে, দেশে থাকা কিংবা দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি কিংবা পরিবারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত; কাউকেই থাকার জন্য জোর করা হবে না, আবার কেউ চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকেও পালিয়ে যাবার অপবাদ দেওয়া হবে না।

মালুমঘাট হাসপাতালের বিশাল মিশনারিদল নৌকা করে সাগরে গিয়ে অপেক্ষমাণ উদ্ধারকারী সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে, অথবা প্রতিবেশী দেশ বার্মার ভেতর দিয়ে জরুরি নির্গমনের কথাও ভেবে রাখে।


আমরা যারা চিটাগাংয়ে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকগোষ্ঠীর সদস্য ছিলাম তাদের কাছে এই মর্মে চিঠি আসে, আমরা যদি দেশত্যাগ করতে ইচ্ছুক হই, তাহলে যেন একটি নির্দিষ্ট পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত চত্বরে গিয়ে রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিমানের জন্য অপেক্ষা করি।

২১শে মার্চ, রবিবার রাতে আমরা চিটাগাংয়ের কর্মীরা একত্রিত হই আমাদের পরিকল্পনাবিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গুর্‌গানস পরিবারের ছুটিতে যাবার কথা ছিল। তাঁরা যুক্তি দেখান যে, এই প্লেনটা ধরাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। জিন গুর্‌গানস চলে গেলে রিড মিনিখই হবেন মিশনের একমাত্র পুরুষ সদস্য—ফলে তাঁর যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। লিন সিলভারনেইল, যার সঙ্গে আমি শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম, এবং আমি, আমরা কেউই বাক্সপ্যাটরা বেঁধে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার তাড়না বোধ করিনি। আমরা তিনজন তাই থাকার পক্ষে ভোট দিই।

২৩শে মার্চ—পাকিস্তান দিবস! সরকারিভাবে এই দিনটি ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ও অগ্রযাত্রা উদযাপনের জন্য নির্ধারিত, তবে এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করাটাও। বাংলাদেশের লাল, সবুজ আর সোনালি রঙের জাতীয় পতাকাখানি সেদিন শহরের সব বাড়ি, দোকানপাট ও গাড়িতে গাড়িতে উড়ছিল। কেবল ঢাকা বেতারকেন্দ্র আর সরকারি দপ্তরগুলোতে ছিল চাঁদতারার সমাহার।

পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে অটুট রাখার লক্ষ্যে ওই একই দিনে এম ভি সোয়াত নামে একটি পাকিস্তানি জাহাজ প্রাণসংহারী অস্ত্রশস্ত্রে বোঝাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। অস্ত্রবাহী জাহাজ ভেড়ার খবরটা দ্রুত শহরময় চাওর হয়ে যায়, আর লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। উৎপাটিত বৃক্ষ, আলকাতরার খালি ড্রাম, সিমেন্টের চাঙর, পরিত্যক্ত গাড়ি—হাতের কাছে যা পাওয়া গেছে তা-ই রাস্তায় ফেলে সৈন্য ও অস্ত্রসমূহ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। হাজার হাজার বাঙালি লাঠিসোটা নিয়ে বন্দর অভিমুখে যাত্রা করে অস্ত্রখালাস ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। এটা বাস্তবিক একটি শোচনীয় দৃশ্য ছিল—এমন বিপুল সাহস পাশাপাশি প্রস্তুতি ও শৃঙ্খলার এমন সামগ্রিক অভাব!

শেখ মুজিবের আদেশে বন্দরশ্রমিকেরা অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকার করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের এই কাজ করতে বাধ্য করা হয়। “যে-কোনো মূল্যে এই অস্ত্র খালাস করতেই হবে,” পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারেকে এই কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। আর সেই মূল্য শোধ করা হয়েছিল বৈকি—বাঙালির রক্তে। সেদিন বন্দরে কত মানুষ মারা গিয়েছিল আর কতজন আহত হয়েছিল তার সংখ্যা কেউ কোনোদিন জানবে না।

জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজেই ছিলেন বাঙালি। তিনি তাঁর নিজের মানুষেরই ধ্বংস বয়ে আনছেন তাঁর জাহাজে করে এই ভাবনা তাঁকে নিশ্চয়ই তাড়া করে ফিরছিল সর্বক্ষণ! বন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি নিজেকে তাঁর কামরার শৌচাগারে আটকে রাখেন। তিনদিন পর বন্দরে সমাগত জনতার করুণার ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আসুন, যদি চান, আমাকে হত্যা করুন আপনারা।” বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদে লুকিয়ে রাখেন।

২৬শে মার্চ সকালে জেগে উঠে আমরা শুনি চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রসঙ্গে এই দিনটিকে উল্লেখ করা হচ্ছিল, “সংগ্রামের গৌরবময় পঁচিশতম দিন” হিসাবে। আমরা যা জানতাম না, এবং জানিনিও আরো বহু সপ্তাহ ধরে যে, ঢাকায় সেই ‘গৌরবময় সংগ্রাম’-এর ইতি হয়েছিল—অন্তত সাময়িকভাবে। টাইম ম্যাগাজিনের ৫ই এপ্রিলের সংখ্যায় ২৫শে মার্চের রাতটিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল:

ঢাকায় ট্যাংক ও ট্রাকভর্তি বেয়নেটধারী সৈন্যরা আল্লাহু আকবর ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে আসছিল তাদের ঘাঁটি থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হওয়িৎজার ট্যাংক থেকে ছোড়া কামান ও রকেটের গোলায় ঢাকার একাধিক অঞ্চল কেঁপে উঠেছিল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে শোনা যাচ্ছিল গ্রেনেডের শব্দ, আর কালো ধোঁয়ার উঁচু স্তম্ভ শহরের মাথা ছাড়িয়ে উঠছিল ক্রমশ।

পরবর্তী সংস্করণ, ১২ই এপ্রিলের টাইম পত্রিকায় আরো বিশদভাবে লেখা হয়।

ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে ট্যাংক গড়িয়ে চলে বাড়িঘর গুড়ো করে দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সৈন্যরা ঘুমন্ত ছাত্রদের হত্যা করে নির্বিচারে। নিউমার্কেটের সামনে উর্দুভাষী সৈন্যেরা বাঙালি নগরবাসীদের আত্মসমর্পণের হুকুম জারি করে এবং তারা তাতে তিলমাত্র দেরি করলে সঙ্গেসঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণকবরে, পুরনো ঢাকায় এবং মিউনিসিপালিটির ময়লার ডিপোতে লাশের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

কিন্তু আমরা চট্টগ্রামে এসবের কিছুই জানতে পারিনি। সকাল পৌনে নয়টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে জাতীয় সংগীত বেজে হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে কেবল রেকর্ড করা গান শোনা যাচ্ছিল।

আমাদের বন্ধু মিস্টার ও মিসেস টমাস দাশ সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। প্রাক্তন স্কুলশিক্ষয়িত্রী মিসেস দাশ ছিলেন লিন সিলভারনেইলের দেশি সহকর্মী। লিন, একজন নার্স, যে ভাষাতত্ত্বের প্রাথমিক জ্ঞান আয়ত্ত করেছিল, গত চারবছর ধরে বাইবেল অনুবাদ করছিল। সে মূল গ্রিক থেকে নিউ টেস্টামেন্টের বিভিন্ন পুস্তকের সহজ ইংরেজি সংস্করণ তৈরি করছিল। মিসেস দাশ ছিলেন তার বাঙালি সহযোগী। লিনের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে তিনি বাংলা নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম খসড়া রচনা করছিলেন।

তবে মিসেস দাশ কাজ করতে আসেননি। তিনি এবং তাঁর দেবতুল্য স্বামী আমাদেরকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে এসেছিলেন। আমরা একসঙ্গে আলোচনা করি, গান গাই ও প্রার্থনায় যোগ দিই। মিসেস দাশ আমাদেরকে একটি নতুন গান শেখান, চমৎকার এক ভারতীয় সুরে গাঁথা এই গানখানি:
হে যিশু, তুমি আমার;
আমার জীবন বাঁচাও হে যিশু।

পাপী যারা তারা তাঁর কাছে যাবে;
প্রভু আমাকে ত্রাণ দাও।

নদী গভীর, নৌকা ছোটো,
প্রভু পার করো আমায়।

তোমাতেই জয়ী আমি,
এসো প্রভু, আমাকে শক্তি দাও।

আমাদের সবারই প্রভুর দেওয়া শক্তি দরকার, কেননা নদী ছিল গভীর আর নৌকাখানি ছোট।

বন্ধুরা থাকতে থাকতেই আমরা রেডিয়ো খুলি রাত দশটার খবর শুনব বলে। তার পরিবর্তে আমরা সামরিক শাসনের পনেরোটি নির্দেশনার ঘোষণা শুনি। তার মধ্যে ছিল:

পাঁচজনের বেশি মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হতে পারবে না।
কোনো রাজনৈতিক সভা করা যাবে না।
সেনাদপ্তরে সকল অস্ত্র জমা দিতে হবে।
সকল ছাপা কিংবা অনুলিপি করার যন্ত্রও সেনাদপ্তরে জমা দিতে হবে।
সবাইকে দ্রুত কাজে যোগ দিতে হবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এই নির্দেশগুলো যখন আমরা ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলাম তখনও বাইরে রাস্তায় বাঙালিদেরকে প্রতিবাদ করতে শুনছিলাম। দাশদম্পতি তাড়াতাড়ি বিদায় নেন নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। তাঁরা চলে গেলে আমরা গাড়ি রাখার জায়গাটায় তাকিয়ে দেখি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলের পুরনো ট্রাকের ওপর লোকেরা জড়ো হচ্ছে। লাঠিসোটা হাতে তরুণে ঠাসা ট্রাকগুলো বেরিয়ে যাবার সময় চারপাশ জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সেই চিৎকৃত জয়ধ্বনির জন্ম হয়ে গিয়েছিল নয় মাস আগেই।

রিড তাঁর কোনার বাড়ি থেকে হেঁটে আসেন আমাদের ঘরে। “তোমরা সবশেষ নির্দেশগুলোর কথা শুনেছো?” তিনি জিজ্ঞেস করেন। “এসব কিন্তু ভালো মনে হচ্ছে না।”
“আপনি যদি আমাদের এখানে থাকেন তাহলে আমরা একটু নিরাপদ বোধ করব।” আমি কবুল করি।
“ঠিক আছে, আমি কিছুদিনের জন্য থাকব, কিন্তু আমার পক্ষে তো অনির্দিষ্টকাল ধরে থাকা সম্ভব নয়।” তিনি জবাব দেন।

সেই শুক্রবার রাতে আটটা বাজার আগে আগে আমরা রেডিয়ো খুলি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতির উদ্দেশে ভাষণ শোনার জন্য।

হঠাৎ রাস্তায় আমরা একটা জোরালো গুঞ্জনের শব্দ শুনতে পাই। আমরা ভেবেছিলাম এটা আরো বুঝি নতুন কোনো নির্দেশ প্রচার-করা লাউডস্পিকারের শব্দ। বারান্দা দিয়ে দেখি, যে-বাড়িতেই রেডিয়ো রয়েছে তার সামনে লোকের জটলা। আমরা আমাদের রেডিয়োর ডায়াল ঘোরাই যতক্ষণ না বাইরের রেডিয়োগুলোর শব্দের সঙ্গে আমাদেরটা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তখন আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা শুনতে পাই।

তিনি জনগণের উদ্দেশে বলছিলেন: “আপনাদের হাতে যাকিছু অস্ত্র আছে তা নিয়েই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসুন। যে-কোনো মূল্যে শত্রুর মোকাবিলা করুন, এদেশের পবিত্র মাটি থেকে শেষ শত্রুটিও নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত।”

আমরা জানতাম না যে, এটা ছিল একটা পূর্বে ধারণকৃত টেপ। কারণ এর আগের রাতেই, আলাপ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর, মধ্যরাতে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। অনেক পরে আমরা একটা গুজব শুনেছিলাম যে, সেদিন তার মালামালের সঙ্গে একজন রাজনৈতিক বন্দীকেও বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, শেখ মুজিবুর রহমান।

ঠিক সময়েই ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণ শুরু করেন। কিছু ভূমিকা সেরে তিনি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন।

“এই লোকটি ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। এই অপরাধকে আমরা বিনা শাস্তিতে যেতে দেব না। আমরা কিছু ক্ষমতালোলুপ, দেশদ্রোহী গোষ্ঠীকে আমাদের দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়ে এর ১২ কোটি লোকের ভাগ্য নিয়ে খেলতে দেব না।”

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে একজন বিশ্বাসঘাতক বলেন। তিনি বলেন যে, তিনি নিজে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মুজিব যুক্তির কথা শুনতে সম্মত ছিলেন না। তিনি তখন পুরো আওয়ামী লীগকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। (এটার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, নিক্সন নির্বাচনে জয়ী হওয়াতে তাঁর রিপাবলিকান পার্টিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।)

আমি রাত এগারোটার দিকে শোয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম যখন ভয়েস অভ আমেরিকা খবরে বলে, “শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং তার নামকরণ করেছেন বাংলাদেশ।” [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৩)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;