কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ : আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

ভূমিকা

বই লেখার চেয়ে দূরবর্তী আর কিছু ছিল না আমার মনে। ১৯৭১-এর ঘটনাসমূহ আমার হৃদয়মনে এমন গভীরভাবে দাগ কেটে আছে যে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো লিখিত বয়ানের দরকার পড়ে না। আমি সেইসব ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করে রাখি, এহেন পরামর্শের প্রতিক্রিয়া ছিল তাই স্রেফ হেসে উড়িয়ে দেওয়া।

সেই বছরটি আমার মনে যে-স্মৃতি ও অনুভূতির উদ্রেক করে সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য দলিলপত্র কোথায় পাব আমি? আর, একটি পাণ্ডুলিপিকে গুছিয়ে তোলার মতো এত সময়ই বা আমার কোথায়? সেই সঙ্গে রয়েছে ইতোমধ্যেই কাজে ঠাসা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে আরো কিছু নাছোড় প্রয়োজনের নিরন্তর রক্তচক্ষু প্রদর্শন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে এবং প্রার্থনায় বসে আমি টের পাই, আমি আসলে এই প্রস্তাবনাটিকে মনে মনে বিবেচনা করছি। আমরা যারা সেই দিনগুলোতে বেঁচেছিলাম এবং জেনেছিলাম প্রভুর ওপর নতুনভাবে নির্ভর করা বলতে আসলে কী বোঝায়, শুধু আত্মরক্ষার জন্যমাত্র নয়, বরং জরুরি রসদ সরবরাহর জন্যও বটে, তাদের দায়িত্ব রয়েছে এই বাঁচার কৌশলগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার।

পড়ার টেবিলের ড্রয়ার ঘেঁটে আমি আঁকিবুঁকিকরা কাগজপত্র, পত্রিকার কাটিং এবং একখানা নোটবই, যাকে আমি মজা করে বলতাম ‘আমার জার্নাল’, খুঁজে বার করি। এইসব আরম্ভ থেকেই উৎপত্তি হলো অবশেষে এই আস্ত গ্রন্থটির।

আমরা যারা এই দেশে কাজ করছিলাম তাদের কাছে নাটকীয় এবং বিয়োগান্ত ঘটনাবলি অপরিচিত ছিল না মোটেও। ১৯৬৩ সালে মিশনারিদলে যোগ দেওয়ার পর থেকে আমরা এই এলাকার বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো দেখেছি, যে-স্থানটিকে বর্ণনা করা হতো ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড় ডেকে আনা জলবায়ুজনিত শোষণবাটি’ বলে; আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের সবচেয়ে মেধাবী ভাষাবিদ বন্ধুটিকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি; একসঙ্গে মারাত্মক এক রোগভোগ করেছি, যার কারণে আমাদের হাসপাতাল এবং মিশনের অন্যান্য দপ্তর পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছিল; এই অঞ্চলে খ্রিস্টের নামে নিবেদিত গির্জার জন্মপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে গিয়ে হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বেঁকে গিয়েছি।

কিন্তু ১৯৭১-এর ঘটনাসমূহ এর সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।

এই বইয়ের ভেতর দিয়ে আমার, আমার সহকর্মীদের এবং বাংলাদেশি ভাইবোনদের (খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান নির্বিশেষে) যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনার উদ্দেশ্য আমার দ্বিবিধ:
—এই সময়টাতে যে-অসংখ্য ছেলেমেয়ে ও নারীপুরুষ তাদের অব্যর্থ প্রার্থনা ও বস্তুগত সাহায্যের মাধ্যমে আমাদের উপকার করেছেন তাদেরকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগানো
—তাদের সেই প্রার্থনারাশিকে, সত্যিকার ‘শেষহীন প্রার্থনা’টুকু এই নবজাত বাংলাদেশ ও তার পুনর্গঠনে লিপ্ত নবীন সরকারের উদ্দেশ্যে ন্যস্ত করা

বহু লোকেরই ধারণা নেই যে, ঈশ্বর তাদের ভালোবাসেন ও তাদের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি আগ্রহী এবং যিশু তাদের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। প্রার্থনায় সমবেত বিশ্বের সকল খ্রিস্টধর্মীর প্রচেষ্টায় আমরা বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারি, যাতে করে সকল জাতি ও বর্ণের বিশ্বাসীরা এই সুসমাচারটুকু প্রচার করে যেতে পারেন।

জিনি লকারবি
চিটাগাং, বাংলাদেশ

বার্তা২৪-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণিত অধ্যায়


জয়বাংলার দেশে

এখন মধ্যরাত। জানালাগুলো আটকানো ও অর্গলবদ্ধ। সব দরজায় তালা। সামনের সিঁড়িতে কাঁটাতার বিছানো। বাঁশের আসনে বসা একটা ছোটখাটো সাদাকালো কুকুর, চোর আসার সামান্যতম ইঙ্গিতেও খেঁকিয়ে ওঠার জন্য উৎকর্ণ। কেননা এটা বাংলাদেশ—একটি ক্ষুধার্ত দেশ!

বাইরে তখনও গুঞ্জরিত হচ্ছিল মানুষজনের আওয়াজ। গাড়িরা দ্রুত ধাবমান। একজন রিকশাচালক তার ঘণ্টি বাজায়। বাচ্চারা কাঁদে। ঘুমাতে যাবার আগে বুড়িরা সুপুরি ছেঁচে, দিনের শেষ পানটি মুখে দেবে বলে। পুরুষেরা পায়চারি করে, এবং দিনের এই সময়েও কেউ একজন ঠিকই চিৎকার করে বলে ওঠে, জয় বাংলা! কেননা এটা বাংলাদেশ—একটি সুখী দেশ।

ক্ষুধা এখানে বরাবরই ছিল; আনন্দই বরং নবাগত।

আমি যখন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন মেথডিস্ট হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা স্কুলের ছাত্রী ছিলাম, তখনই জীবনে প্রথম জন্ম নামক অলৌকিক ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করি। আমি তখন জানতাম না যে, একদিন, অর্ধেক পৃথিবী দূরে, একটি গোটা জাতির জন্মদৃশ্যের সাক্ষী হবার সৌভাগ্য হবে আমার।

ঐতিহাসিকেরা সম্ভবত এটা স্বীকার করবেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের দেশ ভাগাভাগির সময় থেকেই একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উৎপত্তি অনিবার্য ছিল। তবে, আমরা যারা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছি তাদের কাছে এটা ছিল এক নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক জন্ম। একটা স্বাধীন দেশের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে ছিল না কিছুই। অবশিষ্ট পাকিস্তান থেকে হাজার মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থিত, একটি শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন, পূর্ব পাকিস্তান ছিল ব্রাত্য ও সৎবোনতুল্য। তদুপরি, এই দুই অংশের মধ্যে সাদৃশ্যও ছিল খুব কমই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা লম্বা, তাগড়া, সামরিক জাতি; বাঙালিরা ছোটোখাটো, কোমল ও কবিস্বভাবের। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আকৃতি, প্রকৃতিতে আরবি-সদৃশ ভাষা উর্দুতে কথা বলে, আর বাঙালিরা তাদের সংস্কৃত-দুহিতা বাংলাকে নিয়ে গর্ব করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা গম, আটাখেকো জাতি আর বাঙালির পাতে ভাত না থাকলে মনে করে তার খাওয়াই হয়নি বুঝি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যবসাবুদ্ধিতে দড়, আর বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষিকর্মে সিদ্ধহস্ত।

এমনকি আবহাওয়াও ছিল ঐক্যের বিরোধী। পশ্চিম পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি ছিল চরম ভাবাপন্ন: সুউচ্চ পর্বত আর রুক্ষ মরুভূমি, পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা আর তপ্ত, শুকনো সমতলভূমি। বাংলা হচ্ছে নদী আর শ্যামলবরণ উর্বর কৃষিজমিতে ছাওয়া, ধানচাষের মৌসুমে যা মহামূল্যবান হিরে-মাণিক্যের মতো চকচক করে ওঠে। বস্তুত, যে-একটিমাত্র বন্ধন এই দুটি বিচ্ছিন্ন অংশকে এক করে রেখেছিল সেটি হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। তবে পূর্ব অংশে সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশাল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মেলামেশার কারণে এমনকি এই বন্ধনটিও বুঝি তেমন মজবুত ছিল না।

পাকিস্তানের গঠনপ্রক্রিয়ার একেবারে ভিত্তিমূলে প্রোথিত এইসব প্রকট পার্থক্যের কারণেই যে এই বৈষম্যেরও সূত্রপাত, সেটা বুঝতে তেমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বহু ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য দৃশ্যমান ছিল। সম্ভবত সবচেয়ে প্রকট ছিল এইগুলো:
এক. পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ও পণ্য, যেমন পাট ও চা, থেকে উপার্জিত অর্থ এবং প্রাপ্ত বিদেশি সাহায্যের সিংহভাগই পূর্বকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হয়ে যেত।
দুই. অর্থনৈতিক নীতিমালার পক্ষপাতও ছিল পশ্চিমাংশের প্রতি: শুল্ককাঠামো ও নীতিমালা, আমদানি অনুমতিপত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে পশ্চিম থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য হতো পূর্ব পাকিস্তান। প্রায়শই সেগুলো হতো অতীব নিম্নমানের, যা সাধারণ বিশ্ববাজার থেকেই অনেক কম দামে কেনা যেত।
তিন. উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও বিদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তিসমূহও অশোভনরকম অধিক হারে বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানি প্রার্থীদের জন্য।
পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব মতেই ১৯৬৯-১৯৭০ বছরের অর্থবছরে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৬১ শতাংশ বেশি ছিল।

কিন্তু একজন ঠিকই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এই লাঞ্ছিত, বঞ্চিত বাঙালিদের স্বার্থরক্ষায়। তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান—আদর করে যাকে সবাই ডাকত ‘মুজিব’ বলে। তিনি বাঙালির কাছে কোনো আগন্তুক ছিলেন না। একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটি মফস্বলের এক মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা শেষে প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন। সেখানেই তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। তাদের দাবি আদায়ের লক্ষে তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করেন। এই অপরাধের জন্য তাঁকে জেলে প্রেরণ করা হয় এবং পরবর্তী দুই দশক তিনি দেশের বিভিন্ন কারাগারে কেবল আসা-যাওয়া করতে থাকেন। তাঁর অপরাধ যে আসলে কী ছিল সেটা কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁকে শত্রু ও পাকিস্তানের প্রতি হুমকি বলে বিবেচনা করত। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা প্রণয়ন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি তোলে: স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা কিংবা বিচ্ছিন্নতা নয়! মুজিবের এই রাজনৈতিক মঞ্চ পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদভিত্তিক কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অবসান দাবি করে কার্যত। কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তর থাকবে কেন্দ্রের অধীন আর বাকি সব; শুল্ক, বাণিজ্য ও বিদেশি সাহায্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত হবে দুই প্রদেশের ওপর।

বাতাসে বিপদের আভাস পাওয়া যায়।

চট্টগ্রামের জীবন, ঘূর্ণিঝড় আর অন্যবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝখানে, কখনোই সেই অর্থে স্বাভাবিক ছিল না (সেটার মানে যা-ই হয়ে থাকুক)। তবে, তার চেয়েও অন্ধকার ও অলক্ষুণে মেঘের ছায়া এই অঞ্চলের নড়বড়ে নিরাপত্তাকে ভয় দেখাচ্ছিল তখন।

রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসছিল।

অশান্ত পূর্ব পাকিস্তানকে, যার জনসংখ্যা ছিল পশ্চিম থেকে কয়েক কোটি বেশি, শান্ত করার জন্য ১৯৭০ সালের কোনো এক সময়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

সেই নির্বাচনের সময় অবশ্য পাল্টাতে থাকে, অংশত, সম্ভাব্য তারিখের আগে-আগে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মানবেতিহাসের ভয়ঙ্করতম জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়টির কারণে, যার আঘাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের মৃত্যু এবং কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে।

ধ্বংসযজ্ঞের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর সবার চিন্তা আবার নির্বাচনের তারিখের দিকে নিবদ্ধ হয়। দেশের তেইশ বছরের ইতিহাসে সেই প্রথমবারের মতো একটি অবাধ ও উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল।

কিন্তু যেখানে মাত্র বিশ শতাংশ মানুষ সাক্ষর সেখানে নির্বাচনের প্রচারণা চালানো এবং তা বাস্তবায়িত করা কিভাবে সম্ভব? কেমন করে? অবশ্যই ছবি ব্যবহার করে। রাস্তার প্রতিটি কোনা, প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট, দেয়ালের প্রতিটি শূন্যস্থান কোনো না কোনো দলের প্রতীকচিহ্নে ভরে ওঠে। সেগুলো ছিল সাইকেল, গরুর গাড়ি, হাতি, দাঁড়িপাল্লা, ছাতা ইত্যাকার নিত্যব্যবহার্য বস্তুর ছবি, যা এমনকি নিরক্ষর লোকেরাও চিনতে পারত সহজেই। বিশটিরও বেশি দলের সবারই ছিল একটি নির্দিষ্ট প্রতীক। তবে অগুরুত্বপূর্ণ এইসব জিনিসের ছবিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতীক তথা নৌকার ছবি। [চলবে]

   

মহাশূন্যে যাবে জাপানের তৈরি কাঠের স্যাটেলাইট



বিজ্ঞান ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য কাঠের স্যাটেলাইট তৈরি করেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। এটি স্পেসএক্স থেকে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

বুধবার (২৯ মে) ইয়েমেনের বার্তাসংস্থা সাবা এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

খবরে জানানো হয়, জাপানের কিয়েটো বিশ্ববিদ্যালয় ও সুমিটোমো ফরেস্ট্রি ফাউন্ডেশন বিশেষজ্ঞেরা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের চেষ্টায় এই স্যাটেলাটটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

বুধবার কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা ৪ বছরের কঠোর পরিশ্রম করে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন। এই স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয়েছে, ‘লিগনোস্যাট’ (LignoSat)। এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট। পরিবেশের কথা চিন্তা করে এই স্যাটেলাইটটি তৈরি করা হয়েছে। এটি যখন তার অভিযান শেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন এটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটির আকৃতি ১০ সেন্টিমিটার। এটির পুরুত্ব ৪ থেকে ৫.৫ মিলিমিটার। তবে এটির ভেতরের স্তর হবে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি এবং এর ভেতরে একটি সোলার প্যানেল থাকবে। সবমিলিয়ে এটার ওজন হবে মাত্র এক কেজি। এই স্যাটেলাইট সম্পূর্ণ সনাতনী জাপানি পদ্ধতিতে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের ‘অ্যাডহেসিভ’ (আঠা) ব্যবহার করা হয়নি।

জাপানি বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স থেকে এ বছরই উৎক্ষেপণ করা হবে। তারা আরো জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে এটি পৃথিবীর বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে উড়াল সম্প্ন্ন করেছে। স্যাটেলাইটটি কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্য জানানো হয়নি।

;

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;