মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ২



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাতিপি ইয়ামোসের সঙ্গে আলাপ করছিল।  তার গলা এমনই উচ্চকণ্ঠের যে তা খুব কমই বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়।

“তুমি অবশ্যই নিজেকে জাহির করবে, যা আমি স্পষ্ট বলছি। তুমি নিজেকে গুটিয়ে রাখলে কখনোই কেউ তোমাকে গুরুত্ব দেবে না। তোমার বাবা বলেন যে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে এবং কেন তুমি সেসব করোনি? এবং তুমি তাতেই জো হুজুর জো হুজুর করো! তুমি কিছুই না ভেবে তার কথায় সায় দাও আর ওপরওয়ালাই জানেন, সেসব করা আদতে অসম্ভব! তোমার বাবা তোমাকে বাচ্চা, দায়িত্বজ্ঞানহীন বালকের মতোই ভেবে তেমন আচরণ করেন। যেন তুমি আইপির বয়সী!”

ইয়ামোস শান্তভাবে বলে:

“আমার বাবা আমাকে অন্তত আইপির মতো একইভাবে দেখেন না!”

“না, আসলেই তেমন।” সাতিপি নতুন বিষ প্রয়োগে এবার উদ্যমী হলো, “তিনি ঐ বখাটে ছোকরার ব্যাপারে তালকানা। দিনের পর দিন আইপির  বাড় বেড়েই চলেছে। সে যেখানে যেমন খুশি চড়ে বেড়ায় এবং কাজে সাহায্য করে না এবং এমন ভান করে যে তাকে যে কাজ করতে বলা হয়, তা তার জন্য খুবই পরিশ্রমের! ব্যাপারটা অপমানজনক!  এসবই ঘটছে কারণ সে জানে যে তোমার বাবা তাকে লাই দেবে এবং তার পক্ষে থাকবে। তোমার ও সোবেকের এ ব্যাপারে শক্ত হওয়া উচিত।”

ইয়ামোসে ঘাড় বেঁকায়।

“কোনটা ভালো?”

“তোমার জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাবো, ইয়ামোস - তা-ই তো তুমি চাও! তুমি একটা ভীতুর ডিম! তোমার সাহস বলে কিছু নেই। তুমি মেয়েদের মতো মেনিমুখো। তোমার বাবা যা বলেন তাতেই তুমি সঙ্গে সঙ্গে নাচো!”

“আমি সবসময়ই বাবার অনুগত।”

“ঠিক তাই, সেকারণেই তিনি সেই সুযোগ নেন। তুমি মেনিমুখো হয়ে সব দায় হজম কর আর যেসবের দায় তোমার নয়, সেসব বোঝাও বয়ে বেড়াও। তোমারও কথা বলা উচিত এবং সোবেক তাকে যেভাবে জবাব দেয়, সেভাবেই জবাবও দেয়া উচিত। সোবেক কাউকে ভয় পায় না।”

“তা ঠিক। তবে মনে রেখ সাতিপি, বাবা আমাকে বিশ্বাস করেন, সোবেককে নয়। বাবা তার ওপর ভরসা করতে পারেন না। সবকিছুর ব্যাপারে  চূড়ান্ত মত আমি দেই, সোবেক নয়।”

“এবং সেকারণেই এ জমিদারিতে তুমি অংশীদার হিসেবে থাকতেই পারো! যখন তোমার বাবা জমিদারির বাইরে থাকেন, তখন তুমি তার প্রতিনিধিত্ব কর। এমনকি তখন পৌরোহিত্যের দায়ও তোমার ওপর বর্তায়। সবকিছুর ভার তোমার ঘাড়ে চাপে অথচ তোমার কোনো স্বীকৃত কর্তৃত্বই নেই। পুরো ব্যাপারটার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হওয়া দরকার। তুমি এখন মধ্যবয়সী সংসারী মানুষ। এটা মেনে নেয়া যায় না যে তোমার সঙ্গে বাচ্চাসুলভ আচরণ করা হবে।

ইয়ামোসে সন্দিহানভাবে বলে:

“আমার বাবা নিজেই বৈষয়িক তদারকি পছন্দ করেন।”

“ঠিক তাই। এ ব্যাপারটা তাকে আনন্দ দেয় যে এ বাড়ির সবকিছুই তার ওপর নির্ভরশীল থাকুক - এবং এভাবেই প্রতিটি মুহূর্ত কাটুক! এর ফলে ব্যাপারটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি এবার বাড়ি এলে তুমি তাকে অবশ্যই শক্তভাবে চেপে ধরবে আর তাকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে জানাবে যে তুমি জমিদারির অংশিদারিত্ব চাও, যার বন্দোবস্ত লিখিতভাবে সম্পন্ন হবে।”

“তিনি শুনবেন না।”

“তুমি তাকে শুনতে বাধ্য করবে। ওফ, আমি যদি মরদ হতাম! তোমার জায়গায় আমি থাকলে দেখিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল! কখনোবা আমার মনে হয়, আমি একটি মহিলাকে বিয়ে করেছি।”

ইয়ামোসে জ্বলে ওঠে।

“আমি দেখব কী করা যায় - আমি সম্ভবত এ ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলব - তাকে জিজ্ঞেস করব -”

“তুমি জিজ্ঞেস করবে না - তুমি অবশ্যই দাবি জানাবে! সবকিছুর পর, তার চাবুক তোমার হাতেই রয়েছে। এখানে তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই, যার কাছে সে এ জমিদারির তদারকির দায়িত্ব চাপাতে পারে। সোবেক এখনো যথেষ্ট অবাধ্য, তোমার বাবা তাকে বিশ্বাস করেন না, আর আইপি বয়সে খুব কাঁচা।”

“সেজন্যই হোরিকে রাখা হয়েছে।”

“হোরি এ পরিবারের কেউ নয়। তোমার বাবা তার বিবেচনায় ভরসা করেন কিন্তু তাই বলে নিজের কর্তৃত্ব তার হাতে তুলে দেবেন না। কিন্তু আমি দেখছি যে তুমি নিতান্তই মেনিমুখো আর সস্তা। তোমার শিরায় রক্ত  নয়, যেন দুধ বইছে!  তুমি আমার বা আমাদের বাচ্চাদের কথা ভাবো না। তোমার বাবা মারা যাবার আগ পর্যন্ত আমরা কি প্রাপ্যটুকু বুঝে পাব না!

ইয়ামোস ভারী গলায় বলে:

“তুমি আমাকে তাচ্ছিল্য করছ, তাই না সাতিপি?”

“তুমি আমাকে রাগাচ্ছ।”

“শোনো, আমি তোমাকে বলেছি যে বাবা বাড়ি এলে আমি তাকে এসব ব্যাপারে জানাব। প্রতিজ্ঞা করছি।”

সাতিপি দম চেপে ধরে বলে ওঠে :

“হ্যা- কিন্তু তুমি কীভাবে বলবে? মরদের মতো, নাকি ইঁদুরের মতো?”

২.

কাইট তার ছোট বাচ্চা আঙ্কের সঙ্গে খেলছিল। বাচ্চাটি সবে হাঁটতে শুরু করেছে এবং কাইট তাকে হাসিমুখে তানানানা করতে করতে উৎসাহ দিচ্ছিল। কাইট বাচ্চাটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে সামনের হাতটি বাড়িয়ে রেখেছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না অনিশ্চিতভাবে পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বাচ্চাটি তার মায়ের বাহুতে ধরা দিচ্ছিল।

কাইট পুরো ব্যাপারটি সোবেককে দেখাতে চাইছিল, কিন্তু অচিরেই সে বুঝে উঠল যে সে এদিকে মনোযোগী নয় বরং কপাল কুঁচকে বসে ছিল।

“আহ সোবেক, তুমি দেখছ না। সোনামণি, তুমি তোমার বাবাকে বলে দাও যে সে দুষ্টুমি করছে তোমার কা-কারখানা না দেখে।”

সোবেক  বিরক্তভরা কণ্ঠে খেঁকিয়ে ওঠে:

“আমি অন্য কিছু ব্যাপারে ভাবছি, সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

কাইট তার গোড়ালির হিল পেছনে ফেরায়,  তার ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা মসৃণ চুলগুলো সোজা করে। বাচ্চাটির আঙুলগুলো তাকে ধরে রেখেছিল।

“কেন? কোথাও কি ঝামেলা হয়েছে?”

কাইটের কথাতেও মনোযোগ ছিল না। প্রশ্নটা যেন দায়সারাভাবে করা হয়েছে।

সোবেক রেগে গিয়ে বলে:

“সমস্যা এটাই যে আমাকে বিশ্বাস করা হয় না। আমার বাবা একজন বৃদ্ধ, তার চিন্তা ভাবনা একেবারেই সেকেলে ধরনের, এবং জমিদারির প্রতিটি ব্যাপারে তার খবরদারি করা চাই - তিনি আমার ভরসায় কিছুই ছেড়ে দিতে চান না।”

কাইট তার মাথা নামিয়ে অস্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করে-

“আসলেই, এটা খুব খারাপ ব্যাপার।”

ইয়ামোস যদি আরেকটু সাহসী হত আর আমাকে সমর্থন করত তবে বাবাকে বাগে আনা তেমন কঠিন হত না। কিন্তু সে আসলে ভীতুর ডিম। বাবা চিঠিতে তাকে যেসব নির্দেশ দেন, সে সবই ঘাড় গুঁজে পালন করে।”

কাইট বাচ্চার গলায় থাকা জপমালা ঝাঁকাতে  ঝাঁকাতে বলে :

“আসলেই, ঠিক বলেছ।”

কাঠের ব্যাপারে আমি অবশ্যই আমার বিবেচনা বাবাকে জানাব তিনি বাড়ি এলে। এটা ঢের ভালো হয়েছে তেলের বদলে শনবাবদ দাম গ্রহণ করায়।”

“আমি নিশ্চিত, তুমি ঠিক কাজই করেছ।”

“কিন্তু  বাবা তার গৎবাধা পথের বাইরের যে কোনো ব্যাপারেই বাধা দেন। তিনি হম্বিতম্বি করবেন, আমি তোমাকে তেলের দামে এ ব্যবসা করতে বলেছিলাম। আমি জমিদারিতে না থাকলে সবকিছুই ভুলভাবে করা হয়। তুমি একটি বোকা বালক, যে কিছুই করতে জানো না। আমার বয়স কত, সে ব্যাপারে তিনি কী মনে করেন? তিনি বোঝেন না যে আমি আমার কালের পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ এবং তিনি বিগত হচ্ছেন! তার নির্দেশ এবং তার দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক এমন যে কোনো লেনদেনের মানে হলো আমরা ব্যবসায় উন্নতি করতে পারি না অথচ আমরা তা করছি। ধনী হতে হলে কিছু ঝুঁকি তো নিতেই হবে! আমার দূরদৃষ্টি ও সাহস আছে, বাবার কোনোটিই নেই।”

বাচ্চার ওপর চোখ রেখে কাইট ধীরগলায় বলে :

“তুমি খুব বেপরোয়া ও চালাক, সোবেক।”

“কিন্তু তিনি যদি বাড়ি সংক্রান্ত কিছু সত্য ব্যাপারে এখন জানতেন এবং তাতে দোষ খুঁজে বের করে আমাকে নাকাল করতেন, তবে বেশ হত! আমাকে যদি নিজের মতো করে চলার সুযোগ দেয়া না হয়, আমি এসবে থাকব না। বরং চলে যাব।”

কাইট বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়ায়, তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে পাকড়াও করার ভঙ্গিতে বলে-

“চলে যাবে? কোথায় যাবে তুমি?”

“যে কোনো জায়গায়!  এটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার যে একজন উচ্ছৃঙ্খল, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আমাকে কোনোভাবেই নিজের মতো কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন না। তাহলে আমি কী করব?”

“না, কাইট কৌশলী ভঙ্গিতে বলে “আমি বলছি সোবেক, না।”

সোবেক স্ত্রীর দিকে তাকায়, কাইটের কণ্ঠস্বর খেয়াল করে তার উপস্থিতি বুঝতে পারে।  সে তার স্ত্রীর প্রতি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে কোনো ব্যাপারে আলাপের ক্ষেত্রে কাইট যে মানুষ হিসেবে নিজস্ব অস্তিত্ব বহন করে, তারও যে নিজস্ব চিন্তা করার সামর্র্থ্য আছে, তা সে ভুলেই বসেছিল।

“তুমি কী বলতে চাও, কাইট?”

“আমি এটাই চাই যে তুমি বোকামি করবে না। পুরো জমিদারির মালিকানা তোমার বাবার নামে - জমি, সেচব্যবস্থা, গবাদি পশু, কাঠ, শনের খেত - সব। তোমার বাবার মৃত্যুর পর এসবই তোমাদের হবে তোমার আর ইয়ামোসের আর আমাদের বাচ্চাদের। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করলে এবং চলে গেলে তখন তিনি তোমার ভাই ইয়ামোসে ও আইপির মাঝে তা ভাগ করে দিতে পারেন। তাছাড়া তিনি আইপিকে অত্যধিক ভালোবাসেন। আইপি তা জানে বলেই কাজে লাগানোর ধান্দা করে। তুমি আইপির হাতের খেলনা হবে না। এটা তাকে খুব ভালো সুবিধা দেবে, যদি তুমি ইমহোটেপের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যাও। আমাদের অবশ্যই বাচ্চাদের দিকটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

সোবেক তার দিকে তাকায়, তারপর বিস্ময়ের হাসি হাসে।

“একজন নারীকে আগেভাগে কখনোই বোঝা যায় না। আমি আগে টের পাইনি, কাইট, যে তুমি এত বুদ্ধিমতি।”

কাইট আন্তরিকভাবে বলে:

“তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া কর না। তার কথার জবাব মুখে মুখে দিও না। আর কটাদিন সবুর কর।”

“তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ, কিন্তু এই অবস্থা কয়েক বছর যাবত চলতে পারে। বাবা চাইলে আমাদেরকে তার জমিদারীতে অংশীদার করে নিতে পারে।”

কাইট মাথা নেড়ে বলে

“তিনি তা করবেন না। কারণ তিনি একথা বলতে ভালোবাসেন যে আমরা তার ঘাড়ে চেপে খাই, তার ওপর ভর করে বেঁচে আছি, তিনি না থাকলে আমাদের বাঁচবার জো নেই।”

 সোবেক কৌতূহলভরে তাকে দেখে।

“তুমি আমার বাবাকে তেমন পছন্দ কর না, কাইট।”

সে প্রসঙ্গে কথা বলার বদলে কাইট বাচ্চার প্রতি মনোযোগ দেয়।

“এসো, সোনামণি, - দেখ, এই যে তোমার পুতুল।”

সোবেক তার বাঁকানো কালো চুলের দিতে তাকায়। তারপর খানিকটা বিভ্রান্ত মুখে সে ফিরে যায়।

৩.

এশা তার নাতি আইপিকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেই সুদর্শন কিশোর যৌবনে পদার্পণ করছে, চেহারাতে অসন্তোষের ভাব প্রবল। পাশে দাঁড়ানো তরুণকে বৃদ্ধা বেশ তীক্ষ্ম কণ্ঠে শাসাচ্ছিলেন। তার চোখজোড়া ম্লান আর ইদানীং তেমন ভালোভাবে দেখতে না পেলেও এখন সেগুলো যেন জ্বলছিল.

“আমার কানে এসব কী আসছে?” তোমার হাজারটা বায়না, এটা করবে না, ওটা করবে না! তুমি গবাদি পশুর দেখাশোনা করতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু তুমি ইয়ামোসের সঙ্গে যেতে চাও না, খেতের কাজের তদারকিও করবে না, এ কেমন কথা? তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে যখন এসব বায়না করে, তার ফল  কী হয়, জানো?”

আইপি অদ্ভুতভাবে বলে :

“আমি কচি খোকা নই। আমি বড় হচ্ছি, তবে কেন আমাকে ছেলেমানুষ ভাবা হবে? আমাকে কাজের হুকুম দেয়া হবে আর নিজের মতো করে কাজ জন্য কোনো  ভাতাও আলাদাভাবে পাব না! ইয়ামোস আমাকে সবসময় কাজের হুকুম দেয়! সে কি ভাবে?”

“সে তোমার বড় ভাই আর তোমার বাবা জমিদারিতে না থাকলে এর দায়িত্ব ইয়ামোসের ওপর অর্পিত।”

“ইয়ামোস নির্বোধ - ধীরগতির নির্বোধ। আমি তারচেয়ে ঢের চালাক। সোবেকও বোকা কারণ সে খুব ফুটানি মারে যে ভারী বুদ্ধিমান!  বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে আমি আমার পছন্দসই কাজ করতে পারব।”

“ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়” বিরক্তিসহ এশা বলে।

“আর আমি যদি আরো বেশি খাবার ও পানি না পাই আরি তিনি যদি শোনেন যে আমি অসন্তুষ্ট  এবং  কেউ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি, তিনি ক্ষিপ্ত হবেন।”

কথা বলার সময় সে চতুর, বাঁকানো হাসি হাসে।

“তুমি অকালে পেকেছ”, এশা সজোরে বলে। “ ইমহোটেপকে ব্যাপারটা জানাতে হয়।”

“না.  দাদী, তুমি তাকে এসব বলবে না।”

তার হাসি বদলে যায়। কিছুটা দুঃখভারাক্রান্তভাবে সে অনর্থকই বলে :

“এ বাড়িতে শুধু তোমার আর আমার মাথায় খানিকটা ঘিলু আছে।”

 “তোমার বিদ্বেষ!”

“আমার বাবা তোমার ওপর ভরসা করেন - তিনি জানেন, তুমি বিচক্ষণ।”

“তা হতে পারে - আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন -  কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে এসব শুনতে চাই না।”

আইপি হাসে।

“তুমি আমার পক্ষে থাকলে ভালো হত, দাদী।”

“এই পক্ষাপক্ষির মানে কী?”

“বড় দুই ভাই খুবই বিরক্তিকর। তুমি তা জানো না? অবশ্যই জানো। হেনেট তোমাকে সবকিছু বলে।  সাতিপি যেভাবে আর যতভাবে সম্ভব দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে ইয়ামোসের হাড় মাংস জ্বালিয়ে খায়। আর এদিকে সোবেক গাধামি করেছে কাঠ কেনার ব্যাপারে  আর বাবা বাড়ি এসে তা জানলে ভয়ানক ক্ষেপে যাবে। তুমি দেখো দাদী, দুয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাবার জমিদারির অংশীদার হয়ে যাব আর তারপর আমি যেভাবে চাইব, বাবা সবকিছু সেভাবেই করবে।”

“তুমি, পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হয়ে এভাবে ভাবছ?”

“ বয়স নিয়ে ভাবার দরকার কী! বাবার হাতে পুরো জমিদারির ক্ষমতা আছে আর আমি জানি, তাকে কীভাবে বাগে আসতে হবে!”

“এসব ধান্দাবাজি ছাড়ো!”

আইপি নরম গলায় বলে:

“দাদী, তুমি তো বোকা নও! তুমি বেশ ভালোই জানো, বাবা ওপরে যতই হম্বিতম্বি করুক, ভেতরে ভেতরে খুবই দুর্বল মানুষ!”

আইপি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে। সে খেয়াল করে, দাদী মাথা তুলে তার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চেয়ে আছে। সে নিজের মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পায়, হেনেট তার ঠিক পেছনেই চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে।

“তার মানে ইমহোটেপ একজন দুর্বল মানুষ”- হেনেট তার মৃদু ঘ্যাঙানো সুরে বলে, “তিনি মোটেই খুশি হবেন না, আমার মনে হয়, তুমি এই কথা বলেছ জেনে।”

আইপি অকারণে দ্রুত হেসে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে।

”কিন্তু তুমি তাকে বলবে না, হেনেট। ... এখন বলো তো আমাকে ... প্রতিজ্ঞা করছ, প্রিয় হেনেট ...”

হেনেট এশার দিকে পিছলে যায়। সে তার গলা মৃদু চড়ায়।

“অবশ্যই, আমি কখনো চাই না কোনো ঝামেলা পাকাক ... তুমি তা জানো, আমি তোমাদের সবার কথাই ঘাড়গুঁজে মেনে চলি। আমি কখনোই কোনোকিছু বারবার করি না, যদি না মনে হয় যে এটা আমার কাজ”

“আমি দাদীকে খোঁচাচ্ছিলাম, ব্যাপারটা ¯্রফে এটুকুই!” আইপি বলে। আমি বাবাকে বলব। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন যে আমি মোটেই  গুরুত্বসহযোগে ব্যাপারটা সম্পর্কে বলিনি।

সে তীক্ষè দৃষ্টিতে হেনেটের দিকে চেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চলে যায়।

 হেনেট তার দিকে চেয়ে এশাকে বলে-

“দারুণ একটা ছেলে - মরদ হয়ে উঠছে। আর কেমন টাস টাস করে কথাগুলো বলে গেল!”

এশা সতর্কভাবে বলে:

“সে বিপজ্জনকভাবে কথা বলে। তার মাথায় যেসব ছাইপাস ঘুরছে, সেসব আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমার ছেলে আস্কারা দিয়ে তাকে মাথায় তুলেছে।”

“কে-ই বা তেমনটি করবে না! এমন নজরকাড়া, সুঠাম ছেলে।”

“ সুদর্শন হতে হলে মনটাও তেমন হতে হয়!” তীক্ষ্ম কণ্ঠে এশা বলে।

খানিকটা সময় চুপ করে ধীর গলায় এশা বলে:

“হেনেট - আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

“ কেন, এশা? কেন তুমি এত ভাবছ? যা হোক, কর্তা দ্রুতই বাড়ি ফিরবেন এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”

“তাই নাকি? আমার বিশ্বাস হয় না!”

খানিকটা সময় চুপ থেকে সে আবার বলে:

“আমার নাতি ইয়ামোস বাড়িতে আছে?”

“আমি খানিক আগে তাকে বারান্দার দিকে আসতে দেখেছি।”

“ যাও, তাকে গিয়ে বল, আমি তার সঙ্গে কথা বলব।”

হেনেট চলে যায়।  সে বারান্দায় এসে ইয়ামোসকে দেখে তাকে এশার খবর জানায়।

ইয়ামোস তখনই দাদীর ঘরে আসে।

এশা হঠাৎ বলে:

“ইয়ামোস, খুব দ্রুতই ইমহোটেপ এখানে আসবে।”

ইয়ামোসের শান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

“তাহলে তো বেশ ভালো হয়।”

“সবকিছুই তার পক্ষে আছে? বিষয়গুলোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে?”

আমার বাবা যেভাবে বলেছেন,  আমার সাধ্যমতো সেভাবেই সবকিছু করা হয়েছে।

“আইপির ব্যাপার কী?”

ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“বাবা একেবারেই অসচেতন, যা আইপি খুব ভালোই জানে। এটা তার জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।”

“তুমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ইমহোটেপকে স্পষ্ট করবে।”

ইয়ামোস সন্দিহান হয়ে ওঠে।

এশা দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে:

“আমি তোমার পাশেই আছি।”

“ কখনো কখনো”, ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস জড়ানো গলায় বলে, “চারপাশে বাধা ছাড়া আর কিছুই যেন দেখা যায় না। কিন্তু বাবা আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন করণীয় সম্পর্কে। তিনি যা যা করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার অনুপস্থিতিতে সেসব করা কঠিন - কারণ আমার হাতে কোনো কর্তৃত্বই নেই, যদিও তার প্রতিনিধি হিসেবেই শুধু আমি আছি।”

এশা ধীরে বলে:

“তুমি ভালো ছেলে - বিনয়ী ও সজ্জন। তুমি দায়িত্ববান স্বামীও; তুমি সেই প্রবাদটি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছ - একজন পুরুষের অবশ্যই তার স্ত্রীকে ভালোবেসে সংসার রচনা করা উচিত, যেন সে সেই নারীর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারে এবং ভরণপোষণ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বন্দোবস্ত করতে পারে এবং যতদিন তারা বেঁচে থাকে, যেন একে অন্যের মন জয় করে  চলতে পারে। কিন্তু এ কথার আরেকটা অর্থও আছে - তাকে সংসার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে নাক গলানোর সুযোগ না দেয়া। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, আমার নাতি, তবে আমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ভাবতাম।

ইয়ামোসে তার দিতে তাকায় গভীর দৃষ্টিতে, তারপর সেখান থেকে চলে যায়।

আরও পড়ুন: মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;