মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রেনিসেব নীল নদের ওপারে তাকিয়ে ছিল।

খানিকটা দূরে অস্পষ্ট থেকে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠা তার  দুই ভাই ইয়ামোস ও সোবেকের কথা সে শুনতে পাচ্ছিল। খেতের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বাঁধ আরো শক্ত করা দরকার কি না সে ব্যাপারে তারা কথা বলছিল। বরাবরের মতো এখনও সোবেকের কণ্ঠস্বর ছিল গনগনে ও আত্মবিশ্বাসী।  সে সবসময় সহজে অথচ জোরালোভাবে নিজের মতামত প্রকাশে অভ্যস্ত ছিল। ইয়ামোসের কণ্ঠস্বর নিচু ধরনের ও দোদুল্যমান শোনাচ্ছিল, যাতে সন্দেহ ও উদ্বেগ প্রবল হয়ে উঠেছিল। তার চরিত্রে সবসময়ই এক ধরনের উৎকণ্ঠা বা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যেত। সে ছিল পরিবারের বড় ছেলে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মালিকানাধীনগুলোতে কৃষি জমিগুলো তদারকির ক্ষমতা তার আয়ত্তে থাকত। ইয়ামোস ছিল ধীরস্থির, বিচক্ষণ এবং কোনো কাজের ব্যাপারে বাধা না থাকলেও তা খুঁজে দেখা তার স্বভাবে ছিল। সে ছিল ভারিক্কি গড়নের ধীরগতির মানুষ, যার কিছুই সোবেকের সুদর্শন চেহারা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিলত না।

রেনিসেব বেশ মনে করতে পারে যে ছোটবেলা থেকেই সে তার বড় ভাইদের এ ধরনের তর্ক করতে শুনত। এ স্মৃতি হুট করেই তার মনে একধরনের নিরাপত্তা জাগিয়ে তুলত- সে নিজের বাড়িতে আবার এসেছে। হ্যা, সে বাড়িতে এসেছে...

যদিও সে আরেকবার শীর্ণ ঝলমলে নীল নদের দিকে তাকিয়েছিল, তার বিদ্রোহ ও বেদনা আবারও বেড়েছিল। কেয়, তার তরুণ সুদর্শন স্বামী মারা গিয়েছিল ...  হাসিভরা মুখ ও বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী কেয়ের ছবি রেনিসেবের মনে ভাসছিল। সে মৃতের রাজ্যে দেবতা অসিরিসের কাছে চলে গিয়েছিল। আর সে, কেয়ের প্রিয় ও ভালোবাসার স্ত্রী রেনিসেব একাই রয়ে গিয়েছিল। তারা আট বছর সংসার করেছে- যখন রেনিসেব কেয়ের কাছে যায় বিয়ের পর, সে প্রায় বাচ্চা মেয়ে- আর এখন সে বিধবা হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে কেয়ের বাচ্চা টেটিকে নিয়ে।

এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এ জায়গা ছেড়ে কখনো কোথাও যায়নি...

সে সেই ভাবনায় মগ্ন হয়েছিল...

সে ঐ আট বছরের কথা ভুলে যাবে- যা অচিন্তনীয় সুখ আর প্রবল বেদনা ও ক্ষতিতে মোড়ানো।

হ্যা, ভুলে যাবে, তার মনে এসব ভাবনা আর জায়গা পাবে না।  সে আবার হয়ে সমাধিসৌধের পুরোহিত ইমহোটেপের চিন্তামুক্ত, নির্মল মেয়ে। স্বামী ও ভাইয়ের ভালোবাসা আসলে নির্দয়তার ব্যাপার, মধুরতার আড়ালে যা তাকে শুধু প্রতারিতই করেছে। তার মনে পড়ে তামাটে রঙের বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী হাসিমাখা মুখের সেই মানুষটিকে- মাদুলি বেঁধে সুরক্ষিত করে, ব্যান্ডেজে মুড়ে যাকে কবর দেয়া হয়েছে অন্য এক ভুবনে যাত্রার জন্য। কেয় আর এ জগতে নেই- নীলনদে নৌকা চালাতে এবং মাছ ধরতে এবং  রোদের মধ্যে হাসতে, যখন রেনিসেব  নৌকার ভেতর ছোট টেটিকে নিজের কোলের ভাঁজে জড়িয়ে সামনের দিকে বসাত আর তার দিকে পেছনে ফিরে হাসত ...

রেনিসেব ভাবছিল:

আমি এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না। আমি বাড়িতে এসেছি। সবকিছু আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। এখন আমাকেও আগের মতোই হতে হবে। সব আবার আগের মতো হবে। টেটি ইতোমধ্যে সেসব ভুলেও গেছে। সে এখানকার অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাসছে, খেলছে।

রেনিসেব  হঠাৎ করে ঘুরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল,  তখন বোঝা বহনকারী কয়েকটি গাধাকে নদীতীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে শস্যক্ষেত ও সংলগ্ন বাড়িঘর পেরিয়ে প্রবেশপথ দিয়ে উঠোনে চলে এল। উঠোনটি ছিল বেশ আরামদায়ক। সেখানে কৃত্রিম লেক ছিল, যার চারপাশ করবী ও জুঁই ফুলের গাছে শোভিত আর এর পাড় সারি সারি ডুমুরগাছের ছায়ায় ঢাকা ছিল। টেটি ও অন্য বাচ্চারা সেখানে খেলছিল, তাদের গলার আওয়াজ বেশ জোরে স্পষ্টভাবে তার কানে এল। লেকের একদিকে আলাদা সীমানাচিহ্নিত  ছোট একটি জায়গা ছিল। বাচ্চারা এর ভেতরে-বাইরে বারবার আসা-যাওয়া করছিল। রেনিসেব খেয়াল করেছিল যে টেটি কাঠের একটি সিংহ নিয়ে খেলছিল, যেটির মুখ দড়ি দিয়ে টানলে খোলে ও বন্ধ হয়। এটি এমন একটি খেলনা, যেটি সে ছোটবেলায় ভালোবাসত।  সে আবারো নিশ্চিন্তমনে ভাবল “আমি বাড়িতে এসেছি ...” এখানকার কিছুই বদলায়নি; আগে যেমন ছিল সব এখনো তেমনই আছে। এখানে জীবন নিরাপদ, আগের মতোই প্রাণবস্ত। টেটি এখন বাচ্চা এবং সে  এ বাড়ির অন্য মায়েদের একজন যারা ঘরের দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী, কিন্তু  সবটা মিলে এ জায়গাটি আগের মতোই রয়ে গেছে।

একটি বাচ্চা যে বলটি নিয়ে খেলছিল, সেটি তার পায়ের কাছে গড়িয়ে এল। রেনিসেব সেটি তুলে নিয়ে হাসিমুখে তার দিকে ছুঁড়ে দিল।

রেনিসেব উজ্জ্বল রঙা থামঘেরা বারান্দা দিয়ে ঢুকে বাড়ির ভেতরে যায় ঠিক মাঝের বিশাল ঘরটি পেরিয়ে, যেটির দেয়ালজোড়া পর্দাগুলো পদ্মফুল ও পপি ফুলের সাজে শোভিত ছিল। এটি পেরিয়ে তবেই বাড়ির অন্দরমহল।

ক্রমে জোরালো হতে থাকা কণ্ঠস্বরগুলো তার কানে ধাক্কা খাচ্ছিল আর তাই সে আবার থেমে গিয়েছিল, আনন্দের আভাস সেসব গলার স্বরে যেন মিশে গিয়েছিল। সাতিপি ও কাইট বরাবরের মতোই তর্ক করছিল। সাতিপির চড়া ও কর্কশ ধরনের হুমকিদায়ক গলা কি কখনো ভোলা যায়! সাতিপি রেনিসেবের বড়ভাই ইয়ামোসের স্ত্রী, লম্বা ও বলশালী, উচ্চকণ্ঠের মহিলা, যার চেহারায় কমনীয়তা প্রায় ছিলই না আর যে আদেশ দিতেই বরাবর অভ্যস্ত! সে প্রচলিত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাগুলি দেখাতে ওস্তাদ ছিল, চাকরবাকরদের নাস্তানাবুদ করত, সবকিছুতেই দোষ খুঁজত, কড়া মেজাজ আর হুমকি ধামকির পাশাপাশি জাঁকালো ব্যক্তিত্ব ফলিয়ে অসম্ভবকেও সে সম্ভব করে তুলত। সবাই তার খরজিভকে ভয় পেত বিধায় তার আদেশ দৌড়ে পালন করত। ইয়ামোসের যদিও তার দৃঢ়চেতা ও জেদি স্বভাবের স্ত্রীর প্রতি ভালোলাগা ছিলই, তবু সে স্ত্রীর গালাগাল শুনতে এতটাই প্রস্তুত ছিল, যা রেনিসেবকেও  প্রায়ই ক্ষিপ্ত করত।

সাতিপির উচ্চকণ্ঠে বলে চলা বাক্যবাণের বিরতি ঘটলে শুধু তবেই কাইটের বাধাপ্রাপ্ত শান্ত গলা শোনা যেত। সুদর্শন সোবেকের স্ত্রী কাইট দেখতে চওড়া গড়নের সাদাসিধা ধরনের মহিলা ছিল। নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়েই যেন তার দিনদুনিয়া গুজরান হতো, অন্য কোনো বিষয়ে বা আলাপে তার আগ্রহ কখনো প্রকাশিত হত না। কাইট জা সাতিপির সঙ্গে নিত্যদিনের তর্কে বেশ সহজেই  বুঝিয়ে দিত সে কোন দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে চাইছে। সে তার আচরণে ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনোটাই প্রকাশ করত না, নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না।  সোবেকের সঙ্গে তার স্ত্রীর বোঝাপড়া নিবিড় ছিল এবং সে তার যাবতীয় বিষয়াদি নিয়েই কাইটের সঙ্গে অনায়াসে আলাপ করত। সে বুঝতে পারত যে তার স্ত্রী আলাপের জন্য প্রস্তুত, তাদের বোঝাপড়ায় সম্মতি ও মতবিরোধ দুটোই ছিল এবং তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হত না। কেননা কাইটের  মনে ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ ও তাদের দেখাশোনার ব্যাপারে একধরনের উৎকণ্ঠা সবসময়ই বিরাজ করত।

“এটা একধরনের জুলুম, আমাকে তা বলতেই হবে,” সাতিপি খেঁকিয়ে ওঠে। “যদি ইয়ামোসের একটি ইঁদুরের সাহসও থাকে, সে তা এক মুহূর্তের জন্য বরদাস্ত করবে না! কে এখন এ বাড়ির কর্তা, ইমহোটেপের অনুপস্থিতিতে? ইয়ামোস! কাজেই ইয়ামোসের স্ত্রী হিসেবে ভালো মাদুর ও বালিশগুলো বেছে নেয়ার প্রথম সুযোগ আমারই প্রাপ্য! ঐ জলহস্তীমুখো কালো চাকরটাকে অবশ্যই আমি দেখে নেবো ...”

কাইটের ভারী, উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়:

“না, না, আমার সোনামাণিক, তোমার পুতুলের চুলগুলো খেয়ো না। দেখো, এখানে এর চেয়েও ভালো কিছু আছে - একটি মিষ্টি- বাহ, কত মজা ...”

“দেখ কাইট, তোমার দেখছি ভদ্রতা বলে কিছুই জানা নেই; এমনকি আমি কি বলছি তাও তুমি কানে তুলছো না - জবাবে কিছু বলছো না - তোমার ব্যবহার আসলেই অসভ্যদের মতো।”

“ঐ নীল বালিশটা সবসময় আমারই ছিল ... আহা, ছোট আঙ্কের দিকে দেখো, সে হাঁটতে চেষ্টা করছে ...”

“তুমি তোমার বাচ্চাদের মতোই নির্বোধ, কাইট। এবং সেটা একটা ভালো ব্যাপার! কিন্তু তুমি সেটি চাইলেই পাবে না। এটা আমারই হবে, তোমাকে স্পষ্ট বলছি।”

 রেনিসেব কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ তার পেছনে শুনতে পায়। সে চটজলদি ঘুরেই পেছনে বাড়ির পুরনো পরিচারিকা হেনেটকে দেখে বিরক্ত হয়। হেনেটের পাতলা গড়নের মুখে বরাবরের মতো অর্ধহাসির ভঙ্গিটি লেপ্টে ছিল।

”কিছুই তেমন বদলায়নি, তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু ভাবছ, রেনিসেব, সে বলল। “আমরা কীভাবে যে সাতিপির ঐ হেঁড়ে গলা সহ্য করি,  জানি না! কাইট অবশ্যই পরে এর জবাব দিতে পারে। আমরা কেউই তেমন ভাগ্যবান নই। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি, তোমার বাবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, এ বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের পাশাপাশি খাওয়া পড়ার বন্দোবস্ত করার জন্য। আহ! তোমার বাবা সত্যিই একজন ভালো মানুষ। এবং আমিও সেজন্য যা করা উচিত, সাধ্যমতো তা করতে চেষ্টা করি। আমি সবসময় কাজেই ব্যস্ত থাকি - কখনো এখানে, কখনো ওখানে - এর বিনিময়ে আমি কখনো ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করি না। তোমার স্নেহময়ী মা আজ বেঁচে থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। তিনি আমার প্রশংসা করতেন। যেন বোনের মতোই আপন ছিলাম আমরা! তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেছি ‘বাচ্চাদের দেখে রেখো, হেনেট ’, মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন। আর আমিও তাকে যে কথা দিয়েছিলাম, তা এখনও পালন করে চলেছি, তোমাদের সবার দেখাশোনার জন্যই, এবং বিনিময়ে ধন্যবাদটুকুও চাইনি। সেজন্য প্রশ্নও তুলিনি এমনকি তা পাইওনি! আমি শুধু সবাইকে সাহায্য করতেই চেয়েছি আর তা-ই যথেষ্ট ছিল। সে রেনিসেবের বগলের নিচ দিয়ে প্রায় পিছলেই যেন ভেতরের কামরায় ঢুকে পড়ে।

“ঐ বালিশগুলো সম্পর্কে, আমাকে কিছু বলতেই হবে সাতিপি কিছু মনে করো না। আমি শুনেছিলাম সোবেক বলছিল-” রেনিসেব সরে যায় সেখান থেকে। হেনেটের প্রতি তার পুরনো বিরক্তি আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল। এটা খুবই পরিতাপের ব্যাপার যে বাড়ির সবাই হেনেটকে অপছন্দ করে। ঘ্যানঘ্যানে গলায় নিজের অনর্গল প্রশংসা এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে সে কদর্য পরিতৃপ্তি পেত।

“যা হোক, ভালোই,” রেনিসেব ভাবছিল, “কেন নয়?” এটাই সে ভেবেছিল, এভাবেই হেনেট মজা পেতে চায়! তার জন্য জীবন তবে উপভোগ্য - এটা ঠিক যে সে যেন সব কাজ থেকে ছিটকে পড়েছিল আর এবং কেউই তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল না। তুমি কখনোই হেনেটের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারো না- রেনিসেব নিজের বিবেচনার প্রতি নিবিড় মনোযোগ সহকারে এটাই ভাবছিল যে এর ফলে তার মনে উদারতা অনুভূত হচ্ছিল। সে ভাবছিল, হেনেট হচ্ছে সেসব মানুষের একজন যাদের নিয়তিই নির্দিষ্ট থাকে অন্যদের প্রতি সমর্পণে এবং তাদের প্রতি কেউ নিবেদিত নয়। সে দেখতে কুশ্রী ও স্বভাবে নির্বোধ ধরনের হলেও বেশ ভালোই জানত যে বাড়িতে কখন কী ঘটে চলেছে। নিঃশব্দে তার পা ফেলে হাঁটা, তার অতি খাড়া কানজোড়া এবং দ্রুত ঘুরিয়ে ফেলা চোখজোড়া মিলেমিশে এমন অবস্থা সৃষ্টি করত যে  কেউই তার কাছ থেকে বেশিক্ষণ কোনো কিছু আড়াল করতে পারত না।

কখনো বা সে নিজের এই পটুতায় নিজেই অভিভূত হত -অন্য সময়ে সে একজন থেকে দ্রুত আরেকজনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করত এবং আনন্দের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার লাগানো কথার ফল খুঁটিয়ে পরখ করত।

বাড়ির লোকজন বারবার ইমহোটেপের কাছে গিয়ে হেনেটকে বাড়িছাড়া করার অনুনয় জানালেও সে এসব ব্যাপারে কখনো কর্ণপাত করত না। বাড়িতে সেই ছিল একমাত্র ব্যক্তি, যে হেনেটকে পছন্দ করত। ইমহোটেপের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিদান হেনেট এতটা বিশ্বস্তভাবে পরিশোধ করত যে পরিবারটির অন্য সকলের কাছে তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল।

রেনিসেব সেখানে অনিশ্চিতভাবে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তার ভাবীদের তীব্র কোলাহল তার কানে বাজছিল, যা হেনেটের দৌরাত্ম্যে আগুনের মতো গনগনে আঁচ ছড়াচ্ছিল। কাজেই রেনিসেব সেই জায়গা ছেড়ে তার দাদীমা এশার ছোট কামরায় ধীর পায়ে হাজির হয়েছিল। সেখানে এশার পাশে অল্পবয়সী কালো দুটি দাসীও ছিল। তারা তাকে লিনেনের জামাকাপড় দেখাচ্ছিল আর সে সেগুলো দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদেরকে মৃদু বকাঝকা করছিল।

হ্যা, এসবই আগের মতো আছে। রেনিসেব সবই দেখছিল, শুনছিল। বৃদ্ধা এশা খানিকটা বুড়িয়ে গিয়েছিল, এটুকুই তার কাছে নতুন মনে হয়েছিল। কিন্তু এশার কণ্ঠস্বর এবং কথা বলার ভঙ্গি আগের মতোই রয়েছে, একের পর এক ঠিক সেভাবেই, যেভাবে আট বছর আগে এ বাড়ি ছেড়ে রেনিসেব চলে যাবার আগেও এশা বলত...

রেনিসেব সেখান থেকেও সরে এল। বৃদ্ধা দাদী বা দাসী দুটি তাকে খেয়াল করেনি। অল্প সময় নিয়ে সে রান্নাঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে হাঁস ঝলসানোর ঘ্রাণ, হরদম আলাপ, হাসাহাসি, বকাঝকা-টিপ্পনির আমেজ যথারীতি ছিল, সবজি রান্না করার প্রস্তুতিও যথারীতি চলছিল।

রেনিসেব চোখজোড়া অর্ধেক বন্ধ রেখে সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এখান থেকে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল বাড়ির কোথায় কী হচ্ছে! রান্নাঘরের হট্টগোল, বৃদ্ধা এশার তীক্ষ্ম গলা, সাতিপির বাঁজখাই কণ্ঠ এবং কাইটের অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরের পাল্টা জবাব। সবকিছু মিলে যেন নারীকণ্ঠের অদ্ভুত জগাখিচুড়ি - আলাপ, হাসিঠাট্টা, অভিযোগ, বকাঝকা, উল্লাসে ফেটে পড়া...

এবং হঠাৎ করেই রেনিসেবের এ পরিবেশটা যেন গুমোট লাগছিল, চারপাশটা যেন নারীদের খবরদারিতে বড্ড আঁটোসাঁটো। নারীরা স্বভাবে বরাবর কোলাহলমুখরা! তারা অন্তঃপুরের বাসিন্দা - কখনোই শান্ত ও স্থির নয়, সর্বদাই বকবক করছে, উচ্চকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে, - অন্য কিছুই যেন তাদের করার নেই!

এবং কেয় নৌকায় বসা অবস্থায় মাছের দিকে নীরবে লক্ষ্য রাখছিল হাতে বর্শা ধরে...

এই অবিচ্ছিন্ন হট্টগোলের লেশমাত্র সেই স্মৃতিতে ছিল না।

রেনিসেব দ্রুত বাড়ির বাইরে আবার চলে গেল, যদিও সেখানে ছিল স্পষ্ট নীরবতা। সে ফসলের মাঠ থেকে সোবেককে ফিরতে দেখে। ইয়ামোসকে দূর থেকে সমাধিসৌধের দিকে যেতে দেখা গেল।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চুনাপাথরের টিলাসংলগ্ন পথটি ধরে এগিয়ে যায় সমাধিসৌধের দিকে। এটি ছিল মহান মেরিপাথার সমাধি, যেটি দেখাশোনার ভার ছিল তার বাবা ইমহোটেপের। সমাধিসৌধটি দেখাশোনার জন্য যা অনুগ্রহপূর্বক দান করা হয়েছে, সবই এ জমিদারি ও কৃষি জমির অংশ। ইমহোটেপ কোথাও গেলে সমাধিসৌধ দেখাশোনার ভার ইয়ামোসের ওপর বর্তায়।

যখন রেনিসেব ধীরে ধীরে খাড়া পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠছিল, ইয়ামোসের সঙ্গে হোরিকে পরামর্শ করতে দেখা গেল। হোরি হলো তার বাবার ব্যবসায়িক বন্দোবস্তের হিসাবরক্ষক। সমাধিসৌধ সংলগ্ন যে গুহায় উপহার নিবেদন করা হয়, তার পাশের ছোট একটি পাথুরে গুহায় তারা বসেছিল।

হোরির হাঁটুর ওপর একটি প্যাপিরাস বিছানো ছিল এবং দুজনেই এটির ওপর ঝুঁকে ছিল।

দুজনই রেনিসেবকে সেখানে দেখে মৃদু হাসল।  সে তাদের পাশেই ছায়ায় বসল। রেনিসেব বরাবর ইয়ামোসের ভক্ত। ইয়ামোস স্বভাবে শান্ত, রেনিসেবের প্রতি মমতা তার মনে প্রবল। হোরিও ছোট রেনিসেবকে আপনজনের মতো দয়ালুভাবে দেখত, কখনো বা তাকে খেলনা বানিয়ে দিত।  কিশোরী বয়সে যখন সংবেদনশীল ও লম্বা আঙুলের অধিকারী  রেনিসেব বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল বিয়ের পর, হোরি তখন ধীরস্থির এক যুবক। রেনিসেব এতদিন পর তাকে এখানে দেখে ভাবছিল, যদিও হোরির বয়স বেড়েছে, তবু সে দেখতে প্রায় আগের মতোই আছে। যে স্মিত হাসিটি সে রেনিসেবকে উপহার দিল, তাও তার স্মৃতিতে আগের মতোই মনে হয়েছিল।

ইয়ামোসে ও হোরি নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল:

“ছোট ভাই আইপির সঙ্গে তিয়াত্তর বস্তা বার্লি ...”

“তাহলে মোট দুইশত ত্রিশ বস্তাা আর এর মধ্যে একশ বিশ হলো বার্লি।”

“হ্যা, কিন্তু এখানের কাঠের দাম রয়েছে, এবং তেলের বিনিময়ে ফসল পরিশোধ করা হয়েছে ...

তাদের আলাপ চলছিল। রেনিসেব তন্দ্র্াচ্ছন্নভাবে সেখানে বসে থাকলেও তাদের অস্পষ্ট আলাপ তার কানে আসছিল। একটু পর ইয়ামোস প্যাপিরাসের টুকরোটি গোলাকারভাবে মুড়িয়ে হোরির হাতে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

রেনিসেব নীরবতাকে সঙ্গী করে সেখানে বসে রইল।

এবার সে গোলাকারভাবে মোড়ানো একটি প্যাপিরাস হাতে নিয়ে জানতে চাইল, “এটা কি আমার বাবা পাঠিয়েছে?”

হোরি মাথা ঝাঁকায়।

“কী লেখা আছে এতে?” সে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

রেনিসেব প্যাপিরাসটি মেলে ধরে এবং এতে দাগানো চিহ্নগুলো তার নিষ্পন্দ চোখজোড়ায় অর্থহীন মনে হয়।

মৃদু হেসে হোরি তার কাঁধ ঝুঁকিয়ে প্যাপিরাসের লেখায় আঙুল ছুঁয়ে তা পড়তে থাকে। এ চিঠিটি পেশাদার চিঠি লেখক হেরাক্লোপোলিশের চিঠি লেখার অলংকরণ অনুসরণে বিন্যস্ত হয়েছে:

“এই জমিদারির তদারককারী, পুরোহিত ইমহোটেপ বলছি: যারা বহুকাল যাবত স্বস্তিতে বেঁচে থাকে, তোমাদের অবস্থাও তেমনই হোক। প্রভু হেরিসাফ, হেরাক্লোপোলিশের প্রভু এবং ও অন্য সব দেবতা তোমাদের মঙ্গল করুন। দেবতা পিতাহ তোমাদের হৃদয় আনন্দে ভরিয়ে দিন, যারা দীর্ঘদিন বাঁচে তাদের মতো। ছেলে তার মাকে বলছে, পুরোহিত তার মা এশাকে বলছে. তুমি কেমন আছো? নিরাপদ ও সুস্থ আছো তো? গার্হস্থ্য জীবন উপভোগ করছ তো? আমার ছেলে ইয়ামোস, তুমি জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যময় প্রাচুর্যে ভরপুর তো?  আমার জমি যথাসাধ্য কাজে লাগাবে। জমির কাছ থেকে যতটা সম্ভব কশে আদায় করো, প্রয়োজনে জমি খনন কনে কাজের ভেতর আকণ্ঠ ডুবে থাকো। যদি জানতে পারি যে তুমি কঠোর পরিশ্রমী, তবে তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব প্রভুর কাছে।” রেনিসেব হাসে।

“বেচারা ইয়ামোস! সে কঠোর পরিশ্রম করে, তাতে আমার মোটেই সন্দেহ নেই।”

বাবার উৎসাহব্যঞ্জক প্রাণবন্ত ভাবটি যেন রেনিসেবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে- এর পাশাপাশি ইমহোটেপের জমকালো, খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল, অবিরাম নির্দেশনাসম্বলিত চেহারাটিও পাশেই ছিল।

হোরি উঠে দাঁড়ায়:

“আমার ছেলে আইপির দিকে খেয়াল রাখবে। আমার কানে এসেছে, সে নাকি অসন্তুষ্ট। আরো খেয়াল রাখবে, সাতিপি যেন হেনেটের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। শণ ও তেল সম্পর্কে চিঠি লিখে জানাতে ভুলবে না। আমার জমির উৎপাদিত ফসল নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আমার বিষয়াদি ভালোভাবে দেখাশোনা করবে কারণ এজন্য তোমাকেই আমি দায়ী করব। আমার জমি বানে ভাসলে তোমার ও সোবেকের কপালে শনি আছে।”

“বাবা আগের মতোই আছে” রেনিসেব সুখী গলায় বলে। “সবসময় ভাবে যে সে না থাকলে কিছুই ঠিকঠাক চলবে না।”

সে প্যাপিরাসটি গোলাকারভাবে গুছিয়ে বলতে থাকে:

“সবকিছুই আগের মতো আছে ...”

হোরি জবাব দেয় না।

সে এক টুকরো প্যাপিরাস নিয়ে লিখতে শুরু করে। রেনিসেব অলস ভঙ্গিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। সে পড়তে খুব আগ্রহী ছিল।

স্বপ্নের ঘোরে সে বলে চলেছিল:

“এটা জানা বেশ মজার মনে হয়, কীভাবে প্যাপিরাসে লিখতে হয়। কেন সবাই লিখতে শেখে না?”

“এর প্রয়োজন নেই।”

“প্রয়োজনীয় নয়, সম্ভবত, কিন্তু এটা শেখা আনন্দের হবে।”

“তোমার তাই মনে হয়, রেনিসেব কী এমন ভিন্নতা ঘটবে তোমার ক্ষেত্রে?”

 রেনিসেব অল্প সময় নিল এর জবাব দিতে। তারপর ধীরে বলল:

“তুমি যখন এ প্রশ্ন কর, এর জবাবে কী বলতে হবে আমার সত্যিই জানা নেই, হোরি”

হোরি বলে, “এখন আসলে অল্প সংখ্যক লেখককে দিয়েই একটি বড় প্রদেশের কাজ দিব্যি চলে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এমন দিন আসবে, যখন সারা মিশরে লেখকদের বিরাট বাহিনী থাকবে। আমরা মিশরের স্বর্ণোজ্জ্বল আমলের শুরুর দিকে আছি।”

“এটা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাপার” রেনিসেব বলে।

হোরি ধীরে বলে, “আমি নিশ্চিত নই।”

“কেন তুমি নিশ্চিত নও?”

“কারণ রেনিসেব এটা খুব সহজ বা তেমন পরিশ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার নয় - দশ বস্তা বার্লির বা একশ গবাদি পশুর বা দশটি ক্ষেতের ফসলের হিসাব লিখে রাখা - এবং যখন এসব লেখা হবে, তখন হয়ত মনে হতে পারে যে সব তো ঠিকই আছে। কাজেই তখন হিসাব লেখকরা ও কেরানিরা যখন ঐসব জমির চাষাদের কাছে আসে এবং যারা জমিতে বার্লি বোনে এবং গবাদি পশু চড়ায়, তাদের কাছে এলে হিসাব লেখকদের মনে হতে পারে যে কৃষি জমি ও উৎপাদিত বার্লি এবং গবাদি পশু  সবই বাস্তবে আছে - এগুলো প্যাপিরাসের ওপর নিছক কালির চিহ্ন নয়। এবং যখন সব দলিল-দস্তাবেজ এবং হিসাব লেখা প্যাপিরাস নষ্ট হয়ে যাবে, হিসাব লেখকরা শঙ্কিত নাও হতে পারে এজন্য যে চাষারা জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায় ও কাটে, তারা বিতাড়িত হলেও মিশর দিব্যি বাঁচবে। কারণ জমি, ফসল ও গবাদি পশু থেকে যাবে।”

রেনিসেব গভীর মনোযোগ দিয়ে হোরির কথা শুনছিল। সে এবার ধীরগলায় বলে “আমি এবার বুঝতে পারছি, তুমি কি বলতে চাও। তুমি যা চোখে দেখো ও ছুঁতে পারো, সেগুলোই প্রকৃত বস্তু ... লেখার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন যে ‘আমার দুইশত চল্লিশ বস্তা বার্লি আছে’ মানে তোমার এর চেয়ে কম পরিমাণ বার্লি নেই। তার মানে একজন চাইলেই মিথ্যা লিখতে পারে।”

হোরি রেনিসেবের গুরুগম্ভীর মুখের দিকে তাকায়। সে হঠাৎই বলে ওঠে:

“তুমি আমার খেলনা সিংহটা মেরামত করে দিয়েছিলে, অনেক আগে। মনে পড়ে?”

“হ্যা, দিব্যি মনে আছে, রেনিসেব।”

“টেটি এখন ওটা দিয়ে খেলে ... সেই সিংহটাই”।

খানিক থেমে সে আবার বলে,

“কেয় যখন অসিরিসের কাছে চলে যায়, আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি আবার বাড়িতে ফিরে এসেছি এবং আমি আবার সুখী হব এবং কষ্টের সেই স্মৃতি ভুলে যাব - কারণ এখানে সবকিছুই আগের মতো আছে। কিছুই যেন বদলে যায়নি।”

“তুমি সত্যিই তাই মনে কর?”

রেনিসেব সতর্কভাবে তার দিকে তাকায়।

“তুমি কি বলতে চাও, হোরি?”

“আমার মনে হয় সবসময়ই বদল ঘটছে। আট বছর আদতে আট বছরই।

“কিছই বদলায়নি এখানে।” রেনিসেব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

“তাহলে পরিবর্তন তো হতেই হবে।”

রেনিসেব সতর্কভাবে বলে ওঠে

“না, না, আমি চাই সবকিছু আগের মতোই থাকুক।”

“কিন্তু তুমি নিজেই তো আগের সেই রেনিসেব আর নও, যে তার স্বামী কেয়ের কাছে চলে গিয়েছিলে।”

“হ্যা, আমি আগের মতোই আছি। আর যদি তা না-ও হয়, তবে আবার আগের মতোই হব।”

হোরি মাথা নাড়ে।

“তুমি পেছনে ফিরে যেতে পারো না, রেনিসেব। এটা অনেকটা আমার দেয়া হিসাবের মতো। যেমন - আমি একটা কিছুর অর্ধেক নিচ্ছি, এর সঙ্গে সিকিভাগ যোগ করছি, তারপর দশ ভাগের এক ভাগ এবং তারপর বিশ ভাগের চার ভাগ - এবং সবশেষে, তুমি দেখতোই পাচ্ছো, এটা পরিমাপে অন্য কিছু হবে, সবমিলিয়ে।”

“কিন্তু আমি আগের সেই রেনিসেবই।”

“কিন্তু রেনিসেব ইতোমধ্যে সময়ের ¯্রােতে ভেসে আরো নতুন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই সে সবসময়ই আরো ভিন্ন মানুষ।”

“না, না। তুমি আগের সেই হোরিই আছো।”

“তুমি তা ভাবতে পারো। কিন্তু ব্যাপারটা আদতে তা নয়।”

“হ্যা, তাই। ইয়ামোস আগের মতোই যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তেমনি উদ্বিগ্ন। সাতিপি তাকে আগের মতোই একইভাবে গালমন্দ করছে এবং সাতিপির সঙ্গে কাইটের মাদুর বা বিছানা নিয়ে কথা কাটাকাটি আগের মতোই যথারীতি চলছে। আমি যখন ফিরে যাব, দেখব যে তারা যথারীতি হাসাহাসি করছে, যেন সবচেয়ে ভালো বন্ধু! হেনেট এখনো চুপিসারে কান পেতে অন্যের কথা শোনে এবং তার হাহাকার ও ভক্তি আগের মতোই আছে এবং আমার দাদীও তার ছোট দাসীটিকে বকাঝকা করে, লিনেনের জামাকাপড় তদারকির ব্যাপারে। এসবই আগে থেকে দেখা আর বাবা বাড়ি ফিরে এলে যথারীতি হৈচৈ হবে এবং তিনিও অভিযোগ করবেন, “তুমি এটা এখনো করোনি কেন?” এবং “তোমার এটা করা উচিত ছিল”। তখন ইয়ামোসে উদ্বিগ্ন হবে এবং সোবেক হাসবে আর গর্ব করবে এবং বাবার উস্কানিতে সে ইচড়ে পাকা হবে। তার বয়স মাত্র ষোল আর আট বছর থেকেই সে আস্কারা পেয়ে বিগড়াতে শুরু করেছে। এসব কিছুই আগের মতো যথারীতি চলছে, কিছুই বদলাবে না!” একনাগাড়ে গড়গড় করে বলা কথা সে থামায়।

হোরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুভাবে বলে:

“তুমি বুঝতে পারছ না, রেনিসেব। একটি শয়তান বাইরে থেকে এসে আক্রমণ করলে সারা পৃথিবী তা দেখে। কিন্তু অন্য ধরনের পচনও আছে, যা ভেতর থেকে সংক্রমণ ঘটায়, যার কোনো লক্ষণ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এটা দিনের পর দিন অল্প অল্প করে বাড়ে, শেষ পর্যন্ত ফলটি পচে যায় -  খেলে রোগ হয়।”

রেনিসেব তার দিকে তাকায়। সে প্রায় আনমনেই বলে যায়, যেন সে রেনিসেবকে নয়, বরং বিড়বিড় করে নিজেকেই বলছিল।

রেনিসেব আর্তনাদ করে ওঠে:

“ তুমি এসব কী  বলছ, হোরি? তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।”

“আমি নিজেই ভীত।”

“কিন্তু তুমি কী বোঝাতে চাও? কোন শয়তানের ব্যাপারে তুমি বললে?”

হোরি রেনিসেবের দিকে তাকায় এবং হঠাৎকরেই হাসে।

“বাদ দাও রেনিসেব, আমি কী বলেছি সেসব! যেসব রোগ শস্যখেতে হানা দেয়, সেগুলো নিয়েই ভাবছিলাম।”

রেনিসেব এতক্ষণে মুক্তি পায়।

“আমি আনন্দিত। আমি ভাবছিলাম - আমি জানি না আসলে কী ভাছিলাম”

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;