খরগোশ ও মহামায়া



ফারাহ্ সাঈদ
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

মার্বেলের মতো চোখ। ঠিক জ্বলজ্বলে নয় তবে গাঢ়। খরগোশটা শাদা। পাখির পালকের মতন। আমাদের ফ্ল্যাটে ঘুরঘুর করছে সকাল থেকেই। চেনা চেনা লাগে। হয়তো লিফটে দেখেছি কারো সঙ্গে? আমি ধরতে গেলে আম্মা থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওরে ধরিস না খিদা লাগছে, কিছু খাইতে দে।’

মেঝেতে রাখা এই ঝুড়িটা আমারই কেনা। কিছু গাজর রাখা, আর হলুদমতো একটা সবজি। খরগোশটা ঝুড়ির কাছে গিয়ে থামে। কিছু একটা মুখে তুলে নিল। খাচ্ছে সে।

‘এটা কি সবজি রাখার ঝুড়ি আম্মা? আমি তো আনছি সাজায়া রাখার জন্য। আপনে কী করছেন!’ আমি হেসে বলি।
‘তো কী হইছে, ছেলে আমার, কত্তকিছুর শখ তোর, আমি না হয় খরগোশটারে আদর কইরা খাওয়াইলাম। কিছু খুঁইজা পাইলাম না আর, এই ঝুড়িটা কি আর অন্য কাজে লাগে?’
‘আমারেও কিছু খাইতে দেন, তারপর ছাদে যায়া বসি। ঘরে আর ভালো লাগে না মা।’

একটু পর আম্মা একবাটি মুড়ি দেয় আমার হাতে, কড়কড়ে ভাজা। পেঁয়াজ বেরেস্তা দেওয়া। আমি খাচ্ছিলাম জানালার পাশে বসে। খরগোশটা আসে যায় চেয়ারের পাশে। মিনিটখানেক দাঁড়ায় তারপর আবার চলে যায়। মুড়ি খেতে দিলাম কিছু ওকে। নাহ খেলো না খরগোশটা! আম্মা আমার ঘরে এসে বলে, ‘তুই কী দিলি খাইতে? ওইসব খায় না খরগোশ।’ হাসতে থাকে আম্মা।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে যাই। মিঠু ঘরে থাকলেও আম্মাই আমাকে এগিয়ে দেয়। ক্রাচে ভর করে হাঁটি বলে উনি ভাবেন আমি পড়ে যাব। তাই একা হাঁটতে দেন না।

ছাদে কেউ আছে বোধহয়। গুনগুন শব্দ পাই। কেউ গান গাইছে। আমি চেয়ারটাতে বসি। হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা।

এক নিঃশ্বাসে কী কী সব বলল মেয়েটা। আমি শুনে যাচ্ছি তবে খুব হাসি পাচ্ছে আমার। সত্যি সত্যি! আমার হাসি থামিয়ে দিয়ে মেয়েটা বলে, ‘এইভাবে সবগুলা দাঁত দেখিয়ে হাসছেন যে? এটা হাসির কিছু না! আপনার কোনো চিন্তা লাগতেছে না? আপনার ওয়াইফ এভাবে আমার বরের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে আর আমি মেনে নেব?’ কথাগুলো বলে নিজেই হাসে মেয়েটা! তবে এটা বাঁকা হাসি। বিদ্রূপ আছে বৈকি। নামটাও জানি না তার। কী আর বলব।

প্রতিবেশিনীর চোখের দিকেই তাকাই আমি। ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে এসে এ কী বলছে সে! ওর বরের সঙ্গে মিঠুর নাকি কী সব হচ্ছে আজকাল। আমার কি চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কথা ছিল? এখনই ব্লাডপ্রেসার হাই হবার কথা? কই তেমন কিছুই হচ্ছে না। জানতে চাইলাম, ‘আপনি আমাদের উল্টাদিকের ফ্ল্যাটের না? আপনার নামটা?’
‘আমার নাম কণা।’
শুনেও মনে হয় শুনিনি। আরেকবার জানতে চাইব। আরেকবার।

ছাদে কাপড় মেলে দিচ্ছে সে। আমি তাকে দেখি আর ভাবি লিফটে কতবার ভেবেছি অন্তত নামটা জিজ্ঞেস করব। করিনি।

টপ টপ করে পানি পড়ে ধোয়া কাপড় থেকে। ছাদ একটু একটু ভিজে যাচ্ছে, ওর পায়ের কাছেও ছিটকে পড়ছে পানি। কাপড়গুলো ঠিকমত নিঙরানো হয়নি।
‘আপনাদের কাজের মানুষ নাই, আপনি কেন ছাদে?’
‘আপনাকে দেখতে আসছি!’ আবারও সেই বিদ্রূপ হাসি।
আমি কিছু বলি না। তার পায়ের কাছে পানির ঝরে যাওয়া দেখি। একপায়ে নূপুর। কেমন কালচেমতো। রুপালি রঙ ছিল বোধহয়, অনেকদিনে হয়তো কালচে হয়ে গেছে।
‘কী ভাবছেন? ব্যাপারটা ভেবে দেখেন, আর একটু খোঁজ টোজ নিয়েন, কী করে, কোথায় যায় ওরা? আশরাফকে আজকাল কেমন কেমন যেন মনে হয় আমার!’
‘আপনি তো খোঁজ নিচ্ছেন নিয়মিত, আমি আর কী করব?’
‘এটা তো আমার হাজব্যান্ড নিয়ে কথা না শুধু, আপনার ওয়াইফও জড়িত! দুজন কী করছে, আপনি খোঁজ নিবেন না? বউয়ের জন্য ভালোবাসা নাই?’
‘না নাই! তো?’ আমার হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে!

কী বলে এই মেয়েটা! আমার বিশ্বাস হয় না, মিঠু আর ওর বরকে নিয়ে কী সব রটনা! সত্যি, আমার বিশ্বাস হয় না। বিয়ের পর থেকে মিঠুকে যতটা চিনি এমন একটা কিছু ওর দ্বারা অসম্ভব! অন্যরকম মেয়ে সে। কণা মেয়েটা সন্দেহপ্রবণ খুব। তবে বোকা। তাও ওকে আমার ভালো লেগে। এক ধরনের ইন্নোসেন্স আছে! আমি তাও হাসি। কণাও হাসে তবে বিদ্রূপ হাসি।

বালতি নিয়ে চলে যাচ্ছে সে। তারে দেওয়া কাপড়গুলো বাতাসে নড়ে উঠলেও, ভারী চাদরটা নড়ছে না। হালকা প্রিন্টের আকাশী চাদর। ছাদের দরজা খুলে একবার পেছন ফিরে তাকায় কণা।
‘আবার দেখা হবে, আমি আসি।’ চলে যাচ্ছে সে। ছাদের সিঁড়িঘরের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে কণা।
বলতে গিয়েও বলিনি, যেও না। আবার কী ভাবে! তুমি-টুমি করে বললে। আমি আসলে ওকে তুমি করে বলতেই পারি। বয়সে অনেক ছোট হবার কথা। দেখে তো তাই মনে হয়! নাকি শুকনো গড়নে বয়সটা ধরা যায় না। মুখটাও মিষ্টি। হাসলে গালে ছোট্ট একটা টোল পড়ে।

ঘরে ফিরে যাব তাই ছাদের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছি কেবল। কণা এসে আমার ক্র্যাচটা তুলে দিলো। আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি। লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এক্সিডেন্টে দুটো পাই ভেঙেছে যদিও, তাও বাঁ পায়ে কিছুটা জোর পাই। ডান পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে। এখনই পড়ে যাচ্ছিলাম আর ও এসে হাতটা ধরল। আরো এগিয়ে আসে কণা। মেয়েটার ভয় করে না? এভাবে অজানা কারো এত কাছাকাছি আসতে? আমি পেছনে যাই, লিফট ঘেঁষে দাঁড়াই। আরো কিছুক্ষণ থেমে ছিল লিফট, আমি দোতলার বাটনটায় ঠেঁসে ধরি, আমাকে ঘরে যেতে হবে। কণার চুলের গন্ধে মাতাল হয়ে যাচ্ছি যে আমি! আবার হাসে, টোল পড়া গাল, চুলগুলো সারা মুখ ঢেকে আছে। আমি সরিয়ে দিতে গেলে বলে, ‘থাক, পড়ে যাবেন তো!’
‘আপনি সামলে নেবেন’, আমিও হাসি, লিফটের দরজা খুলে যায়। খরগোশটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে কণার কোলে ওঠে। খালি বালতিটা ফেলে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কণা। হুম! ও তাহলে কণার পোষা খরগোশ! আহ বেশ ভালো লাগছে কণার কোলে।

ইতোমধ্যে কণা এসেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে দুবার, খরগোশটাকে নিয়ে যেতে, আম্মার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ হলো ওর। কিছু সুপারি গুঁড়ো করে দিয়ে গেল সে। আম্মা আজকাল দাঁতের জন্য পান-সুপারি খেতেই পারে না বললে চলে। কণাকে খুব পছন্দ হয়েছে আম্মার।
‘মেয়েটা খুব সরল, আর এই খরগোশটাই বুঝি ওর জীবন।’ আম্মা হাসে আর বলে।

মিঠু ঘরে ফিরতে এখনো তিনঘণ্টা বাকি। ঘড়ি দেখি। এটা ঠিক আমার অপেক্ষা নয়। কিছু জমে থাকা কথার অপেক্ষা। সারাদিন কী কী হয় আমি বলে যাই, মিঠু শোনে, কিছুই বলে না, কোনোদিন দু’একটা হ্যাঁ-হু, কিংবা অষুধ খেয়েছি কিনা তাই জানতে চাওয়া।

টিভির অ্যাডগুলো এই দুই মাসে মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। নেটেও থাকতে আর ভালো লাগে না। মানুষ কী সব বিষয় নিয়ে ক্যাচাল করে শুধু শুধু। ল্যাপটপে কিছু সিনেমা দেখি মাঝে মাঝে। বই-টই পড়ি না। তবে আমার অফিসের এক কলিগ তিন চারটা বই দিয়ে গেল সেদিন তাই উল্টে পাল্টে দেখছি আজকাল। গতকাল ডাক্তার বললেন, আরো দু’মাস হয়তো লাগবে ভালো হতে। এভাবে ঘরে বসে বসে আর ভালো লাগছে না। আমি পাগল হয়ে যাব। অফিসে বসকে বললাম বাড়িতে কিছু কাজ টাজ দেওয়া যায় কিনা। তিনি হেসে বলেন, ‘সাইফ বিশ্রাম নাও তুমি, দশ বছরে তোমাকে ছুটি নিতেও দেখিনি তেমন একটা। ফিরে এসে কাজ কোরো।’

আমি আর কী বলি। মন খারাপ করে বসে থাকি। ভাবছি নাহিদদের ওখানটায় যাবো। ওর চিটাগাংয়ের বাসায় যাওয়া হয়নি আমার।

নাহিদ আমার পিঠাপিঠি বোন। ছোট হলেও আমাকে বড়দের মতোই শাসন করে নাহিদ। এতবার যেতে বলছে বেড়াতে, হয়ে উঠেনি। ঘরে বসে আর ভালো লাগছে না। আম্মা যেতে রাজি হলেই হলো!

মিঠু অফিস থেকে ফিরেছে কেবল। চা খেতে খেতে আমি চিটাগাং যাওয়ার কথা বলি। আমাদের তিনজনের একসঙ্গে যাওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ‘না’ বলে চুপ করে থাকে মিঠু।
‘কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাও, মা একা তোমাকে সামলাতে পারবে না। আছে এমন কেউ?’
‘হুম আছে।’
‘কে সাইফ, তোমার অফিসের কোন স্টাফ? দুই তিনদিনের জন্য হলে তো যেতেই পারে।’
‘না অন্য কেউ।’
‘কে?’

আমি কণার কথা ভাবি। ও কি যাবে আমার সঙ্গে? মিঠুকে কিছুই বলি না যদিও। আবারও ভাবছি কণা যদি যেতে পারে। তাও কি হয়! ওর বর ওকে যেতে দেবে কি? কখনোই না!

খরগোশটা আবার কোথা থেকে যেন এলো। মিঠুর চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ায়। অনেকটা সময়।
‘ওকে দিয়ে আসি ওই ফ্ল্যাটে।’
‘তুমি জানো এটা কাদের খরগোশ?’
‘হ্যাঁ দেখেছি একটা মহিলার কাছে, মনে হয় উনি আমাদের উল্টো দিকেই থাকেন।’
‘তুমি চেনো ওদের মিঠু?’
‘না সেরকম না। আশারাফ সাহেবকে চিনো না? উনি তো আমাদের পাশের অফিসে কাজ করেন ‘
‘ওহ!’
আশারাফ মানে কণার বর! ওর থেকেই নামটা শোনা। আমি একবার ভাবি জিজ্ঞেস করব মিঠুকে। কিন্তু কী যে বলি!

মিঠু খরগোশটা কোলে তুলে নিয়ে যায়। আমিও যাই, তারপর কণাদের দরজার পাশে থেমে যাই। কণাকে ভাবছি এখন। ওর ফোন নম্বরটা জানা থাকলে চিটাগাং যাওয়ার কথা বলতাম। কী সব যে ভাবছি!

আজকাল ছাদে প্রায়ই দেখা হয় ওর সঙ্গে। টুকটাক গল্প করি। প্রতিবারই আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় কণা। আজ সিঁড়িঘরেই দেখা হলো কণার সঙ্গে। আমি চিটাগাং যাওয়ার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেল! ওর বর বা বাড়ির অন্যরা কে কী বলবে এ কথা বলতেই কণা বলে, ‘টিকিট কবে করবেন? আর ভাবতে হবে না ওর কথা, আমি ম্যানেজ করে নেব।’
‘বলেন কী! আমি তো এমনি এমনি বললাম আপনাকে। আমার বোনের বাড়িতে যাব, আম্মা বুড়ো মানুষ, কেউ সঙ্গে গেলে হেল্প হতো একটু। তাই ভাবলাম আপনি যদি যেতে চান!’
‘ভাবতে হবে না, আমি যাব বলেছি তো!’
‘আচ্ছা মিঠুকে কী বলব আমি, বলেন তো?’
‘সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?’ সে কি হাসি কণার!

আমি জানি না কণা কী চায়। আমি অস্থির হয়ে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না। আম্মাকে রাজি করালাম, ইনফেক্ট আমার ছোটবোন নাহিদই রাজি করাল আম্মাকে ফোনে। মিঠু তেমন কিছু বলল না। তবে কণার কথা কাউকে কিছু বলিনি।

‘নাহিদরা স্টেশন থেকেই নিয়ে যাবে আমাদের কথা চিন্তা করো না।’
‘তুমি কষ্ট করে যেতে পারলে আমার কী বলো? আমি তো যেতে পারব না তুমি জানো। অফিসে অনেক কাজ আমার।’

মিঠুর কথা শুনে এখন আর কষ্ট পাই না। নীরবতা বলি কিংবা নিষ্ঠুরতা এ আমার সয়ে গেছে! বিশেষ করে এই দু’মাসে আমার সবকিছুই কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে।

কণা সঙ্গে যেতে চায় এ কথাটা আম্মাকে বলব কিনা ভাবছি। না থাক। কী হয় দেখি। আমার তো বিশ্বাসই হয় না স্বামী সংসার রেখে ও আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে। তাছাড়া নাহিদের বাড়িতেই বা কী বলব, কণার কি পরিচয় দেবো সেখানে?

খরগোশটা আজ সকাল সকাল এসে হাজির। অনেকটা সময় ও চুপচাপ আম্মার পাশে বসে আছে, এটা আমার অদ্ভুত লাগে। আমি বসে থাকি। ছেলেটা আর কতটা সময় মায়ের পাশে থাকে, তবে এবার এই এক্সিডেন্টের পর মা আমাকে অনেকটা আগলে রেখেছেন।

মিঠু শুধু শুক্রবারে বাড়িতে থাকে, তাও কতটুকু আর দেখি আমি। সারাটা শুক্রবার ঘুমিয়ে কিংবা টিভি দেখেই কেটে যায় ওর।

ব্যাগ গুছিয়েছি। ফাইনালি কাল চিটাগাং যাচ্ছি আমি আর আম্মা। বিকালে কণার সঙ্গে ছাদে দেখা। ও আমাদের সঙ্গে যাবে তো? ভাবছি। কিন্তু আম্মাকে তখনও বলিনি কিছুই আমি কণাও বারণ করল।
‘কণা, আম্মাকে এখন না বললে, পরে যখন আসবেন, তখন?’
‘সে আমি তখন ম্যানেজ করে নেব, খালাম্মা আমাকে পছন্দ করেন, আপনি কি জানেন না?’
‘তা ঠিক আছে, কিন্তু কণা আপনি কোনো সমস্যায় পড়বেন না তো?’
‘নাহ, এটা আমার ব্যাপার।’

অজানা এক ভীতি কাজ করে আমার মাঝে সারারাত, মিঠু কিংবা কণার বরকে নিয়ে নয় বরং নিজেকে নিয়ে। আমার এইসব কী হচ্ছে আজকাল। কণাও আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। বুঝি না কিছুই, কণা তো এমনিতেই ওর বর আর মিঠুকে নিয়ে আমার কাছে নালিশ করে প্রায়। তাহলে ও কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে আমায়? জানি না, বুঝি না কিছুই।

সকালে গাড়ি আসে নয়টায়। আমি আর আম্মা লিফটে নিচে নেমে আসি। মিঠু বারান্দা থেকেই দাঁড়িয়ে দেখে। শুক্রবার আজ। অফিস নেই মিঠুর। গাড়িতে ব্যাগ তোলা হয়েছে। কিন্তু কণাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। গাড়িটা বেরিয়ে যেতে লাগল, আমি ছিলাম গেইটের দিকে তাকিয়ে। কণা যদি আসে। ড্রাইভারকে থামালাম একবার। দেরি হয়ে যাবে ভেবে আম্মা বলেন, ‘কিসের অপেক্ষা করোস?’
‘না কিছু না।’
গাড়িটা গলির মোড় ঘুরতেই কণাকে দেখতে পেলাম! সঙ্গে সুটকেস। আরে সে কি! ও এখানে। গাড়ি থামিয়ে বললাম, ‘এখানে যে?’
‘নিচে অপেক্ষাই করছিলাম আপনাদের। তারপর পানির বোতল কিনতে এই দোকানে এলাম, আপনি তো দেখি আমাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছিলেন।’
‘উঠে পড়েন গাড়িতে দেরি হয়ে যাবে।’

আমাকে আর কিছু বলতে হলো না। কণাই মাকে কী সব বোঝালো পেছনের সিটে বসে বসে। আম্মাকে শুধু বলতে শুনলাম, ‘ভালো করছো, আমি তো এত চিন্তায় ছিলাম, সাইফকে একা নিয়ে বাসে এভাবে যাব কী করে তাই ভাবতেছিলাম।

‘আমার এত খারাপ অবস্থা না তো আম্মা, একটু কষ্ট হয় কিন্তু আমি তো চলাফেরা করতে পারি!’
‘কণা আসাতে আরো ভালো হইছে না?’ আম্মার কথা শুনে মুচকি হাসে কণা, টোল পড়ে ওর গালে। রোদে মুখ ঢাকে শাড়ির আঁচলে।

বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। অফিসের ড্রাইভারকে বকশিস দিলো কণা। সিটগুলো ভালো পেয়েছি আমরা, তবে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বাস ছাড়বে। নাহিদের সঙ্গে একবার কথা হলো আম্মার, কণার কথা বলেছে কিনা আমি জানি না।

বাসে উঠতে অসুবিধা হলো। কণার কাঁধে ভর করে উঠতে গিয়ে ইতস্তত লাগে আমার। তবে চুলের মিষ্টি গন্ধটা এতটা কাছাকাছি কখনো পাইনি কণার। ধীরে ধীরে উঠি আমরা। আম্মার খুশি খুশি চেহারার কারণ আমি জানি না কিন্তু আমার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে!

আম্মা জানালার পাশে বসেন। তারপর কণা আর আমি বসেছি আইলের এপাশে। কণা আর আমার মাঝে এটুকু জায়গাও খালি থাকে না প্রায়। লোকজন চলাফেরা করছে একটু পরপর। মাঝামাঝিতে বসলে যা হয় আর কি।

পায়ের নুপুরটা খুঁজছি আমি। কী করে যে বলি কণাকে। একটু দেখতে পেলে ভালো লাগে। ডান পায়ে দেখতে পেলাম না তো।
‘পায়ের নুপুরটা পরেননি বুঝি আজকে?’
‘এই তো, কেন?’ বাঁ পা দেখিয়ে বলে কণা, ‘পছন্দ তাই, তোমাকে মানায়।’
কণা মুচকি হেসে জানালার দিকে ঘুরে তাকায়।

পথে থেমেছি আমরা। রেস্টুরেন্টে আমাদের জন্য খাবার অর্ডার দিচ্ছে কণা। আমার ফোন বেজে ওঠে। মিঠুর ফোন। আমি একটু দূরে সরে গিয়ে কথা বলি।
‘তোমরা কোথায়? কতদুর গিয়েছো?’
‘একটু দেরিতে বাস ছাড়ল, পৌঁছুতে দেরি হবে। থেমেছি একটা হোটেলে। খাচ্ছি আমরা।’
‘যা একটা ঘটনা হয়েছে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে সাইফ!’
‘কোথায়?’
‘যাদের ফ্ল্যাটে খরগোশ আছে।’
‘কী বলো!’
মিঠু এক নিঃশ্বাসে অনেক কিছু বলে ফেলল। কণার কথাই বলছিল আসলে। আমি শুধু কান পেতে শুনি। ‘আশরাফের সাহেবের এক কাজিন ছিল যে, ওই খরগোশটা যার। সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, একটা চিঠি লিখে। আর নাকি ফিরবে না কখনো!’
‘আশরাফের ওয়াইফ তো সে?’
‘আরে না তুমি কিছুই খবর রাখো না সাইফ, ওই মেয়েটা তো উনার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন, ওর বাবা মা নেই। এদের বাড়িতেই থাকে, আশরাফ সাহেব কি ম্যারিড নাকি? ওর বড়ভাইয়ের বউ আছে। ও বিয়ে করেনি এখনো। তুমি কিছুই জানো না!’
আরো বলতে থাকে, ‘ওরা মেয়েটার ফোন বন্ধ পাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে, এখন নাকি থানায় যাবে ডায়রি করতে, মেয়েটা নাকি কী সব পাগলামী করে মাঝে মাঝে। তবে জানো ওর খরগোশটা কিন্তু আমাদের বাসায় এখন। দেখি আমি খুঁজে কিছু একটা খেতে দিই। মায়া লাগছে খরগোশটার জন্য।’

আমাদের বাসটা ছেড়েছে এইমাত্র। আম্মার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে, চোখ বন্ধ করে আছেন তিনি। আমি কণার সিটের পাশে এসে দাঁড়াই।
‘বরকে কি বলেছো কণা?’
‘বলিনি কিছু আশরাফকে।’ রান্না করে এসেছি ওর পছন্দের রূপচাদা মাছ। কেউ ছিল না ঘরে, ওরা দু’ভাই বাজারে যায় শুক্রবার সকালে। আর বড় ভাবী তো ঘুমে ছিল, একটা চিঠি রেখে এসেছি ডাইনিং টেবিলে।
‘কী লিখলে?’
‘লিখেছি আর ফিরব না।’ আর হ্যাঁ খরগোশটাকে আপনাদের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে দিয়েছি সেই ভোরে। দরজা খোলাই ছিল।’
‘না ফিরে কই যাবে তুমি?’
‘আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি আমি, আমরা ফিরে আর আসব না ঢাকায়, তাই না?’
‘খরগোশটাকে মনে পড়ছে না তোমার?’
‘না , ও তো মহামায়া, যাকে ছেড়ে দিতে হয়। সারাজীবন কাছে রাখতে নেই।’
‘আশরাফ সাহেবও কি তাই?’
কণা কিছু বলে না, খুব কাছে এসে চুলটা ঠিক করে দেয় আমার।

মিঠুর ফোনের কথা বলিনি আমি কণাকে। আম্মাকেও না। আম্মার হাতে পান দিয়ে কণা উঠে দাঁড়ায়। আমার কাছাকাছি। ওর মোবাইল ফোনটা কোল থেকে মাটিতে পরে ব্যাটারি খুলে যায়। আমি তুলতে গেলে কণা আমার হাত ধরে বারণ করে। আমার পকেটে থাকা ফোনটাও আলগোছে বন্ধ করে দিই আমি।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। আকাশটা রক্তিম। অশান্ত। আমরা পৌঁছে গেছি। এগিয়ে যাচ্ছি, আমি আর কণা। আমার দুটো পায়েই শক্তি পাই। হেঁটে চলার শক্তি।

তবুও কণাকে ছুঁতে পারব বলে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো আরো কিছুকাল।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;