ছোট্ট পাখি চন্দনা



আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার নামটা একটু পুরনো ধাঁচের। ফাতেমা আকতার খানম। আমার বাবা-ভাই কারো নামের সাথেই খান নেই। তবুও আমি খানম। অবশ্য উনিশ শ পঞ্চাশ সালে, যে বছর আমার জন্ম তখন নিশ্চয়ই নামটা ভালোই শোনাত। তাছাড়া নবীজীর মেয়ের নামে নাম। আমার ডাকনামটা কিন্তু দারুণ। চন্দনা। ছোট্ট পাখি চন্দনা। গানটাও দারুণ—ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা। আমার ছোটমামা নামটা রেখেছে।

ছোটমামা একাত্তরের সেপ্টেম্বরেই পেশোয়ার চলে যায়। আর ফেরেনি। এক প্রয়াত বন্ধুর বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করে রেডিমেড দুটো মেয়েও সাথে পায়। মেয়েদেরও হয়তো তার মতোই একজন রেডিমেড বাবার দরকার ছিল। এদের বন্ধন ছিঁড়ে আসতে হয়তো তার মন চায়নি। বাহাত্তরের শেষদিকে একটা গ্রুপ ছবি মাকে পাঠায়। স্টুডিওতে তোলা, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা পাহাড়ি ঝরনা, সামনে ছোটমামা, তার বউ এবং ছোট দুটো মেয়ে। মেয়েগুলো দেখতে কী যে সুন্দর, সিনেমার নায়িকাদের ছোটবেলার ছবির মতন।

তিয়াত্তরে একটা চিঠি, আমাকে লেখা। নভেম্বরের শেষ দিন হাতে আসে। ছোটমামার সেই চিঠিটা :
তোর বাবার চিঠিতে সব খবর পেয়েছি। সেদিন তোর বিয়েতে এত খাটাখাটনি করলাম, অথচ শেষ ব্যাচে খেতে বসেছি বলে একটা রোস্টও পেলাম না। এটা একটা কথা হলো! আমি কিছু কিছু মনে করিনি। গত শবে-বরাতে আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার নামে বরাদ্দ করা রোস্টটা কেটে দিয়েছেন।

বিয়ের জন্যে তুই-ই না পাগল হয়ে উঠেছিলি! তোর বাবা এ নিয়ে আমাকেও তো কম ধমকায়নি। তোর বিয়ের ষড়যন্ত্রে নাকি আমিও আছি। বাবার রাজত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা—এও এক ধরনের আগরতলা ষড়যন্ত্র। তবলিগ দলের এক দ্বীনিভাই নাকি তোর বাবাকে বলেছে—ছেলেটি নাস্তিক। তোর হবু বর মঞ্জুর নাস্তিক। আস্তাগফিরুল্লাহ। আমি বললাম, দুলাভাই, ছেলেটা ভালোই ছিল, আমি সব খবর নিয়েছি, তার বংশে একজন বুজর্গ আছেন, বাবা বোম্বে থেকে জাহাজে চড়ে হজ্ব করতে আরবদেশে গিয়েছেন। মার্ক্স-টার্ক্স পড়ে মাথাটা একটু বিগড়ে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে বিয়ের পর। দেখবেন দুলাভাই, বিয়ের পর জায়নামাজ ছেড়ে সহজে উঠবেই না।
কী বললি, মাথা বিগড়ে গেছে? একটা পাগলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব? এটা হতে পারে না।
একশবার পারে। আপাও তো আপনাকে পাগল মনে করে।
দূর হ শয়তান। আমাকে নিয়ে কথা!
তুই আত্মহত্যার একটা মোক্ষম থ্রেট দিয়ে কাজটা সহজ করে ফেললি। বিয়ের দিন মঞ্জুর টাইস্যুট পরে এলো। সাদা শার্টের ওপর ছাই রঙের কোট। স্যুট কেন, শেরওয়ানি কোথায়, পাজামা নেই? এ ছেলে নাস্তিক না-হয়ে যায় না। আমার দিকে দাঁত কড়মড় করে তোর বাবা বললেন, বদ্ধ উন্মাদ।
বদ্ধ উন্মাদটা কে? আমি না মঞ্জুর?
তিনি কথা বললেন না।
তারপর শরীর খারাপ লাগার অজুহাত দেখিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সোজা বাসায়। বাসা তো দূরে নয়—রিকশায় পাঁচ মিনিটেরও কম। চাবি ছিল তোর মার কাছে। ঘরে ঢুকতে না পেরে রাগে গদ গদ করে ফিরে এলেন। রিকশা থেকে নেমে প্রথম পা-টাই রাখলেন একদলা কাঁচা গোবরের ওপর। ঘাসের ওপর নতুন কেনা বাটার জুতোটা খুব করে ঘষে বিয়ের প্যান্ডেলে ঢুকলেন। ততোক্ষণে বিয়ে পড়ানো, খোরমা বিতরণ, মোনাজাত—সব শেষ। অনেকটা জোর করেই তাকে খাবার টেবিলে বসালাম। ঢোক ঢোক করে দু গ্লাস বোরহানি খেয়ে উঠে পড়লেন। জামাইকে ধরে আনলাম তোর বাবার কাছে। মঞ্জুর কদমবুসি করতে যতই এগুচ্ছে, তোর বাবা ততই পা টেনে নিচ্ছে। গোবরের ব্যাপারটা তাকে আপসেট করে রেখেছে। নতুন জামাই যাতে গোবরের ঘ্রাণ না পায় সে জন্যই তার পা লুকোবার চেষ্টা।

তোকে আর মঞ্জুরকে যখন আস্ত খাশির স্পেশাল ডিশে বসানো হলো সেখান থেকে বেশ খানিকটা তুলে এনে তোর বাবাকে এনে দিলাম। কয়েকবার না না বলেও শেষ পর্যন্ত ভালোই খেলেন। দু গ্লাস বোরহানিতে তো আর পেট ভরে না।

তোকেও দেখলাম কেমন বেহায়ার মতো খাচ্ছিস। নিজের বিয়ের খাবার এত খেতে আছে! আমাকে তো একবারও বললি না, ছোটমামা খাবে না? অবশ্য নিজের বিয়ের দিন কি আর এত কথা বলা যায়!

শেষ ব্যাচে বসলাম। রোস্ট পেলাম না। খাওয়া শেষ না-হতেই সাবান-চিলুমচি হাতে একজন হাজির। পাঁচ টাকা দিয়ে তবে নিষ্কৃতি।

তোর বিয়ের দিন আবহাওয়াটা ভালো ছিল না। কত নম্বর সিগন্যালও ছিল—পাঁচ না দশ মনে নেই। বিয়ের জন্য তুইও ক্ষেপাটে হয়ে আছিস। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল। দুপুরের পর দমকা বাতাস। বিয়ের প্যান্ডেলটা করা হয়েছে একটা খোলা মাঠে। ঝড়ো বাতাসে সামিয়ানার খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে। তোকে তাড়াতাড়ি বরের সাথে গাড়িতে তুলে দিতে হবে।

শেষ মুহূর্তে তুই একটুখানি কেঁদেছিলি। বিয়ের দিন মেয়েদের একটু কাঁদতে হয়।

গাড়িতে তুলে দেবার ঠিক আগের মুহূর্তে তোকে আদর করতে ইচ্ছে করছিল। সাহস পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল মঞ্জুর ছোকরাটা বোধহয় বলছে, ছোটমামা, দিস ফার এন্ড নো ফারদার। আর মামাগিরি ফলাতে হবে না।

শোন, তোর বাবার চিঠির ভেতরে তোর মার একটা ছোট্ট চিরকুটও ছিল—‘তোমরা সকলে মিলিয়া মেয়েটার এতবড় সর্বনাশ করিয়াছো। তাহার দিকে তাকাইতে পারি না। দোয়া করিও যেখানেই থাকুক জামাই যেন ফিরিয়া আসে।’ আমার বিশ্বাসের ভিত বড়ো নড়বড়ে। আমার দোয়াতে কাজ হবে না। তবুও আমার মনে হয় মঞ্জুর তোর কাছে ফিরে আসবে। ফিরতেই হবে তাকে। তোর বাবাকে আমাদের জন্য দোয়া করতে বলিস।
এবার যখন চিল্লায় যাবে একটু মনে করিয়ে দিস আমার কথা। তোর বাবার দোয়া আল্লাহ কবুল করতেও পারেন। একরোখা টাইপের মানুষের দোয়া কবুল হয় কিনা কে জানে।

জুনায়েদ আলী খানের কথা তোর মনে আছে? সিক্সটি সেভেনে তোদের বাসায় একবার নিয়ে গিয়েছিলাম। মানে নাইনটিন সিক্সটি সেভেনে। তোদের জন্য বড় টিনের কৌটোভর্তি মিল্কি চকোলেট এনেছিল। তোর বাবা চকোলেটে কামড় দিয়েই, ওয়াক থু, তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন, এতে শূকরের দুগ্ধ মেশানো আছে, ওটা হারাম। তোর মা-ও দু একটা খেয়ে বলল, তাই তো, আমারও কেমন যেন লাগছে। তোর বাবা কি আগে কখনো শূকরের দুগ্ধ খেয়েছেন যে চকোলেট মুখে দিয়েই বুঝে ফেললেন? এটা আর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো না। হারাম চকোলেট আনার অপবাদ নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হলো। খুব একটা খাতির-যত্ন পেল না।

জুনায়েদ আলী খান লিভার ব্রাদার্সে আমার সিনিয়র সহকর্মী। তাজমহল রোডে নিজের টাকায় কেনা একটা ছোট্ট দোতলা বাড়িতে থাকত। সরকার এটাকে অ্যাবান্ডেড প্রপার্টি ঘোষণা করেছে। বাড়িটার শেষ পর্যন্ত কী হবে আমি জানি না। দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করিস। এ বাড়িটার ওপর জুনায়েদের মেয়েদের দাবি থাকা অসঙ্গত হবে না। একাত্তরের প্রথমদিকেই জুনায়েদ ঢাকার পাট চুকিয়ে পেশোয়ার চলে যায়। সাথে নিঘাত, ওর বউ এবং দুটো মেয়ে নওশিন ও নওরিন। জুলাইতে পারিবারিক গোলযোগে গুলিবিদ্ধ হয়ে জুনায়েদ মারা যায়। খবরটা নিঘাতের কাছ থেকে পাবার আগেই লিভার ব্রাদার্সের এক কলিগ আমাকে জানায়। তাজমহল রোডে জুনায়েদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যাওয়া-আসা করতে করতে নিঘাতের সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জুনায়েদের সাথে শেষদিকে আমার সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। যুদ্ধ চলছিল। মুক্তিযোদ্ধা হবার মতো সাহস বা দেশপ্রেম কোনোটাই আমার ছিল না। বরং ছেলেবেলাটা পশ্চিম পাকিস্তানে কাটানোর কারণে তাদের সাথেই যোগাযোগটা ছিল বেশি। নিঘাতের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার কাছে বেশি জরুরি মনে হয়েছে। হাবিব ব্যাংকে একটা চাকরিও হয়ে যায়। বাহাত্তরে নিঘাতকে বিয়ে করি। বিয়েটা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। জুনায়েদের আত্মীয়রা আমাকে মারতে এসেছিল। নিঘাত তাদের লিখিত দিয়েছে জুনায়েদের সম্পত্তিতে তার কোনো দাবি নেই। নওশিন ও নওরিন কী মনে করেছে জানি না। তবে প্রথমদিকে আমারই মনে হয়েছে আমি ওদের বাবার গোপন ঘাতক। এমন একটা কিছু ঘটুক হয়তো আমিই চেয়েছিলাম। নিঘাত ও আমার একটা মেয়ে হয়েছে, নাম সাভেরা। মানে জানিস তো? সাভেরা হচ্ছে প্রভাত, জাগো হুয়া সাভেরা নামে একটা সিনেমা আছে, খান আতার। এখন আমাদের তিনটি মেয়ে নওশিন দশ, নওরিন চার ও সাভেরা এক বছর। আমি তো আর আটকেপড়া বাঙালি নই। আমি নিজেই নিজেকে আটকেছি। আমি আর ফিরতে চাই না। নিঘাত জুনায়েদের বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়গুলো একত্র করেছে, আমারও কিছু আছে। আমরা দূরে কোথাও মাইগ্রেট করব। নিঘাতের উদ্যোগের কোনো শেষ নেই। মেয়ে তিনটিকে তো মানুষ করতে হবে।

তোদের বিয়েতে কতো খাটলাম। তোর বাবা ভাবলেন আমার ষড়যন্ত্র। তোর মা কী ভাবল কে জানে। কেন যেন আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে মঞ্জুর ছেলেটা আমাকে পছন্দ করছে না। না করুক। তবুও, আমি চাই, আমার চিঠি তোর কাছে পৌঁছার আগেই যেন ছেলেটা ফিরে আসে।

তোর কাছে আগেও লিখতে চেয়েছি। হয়ে ওঠেনি। আজ নিজেকে বাধ্য করলাম। আজ নভেম্বরের বারো তারিখ। তোর বিয়ের দিন।

- ছোটমামা / নভেম্বর ১২, ১৯৭৩।

দুই.

ছোটমামা,
বহু বছর পর তোমার চিঠির জবাব দিতে বসেছি। শেষ পর্যন্ত হয়তো লেখা হবে, পোস্ট করা হবে না। আমার অনেক চিঠিই পোস্ট করা হয় না। কোনো না-কোনো বইয়ের ভেতর রেখে দিই—আর এটাকেই আমরা বলি বুকপোস্ট। বুকপোস্ট করা চিঠি সহজে হারায় না, প্রেরক বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যায়।

তোমার চিঠি আমার একটুও ভালো লাগেনি। এজন্য বারবার পড়িনি। তুমিও আমার ইমম্যাচুরও বান্ধবীদের মতো আশ্বাস দিয়েছো, দেখিস ফিরে আসবে।

কেমন করে ফিরবে? ও, তো নেই।

আমাকে নিয়ে যা যা লিখেছো দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছে হয়নি। তবে তোমার মেয়েদের কথা পড়েছি। নওশিন, নওরিন এবং সাভেরা। মনে মনে তোমার সংসারের ছবি এঁকেছি। সাভেরা কি বাংলা জানে?

কক্সবাজারে হানিমুনের একটা স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছিলে। ওখানকার সেকেন্ড অফিসার নাকি তোমার ক্লাসমেট। এসডিও সাহেবও পরিচিত। বলেছিলে হিলটপ সার্কিট হাউসে থাকতে দেবে। স্পিডবোটে মহেশখালী ঘুরিয়ে আনবে, মাথিনের কূপ দেখাতে টেকনাফ নিয়ে যাবে। পাহাড়ের উপর সার্কিট হাউস। দরজা খুললেই সমুদ্র। মধ্যরাতে সমুদ্রের গর্জনে ঘুম ভেঙে যাবে।

হানিমুনটা হলো না। আমার বিয়ের রাতেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। এত বড় জলোচ্ছ্বাস আর হয়নি। মঞ্জুর বলল, মানুষের লাশের পাশে হানিমুন হতে পারে না। ঠিকই।

একাত্তরে দেশজুড়ে এত যে ঘটনা ঘটে চলছিল, মঞ্জুর কোনোটাই গায়ে মাখেনি। খুব নির্বিকার। কোনো কোনো দিন পাকিস্তানি অত্যাচারের ভয়াবহ কাহিনী আমিই শুনিয়েছি। কতটা তার কানে ঢুকেছে কে জানে। বরং আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, আরে ধ্যাৎ ওসব রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ইউনিভার্সিটিতে ওর চাকরিটা হয় হয় করেছে। আমাকে যখন বিয়ে করল তার বেশ আগেই কলেজেরটা ধরেছে। দিনরাত খেটেখুটে এমফিলের ডিসার্টেশন তৈরি করছে। ইউনিভার্সিটিতে নিতে দেরি হচ্ছে দেখে জি সি দেবই কলেজেরটা ধরতে বলেছিলেন, সাথে এমফিলটাও।

জুলাই পর্যন্ত আমরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ভাড়া বাসাতেই ছিলাম। তিরিশ তারিখে মঞ্জুর বইপুস্তক বাক্স-পেটরা গুছিয়ে আমাকে আমাদের বাসায় রেখে গেল। বলল, ইন্ডিয়া যাচ্ছি। ট্রেনিং নিয়ে শিগগির ফিরব।

ওর সব বইপুস্তক আর আমার বিয়েতে তোমার দেওয়া ফ্রিজটা আমার রুমে রাখলাম, ফার্নিচারগুলো বাইরের ঘরটাতে। তুমি ভাগ্নির বিয়েতে ফ্রিজ দিয়েছো শুনে আমার বান্ধবীরা বলেছে, তুমি নিশ্চয়ই মিলিয়নিয়ার।

তিরিশ তারিখ রাতে মঞ্জুর আমার সাথে থাকেনি। কোথায় ছিল বলেনি। একত্রিশের রাতটা একসাথেই। আমাদের বাসাতে। রাতভর খুব ছটফট করল। আমি একটু বেশি করে আদর করতে চেষ্টা করলাম। মঞ্জুর কেঁদে ফেলল। বলল, ওর মার কথা মনে পড়ছে। ওদিকে বাবার মেজাজ বিগড়ে আছে। মাকে বলেছে, নাস্তিকটা বুঝি চাকরি খুইয়েছে? আগেই বলেছিলাম।

ঢাকা শহরের অবস্থা থমথমে। আমার চারটি ভাইবোন লেখাপড়া বন্ধ করে বসে আছে। বাবার এলপিআর শুরু চুয়াত্তরের মে-র এক তারিখ থেকে। তারপর সংসার কেমন করে চলবে এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাসায় একটা সেমিনারের মতো ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। বাবা রাত দশটার পর আলো নিভিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। পয়সা তো আর গাছে ধরে না। আসলেই সংসার কে চালাবে?

সকালে মঞ্জুর একটা চেকবইয়ের ন’টা পাতায় ফাতেমা আকতার খানম লিখে টাকার জায়গাটা খালি রেখে সই করে বইটা আমার হাতে তুলে দিল। বলল, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কটা তো চেনো, ফার্মগেইট। হাজার পনের টাকা জমা আছে। যখন যা লাগে তুলে নিও। তোমার বাবার কাছে চাইতে যেও না।

তারপর খুব তড়িঘড়ি করে একটা অসমাপ্ত চুমো দিয়ে মঞ্জুর রাস্তায় বের হয়ে পড়ল। কিছু বলতেও পারলাম না। সাবধানে থেকো এ কথাটাও না।

তা কদিন পরই বাবাকে একা বাসায় রেখে আমরা মেঘনা পাড়ি দিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম। মঞ্জুরকে জানাতে পারলাম না। ঠিকানা জানি না যে। কোথায় লিখব। ডিসেম্বর ষোল তারিখে দেশ স্বাধীন হলো। আমরা একুশ তারিখে ঢাকা ফিরে এলাম। এ মাসেরই গোড়ার দিকে আমাদের বাসাটা লুট হয়ে গেল। বাবাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছিল। সাদাকালো টেলিভিশন থেকে শুরু করে কোরআন শরীফের রেহেল পর্যন্ত সব নিয়েছে। নেয়নি বইপত্রগুলো আর তোমার দেওয়া বিশালাকার ফ্রিজ। দু জনকে বাবা চিনতে পেরেছে। ওরা বাবাকে খুব মেরেছে, একজন খুব জোরে বাবার অণ্ডকোষ চেপে ধরেছিল। কথাটা মনে হলে বাবা আতকে উঠলেও মার খাওয়ার ব্যাপারগুলো বাবা পরে আর স্বীকার করত না। বাবার চেনা সেই দুজনের একজন নাকি পরে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

ছোটমামা, ঢাকায় ফিরে তো এলাম। কিন্তু আমার মুক্তিযোদ্ধা কোথায়? আমার স্বামী ফিরল না কেন? স্বাধীনতা দিয়ে আমার কী হবে?

চার বছর ধরে খুঁজেছি, পাইনি। প্রতিদিন প্রতিরাত অপেক্ষা করেছি, আসেনি। ও নাকি নভেম্বরেই বাংলাদেশে ঢুকেছে। সাথে অনেক এম্যুনেশনও ছিল। তাহলে কোথায় গেল? বছর তিনেকের মাথায় বাবা বলল, ওসব ছেলে ছোকরার বিশ্বাস কী? বিয়েশাদি করে কোলকাতার কোথাও ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। আগেই বলেছিলাম, ছেলেটা ভালো না।
কী জানি হতেও পারে।

ছোটমামা, শেষ পর্যন্ত তোমার খোঁজ পেলাম। তুমি লন্ডনের বাইরে এপিং ফরেস্টের কাছে থাকো। তোমার মেয়েরা স্টেটসে। সাভেরা মাইক্রোসফট কোম্পানিতে কাজ করে। মামী মারা যাবার পর তুমি একটি গুজরাটি মেয়েকে বিয়ে করেছো। তোমার দুটো বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে। নিষেধ অমান্য করে তুমি এলকোহলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছো। তোমার বউভাগ্য খুব ভালো। গুজরাটি মামী নাকি একটি বড় বিউটি পার্লার চালাচ্ছে। তোমার মেয়েদের সাথেও তার সম্পর্ক খুব ভালো। এসব খবর এনে দিয়েছে আমার স্বামী সৈয়দ শরাফত উল্লাহ। তুমি কেমন আছো আমার খুব জানতে ইচ্ছে করত। আমাকে খুশি করার জন্য আমার স্বামী এতটা কষ্ট করেছে। বুশ হাউজে ওর এক বন্ধু বিবিসিতে পার্টটাইম কাজ করে। তোমাদের চেনে। তার কাছ থেকেই এসব খবর উদ্ধার করেছে।

আমার বিয়ের খবর হয়তো-বা তুমি পেয়ে থাকবে। একসময় মনে হয়েছে আমার সম্পর্কে তোমার কোনো আগ্রহ নেই। এক ধরনের অভিমান থেকে আমিও তোমাকে মুছে ফেলতে চেয়েছি আমার মন থেকে।

মঞ্জুরের জন্য যত কষ্টই লাগুক, সত্যকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার বরাবরই ছিল। রাতের পর রাত কেঁদেছি। এখনো যে কান্না আসে না এমন নয়। কিন্তু এখন ওকে খুব দূরের মানুষ মনে হয়। অন্য গ্রহের। মঞ্জুর বেঁচে থাক বা না-ই থাক, আমি ওকে হারিয়েছি একাত্তরের আগস্টের প্রথম দিনে। ঠিক তার পাঁচ বছর সাতাশ দিন পর ছিয়াত্তরের আঠাশে আগস্ট আমার বস সৈয়দ শরাফত সাহেবকে বিয়ে করেছি। শরাফত সাহেবের বয়স তখন চল্লিশ হবে। তোমার চেয়েও পাঁচ বছরের বড়। আমার কত?

সাতাশ কি আঠাশ। নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তিয়াত্তরে নামকাওয়াস্তে একটা ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বিটিএমসিতে একটা চাকরি পেয়ে যাই। চাকরিটারও দরকার ছিল।

চাকরিতে ঢোকার তিন মাসের মাথায় আমার বিরুদ্ধে একটা তদন্ত হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা শরাফত সাহেব। অভিযোগ হচ্ছে, আমি প্রতারণা করে চাকরি নিয়েছি। আমার স্বামী নিখোঁজ নয়। প্রায়ই রাতে আমার কাছে আসে, সকালে চলে যায়। কোনো কোনো রোববারে আমাদের দুজনকে মধুমিতা ও বলাকায় দেখা যায়। অভিযোগকারী হিসেবে পাঁচজনের নাম এবং স্বাক্ষর ছিল। আমি তাদের কাউকে চিনি না। বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের নির্দেশ এসেছে।

শরাফত সাহেব বললেন, অভিযোগ প্রসঙ্গে আপনার কিছু বলার থাকতে পারে। বলতে পারেন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার চারপাশের সব ঝাপসা হয়ে আসছিল। বললাম, স্যার অভিযোগটি যেন সত্য হয়। আমার স্বামীকে পেলে চাকরি লাগবে না। ওরা হয়তো জানে আমার স্বামী কোথায়। আমি তাকেই চাই। শরাফত সাহেব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে কী লিখেছেন জানি না। আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। তারপর আরো বছর তিনেক পার হলো। শরাফত সাহেব একদিন তার রুমে ডাকলেন।
স্যার, ডেকেছেন?
হ্যাঁ, বসুন।
তারপর এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন, ফাতেমা আকতার, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
জ্বি স্যার, বিয়ে করা ভালো।
থ্যাঙ্ক ইউ।
কিছুক্ষণ একটা পেপারওয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, ফাতেমা আপনার আপত্তি না-থাকলে আমি আপনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে চাই।
থাঙ্ক ইউ, স্যার। আপনি আমার সম্পর্কে তেমন জানেন না। আমার হাজব্যান্ড আছে এ কে এম মঞ্জুর। খুব ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করার কথা হচ্ছিল। একাত্তরের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে।
আমি জানি। তিনি ফিরে আসেননি।
জ্বি স্যার, হয়তো তার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি।
ফাতেমা, আপনার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান অনেক। এটাকে যদি আমার অযোগ্যতা মনে না-করেন, আমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে পারেন।
আচ্ছা স্যার।
থ্যাঙ্ক ইউ।
স্যার, খুলনার টেক্সটাইল মিলটা প্রাইভেট সেক্টরে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড কিছু তথ্য চেয়েছে। চিঠিটা তৈরি করে আনছি।
আমরা প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডকে সরাসরি লিখব না। আমরা মিনিস্ট্রিকে দেব। ওরা জানাবে।
স্যার আসি।
জ্বি, আপনার সাথে আমার অপ্রাসঙ্গিক আলাপটুকু নিয়ে যদি কারো সাথে আলাপ না- করেন খুশি হব। আপনার জবাব পেয়ে গেছি। একটুও ভাববেন না, এসিআর-এ এর কোনো রিফ্লেকশন হবে না। আপনাকে আসতে হবে না। ড্রাফটসহ ফাইলটা পাঠিয়ে দেবেন।
জ্বি স্যার।

তিনি আগাগোড়া পেপারওয়েট কিংবা ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। একবারও আমার সাথে তার চোখাচোখি হয়নি। সরকারি কাজের বাইরে এটুকুই আলাপ। বাহাত্তরের জুনেই মা আমাকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কত কথা—মেয়েদের শরীর। আর পাঁচ বছর পর কেউ তো চোখ তুলেও তাকাবে না। শরীরটা থাকতে থাকতে একটা ভালো ছেলে ধরতে হবে। আমার শরীরটা কি কেবল ছেলে ধরার জন্যেই?

নিজের টেবিলে ফিরে এলাম। অনেকদিন পর খুব ভালো লাগল। চোখ ঠেলে কান্না আসতে চাইল। বাথরুমে কতক্ষণ কাঁদলাম। মনে মনে স্যারের সাথে কথা বললাম।
স্যার, আমার ডাকনাম কী জানেন?
জ্বি না।
স্যার, আমার ডাকনাম চন্দনা, ছোট্ট পাখি চন্দনা। আমার ছোটমামার রাখা নাম। মঞ্জুর চন্দনা বলে ডাকত। আমি তো দেখতে ছোটখাটো। আমার তুলনায় মঞ্জুর তো গালিভার। ওর পাশে আমাকে বোধহয় তেমন মানাত না। মঞ্জুরই গুনগুন করত, ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা।

টেবিলে ফিরে এসে ড্রাফটটা রেডি করলাম। স্যারের বিষয়ে আমাদের কারোই তেমন জানা নেই। বছর দশেক আগে বিয়ে করেছিলেন, প্রথম বছরেই বউ স্যারের এক স্থপতি বন্ধুর হাত ধরে চলে গেছে। স্ত্রী যখন চলে যাচ্ছে, তখন তাকে উইশ করেছেন, তার নেক্সট বার্থ ডে-র জন্যে একটা আগাম উপহারও দিয়েছেন। বলেছেন, তোমার জন্মদিনে আমার যাওয়াটা অনেকেই ভালো চোখে দেখবে না। এটা রেখে দাও। অল দ্য বেস্ট।

এসব তো আর আমি স্যারকে বলতে শুনিনি। অফিসের লোকজন এ নিয়ে খোশগল্প করেছে। দু চার মাসে একবার তার রুমে ডাক পড়ে। ফাইলটা হাতে নিয়ে বিকেল চারটায় আবার গেলাম তার রুমে। একদিনে দুবার। চোখ খানিকটা তুলে ধমকে উঠলেন, আপনাকে ফাইল পাঠাতে বলেছি। ফাইলসহ আসতে বলিনি।
এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে থাকলাম, স্যার আমি রাজি।
কী রাজি? কণ্ঠে আরো ধমকের ঝাঁজ।
স্যার, আপনি চাইলে আমি আপনাকে বিয়ে করব।
আরো গম্ভীর এবং আরো নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে ম্যাচুরড কোনো সিদ্ধান্ত আসে না। পাঁচ-সাত দিন কি একমাস সময় নিন। ভালো-মন্দ বিবেচনা করুন। লোক লাগিয়ে আমার সম্পর্কে আরো জানুন। আই এম নট ইন এ হারি। তাছাড়া আমি চাইলে আপনি রাজি? আপনার নিজের কোনো চাওয়া নেই? আমি হায়ারার্কিক্যাল পয়েন্ট থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপাতে চাই না। আপনি যখন চাইবেন কেবল তখনই হতে পারে। ড্রাফট কাল পাঠাবেন।

অপমানিত বোধ করলাম। ফাইলটা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে টেবিলে ফিরে এলাম। পাশের টেবিলের সানজিদা আপা জিজ্ঞেস করলেন, শরাফত সাহেব বকেছেন?
জ্বি, আমার ড্রাফটটা টু দ্য পয়েন্ট হয়নি।
ডোন্ট বি ডিজহার্টেন্ড। ওর বারোটা বাজল বলে। ইউনিয়ন ওর ওপর ক্ষেপে আছে। ওরা মন্ত্রী ও সেক্রেটারিকে ওর নামে যাচ্ছেতাই বলে এসেছে। ব্যাটা এবার শিক্ষা পাবে। মুরোদ নেই নিজের বউ ধরে রাখার। ইম্পেটেন্ট কোথাকার।

তিনটি দিন কোনো রকমে পার করলাম। প্রতিদিন ভেবেছি ডাক পড়বে। চার দিনের দিন নিজের ভেতরেই ভেঙে পড়লাম। সেই সাথে জ্বর, মাথাব্যথা। অফিস কামাই গেল আরো পাঁচ দিন। অসুস্থতার কথা বলে ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছি। খুব স্পষ্ট করে দরখাস্তের একপাশে বাসার ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বরও দিয়েছি। দরখাস্ত তাকেই সম্বোধন করে লেখা। অবচেতনে আমি বোধহয় চাইছিলাম তিনি একটা ফোন করবেন, কেমন আছি জানতে বাসায় আসবেন। কিছুই হলো না। উপেক্ষিত বোধ করার কষ্টটা ভীষণ। সেই কষ্টটাই আমাকে সহ্য করতে হলো। এরপর আরো দু মাস। তিনি অফিসে আসা বন্ধ করে দিলেন। শুনলাম চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। চাকরি ছাড়া নিয়ে ইউনিয়ন রটাল, শালাকে বাধ্য করেছি। সানজিদা আপা বললেন, শুনেছো টি গার্ডেনের মালিকের স্ত্রীর সাথে নাকি ধুমছে চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, আপনি যে বলছেন ইম্পেটেন্ট।
এর মধ্যেই আকস্মিকভাবে পিএবিএক্স লাইনে ফোনটা এলো, ফাতেমা আমি শরাফত।
জ্বি স্যার, ভালো আছেন।
ভালো। তুমি কেমন আছো?
তার কণ্ঠে ‘তুমি’ শুনে আমি ফোনে কিছু একটা ফিরে পেলাম।
ভালো স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।
শোনো ফাতেমা, তোমার বিশেষ কোনো অসুবিধা না-থাকলে কালই তোমাকে বিয়ে করব। তিনদিনের একটা ছুটির দরখাস্ত অফিসে ফেলে এসো। আমি সন্ধ্যায় তোমাকে বাসা থেকে তুলে নেব। ঠিকানা, ফোন নম্বর সব জানি। অসুবিধে হবে না। ছুটির তিনদিন আর লাগোয়া শুক্র-শনি মিলে পাঁচ দিন যথেষ্ট, কী বলো?
জ্বি স্যার, যথেষ্ট।
নতুন কিছু কিনতে যেও না। আমি সব ব্যবস্থা করেছি। খুব ঘটা করে বিয়ে করার বয়স তো নেই।
জ্বি স্যার।
ধমকে উঠলেন তিনি, এত স্যার স্যার করছো কেন? বিয়ের পরও স্যার বলবে নাকি?
এইবার আমি হেসে ফেললাম, জ্বি না স্যার।

পরদিন তিনি আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন তার এপার্টমেন্টে, ইন্দিরা রোডে। বললেন, ফাতেমা এটা তোমার বাড়ি। লাল কাতান শাড়ি ও অলংকার এগিয়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হও। নিজেই নিজেকে বউ সাজালাম। কাজী সাহেব এলেন। শরাফতের কয়েকজন বন্ধুও। বললাম, কবুল। তারপর কাবিননামায় সই করলাম। ওতে কী লেখা পড়েও দেখিনি। দরকারও নেই। আটটার মধ্যে সব সেরে শরাফতকে নিয়ে লাল কাতানে বাড়ি ফেরা। আমাকে বউ সাজে দেখে আমার ভাই-বোনরা থ। শরাফত বাবা ও মাকে সালাম করল। বলল, আমাকে মাফ করবেন। ফাতেমার কোনো দোষ নেই। আমিই বাধ্য করেছি। চলুন একটু ডাল ভাত খেয়ে আসি।

বাবা প্রেসারের দোহাই দিলেন, মা হাউমাউ করে কাঁদলেন।

আমরা পাঁচ ভাই-বোন এবং শরাফত তার গাড়িতে সোজা ব্লু বেল নামের একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয়। শরাফতের বন্ধুরাও ছিল। আমার সবচেয়ে ছোটবোন শাপলা কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল, এই মটুটাকে কোথায় পেলি? এটাকে দুলাভাই ডাকলে মানাবে না। ছোট খালুজান ডাকা যেতে পারে।

একসাথে এত দামি খাবার আমরা ভাই-বোনেরা পাইনি। খেতে খেতে শরাফত সবার সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলল। বিয়ে নিয়ে একটা এবং খাবার নিয়ে একটা জোকও বলল। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে সবাইকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে মাকে সালাম করে এবং বাবাকে কিছু না-বলে ফিরে এলাম ইন্দিরা রোডে শরাফত ও আমার এপার্টমেন্টে। রাতভর তার সাথে কথা বললাম। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অনেক টাকা বেতন। শরাফত বলল, কাল আমরা হানিমুনে কাঠমান্ডু যাচ্ছি।
কাঠমান্ডু ! আমি ভেবেছি কক্সবাজার।

স্বপ্নের মধ্যে কদিন কেটে গেল। উনিশশ ছিয়াত্তর। আমিও চাকরিটা ছেড়ে দিই বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে। শরাফতের কথায় এক্সটার্নাল হিসেবে এমএটাও পাশ করি। শেষ পর্যন্ত আবার একটা এনজিওতে। আমরা রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সেক্টরে কাজ করি।

টি গার্ডেনের ম্যানেজার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের কিংবা ইম্পেটেন্ট হবার কোনো লক্ষণ আমার স্বামীর নেই। আমার মেয়ে অথৈ এখন একুশ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়ছে আর তরঙ্গ, আমার ছেলে, ড্রাগ এডিক্ট, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিও আছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। মেয়ে ও ছেলের এসব সামুদ্রিক নাম মঞ্জুরের কাছ থেকে পাওয়া। সত্তরের বারোই নভেম্বর বিয়ে, ডিসেম্বর না-যেতেই ছেলে-মেয়ের নাম পাকা করে বসে আছে। এসব নামের উৎস শরাফতকে কখনো বলিনি। বলাটা কি ঠিক হতো?

ছিয়াশিতে বাবা মারা গেল। মৃত্যুর দুদিন আগে বাবার মাথায় হাত রাখতেই বিড়বিড় করে বলল, আমার মন বলছে নাস্তিকটা মরেনি। ছোটমামা, সত্যি বলছি, মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় বাবার কথাই ঠিক। ও মরেনি। ওর যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ঠিকই ফিরত।

- তোমার চন্দনা।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;