আল মাহমুদ, প্রেমবাদ ও ইমাম খোমেনি



সৈয়দ তারিক
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

এ লেখার একটি মজাদার আপতিক কারণ রয়েছে।
আমার অনুজাপ্রতিম কবিবন্ধু নভেরা হোসেন সেলফোনে বললেন, ‘তারিক ভাই, বইমেলায় গিয়ে আপনার বই কিনলাম। পরে দেখি যে, ওপরে আপনার বইয়ের কভার, ভেতরে আল মাহমুদের কবিতা।’ আমি খুব কৌতুক বোধ করলাম। কবি আল মাহমুদের সঙ্গে এক প্রকার আধিদৈবিক আত্মীয়তার বিরল আস্বাদ পেলাম যেন। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো অবিরল পাপড়ি মেলতে থাকল।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তখন নিতান্ত যুবক। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ নিয়ে একটা আলোচনা লিখেছিলাম ‘একবিংশ’ পত্রিকায়। তিনি লেখাটির প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তখন শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করেন। মাঝে মধ্যেই চলে যেতাম তার দপ্তরে। চা খাওয়াতেন। বেনসন অ্যান্ড হেজেসের প্যাকেট খুলে দিতেন। আর, অনর্গল কথা বলতেন সাহিত্য নিয়ে, তার কবিবন্ধুদের নিয়ে, তার জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে এবং ধর্ম নিয়ে। তার রচনার মতো তার কণ্ঠেও উত্তাপ আছে। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ—এ দুটি নাম প্রায়ই একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। সব তুলনাই সরলীকরণ ও বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবু বলা যায়, শামসুর রাহমানের কবিতার মতো ব্যক্তি শামসুর রাহমানও তুলনামূলকভাবে অধিকতর নাগরিক ও বিদগ্ধ এবং আল মাহমুদের কবিতার মতো ব্যক্তি আল মাহমুদও অধিকতর লোকায়ত ও ভাবপ্রবণ। এ দুই কবি—যারা এককালে বন্ধু ছিলেন, একসময় পরস্পর বিপরীত অবস্থানে চলে যান। আল মাহমুদ সে-বিষয় নিয়েও নানারকম কথা বলতেন। অনেকটা সময় পার হলে তারপর উঠতে চাইলেও উঠতে দিতেন না। সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতেন—‘বসো, সিগারেট খাও।’ কোনো-কোনো দিন অফিসের সময় শেষ হয়ে যেত। উনি উঠতেন। বলতেন, ‘আজ গাড়িতে যাব না। চলো হাঁটি।’ তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে মগবাজারের দিকে চলে যেতাম। তিনি তখন ওই এলাকার মীরবাগে থাকতেন। গল্প করতে করতে দুপুরের রোদ ভেঙে আমরা চলতে থাকতাম।

একদিন তার বাসায় গেলাম বিকেলে। গল্প হলো। চা-নাশতা খাওয়া হলো। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি একটু বাজারে যাব। তুমি বসতেও পারো, আমার সঙ্গে আসতেও পারো।’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই সঙ্গে যাব। কবির বাজার করা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না।’ তিনি বাজার করলেন। শাকসবজি, বড়-বড় চিংড়ি মাছ এবং গরুর গোস্ত কিনলেন। বাজার শেষ হলে বললেন, ‘চলো, আরো গল্প করা যাক।’ আবার গেলাম তার বাসায়। একসময় উঠতে চাইলে বললেন, ‘না, এখন যেতে পারবে না। রান্না হচ্ছে, খেয়ে তারপর যাবে।’ সেদিন তার সঙ্গে ভূরিভোজ করতে হয়েছিল।

অনেকদিন হলো সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ। শ্রদ্ধেয় কবি আল মাহমুদের সঙ্গেও দেড় দশকের বেশি কাল ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। তার লেখাও পড়া হয় না বহুদিন। এমনই সময়ে নভেরা নস্টালজিয়ার উপলক্ষ দিল আমাকে। 

২.
সে বছর (২০০৯) বইমেলায় আমার একটি কবিতার বই বের হয়েছে। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে সেটা। বইটির নাম ‘মগ্ন তখন মোরাকাবায়’। সৈয়দ মুজতবা আলীর দৃষ্টান্তে আমি মাঝে মধ্যে বইটি কিনি একে-ওকে-তাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ও রকম কিনতে গিয়ে আমার হাতেও পড়ল একটা কপি, যার প্রচ্ছদে ‘মগ্ন তখন মোরাকাবায়’ আর ভেতরে আল মাহমুদের ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’। বাঁধাইখানার নিতান্ত বিভ্রাট। তবু এরই ফলে অনেকদিন পর আল মাহমুদের কবিতা (আবার) পড়ার সুযোগ পাওয়া গেল।

কবিরা প্রায় সবাই প্রেমের কবিতা লেখেন। যদি কেউ বলেন যে, সব কবিতাই প্রেমের কবিতা, তা-ও অবশ্যই মান্য। প্রেমই জন্মস্থান, সৃষ্টির আঁতুরঘর। ঘৃণা বা দ্রোহ তো প্রেমেরই বিপরীত প্রকাশ, সৌন্দর্য তো প্রেমেরই অলঙ্কার। তারপরও কিছু কিছু কবিতা বিশেষভাবেই প্রেমের কবিতার তিলক কপালে আঁকে। প্রেমের কবিতার বিশেষ সঙ্কলন হয়।

প্রেম কী?

প্রেম হচ্ছে দুটি সত্তার মধ্যে আত্যন্তিক আকর্ষণ—যে আকর্ষণ বিশ্বজাগতিক প্রধান সত্য। যে চারটি বল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কাজ করে (অভিকর্ষ, তড়িৎ-চৌম্বক বল, স্ট্রং ফোর্স ও উইক ফোর্স) তার সবই আকর্ষণমূলক। সবরকম ইতিবাচক মানবিক সম্পর্কের মধ্যেই ভালোবাসা আছে, তবু প্রেম বলতে প্রচলিতার্থে নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ বোঝায়। এর পেছনে দৈহিক প্রণোদনা নিশ্চয়ই একটি প্রধান নিয়ামক, তবু ভালোবাসা কেবল ভোগাকাঙ্ক্ষার মধ্যেই সীমিত নয়। দুটি সত্তার ঐক্য উপলব্ধির অভিপ্রায় নিহিত থাকে এর মধ্যে। দুটি মানুষ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে জীবনযাপন করতে চায়। প্লেটোর প্রেমতত্ত্ব বলছে, মানুষরা আগে ছিল পরস্পর সংযুক্ত, দেবরাজ জিউস তার তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত করলেন তাদের। আর তাই নিজের বাকি আধখানাকে ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষ অন্যকে ভালোবাসে। এর মধ্যে রূপক সত্য এই যে, মানুষ নিজের সত্তার অপূর্ণতাকে অনুভব করে এবং সেটিকে পূর্ণ করতে চায় অন্য একটি সত্তার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে। নর-নারীর প্রেমেই এর সাধারণ প্রকাশ। কিন্তু এখানে জাগতিক অর্থে চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার থাকে। পরস্পরের দেহভোগের আকাঙ্ক্ষা থাকে। পরস্পরের কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা পাওয়ার ব্যাপার থাকে। কিন্তু এই প্রেমের জন্যই মানুষ কী না করতে পারে! পরিত্যাগ করতে পারে জাগতিক সম্পদ ও সাফল্য, যেমন অষ্টম এডওয়ার্ড করেছিলেন সাম্রাজ্যত্যাগ। এই প্রেমেরই জন্য যুবকরা হয়ে ওঠে উন্মার্গী—লায়লীর প্রেমিক কায়েস যার দৃষ্টান্ত। এই প্রেমে পড়েই যুবকেরা কবি হয়ে ওঠে আর পৃথিবীর মানুষরা তাদের হৃদয়ের কথাগুলো শুনতে পায় অমর পঙক্তিমালায়।

কিন্তু এই সাধারণ ও সঙ্কীর্ণ সম্পর্কের বাইরে রয়েছে উচ্চতর ও গভীরতর প্রেমের আদর্শ, যেখানে সীমিত ব্যক্তিসত্তা পূর্ণসত্তার সঙ্গে প্রণয়ে ব্যাকুল। জালালউদ্দিন রুমির পবিত্র ‘মসনবি’র শুরুতেই এই ব্যাকুল কান্নার কথা আছে, বাঁশির মর্মবেদনায়। আপন সত্তার অপূর্ণতা যে অনুভব করে সে খোঁজে পূর্ণতাকে। এই পূর্ণসত্তাকে মানুষ দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে নানারকম নাম দেয়। মানুষ প্রথমত ইন্দ্রিয়নির্ভর। ইন্দ্রিয় তাকে বাহ্যবস্তুর দিকেই নিবিষ্ট রাখে এবং পূর্ণসত্তাকে সেই বাহ্যিক জগতের দূরতম অধিবাসী ধরে নেয়। কিন্তু গভীর অনুধ্যান তাকে শেখায় যে পূর্ণসত্তা ব্যক্তির চেতনার গভীরেই নিহিত। অপূর্ণ সত্তার নাম দেওয়া হয় ‘জীবাত্মা’, ‘নফ্স’, ‘কাঁচা আমি’, ‘ছোট আমি’ এবং পূর্ণ সত্তার অভিধা হলো ‘পরমাত্মা’, ‘রুহ’, ‘পাকা আমি’, ‘বড় আমি’ ইত্যাদি। এই অপূর্ণ সত্তার একমাত্র বাসনা আপন সত্তার সীমা অতিক্রম করে সত্তার পূর্ণতা লাভ করা। এই পূর্ণতা লাভ করার যে প্রক্রিয়া, দেশ-কাল-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন প্রভৃতির আপেক্ষিকতায় তার বিভিন্ন নাম হয়; কিন্তু মূলগতভাবে সবাই অভিন্ন দর্শনের অনুসারী। ইসলাম ধর্মের কাঠামোয় এ পদ্ধতির নাম সুফিবাদ বা ফকিরি বা তাসাউফ বা মারেফতপন্থা ইত্যাদি। এ পথচারিতার জন্য মুরশিদ বা গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরম সত্তার বাস্তব প্রতিভূ হিসেবে মুরশিদ বা গুরুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। অহম থেকে মুক্তির জন্য এটা খুবই দরকারি। মুরশিদের সঙ্গে এই সম্পর্ক প্রেমের নতুন তাৎপর্য দেয়।

আধ্যাত্মিক সাধকরা সাধনার অংশ হিসেবে এবং/অথবা ভাবধারা প্রকাশের লক্ষ্যে গানে ও কবিতায় যেসব বাণী রচনা করেছেন, তার মধ্যে প্রেম একটি প্রধান অনুষঙ্গ। ‘চর্যাপদ’-এ এক অন্ত্যজ রমণীর উল্লেখ রয়েছে ‘ডোমনি’, ‘চণ্ডালিনী’ ইত্যাদি নামে—যদিও তা আন্তরসত্তার রূপক বর্ণনা। বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধা ও কৃষ্ণের মিলন ও বিরহ এবং এর নানা অনুষঙ্গ বাঙালির হৃদয়ের কীর্তন। এই রাধাকৃষ্ণ জীবাত্মা বা নফ্স বা জৈবপ্রবৃত্তি এবং পরমাত্মা বা রুহ বা বিশুদ্ধ সত্তার প্রতীক। রোমান্স কাব্যগুলোতে প্রেমকাহিনীর রূপকে জীবাত্মার দিব্যাভিসারের কাহিনী আমরা পাঠ করি। পরম সত্তার প্রতি প্রণয়াকাঙ্ক্ষা মানুষকে সার্বিকভাবে মানবপ্রেমিক করে তোলে। কারণ সাধক জানেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এই প্রেমের বাণী আমরা শুনতে পাই কবিরের দোঁহায়, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইর কাব্যে, মীর তকি মীরের গজলে, মীরা বাঈয়ের ভজনে, আমির খসরুর কাওয়ালিতে। এই প্রেমের বাণী আমরা পাঠ করি জালালউদ্দিন রুমি, হাফিজ, জামি, সাদি, খৈয়ামের কাব্যে, ইকবালের দর্শনস্নিগ্ধ কবিতাবলিতে। এই প্রেমের বাণী আমরা হৃদয় মেলে শুনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম-ডি এল রায়-অতুল প্রসাদ-রজনীকান্ত সেনের অমর সঙ্গীতমালায়। এই প্রেমের বাণী আমরা শুনতে পাই ফকির লালন সাঁই ও হাছন রাজার মহৎ কালামগুলোতে। এই প্রেমে জাগতিক তুচ্ছতা থেকে আধ্যাত্মিক অপার সৌন্দর্যের হাতছানি; এই প্রেমে ব্যক্তির অহমকেন্দ্রিক ও ভোগলিপ্সু সঙ্কীর্ণ দুনিয়াদারির জীবন থেকে উদার, সর্বজনীন ও মহামানবিক দিব্য জীবনের আহ্বান—যে প্রেমের চর্যা দুনিয়াকেই স্বর্গে পরিণত করে। কবির আধ্যাত্মিক দর্শন থাকলে দেখা যায়, সাধারণ প্রেমের কবিতাতেই আধ্যাত্মিক সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। ‘গীতবিতান’-এর ‘প্রেম’ এবং ‘পূজা’ পর্যায়ের অনেক কবিতাই স্থানান্তরযোগ্য।

আল মাহমুদ—বেদনার বিষয়—সেই ধারার কবি নন। অথচ তারই ছিল সম্ভাবনা এই ধারার সার্থক কবি হওয়ার। সেই ১৯৭৪ সালে যখন ‘গণকণ্ঠ’ নিষিদ্ধ হলো এবং এই পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক আল মাহমুদ—যিনি ‘সোনালী কাবিন’-এর রচয়িতা—কারাবন্দি হলেন, তিনি একদিন ‘ইসলামি কবি’ হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে সান্নিধ্যের কালে তাকে বলতে শুনেছি, কেউ কেউ তার নামে অপপ্রচার করে যে, তিনি পেট্রোডলার পেয়ে ভোল পাল্টেছেন; কিন্তু সত্য হচ্ছে যে, তিনি জেলে থাকা অবস্থায় পবিত্র ‘কোরআন’ পাঠ করে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। ঘটনা হচ্ছে এই যে, সে সময় থেকে আজ অবধি যেসব ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে তার কুটুম্বতা তাদের ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বাহ্যিক আচরণিক দিক নিয়েই প্রধান কায়কারবার এবং এদের কোনো কোনো অংশ উদার মানবিকতা, সহনশীলতা ও সর্বজনীনতার বিপক্ষ শক্তিও বটে। নিশ্চয়ই পছন্দের এখতিয়ার তার ছিল এবং তা আসলে তার তকদির। তবু যদি তিনি ইসলামের অন্তরে নিহিত মৌল সত্য, সৌন্দর্য ও পদ্ধতির অনুসারী হতেন, যদি তিনি সুফিবাদকে একান্তভাবে গ্রহণ করতেন, তবে হয়তো বাংলা ভাষার একজন মহৎ মর্মবাদী কবিকে আমরা পেতাম এবং তার বাণী আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্রযাত্রায় সহযোগী কালাম হয়ে উঠত। কারণ সুফিবাদ শেখায় মানবপ্রেমই ধর্মের মৌল আচরণ, সুফিবাদ শেখায় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাই ধর্মের প্রধান শিক্ষা। বিশেষত, এই মৌলবাদী (ভাস্কর্যও এ দেশে ভেঙে ফেলা হয় ‘মূর্তি’ অপবাদ দিয়ে!), উগ্রবাদী (একে-ওকে-তাকে ‘মুরতাদ’ বা ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়ে কী নৈরাজ্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা!) ও জঙ্গিবাদী (কী ভয়ঙ্কর রক্তলোলুপ বীভৎসতা শান্তি ও আত্মসমর্পণের ধর্ম ইসলামের নামে!) অপতৎপরতার যুগে প্রেমবাদের চর্চা খুবই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তার ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’র মধ্যে নির্জনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ‘কৃষ্ণকীর্তন’ ও ‘নেকাব’-এর মতো কোনো-কোনো কবিতা এবং চমক দেয় সম্ভাবনার।

৩.
এ বইয়ে আল মাহমুদ অনূদিত কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনুবাদও সঙ্কলিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ‘গজল’ শীর্ষক কবিতা। কবিতাটি সুন্দর। সুফি ভাবধারায় লিখিত। এটি পড়লে মনেই হবে না যে, তিনি ইরানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সেই রাষ্ট্রবিধাতা। এটা পড়লে মনেই হবে না যে, এর রচয়িতা তিনি, যিনি সালমান রুশদি নামের লেখক একটি উপন্যাস লেখায় তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছিলেন লেখককে কেউ হত্যা করতে পারলে তাকে বিশাল অঙ্কের পারিতোষিক দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে। কোনো লেখা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে নিশ্চয়ই তার সমালোচনা করে অন্য লেখা তৈরি হতে পারে। কিন্তু কোনো লেখককে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা কী করে একজন ‘নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখাল্লা পরা’ লোক করতে পারে, তা বিস্ময়কর। কারণ সুফিবাদ প্রেমের, ধৈর্যের ও ক্ষমার পথ।

মুসলমানদের কোনো কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে সহনশীলতা খুবই কম। এরা কেউ কেউ বড় পীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানি, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি এবং আহমদ রেফায়িকে ‘খামসায়ে কাফেরে আকবর’ বা ‘পাঁচজন শ্রেষ্ঠ কাফের’ বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এরাই কেউ কেউ আল্লামা ইকবালকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। এরাই কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলামকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল (ইতিহাসের কী বিদ্রুপ, আজ তারাই কেউ কেউ নজরুলকে ‘নায়েবে রসুল’ বলে থাকে)। এসব ফতোয়ার কারণে ধর্মে জমেছে ক্লেদ, সভ্যতায় লেগেছে আঘাত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রুশদি রচিত ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনির ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু হয় ও দেশে দেশে নিষিদ্ধ হয় বইটি, তখন আমরা, বাংলাদেশের ২০ জন তরুণ লেখক-কবি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলাম। যার মূল বক্তব্য ছিল এই যে, কোনো সৃজনশীল লেখককে নিষিদ্ধ করা উচিত নয় এবং তাকে হত্যা করার নির্দেশ ও উৎসাহ সভ্যতাবিরোধী। এর ফলে আমরা এ-দেশি মৌলবাদীদের রোষের মুখে পড়েছিলাম।

আজ বলতে পারি, কোনো লেখকেরও উচিত নয়, যে-ব্যক্তিকে পৃথিবীর নানা স্তরের মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, তাকে সাহিত্যকর্মে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যা মানুষের মনে গুরুতর আঘাত করে। এটাও মানবিক সম্প্রীতির পরিপন্থী।

তারপরও জিজ্ঞাসা জাগে, এই হত্যার নির্দেশ দেওয়া তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব যিনি লিখতে পারেন :
‘মসজিদ আর মাদ্রাসার প্রতি আমি বেজার
আমি দেহ থেকে খুলে ফেলেছি খোদাভীতি
ও লোকদেখানো ধার্মিকতার পোশাক।
এবং পরে নিয়েছি নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখাল্লা, শালীন।
বকবাজ শহুরে মোল্লাদের উপদেশে আমি তিতিবিরক্ত।
আর সাহায্যটুকু তো মদাসক্ত মাতালের নিঃশ্বাস থেকেই আমি পেয়েছি।’

সংযোজন :

ওপরের লেখাটি তৈরি হয়েছিল ২০০৯ সালে। তারও কয়েক বছর পরে, ২০১৩ সালে, আল মাহমুদ-এর সাথে শেষবার দেখা হয়েছে ‘নতুনধারা’ সাহিত্য পত্রিকা আয়োজিত কবিতা পাঠের আসরে। বয়সের ভারে তিনি ক্লান্ত। তার সাথে করমর্দন করে বললাম, ‘মাহমুদ ভাই, আমি সৈয়দ তারিক।’ তিনি যেন কোনো সুদূর কালের অন্তর হতে ধীর স্বরে বললেন, ‘অনেক আগে সৈয়দ তারিককে আমি চিনতাম।’

এর কয়েক বছর পর তিনি পার্থিবতা ঘোচালেন। একদিকে কবিতায় ও গল্পে তার অসাধারণ অবদান অন্যদিকে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রবণতা তাকে একটি বিচিত্র গ্রহণ-বর্জনে রেখেছিল, রেখেছে এখনো। তবে, সন্দেহ নাই, তার কাব্যকীর্তিই নাক্ষত্রিক দ্যুতি ছড়িয়ে বহাল থাকবে।

আমার ইচ্ছা করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার সমাধির পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আসি।

   

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;