বিশ্ব চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেন



রায়হান রহমান রাহিম, কন্ট্রিবিউটর
মোজার্ট ও বিথোফেন

মোজার্ট ও বিথোফেন

  • Font increase
  • Font Decrease

সংগীত পছন্দ করুন বা না-ই করুন, মোজার্ট এবং বিথোফেনের নাম শোনেননি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে। বহু বছর আগে, সংগীত যখন ছিল কেবলই আভিজাত্যের অন্যতম উপাদান, সেই সময় সংগীতকে ব্যক্তি মানসের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই দুই মহান শিল্পী।

সংগীতকে তাঁরা এমন একটি শিল্প-মাধ্যম রূপে বের করে এনেছিলেন যেন বৈচিত্র্যময় জীবনের খুব কাছের অনুভব এই সংগীত। এবং মানুষ চাইলেই তার সব রকম অনুভূতি সংগীতের মাধ্যমে অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে। তাঁদের কাজের ব্যাপকতা এত প্রসারিত ছিল যে নানা শিল্প-মাধ্যমে তাঁদের তৈরিকৃত সুর মিশেছে। সেই মিশ্রণ শিল্পের ভাবকে করেছে তাৎপর্যমণ্ডিত, দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই আমরা এই বিষয়টিকে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখেছি।

মোজার্ট-এর পুরো নাম উলফগ্যাং অ্যামাদিউস মোজার্ট। ১৭৫৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে লিওপোল্ড-মারিয়া দম্পতির সংসারে মোজার্ট জন্মগ্রহণ করেন। আঠার শতকের মধ্যবর্তী এই সময়টি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য ছিল এক ক্রান্তিকাল। রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙন-পরবর্তী প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রভাব সালজবার্গ শহরের ওপরও পড়েছিল। রেঁনেসা ও বারোক যুগের সুরশৈলী যে-রকমভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এই সময়ে এসে তার একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন চোখে পড়ে। নাতিদীর্ঘ কম্পোজিশনগুলোকে পূর্ণমাত্রা ও পূর্ণাঙ্গ কম্পোজিশনগুলোকে জটিল যন্ত্রাণুষঙ্গে ভিন্ন মাত্রা দেবার প্রয়াস গড়ে উঠতে দেখা যায়। সংগীত ক্রমেই গির্জা ও রাজদরবার-ভিত্তিক একটি শিল্পমাধ্যমের স্বীকৃতি পেয়ে আভিজাত্যের তকমা গায়ে জুড়ে নেয়।

বাবা লিওপোল্ডের হাত ধরে মোজার্টের সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল। সালজবার্গ কোর্টের এসিস্ট্যান্ট কনসার্ট মাস্টার লিওপোল্ড একজন সফল কম্পোজার এবং বেহালাবাদক ছিলেন। লোকশ্রুতিতে আছে, লিওপোল্ড যখন সাত বছর বয়সী কন্যাকে কিবোর্ডে হাতপাকা করবার দীক্ষা দিচ্ছিলেন, সবসময় বোনের সাথে থাকা তিন বছর বয়সী মোজার্ট খেলার ছলেই কিবোর্ড আত্মস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। বাবা লিওপোল্ডের সাহায্যে অল্প বয়সেই ভায়োলিন-সহ নানা সংগীত বাদ্যযন্ত্র মোজার্টের আয়ত্তে এসে যায়। ধীরে ধীরে মোজার্ট পিয়ানো, অর্গান এবং ভায়োলাও শিখে নেন এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি নিজস্ব কম্পোজিশন তৈরি করে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।

তারপর মোজার্টের গল্পটা শুধুই ইতিহাসের। একের পর এক সিম্ফোনি, অপেরা, মিনি অপেরা, স্ট্রিং কোয়ার্টেটের অর্কেস্ট্রা, ভায়োলিন সোনাটা, সেরিনেইডস, মোটেটস, মাসেস-সহ মহান নানা ধ্রুপদী সংগীত তিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছর আয়ুষ্কালীন জীবনে তৈরি করে গেছেন।

বিথোফেনের গল্পটা তো আরো অদ্ভুত। পিতা জোহান ভ্যান বিথোফেনের ছিল সংগীত অনুরাগী মন। তিনি চাইতেন ছেলে মোজার্টের মতো কিংবদন্তি হবে। সেই লক্ষ্যেই খুব অল্প বয়স থেকেই জোহান ছেলেকে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করাতেন।

১৭৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জার্মানির বন শহরে লুডভিগ ফান বিথোফেন জন্মগ্রহণ করেন। ধ্রুপদী সংগীত যখন গির্জা ও রাজদরবারের চার দেয়ালে আটকে আছে তখন রাস্তায় এবং তথাকথিত সকল আমোদের আসরগুলোতে এক ধরনের হালকা সংগীত বাজবার রেওয়াজ ছিল। তবুও বাবার ইচ্ছানুযায়ী খুব অল্প বয়স থেকেই বিথোফেনকে ধ্রুপদী সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করতে হয়। মদ্যপ পিতার সাথে বিথোফেনের সম্পর্ক ভালো ছিল না এবং অল্প বয়সে মাতৃহীন হয়ে বিথোফেন ধীরে ধীরে সংগীত চর্চা, নতুন সুর তৈরির দিকেই তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন।

মাত্র সাত বছর বয়সে জনসমক্ষে বিথোফেন পিয়ানো বাজিয়ে আলোচনায় চলে এসেছিলেন। যে সময়টায় সংগীত ছিল গির্জা ও রাজাদের নির্দেশিত শিল্পমাধ্যম ঠিক সে সময়েই নিজস্ব আবেগ আর সংগীত-দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিথোফেন তৈরি করেছিলেন একের পর এক সোনাটা, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা। ১৮১০ সালের দিকে তাঁর শ্রুতিজনিত সমস্যা এত বিকটাকার হয়ে ধরা পড়ে যে তিনি প্রায় বধিরই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। তবুও ভাবলে অবাক হতে হয়, তাঁর বিখ্যাত ‘নবম সিম্ফোনি’র কাজ ১৮২৪ সালে শেষ হয় এবং সে-সময় তিনি কানে কিছুই শুনতেন না। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই মিউজিক মায়েস্ত্রো ১৮২৭ সালের ২৬ শে মার্চ পরপারে পাড়ি জমান।

চলচ্চিত্রকে বলা যায় একটা মিশ্র শিল্প-মাধ্যম৷ মিশ্র ঠিক সেই কারণে যে—নিজস্ব ভাব সাবলীলভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে চলচ্চিত্রকে সবসময়ই অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমের ওপর ভর করতে হয়। চলচ্চিত্র আমাদের জীবনের সবচেয়ে কাছাকাছি শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রত্যক্ষ প্রভাব তো রয়েছেই বরং সংগীত আয়োজনের সঠিকতা এবং উপযুক্ত প্রয়োগ চলচ্চিত্রকে বরাবরই একটি নতুন মাত্রা দান করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন চলচ্চিত্র-পরিচালকগণ নিজেদের নির্মিত চলচ্চিত্রকে মানুষের হৃদয়ের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসতে যতবার সংগীতের ব্যবহার সমন্ধে চিন্তা করেছেন, ততবারই তাঁরা মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুরের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনা সংকোচে।

জীবন সম্পর্কিত প্রত্যেকটি অনুভব-অনুভূতির সাথে এই দুই শিল্পীর তৈরিকৃত সুরের অন্তরঙ্গতা এত প্রবল ছিল যে এই সুর ব্যবহার করা ছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালকদের হাতে চলচ্চিত্রকে আরো জীবনমুখী করবার অন্য উপায় ছিল না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা নানা চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুর ব্যবহার নিয়ে এবার একটু জেনে আসা যাক।

নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র তৈরিকালীন সময় থেকে মোজার্টের সংগীত চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। স্প্যানিশ চলচ্চিত্র পরিচালক লুইস ব্যুনয়্যেল ১৯৩০ সালে তার “L'Age d'Or” নামক নির্বাক চলচ্চিত্রে মোজার্টের “Ave verum corpus” নামক মোটেটটি ব্যবহার করেন। এরপর একে একে “দ্য ব্লু এঞ্জেল”, “ওয়াথেরিংহেইটস”, “দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ানগ্রে”, “কাইন্ডহার্টস এন্ড করোনেটস”, “ভার্টিগো”, “দ্য ইপক্রেস ফাইল”, “পিকনিক এট হ্যাংগিং রক”, “আলভিরাম্যাডিগান”, “দ্য স্পাইহুলাভডমি”, “এ্যানি হল”-সহ নানা সিনেমায় তাঁর পিয়ানো সোনাটা, মিনি অপেরাটিউন, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা একে একে ব্যবহৃত হয়ে চলচ্চিত্রে সংগীতের একটি সুস্থিত অবস্থান তৈরি করে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্ট্যানলিকুবরিকের ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি অগাধ আগ্রহের খবর আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কুবরিক সবসময়ই সঠিক দৃশ্যের জন্য সঠিক সংগীত বেছে নেওয়াতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার “আইজ ওয়াইড শাট” চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? নায়ক টমক্রুজের ভীত চোখ, অস্থির পায়চারিতে দর্শককে আরো গভীরভাবে আটকে দিতে কুবরিক সাহায্য নিয়েছিলেন মোজার্টের “Rex tremendae” নামক সৃষ্টির।

বিখ্যাত রোমান্টিক চলচ্চিত্র “হোয়েন হ্যারি মেট স্যালি”-র কথা আমরা ভুলব কেমন করে? সে চলচ্চিত্রটিতেও মোজার্টের ই ফ্ল্যাট মেজর স্কেলের স্ট্রিং কুইন্টেটটি অন্যরকম আবহ তৈরি করেছিল। তারপর “এলিয়েন”, “আউট অফ আফ্রিকা”, “নাও ইউসিমি ২” , “ব্রেথলেস”, “মাই লেফট ফুট”, “ফাইভ ইজি পিসেস”-সহ আরো অসংখ্য সিনেমার আদি, মধ্য কিংবা অন্তে মোজার্টের সংগীত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে আলোকিত করেছে।

জীবন ধারণকালীন জটিলতা, বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণতা-অপূর্ণতার সংযোগে বিথোফেন যে সুরই তৈরি করেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালকরা সেখানে পেয়েছেন আত্মার সজীব সংযোগ। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় একটা কথা কিন্তু বেশ প্রচলিত। বলা হয়—“আপনি যদি একটি চলচ্চিত্রও জীবনে দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে আপনি বিথোফেনকে শুনেছেন।”

আইএমডিবি’র তথ্যানুসারে ১২০০-র অধিক চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্রে বিথোফেনের সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “ডেড পোয়েটস সোসাইটি” চলচ্চিত্রটি নিয়ে এখনো নিয়ম করে সব মহলে কথা হয়। এ সিনেমায় বিথোফেনের “Ode to Joy” যা “Symphony No. 9” নামেও খ্যাত, ব্যবহার করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক। শুধু এই সিম্ফোনিটিই নয়, বিথোফেনের তৈরিকৃত “Piano Concerto No. 5”-এর সফল ব্যবহারও আমরা উক্ত সিনেমাতে শুনেছি। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তারেক মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “আদম সুরত”-এ পরিচালক তারেক মাসুদ বিথোফেনের “Symphony No. 9” ব্যবহার করেছিলেন।

“ক্রিমসন টাইড”, “লিংকন”, “মিশন ইম্পোসিবল”, “দ্য জু কিপারসওয়াইফ”, “ফ্যান্টাসিয়া”, “মিসারি”, “ক্যালিফোর্নিয়া”-সহ বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোতে বিথোফেনের পিয়ানো সোনাটা কী চমৎকার আবহ তৈরি করেছে। “বিফোরসানরাইজ”, “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড : জুরাসিক পার্ক”, “দ্য এজ অফ ইনোসেন্স”-সহ বিভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমাগুলোতে বিথোফেনের “Piano Sonata No. 8”-এর ব্যবহার ঘটনার বাঁক বদলে দিয়েছে নতুন মাত্রা।

এক কথায় বলা যায়, তাঁর স্ট্রিং কোয়ার্টেট, সিম্ফোনির সুর এবং পিয়ানো সোনাটাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে—এমন চলচ্চিত্রের নাম বলে এবং লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;