গরিব মানুষকে টার্গেট করে চাকরির লোভ দেখিয়ে ভারতে নিয়ে যেত। এরপর পাসপোর্ট জিম্মায় নিয়ে টাকার লোভসহ ভিন্ন কৌশলে তাদের কিডনি হাতিয়ে নিতো চক্রটি। এসব কিডনির গ্রহীতাও বাংলাদেশি।
রোববার (১২ মে) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপস) ড. খ: মহিদ উদ্দিন।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় চক্রটির বিরুদ্ধে রবিন নামে এক ভুক্তভোগী একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় ধানমন্ডি থানা পুলিশ এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গত ১১ মে ধানমন্ডি ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে থেকে ও বাগেরহাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানান তিনি।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. রাজু হাওলাদার (৩২), শাহেদ উদ্দীন (২২) ও মো. আতাহার হোসেন বাপ্পী (২৮)। এ ঘটনায় পলাতক রয়েছেন মো. মাছুম (২৭), শাহীন (৩৫) ও সাগর ওরেফ মোস্তফাসহ (৩৭) অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন।
ধানমন্ডি থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এরা সঙ্ঘবদ্ধ একটি চক্র। তারা দেশের গরিব মানুষজনকে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভারতে নিয়ে নানা কৌশলে তাদের কিডনি হাতিয়ে নেয়। ভুক্তভোগী রবিনকে ভারতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রথমে দিল্লির ফরিদাবাদ এলাকায় নেওয়া হয়। পরে তাকে নানা কৌশলে কিডনি বিক্রির জন্য রাজি করে। চুক্তি অনুযায়ী চক্রটি তাকে ৬ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে তাকে দেয় ৩ লাখ টাকা।
ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, গত ২০২৩ সালে এপ্রিল মাসের কোনো এক তারিখে মিরপুর-১০ নং শাহ আলী মার্কেটের পিছনে চায়ের দোকানে রবিন তার এক বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছিল এবং সংসারের অভাব অনটন নিয়ে কথাবার্তা বলছিল। এসময় পাশে বসা অভিযুক্ত পলাতক আসামি মাছুমও চা পান করছিল। কথাবার্তা শুনে মাছুম নিজ থেকেই ভিকটিমকে বলে, ভারতে তার ব্যবসা আছে এবং ওই প্রতিষ্ঠানে সে রবিনকে চাকরি দিতে পারবে। একপর্যায়ে মাছুমের সঙ্গে মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান করেন রবিন। এরপর মাছুমের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো রবিনের। একপর্যায়ে ভারতে গিয়ে চাকরির বিষয়ে রাজি হয় রবিন।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে মাছুম ভিকটিম রবিনকে বলে ভারতে তার প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য যেতে হলে ডাক্তারি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভিকটিমকে নিয়ে যায় মাছুম। সেখানে ভিকটিমের সঙ্গে গ্রেফতার আসামি মো. রাজু হাওলাদারের পরিচয় হয়। পরে আসামিরা ভিকটিমের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তার পাসপোর্ট নেয় ভারতের ভিসার জন্য।
ভিসার পাওয়ার পর ভিকটিমকে মাছুম ও মো. রাজু হাওলাদার গ্রেফতার শাহেদ উদ্দিন (২২) ও মো. আতাহার হোসেন বাপ্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা একে অপরের ব্যবসায়িক পার্টনার, বাংলাদেশ ও ভারতে তারা যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে বলে ভিকটিমকে জানায় আসামিরা। পরবর্তীতে ভিকটিমকে ভারতের দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে রিসিভ করে পলাতক আসামি শাহীন (৩৫) ও সাগর। তারা ভিকটিমকে রিসিভ করে তার পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়। পরে দিল্লি থেকে ভিকটিমকে ফরিদাবাদ নামের একটি এলাকায় নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ফরিদাবাদে ভিকটিমকে আটক রাখা অবস্থায় ভারতে যায় মাছুম ও সাগর। মাছুমকে পেয়ে ভিকটিম তার চাকরির কথা জিজ্ঞাসা করলে সে বিভিন্ন রকম তালবাহানা করতে থাকে। এক পর্যায়ে আসামিরা ভিকটিমের আর্থিক অনটন, সাংসারিক অর্থনৈতিক দূরবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি কিডনি দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এক পর্যায়ে তারা ভিকটিমকে ভয়ভীতি দেখায় যে, পাসপোর্ট ছাড়া সে দেশেও ফিরতে পারবে না। পরে ভিকটিমকে নয়াদিল্লির এশিয়ান হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কিডনি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করায়। ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে কিছুদিন পর ভারতের গুজরাটে নিয়ে যায় এবং মুক্তিনগর এলাকায় ২ তলা বিশিষ্ট একটি বাসায় ভিকটিমকে রাখা হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কাউকে কিছু না বলার শর্তে গত ৪ মার্চ ভারতের গুজরাট কিডনি এন্ড স্পেশালাইজড অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভিকটিমের একটি কডিনি নেওয়া হয়।
অপারেশন শেষে হাসপাতাল থেকে ৪ দিন পরে ছাড়া পায় ভিকটিম। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আসামিরা ভারতের অজ্ঞাত স্থানে প্রায় ১০/১১ দিন ভিকটিমকে আটক রাখে। এদিকে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমে ভিকটিম জানতে পারে যে, তার কিডনি আসামিরা দালাল চক্রের কাছে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে। এক পর্যায়ে দালালচক্র ভিকটিমকে কিছু টাকা দেওয়ার কথা বলে। বাংলাদেশে অবস্থান করা চক্রের অন্য সদস্যরা ভিকটিমের স্ত্রী ইশরাত জাহানের বিকাশ নম্বরে ৩ লাখ টাকা দেয়। দেশে এসে ভিকটিম বুঝতে পারে যে, সে বড় দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে তার কিডনি হারিয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের টার্গেট যাদের আর্থিক চাহিদা আছে। রবিনের ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছে তাকে কিন্ত খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চক্রটি এসব কিডনি আরও চড়া দামে বিক্রি করে আসছে। চক্রটি বাংলাদেশ থেকে শুরু করে কলকাতা ও গুজরাটেও কাজ করে আসছে।
অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, আমরা জানতে পেরেছি এখন পর্যন্ত চক্রটি ভারতে নিয়ে ১০ জন ব্যক্তির কিডনি হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া তাদের পাইপলাইনে আরও পাঁচ থেকে ছয়জন ছিল বলে জানিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চক্রটি রবিনকে ৬ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল কিডনির বিনিময়ে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত তিন লাখ টাকা দেয়। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাদের কিডনি নেওয়া হচ্ছে এসব কিডনির গ্রহীতারাও বাংলাদেশি।