পানি থেকে বাঁচতে চট্টগ্রামে ‘প্লাস্টিক কোটিং’ সড়ক
চট্টগ্রাম: বৃষ্টি, জোয়ার বা বন্যার পানির ক্ষতি থেকে বাঁচাতে কার্পেটিং সড়ককে ‘প্লাস্টিক কোটিং সড়ক’ হিসেবে তৈরি করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কার্পেটিং সড়ক নির্মাণের কাঁচামাল বিটুমিনের সঙ্গে বর্জ্য পলিথিনের চূর্ণ পাথরের খোয়া ভালো করে মিশিয়ে বিশেষ ভাবে এই সড়ক তৈরি করা হবে। এতে বিদ্যমান সড়কের চেয়ে বেশি টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব হবে এবং কার্পেটিং সড়কের নির্মাণের চেয়ে দশ শতাংশ খরচ কম হবে।
ভারতের বন্যাপ্রবণ বিভিন্ন প্রদেশে অনেক আগেই নতুন প্রযুক্তির এই সড়ক নির্মিত হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার সল্টগোলায় এই ধরনের একটি সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। সেটি নির্মিত হলে এটি হবে এই প্রযুক্তিতে নির্মিত দেশের প্রথম সড়ক।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে ‘সড়ক নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক প্রকৌশলীদের এক সেমিনারে নতুন প্রস্তাবটি দেন সাদার্ন ইউনিভার্সিটির উপ উপাচার্য প্রকৌশলী আলী আশরাফ। পরে লিখিতভাবে সড়কটি নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দেন তিনি।
এ প্রযুক্তি সম্পর্কে আলী আশরাফ জানান, ফেলে দেয়া ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগকে সংগ্রহ করে মেশিনে কুচি করে কেটে তাপের মধ্যে পাথরের খোয়ার সঙ্গে মেশানো হবে। এতে পাথরগুলো পলিকোটেড বা গলানো পলিথিনে আবৃত হয়ে যাবে। আর এই পলিকোটেড পাথরগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান পদ্ধতিতে বিটুমিন মিশিয়ে সড়ক কার্পেটিং করা হবে।
তিনি জানান, বিটুমিনের প্রধান শত্রু হচ্ছে পানি। কার্পেটিং সড়ক পানিতে ডুবে থাকলে বিটুমিন থেকে পাথর পৃথক হয়ে যায়, এতে সড়ক টিকে না। কিন্তু এই প্রযুক্তিতে পলি কোটিং থাকায় পাথরের ভেতর পানি ঢোকার কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে পানির মধ্যেও এটি পৃথক হয় না, টেকসই থাকে।
ভারতের সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অনেক আগেই ভারত বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই ধরনের সড়ক নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হয়েছে জামশেদপুর সিটিতে। টাটা কোম্পানির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জামশেদপুর ইউটিলিটি ও সার্ভিস কোম্পানি এই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণে সফলতা দেখিয়েছে। ফেলনা প্লাস্টিকের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের মূল আবিষ্কারক রাজগোপাল বাসুদেব। তিনি দক্ষিণ ভারতের এক প্রকৌশল কলেজের রসায়নের অধ্যাপক। রাজগোপাল বাসুদেব কিন্তু তার এই আবিষ্কার বিনা খরচেই অন্যদেরকে ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছেন। একটা ডাচ প্রতিষ্ঠান তার মৌলিক চিন্তাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে কাজ করছে।
ভারতে নির্মিত সড়ক পাঁচ বছরের বেশি টেকসই হয়েছে। সেখানে শুধু পলিথিন নয়, ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল, পলিব্যাগ, চিপসের প্যাকেট ও বিস্কুটের প্যাকেট দিয়েও এই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণে সফলতা এসেছে। এতে ১৫ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হয়েছে।
সেই বিষয় মাথায় রেখেই চট্টগ্রাম সাদার্ন ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী অনেক আগেই ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে সফল হয়েছে। এটি বাস্তবে প্রয়োগ চায় তারা।
গবেষক দলনেতা প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন,‘আমরা বিনামূল্যে নিজের গাড়ির তেল জ্বালিয়ে কনসালটেন্সি করব। বন্যা, বৃষ্টি বা জোয়ারপ্রবণ পাশাপাশি দুটি সড়কের একটিতে কার্পেটিং অন্যটিতে প্লাস্টিক কোটেড কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ করে আমরা বিষয়টি প্রমাণ করতে চাই। কার্পেটিং সড়ক প্রতিবছরই মেরামত করতে হয়। কিন্তু এই সড়কটি একনাগাড়ে পাঁচ বছর কোনো মেরামত ছাড়াই চলবে।
তিনি বলেন,‘প্রস্তাবের পর আমরা ইতোমধ্যে ল্যাব টেস্টে ‘ডাবল সিওর’ করে নিশ্চিত হয়েছি। এখন রন্ধন প্রণালি বা কীভাবে সড়কটি নির্মাণ করব তা চূড়ান্ত করছি। আমাদের প্রস্তাবের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে আগ্রহ রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নগরীর সল্টগোলা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত প্রধান সড়কটিকে এই প্রযুক্তির সড়ক হিসেবে নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। আমরা তাদের প্রস্তাবের কারিগরি, পদ্ধতিগত ও টেকসই দিকগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে শিগগিরই বসব। সেসব বিষয়ে সন্তুষ্ট হলেই কেবল বাস্তবায়নে অগ্রসর হব। ছোট্ট পরিসরে শুরু করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই। সেটা প্রথম চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করতে চাই।’
তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম সিটির বন্যা প্রবণ অনেক সড়ক এভাবে নির্মাণ করা গেলে প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হবে।
চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী আলী আশরাফ জানান, ব্যবহৃত পলিথিন ১০০ বছরেও কোনো ক্ষয় হয় না। আর সেগুলো নালা-নর্দমা, খাল-বিল, নদীকে ভরাট করে ফেলছে। কোনো ভাবেই এগুলোর বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। সেগুলোকে সংগ্রহ করে ব্যবহার করা গেলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অগ্রগতি হবে। আর টাকা দিয়ে কেনার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পলিথিনগুলো আমাদের হাতে চলে আসবে। আর এই প্রযুক্তিতে ১০ শতাংশ পলিথিন মেশানোর কারণে খরচও সাশ্রয় হবে।