নিজেকে বার বার অতিক্রম করে যাওয়ার মতো বহুমাত্রিক কাজের মধ্য দিয়ে ভ্রমণগদ্য লেখালেখিতে যুক্ত এলিজা বিনতে এলাহী ইতিমধ্যে তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন। ঐতিহ্যভ্রমণকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেই ক্ষ্যান্ত হননি এলিজা; লেখালেখি, অডিওভিজ্যুয়াল তৈরি আর ভ্রমণ তথ্যচিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে মাত্রাবহুল রকমে প্রসারিত রেখেছেন।
সোমবার (৩ অক্টোবর) বিকালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে এলিজার চতুর্থ ভ্রমণ তথ্যচিত্র টুম্স এর প্রিমিয়ার শো’। এতে ভ্রমণ ও পর্যটনে যুক্ত বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত থাকবেন বলে আশাপ্রকাশ করা হয়েছে।
এলিজা বিনতে এলাহী’র টুমস-ঐতিহ্য তথ্যচিত্র বাংলাদেশে বিদেশি ট্রি প্লান্টার্সদের সমাধিকেন্দ্রিক। এর পুরো নাম টুমস- টি-প্ল্যান্টার্স সিমেট্রিজ ইন সিলেট। এই ভূখণ্ডে যুগে যুগে পা পড়েছে বিদেশিদের । কোন কোন জাতি গোষ্ঠীর রয়েছে দীর্ঘ শাসন ও ব্যবসা বাণিজ্যের যোগ। এদের মধ্যে যারা প্রয়াত হন, তাদের অনেককেই সমাহিত করা হয় ভূখণ্ডের নানা জায়গায়। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠে বিদেশিদের সমাধি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্র, সিলেট বিভাগের চা বাগানগুলোত আছে প্ল্যান্টার্সদের সমাধি । টুমস-য়ে সেগুলো খুঁজে বেরা করা হয়েছে।
তথ্যচিত্রের প্রিমিয়ার শো উপলক্ষে এলিজা বিনতে এলাহী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমি ভ্রমণপ্রেমী মানুষ। বাংলাদেশের সব জেলা ও বিদেশে ঐতিহ্যভ্রমণের সূত্রে বহু কিছুর সন্ধান পেয়েছি, তাই তুলে ধরেছি নানা মাধ্যমে। বর্তমান তথ্যচিত্রটি ভ্রমণ ও ঐতিহ্যেরই একটি প্রামাণিক বিষয়।
ঢাকার আকাশে ওড়া প্রথম বেলুনিস্ট মার্কিন আকাশচারী জিনেথ ভ্যান তাসেল’ এর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র- ‘ ইন সার্চ অফ জিনেট ভান তাসেল’ অতিমারির প্রাক্কালে প্রদর্শিত হয়েছিল। অতিমারির মহাদুর্যোগেও বিন্দুমাত্র নিজের ভ্রমণ ও তথ্যচিত্রের কাজ থেকে দমে যাননি এলিজা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো নিয়ে তার তথ্যচিত্র ‘রোড টু ফ্রিডম’ সুনাম কুড়ায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতিরজনকের প্রতি এলিজার গভীর শ্রদ্ধার স্মারক এই তথ্যচিত্র। দেশের প্রথম নারী ভ্রামণিক ‘হরিপ্রভা তাকেদা’র ওপর তৃতীয় তথ্যচিত্রটির কৃতিত্বও এলিজার। ঢাকার এলিটমহলে ; হরিপ্রভা তাকেদা: এন আনসাং ট্রাভেলার অফ বেঙ্গল’ এর নির্মাণ নিয়েও প্রশংসার বান ডেকেছিল।
তথ্যচিত্রগুলো উদ্বোধনের পর বাণিজ্যিক উন্মুক্ত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেই। এটি পরে একটি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করে থাকে।
এই তথ্যচিত্র নির্মাণ ও পরিবেশনায় এবার এলিজার প্রতিষ্ঠান কোয়েস্ট এর সঙ্গে প্রাণ, সেফওয়ে লজিস্টিকস, ভ্রমণগদ্য, ঘুরান্তিস সহযোগী হয়েছে। মিডিয়া পার্টনার হিসেবে যোগ দিয়েছে-দৈনিক ইত্তেফাক,বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, দীপ্ত টিভি ও এবিসি রেডিও।
লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বিচে: কঙ্গো-বুরুন্ডি (পর্ব ২)
হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
কামিম্বি শহরতলী- রুয়ান্ডা
ট্রাভেল
রুসিজি, কঙ্গো-রুয়ান্ডা বর্ডার: পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে কঙ্গো রুয়ান্ডা বর্ডারে চলে এলাম। জায়গাটার নাম রুসিজি-১ দুই দেশের সীমান্ত চেক পোস্ট এখানে। ইমিগ্রেশন শেষ করে রুসিজি নদীর উপরের ব্রিজ পার হয়ে রুয়ান্ডার চেকপোস্টে গেলাম। রুয়ান্ডার দিকে রাস্তা বেশ ভাল। এই দিকে পাহাড় একটু বেশি। ছোট রুসিজি নদী দুই দেশকে আলাদা করে রেখেছে।
ইমিগ্রেশন অফিস রুসিজি
রুসিজি একটা ছোট পাহাড়ি নদী, নদী না বলে এটাকে একটা খাল কিংবা নালা ও বলা যেতে পারে। এই নদী লেক কিভুর পানি নিয়ে লেক টাঙ্গানিকার দিকে বয়ে চলছে। লেক কিভু সাগর সমতল থেকে প্রায় পনের’শ মিটার উঁচুতে আর লেক টাঙ্গানিকা সাগর সমতল থেকে প্রায় সাতশত পঞ্চাশ মিটার উপরে। গোমা এলাকার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে এত উঁচুতে এই মিষ্টি পানির লেকগুলো সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলে এখনও জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে।
রুসিজি সীমান্ত- রুয়ান্ডার ভেতরে
বুকাভু থেকে রুয়ান্ডা কঙ্গো সীমান্ত রুসিজি-১ ও রুসিজি-২ চেক পয়েন্টে পনের বিশ মিনিটে যাওয়া যায়। তাই বুকাভুর বেশির ভাগ মানুষ রুয়ান্ডার কামিম্বি বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাহিরে যাতায়াত করে। ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে রুয়ান্ডা সীমান্তের কাছে এই বিমানবন্দর বানিয়েছে। এখান থেকে রুয়ান্ডা এয়ার যাত্রীদেরকে কিগালি নিয়ে যায়, সেখান থেকে সারা পৃথিবীর যে কোন গন্তব্যে যাওয়া যায়।
রুসিজি বর্ডার-রুয়ান্ডার রাস্তা
রুয়ান্ডার এই অংশের কাছেই কামিম্বি শহর। এটা একটা ছোট সীমান্ত জনপদ। বিমানবন্দর থাকার কারণে এখানে অনেক বিদেশীর আনাগোনা আছে। কঙ্গোর ভেতরে বুকাভু শহর ও তার আশেপাশে অনেক বিদেশী এন জি ও কাজ করে। তারা নিজদেশে যাতায়াতের জন্য কামিম্বি বিমানবন্দর ব্যবহার করে। বুরুন্ডির রাজধানী বুজুম্বুরার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য আমরা একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ি কামিম্বি শহরে। আমরা ট্যাক্সিতে করে বুজুম্বুরা যাব একরাত সেখানে থেকে পরদিন আবার রুসিজি -১ চেকপোস্টে ফিরে আসব। যাওয়ার পথে একটু ঘুরে রুয়ান্ডার কামিম্বি শহরেটা দেখে যাব।
ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ শেষ করে ট্যাক্সিতে করে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ি পথে আমরা চলছি। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই রাস্তা বুরুন্ডির দিকে চলে গেছে । দশ মিনিট চলার পর আমরা কামিম্বি শহরে পৌঁছালাম। যে কোন সাধারণ মফস্বল শহরের মত শহর। ব্যাংক, দোকানপাট সবই আছে এখানে। বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। রুয়ান্ডা এখন ফ্রেঞ্চ ভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজির দিকে জোর দিয়েছে। আমাদের ড্রাইভার কিন্তু ইংরেজি বোঝে না। অল্প অল্প ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা থাকাতে তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু কথা বলা যায়।
রুয়ান্ডার এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা মসজিদ দেখলাম, আমাদের ড্রাইভার ও মুসলিম, সে এখানকার অনেক মানুষকে চেনে। কামিম্বি শহরে দেখার কিছু নেই। শহরে প্রাণকেন্দ্রে রাস্তার মোড়ের আইল্যান্ডে একটা বড় ঘড়ি সময় জানিয়ে দিচ্ছে। এখানে ট্রাক, বাস ট্যাক্সি সবই পাওয়া যায়। বিমান বন্দরের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শহরটাতে বেশ প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়। এখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার আমরা বুজুম্বুরার পথে রওয়ানা হলাম। রুসিজি ১ থেকে বুজম্বুরা প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার রুয়ান্ডাতে আর বাকী পথ বুরুন্ডির ভেতরে। রুয়ান্ডার ভেতর রাস্তা পাহাড়ি হলেও বেশ সুন্দর এবং উন্নত।
রুয়ান্ডা থেকে বুরুন্ডির পথে যেতে
রাস্তা থেকে নীচে পাহাড়ের উপত্যকাতে মাঝে মাঝে ঘরবাড়ী দেখা যায়। পাহাড়ের মাঝের পথ দিয়ে রুসিজি নদী একে বেঁকে লেক তাঙ্গানিকার দিকে চলছে। এদিকে গ্রাম অঞ্চল, মানুষজন মাঠে কাজ করছে কেউবা ঘরে ফিরছে। হাঁটা কিংবা সাইকেলেই তাদের যাতায়াত। আনায়াসে পাহাড়ি পথে তারা তাদের গন্তব্যে চলছে। মাঝে মাঝে কয়েকজন হাত দিয়ে ট্যাক্সিতে লিফট নিতে চাইছে এরা ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রোতে করে আশেপাশের জনপদে যাবে। বুরুন্ডি সীমান্তের কিছু আগে ড্রাই ভার একটা ছোট শহরের মানি এক্সচেঞ্জে গাড়ি থামাল। আমরা নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। মানুষজন বেশ বন্ধুভাবাপন্ন, ভালই লাগল। এক ঘণ্টা চলার পর আমরা রুয়ান্ডা বুরুন্ডির সীমান্ত জনপদ রুয়া বর্ডারে পৌঁছে গেলাম।
রুয়া এলাকায় রুয়ান্ডা সরকার নিজ খরচে সুন্দর বর্ডার চেকপয়েন্ট বানিয়েছে। এখানে রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডির পতাকা বাতাসে খেলা করছে। দুদেশের কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য পাশাপাশি ডেস্ক, কাঁচের পার্টি শান দিয়ে আলাদা। ব্যাঙ্কের জন্য ও জায়গা করা আছে। ফর্ম ফিলাপ করার জন্য চেয়ার টেবিল আছে। হাত মুখ ভিজিয়ে নেয়ার জন্য পরিস্কার টয়লেট আছে দুইদিকেই। একটু দূরে কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য বাংলো বানানো হয়েছে। এই কমপ্লেক্সে সব ধরনের সুবিধা আছে। এলাকাটা চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দুই দিকে সীমান্তের প্রহরাতে পুলিস আছে।
ইমিগ্রেশন অফিস রুয়া-রুয়ান্ডা বুরুন্ডি বর্ডার
আমাদের পাসপোর্ট চেক করে দেখল রুয়ান্ডার পুলিশ। তারপর পারকিং লটে গাড়ি পার্ক কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসের ভেতরে গেলাম। মানুষজন তেমন নেই। দু একটা গাড়ি আছে, সেগুলোর মানুষজন ফর্ম ফিলাপ করে কাউনটারে জমা দিচ্ছে। আমাদের পাসপোর্টে রুয়ান্ডার এক্সিট সিল দিয়ে পাশের বুরুন্ডির অফিসারকে এগিয়ে দিল। অফিসার পাসপোর্ট দেখে আবার বুরুন্ডির এন্ট্রি সিল দিয়ে দিল। কাজ শেষে আবার আমরা পথে নামলাম। এখান থেকে বুরুন্ডি ৮০ কিলোমিটার।বুরুন্ডির রাস্তা উপত্যকার মধ্যে, দূরে অনেক উঁচু পাহাড়ের সারি যেন মেঘের সাথে মিশে আছে।দুপাশে ফাঁকা তৃণভূমি, মাঝে মাঝে ঝোপ গাছ। কিছু কিছু চাষ হয় এই মাঠে।
বুজুম্বুরার পথে – বুরুন্ডি
পথের এক জায়গাতে তুলার ক্ষেত, অনেক এলাকা নিয়ে সাদা হয়ে আছে সারা মাথ।মানুষজন মাঠে কাজ করছে, সাইকেল এখানকার অন্যতম বাহন, মাঝে মাঝে মোটর সাইকেল ও গাড়ি দেখা যায়। রাস্তার অবস্থা বেশী ভাল না তবে চলাচল করা যায়।পথের পাশে হঠাৎ এক জায়গাতে অনেক এলাকা জুড়ে বিশাল ক্যাকটাসের বন। রুয়ান্ডার পথে এধরনের দৃশ্য দেখা যায়নি। রাস্তা মাঝে মাঝে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চলছে। নীচে রুসিজি নদী মাঝে মাঝে এঁকে বেঁকে চলছে দেখলাম। কিছু জায়গাতে বেশ স্রোত ও আছে এই ছোট নদীতে।
এরপর রাস্তার দুপাশে অনেক অর্ধসমাপ্ত ঘরবাড়ী দেখলাম ।বাড়ীগুলো বানানো প্রায় শেষ কিন্তু জানালা দরজা লাগানো হয়নি, কেউ সেখানে থাকে না। এর থেকে একটু দূরে ছোট গ্রামের কুঁড়ে ঘর দেখা যায়, হয়ত ভবিষ্যতে গ্রামের মানুষ এসব ঘরে থাকবে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট জনপদ আছে। খুব সাধারণ মানের ঘরবাড়ী, মানুষ জন সরল জীবন যাপনেই অভ্যস্ত। মসজিদ দেখলাম কয়েকটা, সীমান্তের এই দিকে মুসলিম জনবসতি আছে বেশ কিছু।
বুজুম্বুরার কাছে রাস্তার মান একটু ভাল, প্রায় ঘন্টা খানেক আমরা খারাপ রাস্তায় চলেছি। শহরের বাহিরে বুজুম্বুরা বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর দিয়ে ও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী এবং এন জি ও কর্মীরা আশেপাশের দেশে যাতায়াত করে। আমরা শহরের ভেতরে ঢুকে গেলাম। রাস্তা বেশ খোলামেলা, ট্রাফিক জ্যাম তেমন নেই শহরের এই অংশে। শহরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমরা ডাউন টাউনে চলে এলাম। এর পাশেই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের ড্রাইভার ও রুয়ান্ডিজ মুসলিম। শহরে মোটামুটি ট্রাফিক জ্যাম আছে। দুপুর হয়ে গেছে, আমরা একটা হোটেলে এলাম। মোটামুটি থাকা যায়। হোটেলে ব্যাগ রেখে আবার পথে বের হলাম।
ডাউন টাউন বুজুম্বুরা
বুজুম্বুরা শহরে অনেক মানি এক্সচেইঞ্জ আছে, হোটেল থেকে বের হয়ে বেশ জ্যামে পড়লাম। তারপর বড় একটা বাজার এলাকাতে এলাম। এখানে প্রচুর ফল ও তাজা সবজি পাওয়া যায়। গাড়ি পার্ক করে আমরা টাকা বদলে নিলাম। ডলারের বিনিময়ে প্রায় ১৬৫০ ফ্রা পাওয়া গেল। মোটামুটি জমজমাট শহর। মানুষজন তাদের নিত্য দিনের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমরাও দেরি না করে টাঙ্গানিকা লেকের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বিচে: কঙ্গো-বুরুন্ডি (পর্ব ১)
হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বীচে: কঙ্গো থেকে বুরুন্ডি
ট্রাভেল
উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে দুইটার সময় সাব-৩৪০ বিমানে করে কঙ্গোর কাভুমু বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। ফ্লাইট টাইম এক ঘণ্টা বিশ মিনিট। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় বিমান মেঘের উপর দিয়ে চলছিল, নিচে তাই সাদা মেঘের সাগর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। মেঘের উপর ঝকঝকে সোনালি আলোতে ডানা মেলে উড়ছিল আমাদের বাহন। কাভুমু বিমানবন্দর সাউথ কিভু প্রদেশে এবং বুকাভু এই বিমানবন্দরের কাছের বড় শহর।ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো সেন্ট্রাল আফ্রিকার গ্রেট লেক রিজিওনের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র। এটা আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং সারা পৃথিবীতে আয়তনে ১১ তম। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশ আফ্রিকার মধ্যে চতুর্থ জনবহুল দেশ।
কঙ্গোর সাথে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি,জাম্বিয়া, এঙ্গোলা, কঙ্গো ব্রাজাভিলের সীমান্ত আছে। লেক টাংগানিকা কঙ্গোকে তাঞ্জানিয়ার থেকে আলাদা করে রেখেছে। পশ্চিমে ৪০ কিলোমিটার করিডোর দিয়ে কঙ্গো আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত। নানা ঘাত প্রতিঘাত, যুদ্ধ বিগ্রহ করে কঙ্গো বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটাতে এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে। এই দেশের মাটির নিচের সম্পদের লোভে হানাহানি আর রক্তপাত লেগেই আছে। এই বিশাল দেশটাতে কবে শান্তি আসবে তা কেউ জানে না। এক অনিশ্চিত জীবন নিয়েই এদেশের মানুষ তাদের দিন কাটাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালেই আমার এদেশে আসা হল।
স্থানীয় সময় দুইটা ত্রিশ মিনিটে আমাদের বিমান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের কাভুমু বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। আকাশ একটু মেঘলা থাকলেও বেশ আলো ছিল চারিদিকে। বিমানবন্দর একটা পাহাড়ের উপর এবং আসেপাশে সব পাহাড়ি এলাকা। ইমিগ্রেশানে একজন অফিসার বসে আছে, পাসপোর্ট নিয়ে এন্ট্রি সিল দিয়ে দিলেন।সব ফরমালিটিজ শেষ করে কাভুমু থেকে বুকাভুর দিকে রওয়ানা হলাম।
কাভুমু বিমানবন্দর বুকাভু থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, প্রায় এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ, এই পথ বুকাভু থেকে লেক কিভুর পাড় ঘেঁসে অনেকদুর গিয়ে পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে। পাহাড়ের উপর এই বিমানবন্দর। এর পাশেই কঙ্গোর সামরিক বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি। অনেক উঁচুতে বলে এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, চারিদিকে পাহাড় হলেও মাঝে বেশ ফাঁকা থাকার কারনে খোলামেলা পরিবেশ ও বাতাস চলাচল স্বাভাবিক।
কাভুমু থেকে বুকাভুর পথে
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে রাস্তাগুলো বেশ ভাল। পাহাড়ি পথে আমরা বিমানবন্দর থেকে কাভুমু শহরের দিকে চলছি। ছোট জনপদ, শহরের মাঝে একটা মোড় আছে, সেখানে কিছু দোকানপাট, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এসব দোকানে পাওয়া যায়। মোটর সাইকেল, সাইকেল ও মাইক্রবাসে সাধারণ মানুষ চলাচল করে। ঘরবাড়ি বেশিরভাগ ইটের দালান, টিনের চালা। মানুষজন আছে, মোটামুটি প্রাণচঞ্চল জনপদ। পাহাড়ের উঁচুনিচু পথে চলেছি, পাহাড়ি রোলিং কান্ট্রি সাইড বলা চলে এই এলাকাকে।
পথের ছোট জনপদ, বনপথ
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে। এখানে মাঝে মাঝে ঘন বন আছে। রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল আছে, পাহাড় থেকে নিচে এবং দূরে মাঝে মাঝে জনপদ দেখা যায়। অনেক কলার বাগান আছে পাহাড়ের ঢালে। ছোট ছোট জনপদে পাকা ঘরবাড়ীও আছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এখানে পাওয়া যায়। সাউথ কিভু প্রদেশের সিকিউরিটি সিচুয়েসান তুলনামুলক ভাবে ভাল। মানুষের যানমালের কিছুটা নিরাপত্তা এখানে আছে। আলোকিত দিন, চমৎকার আবহাওয়া, আমরা গল্প করতে করতে চলছি। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল আরোহী দেখা যায়। এই পাহাড়ি পথে তারা বেশ কষ্ট করে সাইকেল দিয়ে যাত্রী ও মালপত্র পারাপার করে।
চলার পথের জনপদ
পাহাড়গুলো বেশ উঁচু এবং পাথুরে, চলার পথে অনেক পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে ট্রাকে তোলা হচ্ছে দেখতে পেলাম। আমাদের যাত্রাপথ এক ঘণ্টা, বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা পাহাড়ের নিচে লেক কিভুর অস্তিত্ব টের পেলাম। লেকের পাশ দিয়েই চলছে এই পাহাড়ি রাস্তা। লেক কিভুর শান্ত নীল পানি দেখে বেশ ভাল লাগল। আমরা এই লেক দেখব বলেই এত দূর থেকে এদেশে এসেছি। লেকের একপাশে রুয়ান্ডার জনপদ। দূর থেকে তা দেখা যায়। পথে একটা বেশ বড় চার্চ দেখলাম। অনেক এলাকা নিয়ে এর সীমানা।
পাহাড়ের নিচে কৃত্রিম লেক তার পাশে বাঁশবন, লেকের পানিতে পাহাড়ের উপর থেকে আসা সূর্যের আলো আর বাতাসে বাঁশপাতার মিলিয়ে বেশ সুন্দর আবহ এখানে। আশেপাশের পরিবেশ থেকে এই এলাকার আলাদা পরিবেশ নজরে পড়ে।
পাহাড়ি রাস্তা থেকে নীচে বামে লেক কিভু, দূরে বুকাভু শহর
লেকের পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমরা বুকাভু শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি। দূর থেকে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠা এই শহর দেখা যাচ্ছে। বিকেলের সূর্যের আলো এখন শহরের উপর পড়ছে। বুকাভু শহরটা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের রাজধানী, সাউথ কিভু প্রদেশের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ। পাশের প্রদেশ নর্থ কিভুর রাজধানী গোমা, লেক কিভু বুকাভু থেকে গোমা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো একটা বিশাল দেশ, দেশটা আয়তনে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল গুণ বড়। ফরাসি এদেশের সরকারি ভাষা এর পাশাপাশি লোকজন স্থানীয় ভাষার ভাবের আদান প্রদান করে। সোহেলি ভাষা এবং রুয়ান্ডার ভাষা এরা বুঝে।
দূরে রুয়ান্ডার জনপদ
বুকাভু শহরের ভেতর জলপথে লেকে চলাচলের জন্য বন্দর আছে। এই বন্দর থেকে মালপত্র ও যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ও ছোট জাহাজ গোমা ও রুয়ান্ডার কিছু গন্তব্যে চলাচল করে। পুরো লেকটাই পাহাড়ের উপত্যকায়। এই লেকের গভীরতা কোন কোন জায়গাতে চারশত পঞ্চাশ মিটার। বেশ খাড়া পাড় বলে এখানে কোন প্রাকৃতিক বিচ বা বিনোদনের জায়গা নেই।
ব্যস্ত বুকাভুশহরের রাস্তা
শহরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই বাড়ছে ভিড় ও ট্রাফিক জ্যাম। রাস্তা একটু খারাপ শহরের মধ্যে। মোটর সাইকেল কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চলে, তাই বেশ সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। আমাদের জেলা কিংবা মফস্বল শহরের মত এই বুকাভু শহর। সাধারনের চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল, সাইকেল আর মাইক্রবাস আছে। ভিড় এবং যাত্রী তোলার ধরন আমাদের দেশের লোকাল বাসের মতই। মানুষ গাদাগাদি করেই চলছে। অনেক নতুন মডেলের গাড়িও আছে এখানে। এই দেশে দুটো শ্রেণীর মানুষ আছে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত প্রায় নেই বললেই চলে।
শহরের শেষ প্রান্তে আমাদের থাকার জায়গা, পুরো শহরটা তাই দেখতে দেখতে চলেছি। কিভু লেকের কোন না কোন অংশ শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যায়। পাহাড়ি চড়াই উতরাই ভেঙ্গে উঁচু নিচু পথ নানা দিকে চলে গেছে। শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল স্বাধীনতা চত্তর। এখানে একটা বিশাল বৃত্তাকার আইল্যান্ড আছে। সেখানে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কঙ্গোর পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। এই জায়গাতেই সব ধরনের মিটিং মিছিল আর গণ্ডগোল শুরু হয় তারপর তা অন্যান্য জায়গাতে ছড়িয়ে যায়। চত্বরটা বেশি বড় হওয়াতে রাস্তা সরু হয়ে গেছে বলে এখানে ট্রাফিক জ্যাম লেগেই আছে, একটা বাসস্ট্যান্ডও এখানকার ভিড় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্বাধীনতা চত্তর- বুকাভু, কঙ্গো
শহরে আসতে আসতে প্রায় চারটা বেজে গেল, এই সময় সব অফিস আদালত ছুটি হয় বলে বেশ ভিড় থাকে শহরে। আমরা শহরটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে চললাম। অফিস পাড়ার দিকটা এখন প্রায় খালি হয়ে এসেছে। এখানে রাস্তাগুলো একটু চওড়া এবং তুলনামুলকভাবে ভাল। প্রাদেশিক দপ্তর, আইন মন্ত্রণালয় এবং কিছু প্রাশাসনিক ভবন দেখে আমরা গন্তব্যের পথে যাত্রা করলাম। এখানে উন্নয়নের কাজ চলছে, একটা চত্তরে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ হচ্ছে। এখানকার বাড়ি ঘরগুলোর শেষ তালার ছাদ টিনের চালা কিংবা টালি দিয়ে বানানো এবং উজ্জ্বল রঙ করা।
শহরে কিছু অংশ দেখে লেক কিভুর পেনিনসুলা এলাকায় এলাম। এখানেই আমাদের থাকার জায়গা। এখানে পাহাড়ের উঁচু থেকে লেকের দৃশ্য দেখা যায়, পড়ন্ত বিকেলের আলো শহর ছাড়িয়ে লেক ও তার আশ পাশ আলোকিত করছে। দূরের রুয়ান্ডার জনপদ ও এই আলোর ছটায় আলোকিত। এখানে সন্ধ্যার পর সাধারণত বাহিরে চলাচল কমে যায়। প্রায় বিদ্যুৎ থাকে না, যাদের সাধ্য আছে তারা জেনারেটর চালায়। মাঝে মাঝে পানির ও সমস্যা হয়। নিচে লেকে এত পানি তবুও বিদ্যুতের অভাবে পানি পেতে সমস্যা হয় এখানে।রাতে বিশ্ব কাপের খেলা দেখে ঘুমিয়ে গেলাম।
এপ্রিলের আবহাওয়া বেড়ানোর জন্য তেমন আদর্শ না হলেও সুযোগ যেহেতু পেয়ে গেলাম তাই ঢাকা থেকে খুলনা যাবার প্ল্যান করলাম, এবার বাসে না গিয়ে ট্রেনে যাব ঠিক করলাম। ঢাকা থেকে খুলনা এসি বাস আছে এবং টিকিটও সহজেই পাওয়া যায়। আমরা ট্রেনে যাব তাই ঢাকা-খুলনা সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে যাওয়া ঠিক হলো। এসি ফোরবার্থের টিকিট পেয়ে গেলাম। আমার দুটো পরিবার এবার ভ্রমণে বের হয়েছি। সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ছয়টা বিশ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছাড়ে। বাচ্চাদের অত ভোরে উঠতে অসুবিধা হবে তাই আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পাঠালাম। গাড়িতে খাবার জন্য নাস্তা ওদের মা বেশ সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিল। সময় মত স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেন আরো ঘণ্টা দেড়েক পরে আসবে। এসি ওয়েটিং রুমে বসে রইলাম, এর রক্ষণাবেক্ষণ অতি সাধারণ মানের অথচ একটু দেশপ্রেম কিংবা আন্তরিকতা হলেই অনেক উন্নত মানের ভ্রমণ উপহার দিতে পারে দেশবাসীকে কিংবা বাংলাদেশ দেখতে আসা পর্যটকদেরকে ।
অবশেষে ট্রেন আসল। কুলি ঠিক করা ছিল। জিনিস পত্র আমাদের কমপার্টমেন্টে এনে দিল। এসি কমপার্টমেন্ট, একসময় এগুলো ঝকঝক করত এখন একটা সুইপার ফিনাইল দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করে কোনমতে রুমে একটু ভেজাপাটের ঝাড়ু দিয়ে গেল। সোফা গুলোতে ময়লা রয়ে গেছে, যাক নিজেরা পরিস্কার করে বসলাম। এই বগিতে যাত্রীদের জন্য এটেনডেন্ট আছে, এই ট্রেনের একটা দিক ভাল যে রুমের সাথে এটাচড বাথরুম, সেখানে টয়লেট পেপারও আছে। তবে গোটা বগিতে তিনটার মতো কামরাতে যাত্রী, বাকীগুলো খালি, অথচ টিকিট নেওয়ার সময় জানতাম সবটিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। ইঞ্জিন লাগার পর এসি চালো হলো। ঠান্ডা বাতাসের আমেজে দু ঘণ্টা লেইট ও অন্যান্য কষ্ট গুলো আস্তে আস্তে কমে গেল।
সাড়ে আটটার দিকে ট্রেন ছাড়লো। গরমের দিন হলেও সূর্যের আলোতে তখনও গরমভাব আসেনি, এসির মধ্যে এ আলোটাই ভাল লাগলো। কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের দুপাশের সেই পরিচিত দৃশ্য, আরো নান্দনিক এলাকা বানানো যেত এই জায়গাগুলোকে। কে খেয়াল রাখে। লাইনের দুপাশে ধুলি উড়িয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস সুন্দরবনের নগর খুলনার উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। এয়ারপোট ও জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্তসেই পুরানো সব দৃশ্য, জয়দেবপুর থেকে নতুন লাইন টাঙ্গাইল হয়ে বঙ্গবন্ধু যমুনা ব্রীজ পর্যন্ত চলে গেছে। এই লাইন দিয়ে ব্রডগেজ ও মিটার গেজ উভয় ট্রেন চলতে পারে। নতুন বড় স্টেশন হয়েছে টাঙ্গাইলে তাছাড়া মৌচাক ও অন্যান্য কয়েকটা স্টেশন ও আছে। এখানে মাঝে মাঝে ট্রেন থেমে একটা দুটো আপ বা ডাউন ট্রেনকে পাস দিল।
বঙ্গবন্ধু যমুনা ব্রিজ
বিজেএমবিতে উঠে ট্রেনের গতি কমে গেল। কোথায় সেই প্রমত্তা যমুনা, ব্রিজের নীচে চিকন খালের মত যমুনার অংশ তার পাশেই চর। চরের বালি ঢেউ খেলানো যেন নদীর ঢেউ বালিতে তার ছাপ রেখে গেছে। চরে শনের ক্ষেত, অসমতল ভূমি দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন লাইনের পাশে ট্রেন। পাশ দিয়ে উত্তর বঙ্গগামী বাস ট্রাক চলছে। আবার একচিলতে যমুনা তারপর ব্রিজটা উত্তর বঙ্গে গিয়ে শেষ । দুপাশের প্রকৃতি এখন একটু অন্য রকম। ট্রেনের দুধারে যেন ফাঁকা ধানের মাঠ, সবুজ ধান ফসল আসবে আসবে। দুরের গ্রামগুলো গাছ পালায় ছায়াঢাকা। কৃষক ধানক্ষেতের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ কাজ করছে। পানি এখন উঠে পাম্প মেশিনে, পানি দেয়া হয়েছে ক্ষেত গুলোতে। সিরাজগঞ্জ, পাবনার পাকশি তারপর ট্রেন চলবে দক্ষিন বাংলার দিকে, পথে উত্তর বাংলার অনেক ট্রেন স্টেশন।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
পাকশি স্টেশন পার হয়ে ট্রেন বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর, নীচে একসময় ছিল প্রমতা পদ্মা। এখন তার কিছুই নেই। যেন চকচক করে বালু কোথাও নাই কাঁদা। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের প্রায় সমান্তরালে চলে গেছে লালন শাহ ব্রিজ। ব্রিজ দিয়ে বাস ট্রাক চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে। ব্রিজ পার হয়ে ভেড়ামারা স্টেশন, আমরা দক্ষিণ বাংলায় ঢুকে গেছি। দর্শনা, চুয়াডাংগা, কোট চাঁদপুর হয়ে যশোর স্টেশন। ট্রেন থামলেই বাচ্চারা জানতে চায় কোন স্টেশন, কি আছে এখানে। নতুন অভিজ্ঞতা বাচ্চাদের জন্য। খুলনা আর ঘণ্টা দেড়েকের পথ । যশোর স্টেশনে ট্রেন কিছুক্ষণ থামল, তারপর আবার পথচলা । খুলনার কাছাকাছি আসতেই বেলা শেষ। মাগরিবের আজানের সময় খুলনা স্টেশনে ট্রেন থামল, স্টেশন থেকে বাহিরে এসে মসজিদে নামাজ পড়লাম। একটু ঝড়ো বাতাস ছিল তখন। এই দুদিনে যদি আবহাওয়া ভাল না থাকে তাহলে এই ভ্রমণটা মাটি হবে। অনেক আশা নিয়ে এসেছি এবং ইনশাআল্লাহ আবহাওয়া ভাল থাকবে।
রাতে খুলনা শহর দেখতে বের হলাম, খোলামেলা শহর জানজট মুক্ত নির্মল, ভাল লেগে গেল প্রথমবারেই। ঢাকার দুঃসহ জট এখানে স্বপ্নের মত। খুলনায় থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। স্টেশনের পাশে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য কতগুলো বেসরকারি পর্যটন সংস্থার অফিস। এখানে হোটেলের খোজ পাওয়া যায়। ট্যাক্সি কিংবা রিক্সায় হোটেলে যাওয়া যায়। দামও সাধ্যের মধ্যে। পরদিন সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে সাতক্ষিরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সাতক্ষীরা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে এবং সেখান থেকে নীলডুমুর আরো ঘণ্টা দেড়েকের পথ। বাসে আসলে অবশ্য সময় আরো বেশি লাগে। নীলডুমুরের স্থানীয় নাম বুড়ি গোয়ালিনী, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ পর্যন্ত অনেক বাস যায় যেখান থেকে স্থানীয় বাহনে বুড়ি গোয়ালিনী যাওয়া যায়। নীলডুমুরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি রাস্তার দু পাশে ফনিমনসার ঝোপ দেখা যাচ্ছে। বাড়িঘরের কাছেও এ ধরনের ঝোপ যা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় দেখা যায় না ।নীলডুমুর এলাকায় ঢোকার সাথে সাথেই প্রকৃতি একটু অন্যরকম। দূরে শাখা নদী, নদীর অন্যপাড় সুন্দরবনের অংশ। রাস্তার দুপার্শ্বে জলমগ্ন এলাকা, চিংড়ি চাষে লেগে গেছে । লবণাক্ততা চাষাবাদের জন্য অনুপযোগী হলেও এই লবনপানির জলাবদ্ধতা চিংড়ি চাষের উপযুক্ত জায়গা । এখানেও বাড়ীঘর ও রাস্তার পাশে ফনীমনসার ঝোপ দেখলাম ।
পর্যটনের জন্য স্থানীয় এনজিও বর্ষা মোটেল বানাচ্ছে। তাছাড়া শাখা নদীর পাড়ে ছোট ছোট গোলঘর বানানো আছে। যেখানে বসে থেকে এক দৃষ্টিতে সুন্দর বনের সোভা দেখা যায় দিন রাত। এছাড়াও তাদের আছে ছোট ছোট বোট/লঞ্চ। এসব লঞ্চে সুন্দর বনের ভিতরে ভ্রমনের ব্যবস্থা করে থাকে। মোটামুটি এসময় পর্যটকের ভিড় না থাকলেও সুন্দরবনের টানে অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে।
ঘোলাপেটুয়া নদী
দুপুরে রোদের প্রচন্ড তাপে বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করিনি ।বিকেল বেলা সুন্দরবন দেখার পালা। ঘোলাপেটুয়া নদীর ঘাট থেকে রওয়ানা হলাম সুন্দরবন দেখতে। নদীর দুপাশ থেকে অসংখ্য শাখা শিরা উপশিরার মত ছড়িয়ে গেছে । ভাটার সময় বলে এগুলোতে পানি ছিল না তবে জোয়ারের সময়ে এগুলোতে পানি থাকে। ভেজা দুইকুল দেখেই তা বোঝা যায়, নদীপথে ৪৫ মিনিট চলার পর বন বিভাগের টহল ফাঁড়ির জোট দেখা গেল। যাত্রা পথে বুড়ি গোয়ালিনী বাজার দেখলাম। এই বাজারের ঘাট থেকে যন্ত্রচালিত নৌকায় সৌখিন পর্যটকরা সুন্দরবনে ঘুরতে যায়। ঘাটে এ রকম কতগুলো নৌকা বাঁধা আছে। কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুরিজম কেন্দ্রে বোট ভিড়ালাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ব্রিজের মত পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে ফরেস্ট অফিসে যেতে হয় ।
কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুটিজম কেন্দ্র
বনবিভাগের লোকজন এখানে থাকে। নামমাত্র দাম দিয়ে টিকিট করে এখানে বেড়ানোর ব্যবস্থা আছে। ইনচার্জ আমাদেরকে জানালো বাঘ ও এখানে মাঝে মাঝে আছে এবং হরিনের অভয়ারণ্য এটা, মাটিতে অনেক হরিণের পায়ের ছাপ দেখলাম। বাচ্চারা গোলপাতা গাছ দেখার জন্য উৎসুক, নারকেল পাতার মত পাতার নাম কেন গোলপাতা এটাই তারা ভেবে পায়না। সুন্দরী, কেওড়া ইত্যাদি নানা ধরনের গাছ এখানে আছে। বনবিভাগ পর্যটনের জন্য সুন্দর ওয়াকওয়ে বানিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ জানাই দুরদর্শী সেই বন কর্মকর্তাকে।
ওয়াকওয়ে কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুরিজম কেন্দ্র
ওয়াকওয়ের একদিক দিয়ে যাত্রা শুরু করলে সুন্দরবনের গাছপালা, হরিণের পায়ের ছাপ, জোয়ার ভাটার চিহ্ন, কৃত্রিমভাবে বানানো মিষ্টি পানির আঁধার এগুলো সব দেখতে দেখতে আবার নিজ অবস্থানে ফিরে আসা যায়। ওয়াকওয়ের নীচে জোয়ারের পানি আসে, ভাটার সময় পানি নেমে যায়। মিষ্টি পানি খেতে বনের অন্যান্য প্রানী আসে। বাঘ মামারা পানির টানে চলে আসে এখানে। এই নির্জন এলাকায় বন বিভাগের লোকজন মুরগী পালে এবং কাছের বাজার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জীবন উপকরন সংগ্রহ করে আনে। চোরাকারবারি বা বনদস্যুদের হটাতে তাদের ইঞ্জিন চালিত বোট আছে। তবে এটা দিয়ে দ্রুতগামী দস্যুর বোট ধাওয়া করা বেশ কষ্টকর। সন্ধ্যা হয় হয় করছে, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পরছে। সুন্দরবনের জালের মতো বিছানো ছোট ছোট খাল ও বনের গাছপালায় ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বোটে চড়লাম। আলো থাকতে থাকতে বুড়ি গোয়ালিনী ঘাটের দিকে রওয়ানা দিলাম। বাচ্চারা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক লীলাভূমি সুন্দরবন দেখে মুগ্ধ হলো। এটা এক নতুন অভিজ্ঞতা।
বুড়ি গোয়ালিনী এলাকা, সাতক্ষীরা
সন্ধ্যায় ফেরত এসে আবার নদীর ঘাটে গেলাম জোয়ার দেখার জন্য, আকাশে হালকা চাঁদের আলো, নদীর ঘাটে সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নদীতে জোয়ারের পানির ছলাত ছলাত শব্দ। জোয়ারের সময় কিভাবে পানি বাড়ে তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তারা ঘাটের সিঁড়ির দিকে খেয়াল করছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। একটু একটু করে পানি বেড়ে সিঁড়িগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে আর তাদের আগ্রহ আরও বাড়ছে, একসময় অনেক কাছে জোয়ারের পানি এসে গেল, নদীর এই জোয়ার ভাটার অভিজ্ঞতাও তাদের কাছে নতুন, যদিও কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে তারা দেখেছে। রাত বাড়ছে তাই রেস্ট হাউজে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে খুলনার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা, সাতক্ষিরা হয়ে রওয়ানা দিলাম ।
বুড়ি গোয়ালিনী এলাকা, সাতক্ষীরা
খুলনা শহরের সাতক্ষীরার ঘোষের মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে নতুন নতুন নাম ও ডিজাইনের মিষ্টি কেনা হলো, একটা মিষ্টির নাম ইলিশ এটা বেশ হিট হলো, বাচ্চাদের এটা বেশ পছন্দ। সন্ধ্যায় রুপসা ব্রিজ দেখতে বের হলাম, প্রথমে লঞ্চ ঘাটে এলাম, লঞ্চঘাট খুলনা স্টেশনের পাশেই ।
রাত হওয়াতে যাত্রী নেই, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য রুপসা নামের পর্যটক ভর্তি দুটো লঞ্চ ঘাটে অপেক্ষা করছে। এরা প্রাইভেট পর্যটন সংস্থার মাধ্যমে প্যাকেজ ট্যুরে সুন্দরবন যাচ্ছে। একটা লঞ্চে অনুমতি নিয়ে উঠলাম, ঢুকতেই খাবার ঘর, রাতে বিরিয়ানী খাচ্ছিল যাত্রীরা । দোতালায় উঠে কেবিনগুলো দেখলাম, পর্যটকরা তাদের রুমে আরাম করছে, সকাল নাগাদ লঞ্চ ছেড়ে যাবে । এটা কটকা ও হিরন পয়েন্ট হয়ে আবার এখানেই ফিরে আসবে ।
রাতের রুপসা ব্রিজ
লঞ্চ ঘাট থেকে রুপসা ব্রিজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, রাস্তা প্রায় ফাঁকা, ব্রিজের উঠার রোড চমৎকার। সুন্দর ও নান্দনিক ব্রিজ এলাকা, আলো জ্বলজ্বল করছে। টোল প্লাজার ওপারে না গিয়ে এপারেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, নিচে নদী বয়ে চলছে। নদীতে সেই চিরপরিচিত নৌকায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে, যন্ত্রচালিত নৌকা শব্দ করে রাতের আঁধারে নদীর বুক চিরে গন্তব্যে যাচ্ছে। ব্রিজের উপর সুন্দর বাতাস কিছুক্ষণ থেকে ফিরে চললাম। ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সুন্দরবন দেখার চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসলাম। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল বলে সুন্দরবন ভ্রমণ এখন তেমন কষ্টসাধ্য নয়। একটা ছোট গ্রুপে বেশ মজা করে প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় সুন্দরবন দেখা যায়। দেশকে দেখুন, আমাদের দেশ অনেক সুন্দর। আসুন আমরা তাকে আরও সুন্দর করি।
ব্রি জেনারেল (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন লেখক সদস্য বাংলাদেশ ট্র্যাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন
নাদির অন দ্য গো আয়োজন করল প্রথম মিটআপ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজারো নাদির ভক্ত। যারা সরাসরি নাদিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সরাসরি সুযোগ পেয়েছেন। অনুষ্ঠানটি সৌজন্য করে শেয়ারট্রিপ। আয়োজক ছিল দ্য মার্বেল বি ইউ।
‘নাদির অন দ্য গো’ সুপরিচিত পুরস্কার প্রাপ্ত কনটেন্ট নির্মাতা। দেশে-বিদেশে লাখের বেশি ফলোয়ার প্রতিদিন তার কনটেন্ট উপভোগ করছেন।
নাদির মার্বেল অব টুমরো, বাংলাদেশের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সার প্ল্যাটফর্মের ট্রাভেল ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বিজয়ী। নাদির ও ভ্রমণ ভক্তরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, তার থেকে অনুপ্রেরণাও নিয়েছেন।
কনটেন্ট সহযোগী হিসেবে আয়োজনকে উজ্জীবিত করেছে ডিজিটাল ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর অরিজিনালস’। তা ছাড়া সার্ভিস সহযোগিতায় ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স’। কমিউনিটি এনগেজমেন্টে কাজ করেছে ‘কলোনি অব আর্টস’।
নাদির জানালেন, দারুণ একটি দিন ছিল। ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা আর দেখা করতে পারা সত্যিই আনন্দের। মার্বেল বি ইউ আর শেয়ারট্রিপ যৌথভাবে দারুণ আয়োজন করেছে।
শেয়ারট্রিপ মার্কেটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সামিউর রহমান জানালেন, যখন ভ্রমণের বিষয় আসে, নাদির তখন লাখো ভক্তের অনুপ্রেরণা। শুধু নাদিরের জন্য নয়, ভ্রমণ উদ্যোগে উৎসাহ দিতে শেয়ারট্রিপ সবসময়ই কনটেন্ট নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করবে।
দেশি-বিদেশি ভ্রমণকে উৎসাহ ও তথ্যবহুল করতে ভবিষ্যতে আরও অভিনব সব উদ্যোগ নিয়ে কাজ করবে ‘দ্য মার্বেল বি ইউ’।