গেজেটে নাম আছে, কিন্তু ভাতা নেই শংকুর
শংকু সমঝদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ শিশু। যার সাহস আর আত্মত্যাগ কভু ভুলে যাবার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই শংকুর রক্তে রক্তাক্ত রংপুর মুক্তির সংগ্রামে কেঁপে উঠেছিল। শিশু শংকুর অকাল মৃত্যু কাঁদিয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও। তাই ৭ই মার্চের ভাষণে শংকুকে ঘিরে ঠাঁই পায় রংপুর।
সাহসী শংকুর আত্মদানকে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রংপুরকে জায়গা দিলেও স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও ভালো নেই শংকুর পরিবার। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শিশু শহীদের পরিবারটির খোঁজ রাখে না কেউ। এখন অভাব-অনটনে দিন কাটছে দিশেহারা শংকুর মা দীপালি সমঝদারের ।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙে রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। সেই অসহযোগ আন্দোলনের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ১২ বছরের শংকু সমঝদারের।
প্রিয় সন্তান শংকু সমঝদারকে ছাড়াই কেটে গেছে বৃদ্ধা মা দীপালি সমঝদারের ৪৯টি বছর। কেউ খোঁজখবর না নিলেও হয়তো এভাবেই কাটবে বাকি দিনগুলো। বর্তমানে রংপুর মহানগরীর জি.এল রায় রোড কামাল কাছনায় সরকারের দেয়া জীর্ণশীর্ণ একটি বাড়িতে বাস করছেন শংকুর মা শতবর্ষী দীপালি সমঝদার। অসুস্থতা আর অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটছে।
স্বাধীনতার দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ২০১১ সালে শংকু সমঝদারের আত্মত্যাগ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের সঙ্গে তালিকাভুক্ত (গেজেটে ক্রমিক নং- ২৯৬১) হলেও আজও মেলেনি কোন সরকারি ভাতা। চিকিৎসার অভাবে বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ জননী দীপালি সমঝদারের আক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার থেকেও কেন মিলছে না ভাতা।
এ ব্যাপারে বার্তা২৪.কম-কে শহীদ জননী দিপালী সমঝদার বলেন, আমার ছেলের মৃত্যুর খবরে বঙ্গবন্ধু কেঁদেছিলেন। তৎকালীন সময়ে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সিদ্দিক হোসেনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমার হাতে দুই হাজার টাকাও পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার ছেলের আত্মত্যাগকে শেখ সাহেব (শেখ মুজিবুর রহমান) ভুলে যাননি বলেই ৭ই মার্চের ভাষণে রংপুরের কথা বলেছেন।
হুইল চেয়ারে বসে কাঁদতে কাঁদতে শংকুর মা বলেন, আমার খোঁজ হয় শুধু একদিন। বাকি দিন কেউ খোঁজ নেয় না। অনেকের কাছে গেজেটের কাগজ নিয়ে ঘুরেছি, কিন্তু সরকারি ভাতা পাইনি। আমার ছেলে কি শহীদ নয়। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই।
বর্তমানে শহীদ শংকুর পরিবারের সদস্য বলতে তার মা দিপালী সমঝদার, বড় ভাই কুমারেশ সমঝদার ও তার স্ত্রী কনক লতা এবং ছোট বোন ঝর্না সমঝদার সন্তান-সন্ততি নিয়ে কোনো রকমে দিনাদিপাত করছেন। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় অসুস্থ দিপালী সমঝদারের চিকিৎসা সেবাও হচ্ছে না ঠিক মতো।
শংকু সমঝদারের জীবনদানের ওই মিছিলে ছিলেন আরেক সাংবাদিক নজরুল মৃধা। তিনি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। বার্তা২৪.কম-কে তিনি বলেন, ৩ মার্চে শংকু সমঝদারসহ অন্য শহীদদের আত্মদান রংপুরকে মহীয়ান করেছে। পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলোর একটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। সেই ভাষণে শংকুর কারণেই এসেছে রংপুরের নাম।
এদিকে সরকারি ভাতা না প্রদান প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, শংকু মুক্তিযোদ্ধা নয়। সে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব গণহত্যায় শহীদ হয়েছেন। তারপরও শহীদ পরিবার হিসেবে সরকার জমির বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সরকারি ভাতা না পেলেও বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।
একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ।
৩ মার্চ রংপুরে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিশাল একটি মিছিল বের হয়। আলমনগর এলাকার অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে (বর্তমান দুদক অফিস) যেতেই মিছিলে থাকা কয়েকজন ঐ বাসার দেয়ালে উর্দুতে লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে উদ্যত হন। মিছিলের সম্মুখভাগে থাকা শংকুও ছুটে যায় তাদের সাথে। মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শংকু সমঝদার।