কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলায় পাওনা টাকা আদায়ের নামে এক গৃহবধূকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। বিচার চেয়েও না পেয়ে ওই গৃহবধূ ও তার স্বামী বিষপান করেন। এতে ওই গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ স্বামী বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান করছেন।
গত শুক্রবার (২৪ মে) ওই দম্পতি বিষপান করেন। ৫ দিন ধরে ‘বিষক্রিয়ার’ সাথে লড়াই শেষে বুধবার (২৯ মে) দুপুরে ওই গৃহবধূর মৃত্যু হয়। উপজেলার সদর ইউনিয়নের কলেজপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী গৃহবধূর নাম আশা বেগম। তার স্বামীর নাম জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। তাদের ঘরে তিন বছরের একটি শিশু সন্তান রয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন, উপজেলার সদর ইউনিয়নের হলপাড়া গ্রামের আবুসামার ছেলে জয়নাল মিয়া এবং তার সহযোগী কারিগর পাড়ার শুক্কুর কসাই, ডাকাত পাড়ার আলম কসাই ও টাঙ্গাইল পাড়ার সোলেমান।
ঘটনার সাত দিন পর গত শুক্রবার (৩১ মে) রাতে রাজিবপুর থানায় নিহত নারীর মামা মো. আকবর হোসেন ধর্ষণ ও আত্মহত্যা প্ররোচণা মামলা দায়ের করলে শনিবার (১ জুন) রাতেই জামালপুর জেলার দেয়ানগঞ্জ থানা থেকে প্রধান আসামি জয়নাল কসাই ও তার সহযোগী আলম কসাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাজিবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আশিকুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বিষপানে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া গৃহবধূর মামা বাদী হয়ে চার জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। আসামিরা হলো- জয়নাল আবেদীন, শুক্কুর আলী, আলম হোসেন এবং সোলায়মান। তারা সবাই পেশায় কসাই। রাজিবপুরের বিভিন্ন বাজারে তাদের মাংসের দোকান রয়েছে। তাদের মধ্যে জয়নাল পাওনা টাকা আদায়ের নামে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে ধর্ষণের ভিডিও করে ওই গৃহবধূকে জিম্মি করে। এরপর অপর সহযোগীদের নিয়ে দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেন। গত রমজান মাস থেকে ওই গৃহবধূর ওপর এই পাশবিক নির্যাতন চলতে থাকে। স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে বিচার না পেয়ে ক্ষোভ-অভিমানে গৃহবধূ ও তার স্বামী প্রকাশ্যে বিষপান করেন। চার দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ সংকটে বাড়ি ফেরেন তারা। বুধবার (২৯ মে) বাড়িতেই মারা যান ওই গৃহবধূ।
মৃত্যুর আগে গত ২২ মে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে দেওয়া ওই গৃহবধূর জবানবন্দির একটি অডিও রেকর্ডে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে। লোমহর্ষক বর্ণনায় উঠে এসেছে কীভাবে জয়নাল ও সহযোগীরা দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ করেছে।
বর্ণনায় ওই গৃহবধূ অভিযোগ করেন, তার বাবা নেই। মা গৃহকর্মীর কাজে বিদেশে গেছেন। স্বামী টাঙ্গাইলে শ্রমিকের কাজ করেন। স্বামীর ধার করা পাওনা টাকা দিতে না পারায় স্থানীয় জয়নাল মিয়া গত রমজান মাসের শুরু থেকে তাকে ধর্ষণ শুরু করেন। পরে তার সহযোগী শুক্কুর কসাই ও সোলেমানসহ তাকে দিনের পর দিন পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এই নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি বাধ্য হয়ে তার স্বামীকে বিস্তারিত ঘটনা জানান। পরের দিন সকালে নিহত গৃহবধু ও তার স্বামী জাহাংগীর রাজিবপুর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ সদস্য রবিউল তাদের উচিত বিচার করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে থানা থেকে ফিরিয়ে দেন। রাতে পুলিশ সদস্য রবিউলের উপস্থিতিতে স্থানীয় মাতব্বরদের নিয়ে বিচারে শুক্কুর, সোলেমান ও জয়নালকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবার সেই টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
ওই গৃবধূর স্বামী বলেন, 'আমি টাঙ্গাইল থেকে ফিরে দেখি বউয়ের শরীর ভাইঙ্গা গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলে সে শুধু কান্নাকাটি করে। পরে সব জানতে পারি। বিচার চাইলে তারা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। জয়নাল আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়।'
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যসহ স্থানীয়দের কাছে বিচার দিলেও কোনো সুরাহা মেলেনি।
এরপর গত শুক্রবার (২৪ মে) ওই গৃহবধূ ও তার স্বামী বিষপান করেন। গুরুতর অবস্থায় তাদের প্রথমে রাজিবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসক তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। কিন্তু আর্থিক সামর্থ না থাকায় এই দম্পতি বাড়িতে চলে আসেন। বুধবার বাড়িতেই গৃহবধূর মৃত্যু হয়। পরে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য থানায় নেয়।
ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘মামলা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্তসহ দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।’
এর আগে বুধবার ওই গৃহবধূ মারা যাওয়ার পর তড়িঘড়ি করে মরদেহ দাফনের উদ্যোগ নেয় অভিযুক্তরা। স্থানীয়দের বাধার মুখে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নেয়। কিন্তু অভিযুক্তদের যোগসাজশে অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত করেন ওসি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হলে ভুক্তভোগীর মামা বাদী হয়ে থানায় এজাহার দেন। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা নথিভুক্ত করার পাশাপাশি প্রধান আসামিসহ দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।