ভোগান্তি যাদের আজন্ম সাথী

অবহেলিত জনপদের নাম হিজলা-মুলাদী-মেহেন্দীগঞ্জ!

  • এস এল টি তুহিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

বরিশালের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ হিসেবে হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার নাম এখন সর্বজন স্বীকৃত। শুধু বংশ পরম্পরায় বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খুনখারাবি বা মারামারির জন্যই নয়, নদীভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের হাহাকারের জন্যও এ অঞ্চল সমানভাবে পরিচিত এখন।

রাত নামলেই গৃহবন্দি জীবন
মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল ছাড়াও অসংখ্য বসতভিটা, ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে এ অঞ্চলের মেঘনা নদীর ভাঙনে। তার ওপর রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সংকট। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে সুচিকিৎসার জন্য তাকে নিতে হবে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম)। কিন্তু এ জন্য সহজে যাতায়াতের কোনো উপায় নেই। অসংখ্য পোয়াতি মা এই হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই হয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, নয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গেল তিন উপজেলার প্রায় মানুষেরই মুখে।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে সবচেয়ে করুণ ও মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় মেহেন্দীগঞ্জ এলাকার মানুষদের। চারদিকে শুধু অথৈ জলের হাবুডুবু। রাত নামলেই গৃহবন্দি জীবন।

ফেরি বা ট্রলারে করে নদী পার হলে তবেই ওপারে হিজলা ও মুলাদী উপজেলা। এ দুটি উপজেলা পাশাপাশি এবং একই সড়কে, একই সমস্যায় জর্জরিত। এখানে আড়িয়াল খাঁ এবং মেঘনা নদী শহরের সঙ্গে এই দুই উপজেলাকেও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

অন্যদিকে, হিজলা এবং মেহেন্দীগঞ্জ নিয়ে বরিশাল-৪ আসনটি গঠিত। ফলে, হিজলার সঙ্গে মেহেন্দীগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদীভাঙন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে হিজলার তিনপাশে এবং মুলাদীর একপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা।

বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা বরিশাল-৩ সংসদীয় আসন। এখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন। বাবুগঞ্জের সন্তান রাশেদ খান ইতোপূর্বেও এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তবে নিজ এলাকার উন্নয়নে কখনোই কোনো ভূমিকা নেননি বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে মুলাদীর মানুষের জন্য তিনি কিছু করবেন বলে বিশ্বাস করতে চান না মুলাদীবাসী।

যাতায়াত সংকটের কারণে মুলাদীর বেশ কয়েকজন রোগী হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা গেছেন

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিঠু জানালেন, এই যাতায়াত সংকটের কারণে মুলাদীর বেশ কয়েকজন রোগী হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা গেছেন। এখানে মীরগঞ্জ সেতু তৈরির পরও ওপারে বাবুগঞ্জ লাকুটিয়া সড়কটি মেরামত করা না হলে ভোগান্তি কমবে না।

কৃষি এবং নদীতে মাছ শিকার এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা। বলা যায়, জেলে অধ্যুষিত অঞ্চল এই মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা। তিন উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করেন মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান এ.কে.এম. মাহফুজ-উল-আলম।

তিনি বলেন, শুধু মেহেন্দীগঞ্জের জনসংখ্যাই বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ। ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে আমরা যে এখনো বেঁচে আছি, এটাই তো আশ্চর্যের বিষয়! মেহেন্দীগঞ্জের যোগাযোগ সবটাই নদীপথে আর হিজলা উপজেলার মানুষের জন্য সড়ক পথ রয়েছে। তবে তা মুলাদীর খেয়াঘাট পর্যন্তই।

নদীপথে বরিশাল থেকে সরাসরি স্পিডবোটে তিন উপজেলাতেই আসাযাওয়া সম্ভব হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে জানালেন হাতেম আলী কলেজে অধ্যায়নরত হিজলার বাজার টেক এলাকার বাসিন্দা রেদোয়ান।

রেদোয়ান বার্তা২৪.কমকে বলেন, গরিব বা মধ্যবিত্ত কিংবা ধনী, আমাদের সবাইকে বাজার-সদাই করতে, চাকরি, পড়াশোনা করতে বরিশাল শহরে যেতেই হয়। শহরে যেতে হলে হিজলা থেকে ‘মাহেন্দ্র’ (হিউম্যান হলার) বা অটোরিকশা নিয়ে মুলাদীর কাজীচর খেয়াঘাট যেতে হবে। সেখান থেকে খেয়া পার হয়ে ওপারে মীরগঞ্জ। মীরগঞ্জ থেকে অটোরিকশা বা ইজিবাইক নিয়ে বাবুগঞ্জের রহমতপুর যেতে হবে। আগে তাও লাকুটিয়া দিয়ে যাতায়াত করা যেতো। কিন্তু ওই সড়ক এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। আমাদের তাই আরো ঘুরে রহমতপুর থেকে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় পৌঁছাতে কম করে হলেও দুই, আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে এখন।

বরিশাল থেকে হিজলা উপজেলা পরিষদে এসে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল নিয়ে এই প্রতিবেদকেরও দেড় ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে মাত্র ৪০ কিলোমিটার পথের দূরত্ব পার হতে।
তিন পাশে নদী। একপাশে সড়ক চলে গেছে, মুলাদীর কাজীরচর খেয়াঘাট পর্যন্ত। চারদিকে শুধু ভাঙনের চিত্র এখানে।

বেড়িবাঁধ এলাকায় বাঁধের ওপর অসংখ্য ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। টেকের বাজার বা বাজার টেক পার হয়ে দক্ষিণে বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রাম। মেঘনা নদীর পাড়ে এখানে ২শ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে নদীভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। নদী তীরবর্তী বাউসিয়া গ্রামের মানুষ তাতেই অনেক খুশি!

স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ ও শাম্মী আহম্মেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তারা বলেছেন, এই ব্যাগ যদি ফেলা না হতো, তাহলে এবছরের মধ্যে হিজলা উপজেলা পরিষদ এলাকাও নদীতে বিলুপ্ত হয়ে যেতো।

স্থানীয় ইউপি সদস্য ঝন্টু হাওলাদারসহ গ্রামবাসীর কয়েকজন বলেন, এই জিও ব্যাগ হয়ত সাময়িকভাবে ভাঙন রোধে সাহায্য করবে তবে নদীর দুই পাড়ে বরিশালের চরকাউয়া ও চরবাড়িয়া বেড়িবাঁধের মতোই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

একইসঙ্গে মীরগঞ্জ সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি রক্ষার দাবিও জানান হিজলা উপজেলার বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ।

উপজেলা পরিষদ চত্বরে কথা হয়, স্থানীয় সাংবাদিক ও হিজলা প্রেসক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে

এখানে উপজেলা পরিষদ চত্বরে কথা হয়, স্থানীয় সাংবাদিক ও হিজলা প্রেসক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। দেলোয়ার হোসেন জানালেন, ইতোমধ্যে ৫টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে, আরো অর্ধশতাধিক গ্রাম। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদিও এখানে ৬শ ২৮ কোটি টাকার কাজের বরাদ্দ দিয়েছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টাও শুরু হয়েছে। তবে ১০টি প্যাকেজে এই কাজ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি প্যাকেজের কাজই দৃশ্যমান।

এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, নদীভাঙন রোধে গৃহীত পদক্ষেপ আমার আসার আগেই হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কাজের মান নিয়েও কিছু বলতে পারবো না। তবে মীরগঞ্জ সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে।

মীরগঞ্জ সেতু তৈরি হয়ে গেলে এ অঞ্চলের মানুষের ৮০ ভাগ ভোগান্তি দূর হয়ে যাবে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন।