কোরবানির আমলের ধারাবাহিকতা ও বাধ্যবাধকতা



মাওলানা ওয়াহিদুল আলম, অতিথি লেখক, ইসলাম
মিনা প্রান্তর, বা দিকের পাহাড়ের ওপর হজরত ইবরাহিম আ. ছেলে ইসমাইলকে কোরবানি করার চেষ্টা করেন, ছবি: সংগৃহীত

মিনা প্রান্তর, বা দিকের পাহাড়ের ওপর হজরত ইবরাহিম আ. ছেলে ইসমাইলকে কোরবানি করার চেষ্টা করেন, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কোরবানি হজরত আদম আলাইহি সালামের পর থেকে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরিয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সকল নবীর উম্মতকেই কোরবানি করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব। এই স্বভাবের স্বীকৃতি প্রদান করে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ -সূরা হজ: ৩৪

আমাদের কোরবানি সুন্নতে ইবরাহিমি
আমাদের ওপর যে কোরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নতে ইবরাহিমি’ হিসেবে চালু হয়েছে।

মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে- ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। হজরত ইবরাহিম (আ.) যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাইলকে তার উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আজহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জানমাল আল্লাহর পথে কোরবানি করার সাক্ষ্য প্রদান করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই মহত্ত্ব ও মাকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূল (সা.) এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আজহা উপহার দিয়েছেন এবং কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন।

হজরত ইবরাহিম (আ.) কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। তিনি স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয়বস্তু কোরবানি দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে জানা যায়, এই স্বপ্ন হজরত ইবরাহিম (আ.) পরপর তিন রাত্রি দেখেছিলেন। প্রথমবার তিনি ১০টি উট কোরবানি করেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখলে এবার তিনি ১০০টি উট কোরবানি করলেন। তৃতীয়বার যখন একই স্বপ্ন দেখলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমার কাছে প্রিয়বস্তু একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাইল ছাড়া তো আর কিছুই নেই। মূলত আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাও তাই। প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ তাকে এমন সময় দেওয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন-পালন করার পর পুত্র পিতার সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে এবং তাকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে। তাফসিরবিদগণের কেউ কেউ লিখেছেন, এ সময় হজরত ইসমাইলের বয়স ছিল তেরো। কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাফসিরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা।

এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী-রাসূলগণের স্বপ্নও অহির অন্তর্ভুক্ত। স্বপ্নে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর একমাত্র পুত্রকে জবেহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেওয়ার কারণ হলো- হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান প্রতিপালকের নির্দেশ সত্বর পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।

কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহিম (আ.)- এর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন- তাই তিনি পুত্র ইসমাইলের সঙ্গে পরামর্শ করার নিমিত্তে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন বলো, তুমি কি মনে করো?’ -সূরা আস সাফফাত: ১০২

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শের ছাঁচে গড়া পুত্র ইসমাইল তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণে মস্তক অবনত করে জবাবে বললেন, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই হিসেবে পাবেন।’ -সূরা আস সাফফাত: ১০২

এরপর পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কোরবানির নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন। ইতিহাস ও তাফসিরভিত্তিক কোনো কোনো রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, শয়তান কোরবানির মহান এ কাজে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করে। সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাইল (আ.)-কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা শয়তানের প্ররোচণাকে কোনো পাত্তা দিলেন না। মরদুদ শয়তান হজরত হাজেরা (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-কে ধোঁকা দেওয়া থেকে নিরাশ হয়ে মদিনা যাওয়ার পথে তিন জায়গায় তিনবার হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) তাকে প্রত্যেকবারই সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিস্বরূপ মিনায় ওই তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিধান হাজিদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন কোরবানির উদ্দেশে মিনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাইল পিতা ইবরাহিম (আ.) কে বললেন, আব্বাজান! আমার হাত-পা খুব শক্ত করা বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার সওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হয়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটি ভালো করে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালামটুকু অনুগ্রহপূর্বক পৌঁছে দেবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু হজরত ইবরাহিম (আ.) দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, ওগো আমার প্রাণপ্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছো। হজরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন। অতঃপর তাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহতায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজান! আমাকে উপোড় করে শুইয়ে নিন। কারণ আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। হজরত ইবরাহিম (আ.) তাকে উপোড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুণরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখনও গলা কাটছে না। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হজরত ইসমাইলের বিনা জবেহেই তার কোরবানি কবুল করে নিলেন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের আনুগত্যের শির নত করে দিলেন এবং ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে উপোড় করে শুইয়ে দিলেন (জবেহ করার জন্য), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক কঠিন পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কোরবানি দিয়ে ফিদিয়াস্বরূপ তাকে (ইসমাইলকে) উদ্ধার করেছি।’ -সূরা আস সাফফাত: ১০৩-১০৭

অতঃপর মহান আল্লাহ নির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে জবেহ করুন। তখন ইবরাহিম (আ.) পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি হৃষ্ট-পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সে দুম্বাটিকে জবেহ করলেন। এটাই সেই কোরবানি যা আল্লাহর দরবারে এতই প্রিয় ও মাকবুল হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা অবিস্মরণীয় রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন। যার কারণে মিল্লাতে ইবরাহিমে তথা দ্বীন ইসলামের এক মহান ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে এ কোরবানি আজও পালিত হয়ে আসছে।

আল্লাহু আকবার তাকবিরের প্রেক্ষাপট
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওনা হলেন। তিনি ভাবলেন, না জানি আমি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইবরাহিম (আ.) জবাই কাজ শেষ করে দেন! আর এ জন্যই জিবরাইল (আ.) আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার। হজরত ইসমাইল (আ.) পিতার মুখে তাওহিদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। হজরত জিবরাইল (আ.) এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরের দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।

   

পথচারীদের ঠাণ্ডা শরবত দিচ্ছে মারকাজুল কোরআন পরিবার



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
পথচারীদের ঠাণ্ডা শরবত দিচ্ছে মারকাজুল কোরআন পরিবার, ছবি : সংগৃহীত

পথচারীদের ঠাণ্ডা শরবত দিচ্ছে মারকাজুল কোরআন পরিবার, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

চলমান তীব্র দাবদাহে রাজধানীর পিপাসার্ত মানুষের মাঝে টানা চার দিন ধরে সুপেয় ঠাণ্ডা শরবত (লাল চিনি, বিট লবণ, লেবু এবং এসএমসির ম্যাংগো ও অরেঞ্জ ফ্লেবার মিশ্রিত) বিতরণ করছে মারকাজুল কোরআন শিক্ষা পরিবার।

রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যাণ্ড, মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে এবং মিরপুর ১ ও ১০-এর বিভিন্ন পয়েণ্টে শনিবার (২৭ এপ্রিল) সকাল থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পর ধারাবাহিকভাবে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন ১ হাজার ৫ শ’ লিটার শরবত বিতরণ করা হচ্ছে।

মে দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচিকে সামনে রেখে মারকাজুল কোরআন শিক্ষা পরিবার বুধবার (১ মে) মিরপুর ঈদগাঁহ ময়দান ও টিএসসির মোড়ে শরবত বিতরণ করবে।

পথচারীদের মাঝে ঠাণ্ডা শরবত বিতরণের বিষয়ে মারকাজুল কোরআন শিক্ষা পরিবারের সভাপতি ও মানবসেবায় সাড়া জাগানো প্রতিষ্ঠান তাকওয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান গাজী ইয়াকুব বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সমগ্র দেশবাসী এখন প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে অবস্থান করছেন। এমন সময় আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তীব্র গরমে আমাদের আশপাশে অবস্থান করা শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই তাদের উদ্দেশ্যেই মূলত এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘গরমের তীব্রতা বেশি থাকলে সামনে আরও বেশ কিছুদিন এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

হিট স্ট্রোকের মারাত্মক এই অবস্থায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্পটে ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত পথচারীদের বিনামূল্যে এমন উদ্যোগে ভীষণ খুশি সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, প্রচণ্ড গরমে রাস্তায় বেরিয়ে সবার প্রাণ যখন উষ্ঠাগত, তখন পথচারীদের ডেকে ডেকে শরবত করাচ্ছেন আলেম-উলামা ও মাদরাসার ছাত্ররা। এর চেয়ে বড় মানবিক কাজ আর হতে পারে না।

;

শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক হবে ভাই ভাই



মাওলানা ফখরুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে মে দিবস গুরুত্বসহকারে পালিত হয়, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে মে দিবস গুরুত্বসহকারে পালিত হয়, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণা ও আবেগের দিন পয়লা মে। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মাহুতি দান করেছিলেন শ্রমিকরা। তাদের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে মে দিবস গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। মে দিবস এলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ঘর্মাক্ত মেহনতি মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর এই মেহনতি মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে এই ঐতিহাসিক দিনে।

সময়ের পরিবর্তনে মে দিবস এখন সারা দুনিয়ায় সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেরণায় কল-কারখানা, অফিস-আদালতসহ সব কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা এখন উজ্জীবিত। যে উদ্দেশ্যে শ্রমিকেরা আন্দোলন করে জীবন দিয়েছিলেন সেই কাঙ্ক্ষিত কাজের সময়সূচি এখন প্রায় কর্মক্ষেত্রে অনুসৃত হচ্ছে। তবে মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে নানা আপত্তি রয়েছে। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা যে নেই তা বলা যাবে না।

এমন কথাও বড় করে বলার উপায় নেই যে, ১৮৮৬ সালের পর দীর্ঘ একশত আটত্রিশ বছর পর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি মিলেছে; শ্রমিক তার অধিকার সত্যিকারার্থে ফিরে পেয়েছে এবং তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত মজুরি নিশ্চিত করতে পেরেছে। কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, কিন্তু এখনও শ্রমিক নিপীড়ন থামেনি এবং শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে সহজেই এটা অনুধাবন করা যায়।

সুতরাং অনেকটা জোড় গলায় বলা যায় যে, দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামই শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এখন থেকে দেড় হাজার বছর আগে।

নবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিকের মেহনতের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য তিনি যে ঐশ্বরিক বিধান চালু করেছিলেন, তাতে শ্রমিক ও শ্রমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার অমোঘ বাণী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অতুলনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে ভাই ভাই উল্লেখ করে তিনি তাদের অধিকার ও পাওনার ব্যাপারে যে উক্তি করেছিলেন তা অসাধারণ।

নবী কারিম (সা) বলেছেন, ‘মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি থাকা ও পোশাক দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন।’ -সহিহ বোখারি

রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রমিককে আপনজনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করো, তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে।’ একই কথা নবী কারিম (সা.) আরেক হাদিসে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোনোরকম কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জানো না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথাদানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করো না।’ -সহিহ বোখারি

শ্রমিকরাও মানুষ। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও মানবিক অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখার বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘মজুরদের সাধ্যের অতীত কোনো কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয় তবে নিজে সাহায্য করো।’ -সহিহ বোখারি

শ্রমিকের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুলত্রুটি ক্ষমার মতো মহৎ মনের অধিকারী হয়, সেটা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহর নবী (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘মজুর চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ।’ নবী কারিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘অসদাচরণকারী মালিক বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’

শ্রমিকের মজুরি আদায়ের ব্যাপারে নবী কারিম (সা.)-এর অতি পরিচিত এবং বিখ্যাত একটি উক্তি সবার জানা। তিনি বলেছেন, ‘মজুরকে তার গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই মজুরি পরিশোধ করে দাও।’ শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নবী কারিম (সা.)-এর এই বাণী শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টিকে আরও বেশি মহীয়ান করেছে।

এভাবে ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার যে নিশ্চয়তা দিয়েছে, তা দুনিয়ার আর কোনো মতবাদ বা দর্শন দেয়নি। আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনোটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেনি। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রদানসহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে।

মে দিবসের প্রাক্কালে আমরা বলতে চাই, নানা আয়োজনে প্রতি বছর শ্রমিক দিবস পালন করার মধ্যে শ্রমিকের প্রকৃত মুক্তি নেই। যে অধিকারের জন্য শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শিকাগোর রাজপথে, তা বাস্তবে এখনও অর্জিত হয়নি। আজও শ্রমিকেরা পায়নি তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পায়নি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি কাঠামো এবং স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত জীবনের নিশ্চয়তা। মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শ্রমিকের প্রতি মালিকের সহনশীল মনোভাব থাকতে হবে। শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে তাকে কাজ দিতে হবে। শ্রমিককে মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য তার মজুরি সেভাবে নির্ধারণ করতে হবে।

মালিককে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তার নিজের স্বজনরা যে রকম জীবনযাপন করবে, তার অধীনস্থ শ্রমিকরাও সে রকম জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। মালিক-শ্রমিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে, তাকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা অবশ্যই সুরক্ষিত হবে- ইনশাআল্লাহ।

;

শ্রমিকরা আল্লাহর বন্ধু



পারভীন আকতার, অতিথি লেখক, ইসলাম
শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দিতে বলা হয়েছে, ছবি : সংগৃহীত

শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দিতে বলা হয়েছে, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রমিকের ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো যে; ইসলামই শ্রমিকদের যথাযথ পাওনা পরিশোধপূর্বক তাদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতের ঘোষণা দিয়েছে। শ্রমিকদের মর্যাদা প্রসঙ্গে নবী কারিম (সা.) ঘোষণা করেন, ‘শ্রমিক হলো আল্লাহর বন্ধু।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাকে ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।

এ কথা হাদিসে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, মানুষ হিসেবে আল্লাহর রাসুল (সা.) পারিবারিক কাজ কর্মসমূহ সম্পাদনে রত থাকতেন। যখন আজান হতো তখন তিনি নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা বিচার করি তাহলে দেখতে পাবো যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) কাজ করেছেন।

নবী কারিম (সা.)-এর সাহাবিরাও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতেন। নবী কারিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকেও সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

আল্লাহর রাসুল (সা.) বিদায় হজের দিন আরাফাতের মাঠে দাঁড়িয়ে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা যা খাবে ও পরবে তোমাদের অধীনস্থদেরকেও তা খেতে ও পরতে দেবে। তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো কাজ তাদের ওপর চাপানো যাবে না।’

এ সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদিস হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন- কেয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফরিয়াদি হবো। ১. যে ব্যক্তি আমার নামে দান করার ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করেছে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করেছে, ৩. আর যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করে তার কাছ থেকে পুরোপুরি কাজ আদায় করেছে, আর তার মজুরি পরিশোধ করেনি।’ -সহিহ বোখারি : ২২২৭

নবী কারিম (সা.) শ্রমিক, খাদেম ও চাকর-চাকরানীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সবাইকে কঠোরভাবে নির্দেশ দান করতেন। এ মর্মে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু আলী সুয়াইদ ইবনে মুকরিন (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বনি মুকরিন গোত্রের সাত ব্যক্তির মধ্যে সপ্তম ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে দেখেছি। আমাদের সবার একটিমাত্র খাদেম (সেবাকারী) ছিল। আমাদের মধ্যে ছোট ব্যক্তি যে ছিল সে খাদেমকে থাপ্পড় দিয়েছিল, তাই রাসুল (সা.) খাদেমটাকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন।’ -সহিহ মুসলিম

নবী কারিম (সা.)-এর আরেকটি হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু মাসউদ বদরি (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন- আমি আমার এক গোলামকে (দোষের কারণে) চাবুক দিয়ে মারছিলাম, হঠাৎ পেছন থেকে শব্দ শুনতে পেলাম- সাবধান; আবু মাসউদ! রাগে উত্তেজিত থাকার কারণে আমি শব্দটা বুঝতে পারলাম না। নিকটে আসতে আমি বুঝলাম তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)। তিনি বলছেন, তুমি তোমার ক্রীতদাসের ওপর যতটুকু ক্ষমতার অধিকারী, তোমার ওপর আল্লাহ তা অপেক্ষাও অধিক ক্ষমতার অধিকারী।

অন্য বর্ণনামতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভয়ে আমার হাত থেকে চাবুকটি পড়ে গেল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে আমি দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দিলাম। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যদি তুমি এটা না করতে, জাহান্নামের আগুন তোমাকে বেষ্টন করে নিতো।’ -সহিহ মুসলিম : ১৬৫৯

নবী কারিম (সা.)-এর সঙ্গে যারা আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সুমহান দায়িত্ব পালন করেছেন তারাও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিরামহীন চেষ্টার ত্রুটি করেননি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব সাহাবি এ বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু যর গিফারি (রা.) নিজে যে ধরনের কাপড় পরিধান করতেন, তার চাকরকেও সে ধরনের কাপড় ব্যবহার করতে দিতেন। খাদ্য, পানীয়সহ যাবতীয় অন্ন-বস্ত্রের ক্ষেত্রে সাহাবিদের নিয়মনীতি ছিল অনন্য দৃষ্টান্ত।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) এশার নামাজের ইমামতির সময় সুরা বাকারার মতো দীর্ঘ সুরা তেলাওয়াত করতেন। এক্ষেত্রে একজন শ্রমিক সাহাবি জামাত থেকে আলাদা হয়ে একাকী নামাজ আদায় করলে তার বিরুদ্ধে নবী কারিম (সা.)-এর নিকট অভিযোগ দায়ের হলো। আল্লাহর রাসুল (সা.) ওই শ্রমিক সাহাবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে শ্রমিক সাহাবি শারীরিক পরিশ্রমের কারণে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার অপারগতার কথা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে অবহিত করেন। নবী কারিম (সা.) হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে ডেকে এ মর্মে সতর্ক করে দেন যে, জামাতে ইমামতির সময় দীর্ঘ সুরা তেলাওয়াত না করতে। কারণ জামাতে শ্রমিক, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও অন্যান্য অসুবিধায় জর্জরিত মুসল্লি থাকতে পারে। তাদের কথা বিবেচনায় রেখে ইমামতি করতে হবে।

এ হাদিসের মর্মার্থটা উল্লেখ করার উদ্দেশ্যটা হলো- একজন শ্রমিক আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর নিকট কত প্রিয় সে বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য।

;

হাফপ্যান্ট পরা বিষয়ে ইসলাম কী বলে?



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ইসলামে পোশাক কেমন হবে এমন নীতিমালা রয়েছে, ছবি : সংগৃহীত

ইসলামে পোশাক কেমন হবে এমন নীতিমালা রয়েছে, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

রাস্তাঘাটে নানা বয়সী হাফপ্যান্ট পরা মানুষের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না৷ অথচ হাঁটু ঢেকে কাপড় পরা ফরজ, হাঁটু খোলা রাখা হারাম৷ আর এটা এমন হারাম যা গোপনে নয়, প্রতিনিয়ত জনসম্মুখে পাপে লিপ্ত হতে হয়৷ সমাজের মুসলমানদের মাঝে সেই হারামে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা ও ঝোঁক বেড়েই চলেছে৷ যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, কোনো গোনাহ প্রকাশ্য করতে করতে একসময় ভেতর থেকে অনুশোচনাবোধের অনুভূতিটুকু নষ্ট হয়ে যায়৷ হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সবাইকে মাফ করে দেওয়া হবে, কেবল প্রকাশ্য গোনাহকারী ছাড়া৷’ -সহিহ বোখারি

হাফপ্যান্ট পরা কি জায়েজ?
ইসলাম একজন মুসলিমকে শালীন পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, পুরুষকে আবশ্যকীয়ভাবে ঢাকতে হবে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আর নারীর জন্য হাতের কব্জি মুখমণ্ডল পায়ের পাতা ছাড়া সব সতর (মানব শরীরের যেসব অংশ অপরের সামনে ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক, সেটাকে সতর বলে)।

ইসলামে পোশাক কেমন হবে এমন নীতিমালা রয়েছে। প্যান্ট, পায়জামা ইত্যাদি হাঁটুর নিচ অবধি থাকবে, তবে টাখনুর নিচে নয়। আবার পোশাক এতটা আঁটসাঁট হবে না যে, সতরের আকৃতি কাপড়ের ওপর প্রকাশ পায়। হ্যাঁ, পরিধানের প্যান্ট-শার্ট যদি উপর্যুক্ত খারাবি থেকে মুক্ত হয়, তাহলে পরিধান করা নাজায়েজ নয়। অবশ্য এরপরও তা পরিধান করা মাকরুহ। তা ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়। -দরসে তিরমিজি : ৫/৩৩২

জ্ঞানের অভাবে অনেকে সঠিক পোশাক নির্বাচন ও অবলম্বন করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে কিছু নীতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য। আবার কিছু স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে। এর কয়েকটি হলো-

সতর আবৃত করা
পোশাক এমন হতে হবে যা পুরোপুরি সতর আবৃত করে। পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর পুরো শরীর সতর। পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো- সতর ঢাকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি পোশাক, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সৌন্দর্য দান করে।’ -সুরা আরাফ : ২৬

সুতরাং যে পোশাক এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ তা শরিয়তের দৃষ্টিতে পোশাক নয়। তা নাজায়েজ পোশাক। এটা পরিত্যাগ করে পূর্ণরূপে সতর আবৃত করে এমন পোশাক গ্রহণ করা জরুরি। যেমন পুরুষের জন্য হাফ প্যান্ট পরা। নারীদের পেট-পিঠ উন্মুক্ত থাকে এমন পোশাক পরিধান করা।

পোশাক অধিক পাতলা ও আঁটসাঁট না হওয়া
যে পোশাক পরিধানের পরও সতর দেখা যায় কিংবা সতরের আকৃতি পোশাকের ওপরে প্রকাশ পায়, তা সতর আবৃত না করার কারণে নাজায়েজ পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের পোশাক পরিধান হারাম।

অহংকার প্রকাশ পায় এমন পোশাক না হওয়া
এমন পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ, যেগুলোকে শরিয়ত অহংকারীদের নিদর্শন সাব্যস্ত করে। যেমন পুরুষের জন্য রেশমি কাপড় ব্যবহার। হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের পুরুষের জন্য রেশম এবং স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে। আর নারীদের জন্য এগুলো হালাল করা হয়েছে। -জামে তিরমিজি : ১/৩০২

হজরত আবু জুরাই (রা.)থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান থেকে বিরত থাকো। কেননা এটা অহংকারবশত হয়ে থাকে। আর আল্লাহতায়ালা অহংকারীকে ভালোবাসেন না। -সুনানে আবু দাউদ : ২/৫৬৪

হাফপ্যান্ট পরে অজুর বিধান
নামাজের মতো মৌলিক ইবাদত ছাড়াও সবসময় অজু করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছিলেন, ‘হে আমার বেটা! সম্ভব হলে সবসময় অজু অবস্থায় থাকবে। কেননা মৃত্যুর ফেরেশতা অজু অবস্থায় যার জান কবজ করেন তার শাহাদাতের মর্যাদা লাভ হয়।’ -শোয়াবুল ঈমান, বায়হাকি : ২৭৮৩

স্বাভাবিক শালিন পোশাকে অজু করা উচিত। কারণ, সতর ঢাকা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর আবশ্যক। অপরদিকে হাফপ্যান্ট পরলে সতর অনাবৃত থাকে। তাই হাফপ্যান্ট পরা এবং পরিধান করে অজু করা উচিত নয়।

হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা নগ্নতা থেকে বেঁচে থাক। কেননা তোমাদের এমন সঙ্গী আছেন (কিরামান-কাতিবীন) যারা পেশাব-পায়খানা ও স্বামী-স্ত্রীর সহবাসের সময় ছাড়া অন্যকোনো সময় তোমাদের হতে আলাদা হন না। সুতরাং তাদের লজ্জা কর এবং সম্মান কর।’ -সুনানে তিরমিজি : ২৮০০

তারপরও কেউ যদি হাফপ্যান্ট পরে করে অজু করে তাহলে তার অজু হয়ে যাবে। তবে কাজটি অনুচিত এবং এ ব্যাপারে কাউকে উৎসাহিত না করা।

;