পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মে শুভ ও অশুভ শক্তির ধারণা পাওয়া যায়। ভালোর প্রতিনিধিত্বকারী শুভ শক্তি মানুষকে শুভ কাজে উৎসাহিত করে আর মন্দের প্রতিনিধিত্বকারী অশুভ শক্তি মানুষকে বিপথগামী করে। ইসলাম ধর্মে অশুভ শক্তির প্রতিনিধিদের শয়তান বা ইবলিস বলা হয়। শয়তান ও ইবলিস সম্পর্কে ইসলামি বিশ্বাসের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় পৃথিবীর আরো কিছু ধর্মে।
শয়তানের পরিচয়
পবিত্র কোরআন-হাদিসে শয়তানকে প্রধানত দুটি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে- শয়তান ও ইবলিস। আরবি ভাষাবিদরা বলেন, ইবলিস শব্দটি গ্রিক ‘ডায়াবোলস’ Diabolos শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। অর্থ কুৎসা রচনাকারী, বিশ্বাসঘাতক ও মিথ্যুক। ইংরেজি ডেবিল শব্দটিও একই উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে।
শয়তান শব্দটি আরবি ‘শাতানুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ কূপ থেকে পানি তোলার লম্বা রশি। যেহেতু শয়তান তার প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে মন্দ পথে টেনে নিয়ে যায়, তাই তাকে শয়তান বলা হয়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ইবলিসের নাম ছিল আজাজিল। সে ছিল ফেরেশতাদের মধ্যেও সম্মানী। তার চারটি পাখা।’ তিনি অপর বর্ণনায় বলেন, ‘ইবলিস ছিল ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহতায়ালার নাফরমানি করার কারণে তার ক্রোধে পরে শয়তান হয়ে যায়।’ আবু জায়েদ, হাসান, কাতাদাহ প্রমুখ বলেন, ইবলিস জিন জাতির আদি পিতা, যেমন হজরত আদম (আ) মানবজাতির আদি পিতা। তবে সে ফেরেশতা নয়। গ্রিক ভাষায় তার নাম আজাজিল, আর আরবি ভাষায় হারিস। -তাফসিরে কুরতুবি : ১/২৩৬
কোরআন মাজিদে শয়তানের বর্ণনা
কোরআন মাজিদে শয়তানকে মানবজাতির শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে তার ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোরআনে কারিমে শয়তানকে ইবলিস নামে ৯ স্থানে ১১ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর কোরআনে কারিমের প্রায় ৮৮টি আয়াতে শয়তান শব্দটি এক ও বহু বচনে ব্যবহৃত হয়েছে।
শয়তানের ব্যাপারে কোরআন মাজিদের মৌলিক বক্তব্য হলো-
জিনদের অন্তর্ভুক্ত: শয়তান প্রকৃত পক্ষে ফেরেশতা নয়, জিন ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন তারা সবাই সিজদা করল ইবলিস ছাড়া। সে জিনদের একজন, সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল।’ -সূরা কাহাফ : ৫০
আল্লাহর অবাধ্য: ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন ফেরেশতারা সবাই সিজদাবনত হলো কেবল ইবলিস ছাড়া। সে অহংকার করল এবং অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’ -সুরা সোয়াদ : ৭৩-৭৪
শয়তান মানুষের শত্রু: ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিইনি যে তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না। কেননা সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?’ -সুরা ইয়াসিন : ৬০
শয়তান মানুষকে প্রতারিত করে: প্রতারিত করার মাধ্যমে শয়তান মানুষকে মন্দ কাজে উৎসাহিত করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সে বলল, আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেব। আমি তাদের পথভ্রষ্ট করবই; তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবই।’ -সুরা নিসা : ১১৮-১১৯
শয়তানের রয়েছে মানব সহযোগী: মানব সমাজে শয়তানের কিছু সহযোগী আছে। আর তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা অবিশ্বাসী তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।’ -সুরা নিসা : ৭৬
তাওরাত ও ইনজিলে শয়তান
ইনজিল কিতাব বস্তুত তাওরাতেরই নতুন সংস্করণ মাত্র। তাই তাওরাত ও ইনজিলে শয়তান সম্পর্কিত বর্ণনা প্রায় অভিন্ন। এই দুই আসমানি কিতাবে শয়তানকে ইবলিস নামে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাকে মানবজাতির শত্রু ও পাপের উৎস বলা হয়েছে। খ্রিস্ট সমাজে শয়তান লুসিফার নামেও পরিচিত। তাওরাত ও ইনজিলে শয়তান সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার কয়েকটি হলো-
মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করে: শয়তান মানবজাতিকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ভ্রান্তির পথে পরিচালিত করে। ইনজিলের বিশ্ব সৃষ্টিসংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে, শয়তান সাপের ওপর ভর করে বেহেশতে প্রবেশ করে এবং হজরত হাওয়া (আ.)-কে বিভ্রান্ত করে। তিনি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেন এবং জান্নাত থেকে বিতাড়িত হন।
শয়তান পাপের উৎস: ইহুদি ও খ্রিস্টান জাতির কাছে শয়তান পাপের উৎস ও অনুপ্রেরণা। ‘পাদ্রিদের প্রতি উপদেশ’ আলোচনায় বলা হয়েছে, ইবলিস পাপের উদ্ভাবক, পাপের উৎস, পাপীদের সরদার ও আল্লাহর শত্রু। সে ফেরেশতাদের ওপরও প্রভাব বিস্তারকারী।
শয়তান পৃথিবীর রাজা: এই পৃথিবীতে শয়তানের রাজত্ব ও বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। সে পৌত্তলিকতার স্রষ্টা। তবে হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
জাদুজগতের রাজা: শয়তান জাদুকরদের সর্দার। কেননা সে নিম্নবর্গীয় পাপিষ্ঠ আত্মার রাজা। জাদুর প্রভাব বিস্তারে নিম্নবর্গীয় পাপিষ্ঠ আত্মারা ক্রিয়াশীল।
ইয়াজিদিদের বিশ্বাসে শয়তান
ইয়াজিদি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে- ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করে সাতজন ফেরেশতার মাঝে তা স্থাপন করেছেন। আর সাতজনের প্রধান মালাক তাউস বা ময়ুর ফেরেশতা। তাদের বিশ্বাস অনুসারে মালাক তাউস হলো অনুতপ্ত শয়তান। জান্নাত থেকে বিতাড়নের পর সে অনুতপ্ত হয়।
কেয়ামতের আগে শয়তানকে ক্ষমা করা হবে এবং সে তার হারানো মর্যাদা ফিরে পাবে। ইয়াজিদিরা শয়তান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা এবং তাকে পাপের উৎস হিসেবে মানতে অস্বীকার করে।