চেরনোবিলের কিছু নতুন বাসিন্দা



ভাষান্তর: তোফায়েল আহমেদ
ভাদিম মিনজুক তার কারখানায়/ছবি: বিবিসি

ভাদিম মিনজুক তার কারখানায়/ছবি: বিবিসি

  • Font increase
  • Font Decrease

চেরনোবিলে ১৯৮৬ সালের পারমাণবিক দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়া বিষক্রিয়ার কারণে পালিয়ে যায় অনেক বাসিন্দা। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে একগুচ্ছ ভুতের গ্রাম। কিন্তু এখন সংরক্ষিত এলাকার কিনারের দিকের ক্ষয়িষ্ণু বাড়িগুলোতে আবার কিছু নতুন বাসিন্দা বসবাস শুরু করেছেন।

এক উষ্ণ গ্রীষ্মের সন্ধ্যা, মেরিনা কোবলেডেকা তার দুই কিশোরী মেয়ের সাথে বাড়ির পেছনের উঠোনে খেলছেন। পারিবারিক কুকুর বলের সঙ্গে কুস্তি করে মুরগির বাচ্চাগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, দেখে হাসছে ইরিনা ও ওলিনা। বাড়ির পেছনদিকের বেড়ার বাইরের দিকের সবকিছু নীরব এবং স্থির হয়ে আছে।

ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় স্টেসিচিনা গ্রামের অনেকগুলো বাড়ি, একটা দোকান এবং লাইব্রেরি খালি পড়ে আছে। শুধুমাত্র যুদ্ধে বিধ্বস্ত বন আবার তার পূর্বের রূপ ফিরে পাচ্ছে। লতানো গুল্মগুলো পরিত্যক্ত বাড়ির ভাঙা দেয়াল ভেদ করে বেড়ে উঠছে। এখানে তাদের কিছু প্রতিবেশীও রয়েছেন। কিন্তু প্রায় সবাই এখানে সত্তর এবং আশির দশকে এসে বসতি গেড়েছেন। সামাজিক অনুদান ও সুযোগ সুবিধার ঘাটতি সত্ত্বেও, চার বছর আগে মেরিনা ও তার দুই কিশোরী মেয়ে তাদের যা কিছু ছিল সব নিয়ে ইউক্রেনের কয়েকশত মাইল অতিক্রম করে চেরনোবিল সংরক্ষিত এলাকার ৩০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করতে আসেন।

১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, চেরনোবিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার শিকার হয়। পাওয়ার সেন্টারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে, যা একটানা ১০ দিন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। মেঘ এসব রেডিওঅ্যাকটিভ কণাকে হাজার হাজার মাইল জুড়ে বিস্তৃত করে এবং পুরো ইউরোপ জুড়ে বিষাক্ত বৃষ্টি হতে থাকে। ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ, যারা চেরনোবিলে বসবাস করত সবাইকে তাৎক্ষণিক নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত রিঅ্যাক্টরের আশপাশে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয় যা পরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহেও বর্ধিত হয়।

এর পরের কয়েকমাসে আরও ২ লাখ ৩৪ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে ফেলা হয়, যাদের প্রায় সবাইকে তড়িঘড়ি করে বাসস্থান ছাড়তে হয়েছিল। কিছু সংখ্যককে তাদের সবকিছু গোছাতে মাত্র কয়েকঘণ্টা সময় দেয়া হয়। অন্যদেরকে বলা হয়েছিল, তারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ স্থান ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না। এদের অনেকেই যারা প্রান্তিক চাষি ছিল, তাদেরকে অনেকগুলো পাকা টাওয়ার ব্লকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এদের অনেকে কখনই চেরনোবিল ছেড়ে যায়নি।

আজ পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করা অবৈধ। এসব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ১৩০-১৫০ জন বাসিন্দা এখন পর্যন্ত এই এলাকায় বসবাস করছেন। এদের অনেকেই নারী যারা, তাদের ৭০-৮০ দশকে বসবাস করা পূর্বপুরুষদের জমিতে চাষাবাদ করছেন।


বাড়ির উঠোনে খেলছেন মেরিনা ও তার দুই মেয়ে

সংরক্ষিত এলাকার বাহিরে কিছু নতুন আগন্তুক এসেছেন। এদের একজন মেরিনা কোবলেডেকা। মেরিনার বাড়িটি মেরামত করা খুবই প্রয়োজনীয়। মেঝেগুলোতে পচন ধরেছে এবং ধাতব রেডিয়েটার গুলোতেও ফাটল দেখা যাচ্ছে। শীতকালে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়া এসব এলাকায় পচন ধরা মেঝে কিংবা ফাটল পড়া রেডিয়েটরের উপস্থিতি একটি বড় সমস্যা।

তাদের মৌলিক কিছু রাষ্ট্রীয় অনুদান রয়েছে যেমন— গ্যাস, বিদ্যুৎ, মোবাইল সিগন্যাল ইত্যাদি। মোবাইল সিগনাল থাকার মানে হচ্ছে তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তাদের একটি মাত্র টয়লেট যা বাড়ির বাড়ির বাইরের দিকে। পানিও দূষিত। পানির জন্য তাদের একমাত্র অবলম্বন দূষিত নলকূপ যা পাইপের মাধ্যমে বাড়ির সাথে সংযুক্ত হয়েছে। দূষিত হওয়ার কারণে ব্যবহারের পূর্বে পানিকে আগে ফুটাতে হয়।

গ্রামে একটা ভালো বাড়ি থাকা মানে হচ্ছে ৩৫০০ ডলার ব্যয় করার সামর্থ্য থাকা। কিন্তু এমন সম্পত্তি খুবই কম। কাঠে নির্মিত এসব অধিকাংশ খালি বাড়িই বাড়ির মালিকেরা কয়েক শত ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে।

মেরিনা যখন এখানে আসেন, তখন এমন সস্তা বাড়ি ক্রয় করাও তার জন্য কষ্টকর ছিল। এর পরিবর্তে গভর্নিং কাউন্সিল তার পরিবারকে একটি বাড়িতে ভাগাভাগি করে থাকার এক অস্বাভাবিক প্রস্তাব দেয়। বাড়িতে থাকার বিনিময়ে তারা এক বৃদ্ধের সেবা শুশ্রূষা করবে, যিনি ডিমেনশিয়া নামক রোগের একদম শেষপর্যায়ে আছেন। দুই বছর পূর্বে ওই ব্যক্তি মারা যায় এবং মেরিনার পরিবার সেখানেই বসবাস করা শুরু করে।

উঠোনের বাইরে দাড়িয়ে ইরিনা এবং ওলিনা তাদের পরিবারের বাকিদের দেখাচ্ছে— কিছু মুরগি, খরগোশ, ছাগল এমনকি একজোড়া গিনিপিগও।তাদের স্কুল ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্কুলবিহীন দিনগুলোতে তাদের অধিকাংশ সময়ই বাগানে মাকে সাহায্য করা, সবজি ফলানো এবং তাদের পোষা প্রাণীগুলোকে দেখাশোনা করেই কাটায়। পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস হচ্ছে ১৮৩ ডলারের রাষ্ট্রীয় অনুদান (৫২৩৫ ইউক্রেনিয়ান রিবনিয়া), নিজেদের খাদ্য সামগ্রী ফলানো এবং দুধ ও মাংসের জন্য পশু পালন করা তাদের বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয়।

বসবাসের জায়গা পাওয়া

মেরিনা এবং তার মেয়েরা পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলের এক বিশাল শিল্পনগরী তোসকিভকা থেকে পালিয়ে আসেন। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ৪ বছরের এ সংঘাতে আনুমানিক প্রায় ১০০০০ মানুষ মারা যায় এবং বিশ লাখেরও অধিক মানুষ বাস্থচ্যুত হয়।

সংঘাত শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিজেদের ভূখণ্ডে যুক্ত করে। সশস্ত্র রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাশিয়ার পক্ষভুক্ত হয়। যোদ্ধারা কয়লাশিল্পের কেন্দ্রস্থল ডনবাসে দোনস্ক ও লুহানস্ক শহরে দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিটমহল ঘোষণা করে। যেহেতু রাশিয়াপন্থি যোদ্ধারা একের পর এক গ্রাম দখলে নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে শহর বিতাড়ন করছিল, মেরিনাদের বাড়ি তখন তীব্র শেলিংয়ের লক্ষবস্তু হয়।

প্রতিদিন সকালে কিছু সময় ছাড়া বোমাবর্ষণ অনবরত চলত। সাময়িক যুদ্ববিরতির সময় প্রত্যেকে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করত। এ সময়ে ইরিনা এবং ওলিনা স্কুলে যেত, তাদের মা মেরিনা বাজারে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দুপুরের আগেই যুদ্ধ শুরু হত। অধিকাংশ রাতই তাদের তীব্র গোলাবর্ষণের মধ্য কাটাতে হতো।

এমনি এক ফাঁকে ইরিনা এবং ওলিনা বাড়ি ফেরার পথে অপ্রত্যাশিত ভাবে তারা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যায়। তারা এক দোকানির কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দোকানি পরে তাদেরকে রাস্তা থেকে দূরে এক বাড়িতে নিয়ে রাখে। এ ঘটনার পরই মেরিনা তাদের বাড়ি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ডনবাস অঞ্চলের এরকম দশটি পরিবার ছিল যারা একইরকম দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সংরক্ষিত অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করতে যায়। মেরিনার মতো তারাও পুরনো বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের পরামর্শে এখানে আসে। এমনকি এক মহিলা জানান, ‘ইউক্রেনের মধ্য সবচেয়ে কম মূল্যে জীবনযাপন করা যায় এমন জায়গা’ লিখে তিনি গুগলে খোঁজ করেন। উত্তর আসে, ‘চেরনোবিলের কাছে’।

বিপর্যয়ের পর থেকে বিজ্ঞানীরা মাটি, গাছপালা এবং পশুপাখিদের ওপর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পরীক্ষা করছেন, এমনকি সংরক্ষিত এলাকার বাহিরেও। বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয়তা আর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নেই, বলছিলেন ভেলরি কাশপারভ, তিনি ইউক্রেনিয়ান ইনস্টিটিউট অব কালচারাল রেডিওলজির ডিরেক্টর। কিন্তু কিছু এলাকার মাটির দূষিত অবস্থা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। কাশপারভ এবং তার দল সংরক্ষিত এলাকার বাহিরের গরুর দুধে অতিরিক্ত পরিমাণ সিজিয়াম-১৩৭ এর উপস্থিতি পেয়েছেন। ঘাসের মাধ্যমে শোষিত সিজিয়াম কণা গবাদি পশুর মধ্য ছড়িয়েছে।

এর গ্রহণের মাত্রা বৃহৎ পরিমাণে হলে মানবকোষ সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটা থাইরয়েড ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কাশপারভ বলছিলেন এসব ঝুঁকি কিছু নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার দল এমন হটস্পট নির্ধারণে কাজ করছেন, যাতে সংরক্ষিত এলাকার বাহিরে যারা বসবাস করছেন তারা কী ধরনের সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন তা নির্ধারণ করা যায়।

এক মানচিত্রে স্টাচিয়ান গ্রাম দেখাচ্ছিলেন কাশপারভ যেখানে মেরিনার পরিবার বসবাস করে। এই গ্রামেই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থেকে সিজিয়াম-১৩৭ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলছিলেন উৎপাদিত শাকসবজি, ছাগলের দুধে এসবের ঝুঁকি খুবই কম। কিন্তু এই এলাকায় বন্য খাদ্য সামগ্রী যেমন— মাশরুম অথবা বন্য ব্যারিজ এসবের মধ্যে তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি নির্ণয়ে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

মেরিনা বলেন, তেজস্ক্রিয়তার সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে তাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, তার পরিবার এসবের থেকেও ভয়াবহ কিছু থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে, আর তা হল যুদ্ধ। তেজস্ক্রিয়তা হয়ত আমাদের ধীরে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু এখানে গুলি অথবা বোমা মেরে মারতে পারবে না।

এক উদ্যোক্তা

রাজধানী কিয়েভ থেকে গাড়িতে করে মাত্র দুই ঘণ্টারও কম রাস্তা। সংরক্ষিত এলাকা বরাবর এই ভুতুড়ে নগরে শুধু কিছু পরিবারই সুযোগের সন্ধানে আসেনি, আছেন কিছু উদ্যোক্তাও।

প্রতিদিন ভাদিম মিনজুক তার পালিত কুকুরকে নিয়ে সংরক্ষিত এলাকার শুরু নির্দেশকারী উঁচু কাটাতারের বেড়া বরবার হাটেন। পাখির কিচিরমিচির ও বনের নিস্তব্ধতা উপভোগের জন্য এটি তার প্রিয় একটি জায়গা।

এটা ফিনল্যান্ডের উত্তরে কিংবা আলাস্কাতে বসবাস করার মতো, বলছিলেন ভাদিম। এই এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব পুরো ইউক্রেনের মধ্যে সর্বনিম্ন, প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র দুই জন।

ভাদিম মিনজুক তার কারখানায়

পূর্ব ইউক্রেনের হরলিভকাতে তার আগের বাসস্থান, যেখানে প্রতি বছর মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করা যেত। কিন্তু শহর যখন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল, আর্টিলারির আনাগেনা বাড়ছিল, তখন তার এককালের বর্ধিষ্ণু কলকারখানা ও ওয়্যারহাউজগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ভাদিম এখনও স্মরণ করেন একদিনের ঘটনা। বাড়ির পেছনের দরজার দিকে তিনি দেখেন বিদ্রোহী সেনারা বাগানের বেড়ার ডানদিকে ব্যারিকেড তৈরি করছে। মাঝেমধ্যে সৈন্যরা ১০০ মিটারেরও কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তার পরিবারকে শহরের বিভিন্ন সেনা চেকপোস্টে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়েছে। তারা রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। এমনকি তাদের সামনে থেকেই বিদ্রোহীরা এক ব্যক্তিকে কার থেকে তুলে নিয়ে যায়, তারপর তাদের সামনেই হত্যা করে।

প্রথমে ভাদিম তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপদে সরিয়ে রাখে। তারপর তারাও একদিন এই অঞ্চল ত্যাগ করে। হরলিভকাতে যা কিছু ছিল, সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যায় তারা। প্রথম কয়েক মাস সঞ্চয় থেকে খরচ করেছেন। ভাদিম পুরো ইউক্রেন চষে বেড়িয়েছেন যাতে পরিবারকে নিয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করা যায়

এক আত্মীয় শুনেছিলেন চেরনোবিলে কিছু সম্পত্তি সস্তায় বিক্রি করা হবে। তিনি সরেজমিন দেখতে সেখানে যান, গিয়ে ডিডাককি নামক এক গ্রামে এক পরিত্যক্ত শস্যাগার দেখতে পান। সংরক্ষিত অঞ্চলের ঠিক ডানপাশে এবং রাজধানী কিয়েভ থেকে মাত্র ১১৫ কিলোমিটার দূরত্ব। সাথে সম্পত্তির মূল্যও সস্তা ছিল। সুতরাং এটা একটা বাস্তবসম্মত ব্যবসার সুযোগ ছিল। স্থানীয়রা এর লোহা ও কলকব্জা নিয়ে যাওয়ায় এর ছাদটা ফুটো হয়ে যাচ্ছিল। আমি মালিকের সাথে দেখা করে একটি চুক্তি করি।

১৪০০ ডলারে গুদাম ও আরও তিনটি বাড়ি মাত্র ২৪০ ডলারে কিনে ভাদিম সেগুলোকে বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং ধাতু গলানোর ব্যবসা শুরু করেন। আমার কৌশল ছিল বর্জ্য থেকে তৈরি পণ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করা, বলছিলেন ভাদিম। প্রথম বছর সবচেয়ে কঠিন ছিল, কিন্তু গত দুই বছর আমার ব্যবসা ভালো হয়েছে।

এমনকি ভাদিম ডনবাসের প্রাক্তন সাত কর্মীকে আবার নিয়োগ করেন এবং তার একটি বাড়িকে হোস্টেলে রূপান্তর করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করি এবং কর্মীরা যেন ভালো সঞ্চয় করতে পারে এজন্য তাদেরও সহযোগিতা করি। আমি এই গ্রামের সর্বোচ্চ করাদাতা। পরিশেষে আমি ইউক্রেনীয়, এবং আমার দেশকে সহায়তা করতে চাই।

ভাদিম বলেন, মাঝেমধ্যে আমি তেজস্ক্রিয়তার কথাও চিন্তা করি। এমনকি তিনি তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের জন্য হাত দিয়ে নড়াচড়া করা যায় এমন গিগার কাউন্টারও ক্রয় করেন। কিন্তু তিনি ভীত ছিলেন না। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ পর্যায়ে আছে। সর্বোপরি আপনি যুদ্ধে যে ভয়াবহতা দেখেছেন তার তুলনায় তেজস্ক্রিয়তা কিছুই না।

তিনি এখানে জীবনকে উপভোগ করছেন। এটা শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতিই না, বিশেষ একধরনের শান্তিও বটে। মেরিনা এবং ভাদিম উভয়ের পরিবারই বলছিলেন কিভাবে এই শান্তপ্রকৃতি এবং পরিবেশে দীর্ঘসময় ধরে হাঁটাকে তারা ভালবাসেন। জীবন হয়ত খুবই সাধারণ এখানে কিন্ত কোনো পরিবারই এখান থেকে আর বড় শহরে যেতে চায় না। এমনকি যদিও এটার অর্থ এই হয় যে সেখানে প্রচুর বন্ধু ও সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। আমি তেজস্ক্রিয়তাকে ভয় পাই না বলছিলেন মেরিনা। আমার বাচ্চাদের মাথার ওপর দিয়ে আর গোলা উড়ছেনা, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। এই শান্ত পরিবেশে আমরা দুশ্চিন্তা ছাড়াই ঘুমোতে যাই এবং কোথাও আমাদের আর লুকিয়ে থাকতে হয় না। এভাবেই ইতি টানছিলেন মেরিনা।

ভাদিম বলেছিলেন, তার স্ত্রী ওলিনা কখনও কখনও অবরুদ্ধ অঞ্চলটির সাথে তাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত আদি শহর হরলিভাকার তুলনা করেন। তবে এখানে একটি স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে— এখানে সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রান্তে তিনি বিশ্বাস করেন, তাদের পরিবারের একটি ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে। আমার মনে হয়েছিল— আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি, বলছিলেন ভাদিম।

অনুবাদক:তোফায়েল আহমেদ (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: বিবিস

   

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;