করোনার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ওষুধের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রয়মূল্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি



ড: মো: আজিজুর রহমান,
ড: মো: আজিজুর রহমান/ছবি: সংগৃহীত

ড: মো: আজিজুর রহমান/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনাভাইরাস গোত্রের সার্স-কোভ-২ নামক ভাইরাসের প্রজাতিটি ইতোমধ্যে সারা বিশ্বকে প্রায় অচল করে ফেলেছে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ উন্নত অনেক দেশেই চলছে কোভিড-১৯-এর কার্যকরী প্রতিষেধক আবিষ্কারের জোর প্রচেষ্টা।

১। বেশ কয়েকটি ওষুধ ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভালো ফল পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন দেশের গবেষকগণ। এর মধ্যে কয়েকটি ওষুধ আছে যেগুলো অন্য ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না থাকায় সেগুলো পরীক্ষামূলক ভাবে এ রোগে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জার পরীক্ষামূলক গবেষণাধীন ওষুধ ফাভিপাইরাভির, এইডসের ওষুধ লোপিনাভির এবং রিটোনাভির-এর কম্বিনেশন এবং ইবোলা, সার্স, মার্স, মারবার্গ ইত্যাদি ভাইরাসঘটিত রোগের জন্য পরীক্ষামূলক গবেষণাধীন ওষুধ রেমডেসিভির। অন্যান্য যেসব ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে তার মধ্যে আছে ম্যালেরিয়া, রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস (rheumatoid arthritis) এবং লুপাস রোগের ওষুধ ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন; পলিআর্টিকুলার জুভেনাইল ইডিয়োপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস (পিজেআইএ) এবং সিস্টেমিক জুভেনাইল ইডিয়োপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস (এসজেআইএ) রোগের ওষুধ “টোসিলিযুমাব” এবং ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ফুসফুস, ত্বক, কান ও যৌনঘটিত রোগের সংক্রমণে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক “অ্যাজিথ্রোমাইসিন”।

২। ফাভিপাইরাভির (ব্র্যান্ড নাম অ্যাভিগান) হলো জাপানিজ কোম্পানি ফুজি ফিল্ম তোয়ামা কেমিক্যালের আবিষ্কৃত একটি ওষুধ যা জাপান সরকার ২০১৪ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দেয়। ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির রাসায়নিকভাবে বেশ আলাদা হলেও তাদের কাজের পদ্ধতি একই। দুটি ওষুধই আরএনএ ভাইরাসের আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের কাজে বাধা তৈরি করে। চীনে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে যে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয় তা হলো ফাভিপাইরাভির। গত ১৮ মার্চ এলসিভিয়ার প্রকাশিত “ইঞ্জিনিয়ারিং” নামক জার্নালে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এ ট্রায়ালে ৩৫ জন কোভিড-১৯ রোগীর একটি গ্রুপকে দেয়া হয় ফাভিপাইরাভির ট্যাবলেট (প্রথম দিন ১৬০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার এবং পরবর্তী ১৪ দিন ৬০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার) এবং ইনহেলার হিসেবে দিনে দুইবার করে ৬০ মাইক্রোগ্রাম ইন্টারফেরন-আলফা১বি। আরেকটি গ্রুপকে দেয়া হয়েছিলো এইডসের ওষুধ লোপিনাভির (৪০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার) এবং রিটোনাভির (১০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুইবার)-এর কম্বিনেশন এবং ইনহেলার হিসেবে দিনে দুইবার করে ৬০ মাইক্রোগ্রাম ইন্টারফেরন-আলফা১বি। দেখা যায়, রোগীদের ফাভিপাইরাভির প্লাস ইন্টারফেরন দেয়া হয়েছিলো তারা গড়ে চার দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে ওঠে। লোপিনাভির-রিটোনাভির প্লাস গ্রুপের ইন্টারফেরন গ্রুপের রোগীদের গড়ে সময় লাগে এগারো দিন। ফাভিপাইরাভির প্লাস ইন্টারফেরন গ্রুপের রোগীদের চেস্ট ইমেজিংইয়েও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় (প্রায় ৩০ শতাংশ)। আরেকটি সম্প্রসারিত ট্রায়ালে ৩৯০ জন রোগীর ওপর একই রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সে ট্রায়ালে পূর্বের মতোই ফল পাওয়া যায় বলে জানানো হয়। তবে, ফাভিপাইরাভির শুধুমাত্র মৃদু থেকে মাঝারি কোভিড-১৯ রোগে কাজ করে, রেমডেসিভিরের মতো গুরুতর অবস্থায় এটি ভালো কাজ করে না। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ফাভিপাইরাভির করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় এখনও পরীক্ষাধীন।

৩। অন্যদিকে পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণায় খুব ভালো ফল না পেলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মাসের ১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) “ইমারজেন্সি ইউস অথোরাইজেশন” স্কিমের আওতায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা গুরুতর অবস্থায় আছেন, তাদের জন্য ‘রেমডেসিভির’ ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। “ইমারজেন্সি ইউস অথোরাইজেশন” স্কিমের আওতায় অনুমোদিত ওষুধসমূহ সাধারণ এফডিএ-এর সাধারণ অনুমোদনের মতো নয়। তাই, সম্ভাবনা আছে যদি অন্য কোনো ওষুধ ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণায় রেমডেসিভিরের তুলনায় বেশি কার্যকরী প্রমাণিত হয়, ইউএসএফডিএ ওষুধটির প্রাথমিক অনুমোদন বাতিল করে দিতে পারে, ফলে রেমডেসিভিরের পরিণতি দাঁড়াতে পারে ইবোলায় এর ব্যবহারের মতো। প্রসঙ্গত, রেমডেসিভির ড্রাগটির আবিষ্কারক আমেরিকার বিখ্যাত জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি গিলিয়াড সায়েন্সেস ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস রোগে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করে। কিন্তু, ২০১৮ সালে ইবোলা ভাইরাস রোগে এটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ রেমডেসিভিরের চাইতে আরও দুটি ওষুধ (রেজেনেরন এবং মনোক্লনাল এন্টিবডি ১১৪) ইবোলা ভাইরাস রোগে অধিক কার্যকরী বলে প্রমাণ পায়। তাই, ইবোলা ভাইরাস রোগে রেমডেসিভিরের ব্যবহারের অগ্রগতি সেখানেই থেমে যায়। ফাভিপাইরাভিরের মতো রেমডেসিভিরও এক প্রকারের প্রো-ড্রাগ যা প্রাণীদেহে প্রবেশের বিভিন্ন এনজাইমের প্রভাবে সক্রিয় হয় এবং ভাইরাসের আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের বিরুদ্ধে কাজ করে। রেমডেসিভির কোভিড-১৯ আক্রান্তদের দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভাবে কাজ করছে বলে দাবি করছে এর আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান এবং ট্রায়াল সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ। ৬টি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং যুক্তরাজ্য) ১০৬৩ জন রোগীর করা ৩য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল হিসেবে জানানো হয় রেমডেসিভির প্রয়োগে প্লাসেবো গ্রুপের তুলনায় সেরে ওঠার সময় ৪ দিন কমে এসেছে (১৫ দিন থেকে ১১ দিন) এবং মৃত্যুহারও কমেছে (১১.৬ শতাংশ থেকে ৮.০ শতাংশ)। গিলিয়াড এখনো তাদের গবেষণার ফলাফল কোন পিয়ার-রিভিইউড জার্নালে প্রকাশ করেনি কিন্তু খুব শীঘ্রই প্রকাশ করবে বলে জানায়। কিন্তু, ২৯ এপ্রিল বিশ্বের নামকরা প্রভাবশালী জার্নাল “ল্যানসেট”-এ চীনের ১৫৮ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীর উপরে চালানো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হলে রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। ল্যানসেটের সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয় রেমডেসিভির ব্যবহারে রোগীদের অবস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। প্লাসবো গ্রুপের তুলনায় রক্তে এটি রোগীর শরীরে ভাইরাসের সংখ্যাও কমাতে পারেনি। ল্যানসেটের সেই গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে গিলিয়াডের ভাষ্য হলো চীনের ট্রায়ালে রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫৮ জন এবং রোগীরা ছিল শুধু একটিমাত্র দেশের। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত ট্রায়ালে ছয় দেশের মোট ১০৬৩ জন রোগী অংশ নিয়েছে, তাই এই ফলাফলটাই বেশি নির্ভরযোগ্য। গিলিয়াড এও জানায় ১৫টি দেশের ১৮০টি হাসপাতালে ৫,৬০০ জন গুরুতর অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীর ওপর এই ওষুধের কার্যকারিতা আরও পরীক্ষা করার জন্য একটি সম্প্রসারিত ট্রায়াল চালানোর প্রস্তুতি চলছে। গবেষকরা মনে করছেন সেই সম্প্রসারিত ট্রায়ালের ফলাফলই বলে দিবে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এর ভবিষ্যৎ।

৪। ক্লোরোকুইন এবং এর আরেকটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ রাসায়নিক ফর্ম হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়া, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যামিবিয়াসিস এবং লুপাস চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এগুলো ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভিরের মতো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নয়, কিন্তু কোভিড-১৯ চিকিৎসায় চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যহবার করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পোষক দেহের কোষের pH বাড়িয়ে দেয় ফলে কোষের যে সকল অংশ (এন্ডজোম এবং লাইজজম) ভাইরাসকে ফিউসন প্রক্রিয়ায় কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে সহায়তা করে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এটি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন এবং মানবদেহের কোষের ACE2 রিসেপ্টরের সংযোগ প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে, ফলে ভাইরাস কোষের ভিতরে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। মার্চের ২০ তারিখে ফ্রান্সে পরিচালিত একটি ছোট ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গবেষণার ফল এলসিভিয়ারের জার্নাল “ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অ্যাজেন্টস”-এ প্রকাশিত হয় এবং এটিতে দাবি করা হয়, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় স্পষ্টভাবেই কোভিড-১৯ রোগীদের সারিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সাথে অ্যাজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে রোগীদের শরীর থেকে ভাইরাস আরও দ্রুততার সাথে নির্মূল হয়েছে। কিন্তু ট্রায়ালে রোগীর সংখ্যা কম হওয়ায় এই ট্রায়ালের ফলাফলের উপর নির্ভর করা সমীচীন হবে না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দেন। পাশাপাশি ইউএসএফডিএ ওষুধটি রোগীদের ওপর মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়। শুধুমাত্র নিশ্চিত কোভিড-১৯ রোগীদের ওপর এটা সতর্কতার সাথে ব্যবহারের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। এদিকে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে ১৩৭৬ জন নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ রোগীর ওপর চালিত একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার ফলাফল গতকাল প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারে রোগীদের মৃত্যু বা সুস্থ হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। এ গবেষণার ফল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললো।

৫। গত এপ্রিল ২০২০ এর প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের দুটি নামকরা ওষুধ প্রস্তুতকারি কোম্পানি, বেক্সিমকো, বিকনকে এবং পরবর্তীতে এসকেএফ এবং জিসকা ফার্মাকে ফাভিপাইরাভির উৎপাদনের অনুমতি দেয়। ইতোমধ্যে বিকন ফার্মা “ফাভিপাইরা” ব্রান্ড নামে এটি ২০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট প্রস্তুত করা শুরু করেছে এবং তারা বেশ কিছু ট্যাবলেট পরীক্ষার জন্য হস্তান্তর করেছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, বিকন ফার্মা ২০টি ট্যাবলেটের দাম নির্ধারণ করেছে ৮ হাজার টাকা (প্রত্যেক ২০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেটের দাম পড়বে ৪০০ টাকা)। চীনে ব্যবহৃত ডোসেজ রেজিমেন ব্যবহার করলে চৌদ্দ দিনের চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রায় ৩৮,০০০ টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনে সম্ভবত ভুল করে দিনে দুইবার ব্যবহারের পরিবর্তে দিনে তিনবার ফাভিপাইরাভির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এটি দ্রুত সংশোধিত করা উচিত, না হলে অতিরিক্ত ডোজের কারণে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

মে মাসের ১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র রেমডেসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার পর তিন দিনের মাথায় দেশের আটটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে ওষুধটি উৎপাদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই কোম্পানিগুলো হলো বেক্সিমকো, এসকেএফ, ইনসেপটা, স্কয়ার, বিকন, হেলথকেয়ার, অ্যাকমি ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস। দুদিন আগে এসকেএফ ইতোমধ্যে ওষুধটির উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলেছে এবং “রেমিভির” ব্রান্ড নামে বাজারজাত করার প্রস্তুতি শুরু করেছে। পাঁচদিনের চিকিৎসায় এসকেএফের ওষুধটি কিনতে রোগীর খরচ হবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আর দশ দিনের চিকিৎসায় খরচ পড়বে ৬০ হাজার টাকার মতো। বার্তা২৪.কম এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এসকেএফ প্রতিটি ওষুধের বাজারমূল্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। ফাভিপাইরাভির অথবা রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসার এই উচ্চমূল্য কতজন রোগী ব্যাক্তিগতভাবে সরবরাহ করতে পারবে তা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।

৬। ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির দুটোই এখনো বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। এদের মধ্যে রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে এবং ফাভিপাইরাভির গুরুতর করোনা রোগে তেমন কাজ করে না। এটি মৃদু থেকে মাঝারি লক্ষণের রোগীদের ওপর পরীক্ষা করে ফল পাওয়া গেছে। চিকিৎসার খরচও আকাশ্চুম্বি। প্রশ্ন হলো এরকম দুটি ওষুধকে আমাদের দেশে একটি কন্ট্রোলড, র‍্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যাতীত যথেচ্ছভাবে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহার করা উচিত হবে কিনা। আরেকটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সহ যেসব দেশে রেমডেসিভিরের ট্রায়াল চালানো হয়েছে তাতে আবিষ্কারক কোম্পানি গিলিয়াডের সরবরাহ করা রেমডেসিভির ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা হয়েছে। গিলিয়াডের রেমডেসিভির ব্যবহার করেও যেখানে খুব উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায়নি, সেখানে গিলিয়াড ব্যাতিত অন্য কোনো এপিআই প্রস্তুতকারী কোম্পানির রেমডেসিভির কেমন ফল দিবে তা র‍্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যাতীত বলা অসম্ভব। পাশাপাশি যে সকল দেশীয় কোম্পানি এ ওষুধগুলো প্রস্তুত করছে তারা একই সোর্সের এপিআই ব্যবহার করছে কিনা তাও নিশ্চিত করতে হবে। না হলে একেক কোম্পানির প্রোডাক্ট একেক রকম ফলাফল দিবে। এরকম হলে মার্কেটে ছাড়ার পূর্বে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পাশাপাশি এসব প্রোডাক্টের বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্টও করা উচিৎ। আর ইন্টারফেরন-আলফা১বি ইনহেলার একইসঙ্গে ব্যবহার না করলে ফাভিপাইরাভির কাজ করবে কিনা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। উল্লেখ্য, ইন্টারফেরন-আলফা১বি ইনহেলার আমাদের দেশে কোনো কোম্পানি বাজারজাত করে বলে আমার জানা নেই।

দেশীয় ওষুধ কোম্পানিসমূহের উপর আমাদের আস্থা অনেক। যে সকল কোম্পানি ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির উৎপাদনের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের দেশে-বিদেশে বেশ সুনাম রয়েছে। দেশের শত শত গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট সফলভাবে কাজ করছেন এসব কোম্পানিতে। তাদের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বও অনেক উঁচু মানের। আমার বিশ্বাস দেশের এ সংকটে এ সকল স্বনামধন্য কোম্পানিসমূহ ফাভিপাইরাভির ও রেমডেসিভির উৎপাদন এবং বিপণনে শুধু লাভের চিন্তা করবে না, এসব ওষুধের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা, রোগীদের কল্যাণ এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিবে। পাশাপাশি আমি এও বিশ্বাস করি রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর উক্ত বিষয়গুলো যথাযথভাবে তদারকি করবে এবং কিভাবে এ ওষুধগুলোর দাম করোনা রোগীদের ক্রয়ক্ষমতার রাখা যায় সে ব্যবস্থা করবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকায় বিনামূল্যে ওষুধগুলো রোগীদের জন্য সরবরাহ করা যায় কিনা তাও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আসলেই কার্যকরী কিনা তা নিয়ে দেশেই চালাতে আরেকটি র‍্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।

ড: মো: আজিজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ফার্মেসী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

   

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;