কিশোরগঞ্জের সমরেশ বাবু



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
কিশোরগঞ্জের সমরেশ বাবু, ছবি: সংগৃহীত

কিশোরগঞ্জের সমরেশ বাবু, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

কিশোরগঞ্জের সমরেশ বাবু নামে তিনি সমধিক পরিচিত। হাওরের জনপদ ইটনার মতো একটি অতি প্রান্তিক এলাকায় ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করে গত ২০ অক্টোবর (২০১৯) এডভোকেট সমরেশ চন্দ্র রায় ৭৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন। কিশোরগঞ্জের মানুষ তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে, যা একাধিক স্মরণ সভা, স্মৃতিচারণে প্রতিভাত।

আমার আশৈশব পরিচিত তিনি। তার সুদীর্ঘ জীবনের অনেকটুকু সম্পর্কেই আমি ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞাত। যার ভিত্তিতে আমি তাকে ভাটীবাংলার জনদরদী ঐতিহ্যের মরমী উত্তরাধিকার ও বিশিষ্ট সমাজসেবী-শিক্ষানুরাগী-আইনজ্ঞ হিসাবে অভিহিত করতে পারি।

সামাজিক জানাশোনার গন্ডি পেরিয়ে এডভোকেট রায়ের সঙ্গে আমার বেশ কয়েক বার নিবিড় যোগাযোগ হয়েছে। উচ্চশিক্ষা বা পেশাগত কারণে কিশোরগঞ্জের বাইরে অবস্থান করলেও জন্মশহরের সঙ্গে আমার সংযোগ কদাচ বিচ্ছিন্ন হয় নি। ফলে এডভোকেট রায় ও অন্যান্য শহরবাসী সুধীজনের সঙ্গে নৈমিত্তিক দেখা-সাক্ষাত, আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা সভা-সমাবেশে বক্তৃতাকালেও মূল শহরের চৌহদ্দীর মানুষগুলোর দেখা পেয়েছি। বিশেষত আমার জন্ম ও অবস্থান শহরের কেন্দ্রস্থলের গৌরাঙ্গ বাজার এলাকায় হওয়ায় যোগাযোগটি ছিল অতীব স্বাভাবিক ঘটনার মতো। ফলে সমরেশ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে প্রতিনিয়ত।

একবার এডভোকেট রায়ের সঙ্গে আমার মুখোমুখি অবস্থান হয় আদালতে। একটি দেওয়ানি মামলায় আমাদের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন আর প্রতিপক্ষে এডভোকেট সমরেশ রায়। সেটি ছিল খুবই ছোট্ট একটি মিস কেস এবং তার রায় এসেছিল আমাদের পক্ষে। চমৎকার পেশাদারি দক্ষতায় এডভোকেট রায় আমার প্রতিপক্ষকে বিজয়ী করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু এর ফলে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক মোটেও নষ্ট হয় নি। বহু মানুষের সামনে তিনি উচ্চকণ্ঠে এমন একটি কথা বলেছিলেন, যা আজও আমার মনে আছে। তিনি বলেন, ‘পেশার কারণে আমি এই মামলা নিয়েছি এবং লড়াই করছি। কিন্তু আমার প্রতিপক্ষ হলেও আপনি বা আপনার পিতা আমার শ্রদ্ধাভাজন।’

সাহসের সঙ্গে সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলার মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি মোটেও ধামাধরা ও মিনমিনে ছিলেন না। কোনও ধরনের লেজুড়বৃত্তি ও কর্তাভজা মানসিকতা তার ছিলনা। প্রশাসন বা ক্ষমতার পোঁ ধরে তৈলমর্দনের যে প্রবণতা আজকাল অনেকের মধ্যেই যে দেখা যায়, তেমনটি তিনি কখনোই করেননি।

এডভোকেট রায়ের সঙ্গে ২০১৫ সালের পর আরও নিবিড়তা বৃদ্ধি পায়, যখন আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা’র সূচনা করি। সে বছর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতবিদ গুণীজনের সম্মাননার মাধ্যমে আমার পিতা কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আলহাজ ডা. এ. এ. মাজহারুল হক এবং আমার মহীয়সী মাতা সমাজসেবী আলহাজ নূরজাহান বেগমের উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনায় প্রতিষ্ঠিত ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’-এর জনমানবকল্যাণমূলক বেসরকারি-অরাজনৈতিক উদ্যোগসমূহের সঙ্গে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মাত্রা দৃঢ়তর হয়। আর্থ-মানবতা ও জনকল্যাণধর্মী বহুবিধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের পথিকৃৎ ও উদাহরণ সৃষ্টিকারী সম্মাননা বক্তৃতা বহু ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে। আমার প্রদত্ত সম্মাননা বক্তৃতার লিখিত ভাষ্যগুলো ব্যাপকার্থে ‘কিশোরগঞ্জচর্চা’র একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যেও পরিণত হয়েছে। আশার কথা এটাই যে, ক্রমে ক্রমে কিশোরগঞ্জে কর্মরত কল্যাণধর্মী ফাউন্ডেশনগুলোর মধ্যে একটি ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ তৈরি হয়ে সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান মূর্খতা, কূপমণ্ডুকতা, পরশ্রীকাতরতা, অশিক্ষা, অজ্ঞানতার বিপরীতে সম্মিলিত আলোকায়ন ধারাকেই বেগবান করছে। ব্যক্তি মানুষের সামাজিক জীবনে এই আলোকচ্ছটা আমাদের আশাবাদী ও উদ্দীপ্ত করে।

এডভোকেট সমরেশ রায় আমার ও ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম গভীরভাবে লক্ষ্য করতেন। সময় বা সুযোগ পেলে তিনি কথা বলে আমার পরিকল্পনা সম্পর্কেও জেনে নিতেন। আমি বেশ বুঝতে পারি যে, তিনি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন এবং মানুষের জন্য কিছু করতে চান। হাসপাতাল বা শিক্ষায় দান, অনুদানেও তিনি এগিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে তিনি ‘রাজেন্দ্র আশালতা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ গড়ে তার সমাজসেবামূলক কাজগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে পরিচালিত করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ মার্চ, ২০১৭ সালে তিনি ‘রাজেন্দ্র আশালতা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ কর্তৃক কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আয়োজিত গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে আমাকে আমন্ত্রণ করেন। আমি সানন্দে উপস্থিত থাকি এ কারণে যে, ২০১৫ সালে আমরা যাকে ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক সংবর্ধিত করেছিলাম, তাকেই তিনি সম্মাননা জানিয়েছেন। অতএব, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সৎ ইতিহাসঅন্বেষা ও চর্চা, সুস্থ সামাজিক নিরীক্ষা ও আদর্শ-স্থানীয় ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়নের দ্বারা আলো ও শুদ্ধতার জয় হয়ে ‘মাজহারুন-নূর’ তথা ‘আলোর প্রকাশ’ মর্মার্থটি অন্ধকার-অর্বাচীনতার গতানুগতিক ধারার বিপরীতে আশা জাগানিয়া আলোক শিখা জ্বালিয়েছে।

এডভোকেট রায় আলোর জন্য কাজ করেছেন শিক্ষা বিস্তার ও মানবকল্যাণের প্রেরণায়। তিনি বহু গুণীজন, দরিদ্র ছাত্র, বিপন্ন রোগীকে সাহায্য করেছেন। সংশ্লিষ্ট সকলেই কর্তব্য হবে এডভোকেট রায়ের বদান্যতাকে মনে রাখা। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, একটি অতি অবহেলিত, অতি পশ্চাৎপদ এলাকা থেকে উঠে এসে তিনি কঠিন জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে জয়ী হয়েছেন এবং নিজের পিছিয়ে পড়া জন্মস্থানের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষায়, জ্ঞানে, সংস্কৃতিতে এগিয়ে আনতে চেষ্টা করে গেছেন।

প্রসঙ্গত, কেন আমি এডভোকেট সমরেশ চন্দ্র রায়কে ভাটীবাংলার জনদরদী ঐতিহ্যের মরমী উত্তরাধিকার ও সমাজসেবী-শিক্ষানুরাগী অভিধায় আখ্যা দিয়েছি, তা খুলে বলা দরকার। আমরা জানি, প্রত্যন্ত এলাকা হলেও ভাটীবাংলার প্রাণকেন্দ্র ইটনার জনদরদী একটি ঐতিহ্য আছে। আঠারো-উনিশ শতকে ইটনার আনন্দমোহন বসু অবিভক্ত বাংলার রেনেসাঁ-পুরুষ। প্রথম র‌্যাংলার এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একদা সভাপতি আনন্দমোহন বসুর নামে কলকাতা ও ময়মনসিংহে দু’টি কলেজও রয়েছে। ফলে সমাজ প্রগতি ও শিক্ষায় তাঁর ঐতিহ্য অমলিন। ইটনার ভূপেশ গুপ্ত সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা। মানুষের মুক্তির প্রচেষ্টায় তাঁর কর্ম ও জীবনের ঐতিহ্য বহুজনের অনুপ্রেরণার উৎস। জর্জ বিশ্বাস নামে পরিচিত দেবব্রত বিশ্বাস ইটনার জলমগ্ন মৃত্তিকার সোঁদা-গন্ধ সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইটনার গুরুদয়াল সরকার কিশোরগঞ্জের আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রাণ-পুরুষ।

ইটনা তথা ভাটীবাংলার জনদরদী ঐতিহ্যের আরো বিবরণ দেওয়া যায়। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় তা করছি না। তবে শতবর্ষ প্রাচীন জনদরদী ঐতিহ্য থেকে ইটনা বিচ্যুত হয়েছিল। অনেক দিন এমন কাউকে দেখা যায় নি, যিনি জন্মভূমির মুখোজ্জ্বল করার মতো কিছু করেছেন। বহু বছর পর মরমী উত্তরাধিকার হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সমাজসেবী-শিক্ষানুরাগী সমরেশ চন্দ্র রায়। জনদরদী ঐতিহ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকার তিনি। তাঁকে আমরা বলেছি সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী। কিশোরগঞ্জ ডায়বেটিক সমিতির ভবন নির্মাণ, স্কুল প্রতিষ্ঠা, বছর বছর বৃত্তি প্রদান, গুণীজন সম্মাননা ইত্যাদি বহুবিধ কাজের মাধ্যমে তিনি তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিশেষণগুলোকে সপ্রমাণিত করেছেন। তিনি একজন প্রবীণ ও নেতৃস্থানীয় আইনজীবীও বটে। এবং সর্বোপরি, একজন নীরব দাতা। পিতা-মাতার নামে ‘রাজেন্দ্র আশালতা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করে তিনি তাঁর জীবনের সঞ্চয়ের প্রায় পুরোটাই তুলে দিয়েছেন। বৈশ্য যুগের প্রবল স্বার্থযুক্ত পরিস্থিতিতে এমন ত্যাগ খুব সহজ নয়। সমাজে এমন উদাহরণ খুব বেশি পাওয়াও যাবে না।

অতএব, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও যুক্তিবোধের আশ্রয় নিয়ে বলা যায়, তিনি তাঁর স্বদেশবাসী ও জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন; জন্মভূমির মহান ব্যক্তিবর্গের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় মানুষদের কাতারে নিজেকে শামিল করেছেন এবং শিক্ষানুরাগ, সমাজকল্যাণ ও দানশীলতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। সমাজে ইতিবাচক প্রণোদনা জাগ্রত করার জন্য আমাদের সামনে তার মতো একটি ত্যাগী ও কর্মচঞ্চল জীবনের অর্জনসমূহকে উপস্থাপন করারও প্রয়োজন রয়েছে, যা থেকে আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিস্বার্থবাদী, সমাজ ও মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টাহীনগণ পরার্থে কাজ করার শিক্ষা পেতে পারেন এবং সমাজহিতৈষী কাজে আরো অনেকেই উৎসাহিতও হতে পারেন।

একটি নির্মম সত্য তথ্য এখানে উল্লেখ করার তাগিদ অনুভব করছি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বহু আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিস্বার্থবাদী, সমাজ ও মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টাহীন লোকজনকে জানি, যারা জীবনের শেষ পর্যায়টি অতিক্রম করছেন অতীব কষ্টে চাকর ও কুকুরের সাহায্যে। জীবনে তারা খুবই সফল ছিলেন। ছিলেন ডাকসাইটে আমলা, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ইত্যাদি। কিন্তু তারা ছিলেন ভীষণ রকমের আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিস্বার্থবাদী, সমাজ ও মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টাহীন। নিজের, পরিবারের এবং সন্তানদের ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে তারা পরের জন্য বিন্দুমাত্রও করেন নি। সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে ইউরোপ, আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা। স্বার্থপর পিতা-মাতার স্বার্থপর সন্তানেরাও পিতা-মাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যস্ত হয়েছে। পিতা-মাতাকে দেখার সময় তাদের নেই।

ফলে অতি স্বার্থপর পিতা-মাতার ধূর্ততা বিরাট বোকামিতে পর্যবসিত হয়েছে। সন্তান থাকার পরেও নিঃসন্তান এইসব স্বার্থপর পিতা-মাতা নিরাপত্তার জন্য পালিত কুকুরের প্রতি এবং নিজস্ব কাজ-কর্মের জন্য চাকর-বাকরের প্রতি নির্ভরশীলভাবে খুবই লাঞ্ছিত, অমানবিক ও নিম্ন স্তরের জীবন-যাপন করছেন। তাই, আপনার সন্তান মহা-কিছু হয়েছে তো আপনার বা সমাজের কি লাভ হচ্ছে? আপনার অতিরিক্ত স্বার্থপরতা আপনার কি কল্যাণ ও উপকার এনে দিয়েছে? এসব প্রশ্ন সচেতন মানুষ মাত্রেই নিজেকে করার দরকার আছে।

এক্ষেত্রে শিক্ষানুরাগী-সমাজসেবক সমরেশ চন্দ্র রায় বাস্তবিক অর্থেই একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি নিঃসন্তান। কিন্তু সমাজের অবহেলিত-শিক্ষাবঞ্চিত শত শত সন্তানের পিতা তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষার্থীরাই তাঁর সন্তান। নিঃসন্তান হয়েও তিনি নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত নন। চাকর বা কুকুর নয়, তিনি বেঁচে ছিলেন সমাজের শত শত মানুষের শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়। তিনি আলোকিত জীবন-যাপন করছেন অসংখ্য সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীর প্রতি আপত্য স্নেহে-মায়ায়-মমতায়-বদান্যতা।

এই নশ্বর জীবন শেষেও তিনি তাঁর অকৃত্রিম কর্ম ও ত্যাগের উজ্জ্বলতায় আপামর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। পরলোকের পথে তাঁর শেষযাত্রাতেইবতিনি নিঃশেষ হয়ে যাবেন না। তিনি অম্লান হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায় এবং প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের স্মৃতি ও সত্তায়।

জীবনের সফলতা বলতে যা আমরা সবাই অনুভব করি, তিনি সেটা বিজয়ী বীরের মতো অর্জন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণে বেদনার সঙ্গে সঙ্গে একটি সার্থক জীবনের অবসান-যাতনা অনুভব করেছে কিশোরগঞ্জবাসী। ভাটীবাংলার জল ছলছল ভূগোলের আবেগ ও মায়া জড়িয়ে তিনি রয়েছেন সকলের হৃদয় স্পর্শ করে। কিশোরগঞ্জের শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তিনি তাঁর সমকালের অগ্রসর চরিত্র রূপে সমাসীন হয়েছেন। মফস্বলের সমাজ প্রগতির অনন্য উদাহরণ হয়ে তিনি জাগ্রত থাকবেন।

   

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;