বাঙ্কারে গভর্নর: ৮ মার্কিন রণতরী ঠেকাতে ২০ রুশ যুদ্ধজাহাজ



আশরাফুল ইসলাম
বাঙ্কারে গভর্নর: ৮ মার্কিন রণতরী ঠেকাতে ২০ রুশ যুদ্ধজাহাজ

বাঙ্কারে গভর্নর: ৮ মার্কিন রণতরী ঠেকাতে ২০ রুশ যুদ্ধজাহাজ

  • Font increase
  • Font Decrease

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী বাহিনী একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ছিল দিশেহারা। যুদ্ধের ময়দানে টিকতে পারে মার্কিন মদদে নানা কুটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে পাকিস্তানিরা জান্তারা। সময় যতোই গড়াচ্ছিল তারা বুঝে গিয়েছিল পূর্বপাকিস্তানে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র নীলনকশায় বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ সংঘটনে দেশিয় আলবদর বাহিনীর যোগসাজশে একদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তৎপর থাকলেও চারদিক থেকে চেপে ধরা মিত্র বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল জান্তারা।

একাত্তরের ডিসেম্বরের ১৪ ও ১৫ তারিখ ছিল চূড়ান্তভাবেই ঘটনাবহুল সময়। সেই সময়কার ভারতীয় গণমাধ্যমে ধরা দিয়েছে ওই সময়কার চালচিত্রের বিস্তারিত বিবরণ। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির সহযোগিতায় আমরা জানতে চেষ্টা করেছিলাম ঘটনাবহুল সেই সময়ের সত্যিকারের চিত্রটি কেমন ছিল।

কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক যুগান্তর (বর্তমানে অধুনালুপ্ত) সেই সময়ের যুদ্ধের যে সংবাদ প্রকাশ করে তা কেবল চমকপ্রদই নয়, ঐতিহাসিক বিচারেও অনন্য। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাণান্তর প্রচেষ্টায় সেই সময়ের গণমাধ্যমকর্মীদের যে কর্তব্যনিষ্ঠা পত্রিকাটির পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তা সত্যিই অনবদ্য।


১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। দৈনিক যুগান্তরের যে সংখ্যাটি বেরোয় তাতে প্রধান শিরোনাম, ‘বগুড়া মুক্ত।। চট্টগ্রাম ও ঢাকার গভর্নরের প্রাসাদ জ্বলছে ঢাকা দখলের লড়াই’। দৈনিকটি সাব হেড করেছিল, ‘খানশাহীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মন্ত্রিসভাসহ ডঃ মালিকের পদত্যাগঃ নিরপেক্ষ এলাকায় আশ্রয়’।

নয়াদিল্লি থেকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বার্তা সংস্থা ‘ইউ এন আই’-এর বরাতে দৈনিকটি জানায়, ‘ঢাকায় গভর্নরের ‘বাড়ি’ ও কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে এখন আগুন জ্বলছে। গভর্নর ড. এ মালিক, তাঁর মন্ত্রিপরিষদ ও তাঁর উর্ধ্বতন অসামরিক কর্মচারীরা ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে নিরপেক্ষ এলাকা ইন্টার-কন্টিনেন্টাল হোটেলে পালিয়ে গিয়েছেন।’

এই খবরে আরও প্রকাশ, ‘ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে এখন যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের যুগান্তকারী স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন শেষ পর্যায়ে এসে পৌছেছে। ঢাকায় পাকিস্তানিদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করে একটি প্রতিনিধিস্থানীয় সরকার গঠনের জন্য ভারতীয় সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার আজ বিকেলে সদলবলে পদত্যাগ করেছেন এবং ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে নিজেদের সরিয়ে এনেছেন। ঢাকার শহরতলীতে প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই চলছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানরা তীব্র বেগে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। একটা শক্তিশালী পাক বাহিনীর মোকাবেলা করে তারা তাদের সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেছেন। ঢাকা শহরের সেনাবাহিনীর ছাউনীর উপর ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে। এদিন রংপুর সেক্টরে শত্রুর সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার বগুড়ার পতনের মধ্য দিয়ে ঐ সেক্টর মোটামুটি শত্রুমুক্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।’


ঢাকার উপকণ্ঠে বারো জন পদস্থ সেনা কর্তার আত্মসমর্পণের খবর দিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছিল, ‘গভীর রাতে ঢাকা সেক্টরের আরও যে খবর এসেছে তাতে দেখা যায়, ভারতীয় জওয়ানরা শুধু জয়দেবপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ দখল করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছেন। শহরতলীতে পাক সেনাবাহিনীর পুরো একটা বিগ্রেড আটকে পড়েছে। ঐ বাহিনীর অধ্যক্ষ একজন বিগ্রেডিয়ার ও ময়মনসিং-এর মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটারসহ কমপক্ষে বারোজন জাদরেল পাক সেনাপতি আত্মসমর্পণ করেছেন।’

আল্লা বাঁচাও’বিবরের মধ্যে মালিকের প্রার্থনা

১৪ ডিসেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্স এর বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘বিমান আক্রমণ হবার পর পরই ডঃ মালিক ও তাঁর মন্ত্রিবর্গ একটি বিবরে (বাঙ্কার) মধ্যে ঢুকে পড়েন। সেই বিবরে রাষ্ট্রসঙ্গের জনৈক কর্মচারী জন কেলীসহ অনেক বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ আশ্রয় নেন।’

গভর্নর মালিক ‘কম্পমান’

ভারতীয় মিগ বিমান থেকে গভর্নর ডা. মালিকের সরকারি বাসভবনে উপর যখন বোমা বর্ষিত হচ্ছিল তখন তিনি ভয়ে কম্পমান। তিনিসহ তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করে বাঙ্কারে আশ্রয় নেন। 

১৪ ডিসেম্বরে বার্তা সংস্থা পিটি আই’র খবর উদ্ধৃত করে ‘লোকসভার বলিষ্ঠ দাবি/মার্কিন সপ্তম নৌবহরের হুমকির কাছে নতিস্বীকার নয়’শীর্ষক প্রতিবেদনে দৈনিকটি জানায়, ‘মার্কিন নৌ-বহরকে বঙ্গপোসাগরের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতকে যে হুমকি দেখাচ্ছে সে হুমকির কাছে নতি স্বীকার না করতে আজ লোকসভা সরকারের কাছে বলিষ্ঠ আহ্বান জানায়’। এ খবরের পাশেই ‘মালাক্কা প্রণালীতে সপ্তম নৌবহর’ শীর্ষক খবর।

১৪ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে ইউএনআই’র বরাতে প্রকাশিত খবরে যুগান্তর জানায়, ‘‘মার্কিন নৌ-বহরের সাত কি আট খানা জাহাজ সোমবার সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের দিকে এগুচ্ছে। আজ সিঙ্গাপুরের নির্ভরয্যোগ্য সূত্রে এই খবর প্রকাশ পেয়েছে। মালাক্কা প্রণালী প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। যে সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে তা খুবই নির্ভরযোগ্য বলে বর্ণনা করে বলা হয়, জাহাজগুলো উত্তর-পশ্চিম দিকে এগুচ্ছে এবং দুপুরের আগে সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে গেছে। খবরে বলা হয়েছে, পারমাণবিকশক্তি চালিত বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপাইজ’ এই মার্কিন নৌবহরের মধ্যে আছে কিনা তা জানা যায় না।

ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া খবরে বলা হয়েছে যে, ভিয়েতনামের কোন ঘাঁটি থেকে ‘এন্টারপাইজ’কে বঙ্গপোসাগরের দিকে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্যঃ বাংলাদেশে যেসব মার্কিন নাগরিক আটকে পড়েছে, প্রয়োজনসাপেক্ষে তাদের উদ্ধারের জন্য তৈরী থাকা।’’

১৫ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের যে খবর যুগান্তরের ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রকাশিত হয় তাতে প্রধান শিরোনাম, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধ থামান-নিয়াজি/আত্মসমর্পণ করুন-মানেকশ’

‘আপাততঃ বিমান আক্রমণ স্থগিতঃ আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত নিয়াজীকে সময় দান’

প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী আজ যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাব দেন। এর পরই ভারতীয় স্থলবাহিনীর প্রধান এস এইচ এফ জে মানেকশ’ আগামীকাল সকাল ৯টার মধ্যে জেনারেল নিয়াজীকে তাঁর সকল সৈন্যকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিতে বলেছেন।’ 

‘‘জেনারেল মানেকশ’ এই বলে জেনারেল নিয়াজীকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, যদি তিনি তাঁর আহ্বানে সাড়া না দেন তাহলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর পক্ষে আগামীকাল সকাল থেকে আবার প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করা ছাড়া উপায় থাকবে না। জেনারেল মানেকশ’বলেছেন, তাঁর সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে তিনি আজ বিকাল ৫টা থেকে ঢাকার উপর বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নরসিংদী থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে ঢাকার কাছে এসেছেন’’

যুদ্ধ থামাতে ইয়াহিয়ার আকুতি

যুদ্ধ থামাতে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আকুতির খবর তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে চলে এসেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম যুগান্তর তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘আজ গভীর রাতে ঢাকা থেকে ভয়েস অব আমেরিকা ঢাকা থেকে প্রাপ্ত একটি সংবাদ উদ্ধৃত করে বলেছে যে, পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল জেনারেল নিয়াজির নিকট প্রেরিত একটি বাণীতে তাকে ‘যুদ্ধ বন্ধ করার’ পরামর্শ দিয়েছেন।’’

‘‘ঢাকাস্থিত সামরিক কর্তৃপক্ষ ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোন আলোচনা চলছে নাÑরাওয়ালপিন্ডির একজন সরকারি মুখপাত্র আজ রাতে এই খবরটি জানান বলে বিবিসি থেকে প্রচার করা হয়েছে। তিনি আবারও আশ্বাস দিয়েছেন যে, পাকিস্তানী সৈন্যদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে এবং জেনিভা চুক্তি অনুসারে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে’’

‘‘জেনারেল নিয়াজি যে কম্পাঙ্কে তার সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন তাও তিনি তাকে বলে দিয়েছেন। জেনারেল নিয়াজী যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে ভারতীয় স্থলবাহিনীর অধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ’র কাছে আজ এক পত্র পাঠান বলে এখানে সরকারীভাবে জানান হয়’’

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় খবর ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযানকে ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের ঘটনা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম সংহতি জানিয়ে রাশিয়া ৮ মার্কিন রণতরীর বিপরীতে ২০ রুশ যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় ঠেকানোর মার্কিন প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। আমরা দেখব সেই সময়কার গণমাধ্যমের খবরে যেভাবে চিত্রিত হয়েছিল সেই ঘটনাপ্রবাহ।


মার্কিন রণতরীর বিপরীতে ২০ রুশ যুদ্ধ জাহাজ

সিঙ্গাপুর থেকে বার্তা সংস্থা ইউপিআই ১৫ ডিসেম্বর জানায়, ‘আজ এখানে কুটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে যে, পরমাণু শক্তিচালিত মার্কিণ বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ এবং নৌবাহিনীর আরও সাতখানা জাহাজ বঙ্গোপসাগরের অবস্থান করছে।’

জাপানি প্রতিরক্ষা দপ্তরের সূত্র উদ্ধৃত করে কিয়েডো সংবাদ সংস্থার খবর প্রকাশ করে টোকিও থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ‘আজ জানিয়েছে প্রায় ২০টি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে জমায়েত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ক্রুজার এবং ডেস্ট্রয়ারও আছে।’

‘কিয়োডো সংবাদ সংবাদে বলা হয়েছে, জাপানি বাণিজ্যিক নৌবহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি বিমান আজ সকালে নাগাসাকির দক্ষিণে একটি ৭ হাজার টন ক্ষেপণাস্ত্রী ক্রুজার এবং ৫ হাজার ২০৮ টন ডেস্ট্রয়ার দেখতে পেয়েছে। কিয়েডোর সংবাদে আরও বলা হয়েছে যে, গত এক সপ্তাহ ধরেই সোভিয়েত জাহাজগুলি কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’

টোকিও থেকে পিটিআই জাপানের প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক সংবাদ উদ্ধৃত করে আরও জানায়, ‘আজ সকালে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত জাহাজ ও একটি রণতরী জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত ও কোরিয়া বদ্বীপের মধ্যবর্তী সুশিমা প্রণালী অতিক্রম করেছে। সম্ভবতঃ তাদের গন্তব্যস্থল ভারত মহাসাগর।’

`প্রতিরক্ষা দপ্তরের অফিসাররা জাপানের রিপোর্টারদের বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর সোভিয়েতের একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেড ও ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন সুশিমা প্রণালী দিয়ে একই দিকে অগ্রসর হয়েছে।  জাপানের সরকারি মহলের অনুমান, সোভিয়েত নৌবহর সম্ভবতঃ বঙ্গোপসাগরের দিকেই চলেছে। জাপানের সরকার মার্কিন নৌবহরের বঙ্গোপসাগর যাত্রা সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি। তবে তাদের বিশ্বাস মার্কিন নৌবহরের দিকেই সোভিয়েত নৌবহর চলেছে।’

সম্পাদকীয় নিবন্ধে নিয়াজিকে তুলোধুনো

জঙ্গিশাহীর অত্যাচার জর্জরিত ঢাকা-হাজার হাজার নরনারীর রক্তলাঞ্ছিত ঢাকা-মানবতার কবরভূমি ঢাকা আজ গণতন্ত্রী শক্তির পদভারে কম্পমান। পাক সেনাপতি লেঃ জেনারেল নিয়াজি দিশেহারা। তাঁর মুখে নেই যুদ্ধের আকাশচুম্বী স্পর্ধা। তিনি চাচ্ছেন অস্ত্র সম্বরণ। স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন জেনারেল মানেকশ’। অস্ত্র সম্বরণের সঙ্গে থাকা চাই আত্মসমর্পণ। নইলে এ ফাঁদে পা দিবে না ভারত। উত্তরের অপেক্ষা করছেন তিনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাব না পেলে আরম্ভ হবে প্রচণ্ড আক্রমণ। জওয়ান এবং মুক্তিবাহিনী চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলবে ইসলামাবাদের শক্তিমত্তার পীঠস্থান। কিসের আশায় লড়বেন জেনারেল নিয়াজি? ডা. মালিক ছেড়েছেন গভর্নরগিরি। তাঁর সঙ্গে নিয়েছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল। অবরোধ্য পাক সৈন্যরা দিতে পারেনি তাদের তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। নিজেরাই যেখানে ছত্রভঙ্গ কি করে তারা রক্ষা করবে অপরের নিরাপত্তা। যুদ্ধমুক্ত হোটেল কন্টিনেন্টাল এখন হতভাগ্যদের নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সৈন্যদের আশ্রয় কোথায়? সামনে জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গীন-আকাশে ভারতীয় জঙ্গী বিমান। আঙুলে গোনা পরমায়ুর ক’টা দিন নিয়ে ধুঁকছিলেন লেঃ জেনারেল নিয়াজি। হয়ত এখনও তাঁর মনে আছে শেষ রক্ষার গোপন সাধ। যদি নিয়াজির আত্মসমর্পণের সুবুদ্ধি আসে, ভালো কথা। নইলে চূড়ান্ত আঘাত অনিবার্য। জওয়ানদের পায়ের নীচে ঢাকা কাঁপছে। যথাসময়ে আত্মসমর্পণ না ঘটলে তার ধুলিশয্যা অনিবার্য। কেউ মুছতে পারবে না দেয়ালের এই স্পষ্ট লিখন। নিয়াজি সাবধান। চাতুরির সময় অতিক্রান্ত। আত্মসমর্পণ কর কিম্বা ধ্বংস হও। সংহার মূর্তি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে জওয়ান এবং মুক্তিবাহিনী। ওদের হুঙ্কারে ডুবে যাবে তোমার শেষ আর্তনাদ।  

লেখক: ইতিহাস গবেষক ও বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

   

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;