বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ

বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্য বা আজকের চেক প্রজাতন্ত্রে ভ্রমণ ট্রিপে ইউরোপের পশ্চিম থেকে পূর্বে  ভিয়েনা, ব্রুনো হয়ে স্বর্গীয় শহর প্রাগে প্রবেশের রোমাঞ্চকর অনুভূতির তুলনা হয় না। তারপর "নাইট ওয়াক ইন দ্যা সিটি অফ প্রাগ" মানেই লাইফটাইম মেমোরি। তবে, প্রাগে নামেই রাত, বাস্তবে খুঁজতে হবে "কোথায় রাত ?" রাতের যেন পড়ন্ত বিকেল।  আকাশে তখনো কটকটে রোদ। বাতাসে বসন্তের রেশ।

পশ্চিম ইউরোপ যেমন জার্মানিক, পূর্ব ইউরোপের প্রাগ শহরে তেমনই প্রধানত স্লাভিক ট্রাইবদের বাস। চেক ভাষায় প্রাগের নাম প্রাহা। যার অর্থ হল ‘ford’ বা ‘rapid’। আক্ষরিক অর্থে ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরোতে হয় এই অঞ্চল যেখানে নদীর গভীরতা অত্যন্ত কম। মানুষ আর ঘোড়াও সেই তিরতির করে বয়ে চলা অগভীর নদীর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এককালে পেরিয়ে চলত। এখন সেখানে ছোট্ট ব্রিজ হয়েছে। এই হলো প্রাহা নামটির উৎসমূল।

দেশ হিসেবে চেক প্রজাতন্ত্র কিংবদন্তির ভাণ্ডার। বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী স্লেভিক রাজকন্যা লিবিউসে অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতেন । পাহাড়ের মাথায় তিনি আর তার স্বামী রাজপুত্র প্রেমিস্ল শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করতেন। একদিন পাহাড়ের মাথায় উঠে, ভ্লাতাভা নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বললেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর হয়ে উঠবে পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। খ্যাতির শিখরে পৌঁছবে তার শিল্প-কলা-কৃষ্টির উৎকর্ষতায়। শাসন বানালেন একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে চলেছিল। রাণীও বললেন, ওইখানেই  সেই চরম শহরায়ণের সব লক্ষণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভাবীকালে ফলেও গেল তাদের কথা।  পূর্ব ইউরোপের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ গোড়াপত্তন হলো চেক রিপাব্লিকের।  রাজধানী হলো প্রাহা, বিশ্ববাসী যাকে ডাকে প্রাগ।


চেক দেশের সুরম্য রাজধানী প্রাগ দর্শন করতে হয় বাসে চড়ে। প্রথমে নামতে হয় পাহাড়ের মাথায়  স্ট্রাহভ মনাষ্ট্রি দেখতে। মনাষ্ট্রিতে রয়েছে বিয়ার ব্রুয়ারি।  সেখান থেকে দুর্গ শহর প্রাগের  অতি সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। এই ভিউপয়েন্টে গিয়ে চেকের বিশিষ্ট সন্ত সেন্ট নরবার্টিনের বৃত্তান্ত সচিত্র জানা  যায়।

স্ট্রাহভ মনাস্ট্রিতে সেন্ট নর্বার্টিনের রেলিক্স রাখা রয়েছে। আছে প্রকান্ড লাইব্রেরি, বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার, ব্যাসিলিকায়  ফ্রেসকো  ভার্জিন  মেরীর মোটিফ। ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সবকিছুই সযত্নে সংরক্ষিত। পাশেই রাখা রয়েছে প্রকাণ্ড এক অর্গ্যান, যা বাজিয়ে বিশ্বসেরা সুরসম্রাট মোৎজার্ট বলেছিলেন, এমন বড় ও সুন্দর অর্গ্যান তিনি আর কোনোদিনো বাজাননি। 

বাসের পাশাপাশি প্রাগ দেখতে হয় পায়ে হেঁটে। প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘোরার মজাই আলাদা। প্রাগ কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত ছুঁয়ে আগন্তুক পর্যটকদের নিয়ে যায় ফিজিক্স ব‌ইয়ের পাতায়। কারণ, জোহান কেপলার ও টাইকো ব্রাহের জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার ঘটেছিল এই প্রাগ শহরে। পথের ধারে দুই বিজ্ঞানির স্ট্যচু প্রমাণস্বরূপ আজো দৃশ্যমান।

কথিত আছে, দুই দিকপাল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে আর জোহানেস কেপলার ভাগ্যের টানে আসেন প্রাগে। টাইকো ব্রাহে ছিলেন উৎকৃষ্ট পর্যবেক্ষক আর কেপলার ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই প্রাগেই টাইকো ব্রাহে কেপলারকে তার সহকর্মী করলেন। আকাশে হঠাৎ টাইকো দেখতে পেলেন অদ্ভুত সুপারনোভা। কেপলার তা থেকে অঙ্ক কষে সূত্র তৈরি করলেন। বিজ্ঞানের সাধনায় একে অপরের পরিপূরক ছিলেন তারা।


প্রাগের হটস্পট সেন্ট নিকোলাস চার্চ।  কোবলস্টোনের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নির্বিঘ্নে পৌঁছা  যায়। কেননা, প্রাগের সবকিছু সংরক্ষণই অতি সুন্দর। অথচ এরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারো অনেক সুন্দর করে গড়ে তুলেছে। সবকিছু রেখেছে  চমৎকার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি।

ট্রাম প্রাগের মনোরম বাহন। রাস্তা আর  ট্রামলাইনের চলেছে পাশাপাশি। কি অপূর্ব এই স্ট্রীটকারের মায়াবী নেটওয়ার্ক।  সারা শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে ক্রিসক্রস ভাবে রঙীন সুন্দর সুন্দর ট্রাম চলে যাচ্ছে অনবরত। আর এরা কত সুন্দরভাবে এই যানটিকে ব্যাবহার করে সেটাই দেখবার বিষয়।  প্রাগের ট্রামের নেটওয়ার্ক চেক রিপাবলিকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে বৃহৎ।

প্রাগের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যায় নিরাপদে ও অবলীলায়। জেব্রাক্রসিংয়ে পা দিয়ে ট্র্যাফিক লাইট মেনেই চলাচল করে সবাই। যান বা মানুষ, কারোই তাড়া নেই। নিয়ম ভাঙার কথা তো অকল্পনীয়। নিজস্ব ছন্দময় গতিতে সবাই চলছে নিজস্ব পথে। পশ্চিম ইউরোপের মতো রুদ্ধশ্বাস দৌঁড়ে চলার ছিটেফোঁটাও নেই পূর্ব ইউরোপের প্রাগে।

প্রাগে চোখে পড়বে অসাধারণ রেনেসাঁ স্থাপত্য। সমগ্র ইউরোপই নবজাগরণের মূলভূমি। চারিদিক স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। প্রাগের লেসার টাউন হলো নান্দনিকতার চূড়ান্ত প্রকাশস্থল। লেসার টাউন স্কোয়ারের  ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। চার্চটির সংরক্ষণে সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর নামীদামী স্থপতিদের পরিশ্রমে শিল্পকলায় ভরে উঠে চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল।  সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা অন্যধারে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ। 


চার্চের বাইরে  থিকথিক করছে রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক আর প্রাগের বিখ্যাত মানুষ, ধনী লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। ইন্টারন্যাশানাল এমব্যাসিগুলোও এখানে। এই  ব্যারক স্টাইল হল অত্যন্ত সুন্দর স্থাপত্যে নির্মিত বাড়ি। জানলার নীচে খোদাই করা মানুষের মুখ, বাড়ির ছাদের প্যারাপেটে পরী কিম্বা প্রবেশ পথে জীবজন্তুর অসামান্য আর্কিটেকচার।  পুরণো শহরের অনুপাতে অনেকটাই ছোট বলে এর নাম লেসার টাউন।  

চলতে চলতে প্রাগে পাওয়া যাবে অনেকগুলো ট্যানেল। মনে হবে একফালি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আবারো বড় রাস্তায় আসা হয়েছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে  প্রাইভেট ট্রামের একটি কামরাকে। ম্যাজিকের মত ট্রাম এসে দাঁড়াবে সামনে। উঠে পড়তে হবে টুক করে। তারপর সুন্দর অনুভূতিতে স্বপ্নের মত সন্ধ্যেয় প্রাগের  ট্রামে চড়া আর একটা গলির মুখে অবতরণ করে পাথরের রাস্তা দিয়ে এক বিয়ার ব্রুয়ারীর মধ্যে প্রবেশ করা। বোহেমিয়ান বিয়ার বিশ্ববিখ্যাত। কোনও এক 'বিয়ার পাবে' সান্ধ্য আড্ডার অভিজ্ঞান শিহরণ জাগানিয়া। বিশাল সুদৃশ্য কাটগ্লাসের মাগে বিয়ার হাজির হবে। এককোণায় প্রৌঢ় বাজিয়ে চলেবেন একর্ডিয়ানে চেনাঅচেনা গানের সুর। আলো আঁধারিতে মায়াময় পরিবেশ তৈরি হবে। 

রহস্যে মোড়ানো ঘন্টাখানেক পর পাব থেকে বেরিয়ে এলে আলোকমালায় সজ্জিত রোমান্টিক প্রাগের রাজপথে উঁকি দেবে সামনে। দূরে দেখা যাবে বিখ্যাত ইউনিভাসিটি অফ প্রাগ, যেখানে এলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন।  পাশেই রয়েছে চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচু, যা প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোর একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুব-এর এক অনবদ্য কলতান এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে । চার নৃত্যরত শিল্পীর চোখ বাঁধা। তাদের হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশী ও ট্রামপেট।  

ভ্লাতাভা নদীর ওপরে প্রাগের ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজ। ব্রিজে বিশাল চওড়া হাঁটার পথ। ব্রিজের ডাইনে বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দন্ডায়মান  সারেসারে  স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যচুটি সর্বপ্রধান, যে স্ট্যাচুর মাথার চারিপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালী স্টার খচিত।  ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ঠিক ওই স্থানটি থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা। কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর  রাণীর স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন  এবং পুরোহিত তা জানাতে চান নি।  অতি জাগ্রত এই স্ট্যাচুটি ছুঁলে নাকি মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়, অনেকটা মাজারে গিয়ে লাল সূতো বাঁধার মত। নদীর ওপরে পুরণো ব্রিজ, নতুন ব্রিজ রাতের রূপসী প্রাগ শহরকে উন্মোচিত করে বহুবর্ণা আলোকমালায়।


যদি সেই রাতে আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ থাকে, কিংবা ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে রূপসী প্রাগের পথ চলার শেষে পাওয়া যাবে প্রাগৈতিহাসিক ভৌতিক অনুভূতি। ছমছম করে ওঠবে গা। চোখের পলক পড়বে না একবারও। কানে ভাসবে প্রাগের পৌরাণিক উপাখ্যান।  মাথাকাটা এক সাধুর গল্প, যার অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় মনাষ্ট্রির সিঁড়িতে। সেই সাধু অভাবের তাড়নায় নিজের মাথা কেটে দেন।  হেডলেস মঙ্কের গল্প শুনে মনে হবে সামনে নিজের বাড়ি বা হোটেল নয়, অশরীরী আত্মায় ভরা তেপান্তরের দিগন্তব্যাপী মাঠ।

প্রাগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রি, যার সামনে রয়েছে 'পাউডার গেট'। প্রাগের গথিক শৈলীতে নির্মিত টাওয়ার সহ প্রবেশদ্বার যেন মুঘল সম্রাটের 'বুলন্দ দরওয়াজ' অথবা 'গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া' বা 'ইন্ডিয়া গেট'। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে।  সেখানেও রয়েছে নানা  গল্প। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যা আট বছর বয়সে বাগদত্তা হন আরেক দশ বছরের রাজপুত্রের। কিন্তু বিয়ের পর সংসারে বীতরাগ জন্মানো আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে বিচরণের যান তারা।  ওল্ড টাউন অঙ্গনের ওয়েসনেসডে স্কোয়ার'-এ এ গল্প মশহুর, বোহেমিয়ার প্যাট্রন সেন্ট-এর নামে এই স্কোয়ারের নাম। 

এই ঐতিহাসিক স্থানটি হল প্রাগের হেরিটেজ সাইট।  মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। তারওর বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কোয়ার বানানোয় তা পুরনো শহরে পরিণত হয়। এখন আলোয় ঝলমলে প্রাগের নিউটাউন।  রাতের আলোয় ন্যাশানাল মিউজিয়াম, Wenceslas মনুমেন্ট  এক অদ্ভূত রোমান্টিক স্থান। আর ওল্ড টাউন গা ছমছম রূপকথা জগতের মতো ধূসর ও রহস্যঘেরা।

"নাইটস অফ দ্যা ক্রস স্কোয়ার" হলো প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ,  টুরিস্টদের অন্যতম গন্তব্য। ডিজিটাল ক্লিকে, সেলফি স্টিকে রাজকীয় রাতপরী প্রাগের ছবি ক্যামেরায় ধরে সবাই এখানেই। এই পথ ও স্কোয়ার অন্যদিকে চার্লস ব্রিজকেও ছুঁয়েছে। স্কোয়ারের মধ্যখানে রাজা চতুর্থ চার্লসের বিশাল সেমি-গথিক স্ট্যাচু ।


শহরের আলোয় ঝলমলে অতিপ্রাচীন প্রাগ যেন যৌবনউদ্ভিন্না। চালর্স ইউনিভার্সিটির ৫০০ বছর পূর্তিতে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে স্মারক নির্মিত হয়েছে। স্কোয়ারের আশপাশের গথিক স্টাইল অট্টালিকার প্যারাপেটে দাঁড়িয়ে সারে সারে ভাস্কর্য। অপূর্ব নন্দন দৃশ্য প্রাগের সর্বত্র উদ্ভাসিত করে রেখেছে। 

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের শহর প্রাগের নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ হলেও সেখানে পশ্চিম ও দূরপূর্ব ইউরোপের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। প্রাগ যেন নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ও সঙ্গমস্থল। বিশেষত পাশের বলকানের প্রভাব প্রাগে অলঙ্ঘনীয় রূপে পরিব্যাপ্ত। বলকান অঞ্চল বলতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চলকে বোঝায়। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। দানিউব, সাভা ও কুপা নদীগুলো অঞ্চলটির উত্তর সীমানা নির্ধারণ করেছে। বুলগেরিয়া থেকে পূর্ব সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বলকান পর্বতমালার নামে অঞ্চলটির নাম এসেছে।

বলকান অঞ্চলের সন্নিহিত চেক প্রজাতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে বোহেমিয়া নামেও পরিচিত মধ্য ইউরোপের একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে জার্মানি, উত্তর-পূর্বে পোল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্বে স্লোভাকিয়া অবস্থিত। চেক প্রজাতন্ত্র দেশটিতে রয়েছে পাহাড়ি ভূমি যা প্রায় ৭৮,৮৭১ বর্গকিলোমিটার (৩০,৪৫২ বর্গমাইল) অঞ্চলে বিস্তৃত এবং এর অধিকাংশেই নাতিশীতোষ্ণ মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃহত্তম শহর ও রাজধানী প্রাগ। অন্যান্য শহরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বার্নো ও অস্ত্রাভা।

নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মোরাভিয়ার অধীনে বোহেমিয়ার ডাচি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে ১০০২ সালে রোমান সাম্রাজ্যের একটি ইম্পেরিয়াল রাজ্য হিসাবে এটি স্বীকৃত হয়েছিলো এবং ১১৯৮ সালে এটি একটি রাজ্যে পরিণত হয়। ১৫২৬ সালে মোহাচের যুদ্ধের পর, বোহেমিয়ার পুরো সাম্রাজ্যটি ধীরে ধীরে হাবসবার্গ রাজতন্ত্রের সাথে একীভূত হয়। এসময় প্রোটেস্ট্যান্ট বোহেমিয়ান বিদ্রোহ ত্রিশ বছরব্যাপী হোয়াইট মাউন্টেনের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। যুদ্ধের পর হাবসবার্গরা তাদের শাসনকে সুসংহত করে। ১৮০৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সাথে সাথে এসব ভূমি অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, চেক ভূমি আরও শিল্পোন্নত হয়ে ওঠে এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পতনের পরে এর বেশিরভাগ অংশ প্রথম চেকোস্লোভাক প্রজাতন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠে। চেকোস্লোভাকিয়া মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের একমাত্র দেশ ছিল, যা আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়কালে সংসদীয় গণতন্ত্র বজায় রেখেছিল। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তির পর নাৎসি জার্মানি পদ্ধতিগতভাবে চেক ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালে চেকোস্লোভাকিয়া পুনরুদ্ধার করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের পরে এটি পূর্ব ব্লকের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকার ও অর্থনীতির উদারীকরণের প্রচেষ্টা ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের সময় সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের মাধ্যমে দমন করা হয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরের 'মখমল বিপ্লব' দেশে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়। ১ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যায় এবং এর সাংবিধানিক রাজ্যগুলো চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

প্রাগ বা প্রাহা চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৩তম বৃহত্তম শহর। এছাড়াও বোহেমিয়ার ঐতিহাসিক রাজধানী। ভুলটাভা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরে ১.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস, যখন তার নগর জোনগুলোতে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাস বলে অনুমান করা হয়। শহরে নাতিশীতোষ্ণ মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে গ্রীষ্মকাল অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং শীতকাল অপেক্ষাকৃত শীতল।

প্রাগ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, এক সমৃদ্ধ ইতিহাস যাকে পূর্ণতা দিয়েছে। রোমানেস্ক স্থাপত্য যুগে প্রাগ শহর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গথিক, রেনেসাঁ, বলকান ও বারোক স্থাপত্য যুগে এর বিকাশ ঘটে। প্রাগ বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী এবং কয়েকজন পবিত্র রোমান সম্রাটের বাসস্থান ছিল। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা চতুর্থ চার্লস (শা. ১৩৪৬-১৩৭৮ খ্রি)। এটি হ্যাব্সবার্গ রাজ্যের এবং অস্ট্রো-হাংগেরীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর কমিউনিস্ট আমলের মধ্যবর্তীকালে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী হিসাবে বোহেমীয় ও প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার, ত্রিশবর্ষীয় যুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রাগ কিছুসংখ্যক বিখ্যাত সাংস্কৃতিক আকর্ষণের কেন্দ্র, যাদের অনেকগুলো বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের সহিংসতা ও ধ্বংসের পরেও টিকে রয়েছিল। এর প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে 'প্রাগ ক্যাসল' (প্রাগ দুর্গ), চার্লস ব্রিজ, (প্রাগ জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়িযুক্ত) ওল্ড টাউন স্কয়ার, ইহুদি কোয়ার্টার, পেট্রিন পাহাড় ও দুর্গ।

১৯৯২ সাল থেকে প্রাগের বিস্তীর্ণ ঐতিহাসিক কেন্দ্র ইউনেস্কোর 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শহরটিতে দশটির অধিক বড় বড় জাদুঘর, অসংখ্য নাট্যশালা, গ্যালারি, সিনেমা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। একটি সম্প্রসারিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা শহরটিকে সংযুক্ত করেছে। এখানে বহু সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় আছে। প্রাগের 'চার্লস ইউনিভার্সিটি' মধ্য ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্লোবাল এন্ড ওয়ার্ল্ড সিটিজ রিসার্চ নেটওয়ার্ক-এর গবেষণা অনুযায়ী প্রাগ 'আলফা-গ্লোবাল সিটি' হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ। ২০১৯ সালে মারসার কর্তৃক শহরটি পৃথিবীর ৬৯তম সর্বাধিক বাসযোগ্য শহরের মর্যাদা লাভ করে। একই বছর পিকসা ইন্ডেক্স প্রাগকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য ১৩তম শহরের স্থান দেয়। শহরটির সমৃদ্ধ ইতিহাস তাকে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী শহরটিতে প্রতি বছর ৮.৫ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী ভ্রমণে আসে। ২০১৭ সালে প্রাগ লন্ডন, প্যারিস, রোম, ইস্তানবুলের পর সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী গ্রহণকারী ৫ম ইউরোপীয় শহর হিসাবে তালিকাবদ্ধ হয়।

প্রাগ ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় মে থেকে আগস্ট মাস। চেক রিপাবলিকের ক্যাপিটাল প্রাগে যেতে যেকোনো ইউরোপিয়ান শহর থেকেই ফ্লাইট নেওয়া যায়। অথবা টুরগ্রুপের সাথে গেলে তারা বাস বা ট্রেন প্রোভাইড করে। হট টুরিস্টপ্লেস প্রাগে সবধরণের হোটেলের রমরমা। প্রত্যেক হোটেলেই বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট ইন্ক্লুডেড।

প্রাগ এমন এক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রোমান্টিক শহর, যাতে রয়েছে স্বর্গীয় ছোঁয়া, প্রাকৃতিক পরশ ও ঐতিহ্যের দ্যোতনা। প্রাগ শহরকে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের শেষে বিদায় জানিয়েও রেহাই পাওয়া যায় না। জীবনের বাঁকে বাঁকে স্বপ্নে এসে ধরা দেয় প্রাগসুন্দরী। মনে হয়, যে শহরে হাঁটতে আরও আরও পথ বাকী। অনায়াসে, অবলীলায়, জীবনভর যে শহরকে নিজের একান্ত শহরের মতো বুকে লুকিয়ে রাখা যায় এবং কখনোই বিদায় জানানো যায় না।

ইউরোপের আধুনিক কবি  Mitchell Duran যা বিবৃত করেছেন কাব্যিক ব্যাঞ্জনায়:

"Goodbye Prague, to a city

I never thought I'd know.

Goodbye Prague, to a heaven

that is lined with shattered beer bottles and stamped out cigarettes

the junkies and the hobo's here still manage to get a  few puffs out of."

   

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;