ইবনে বতুতার চোখে বাংলাদেশ



মো. তাহমিদ হাসান
শিল্পীর চোখে পর্যটক ইবনে বতুতা।

শিল্পীর চোখে পর্যটক ইবনে বতুতা।

  • Font increase
  • Font Decrease

মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যে সব জায়গায় সফর করেছিল তা বেশিভাগই মুসলিম অধ্যুষিত ছিল। ইবনে বতুতা 'আর রিহলা' নামক গ্রন্থে তার ভ্রমণকাহিনীগুলো লিপিবদ্ধ করেন। রিহলা একটি আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ভ্রমণকাহিনী। তার এই বইয়ের সম্পাদক ছিলেন ইবনে জুজারী। 'আর রিহলা' গ্রন্থে বতুতার বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা পাওয়া যায়। তার ঐতিহাসিক বইয়ে তৎকালীন বাংলার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অবস্থার সম্পর্কে জানা যায়।

ইবনে জুজারী লিখেছেন, '১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইবনে বতুতা তানজিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরলোকগমন করেন ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দ অথবা পরবর্তী বছরে।' ইবনে বতুতার প্রকৃত নাম ছিল শেখ আবু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বতুতা। ইবনে বতুতা ছিল তার বংশগত পদবী যা আজও মরক্কোর প্রচলিত দেখা যায়৷ এ সম্প্রাদায়ের নাম প্রথমে স্থান পায় সাইরেনাইকা ও মিসরের সীমান্তবর্তী একটি যাযাবর জাতি হিসেবে। তাদের এ বংশ কয়েক পুরুষ পূর্ব থেকেই তানজিয়ারে বসবাস করছিল এবং তারা লুবাতার সম্প্রাদায় ভুক্ত ছিল।

ইবনে বতুতা নিজে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি বিশ্বভ্রমণের জন্য বের হয়ে যায় এবং ২২ বছর বয়সে মক্কায় হজ্ব পালন করেন। জানা যায় তিনি ১৩২৫-১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তিনি ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে আসেন এবং সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে দীর্ঘ প্রায় আট বছর কাজীর পদে নিয়োজিত ছিলেন। এরপরেই তিনি ১৩৪৫ অথবা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফখর উদ্দীন মোবারক শাহের শাসনকালে বাংলায় আসেন।

ইবনে বতুতা তার 'আর রিহলা' গ্রন্থে বলেছেন, 'দীর্ঘ তেতাল্লিশ রাত্রি সমুদ্রের বুকে কাটিয়ে আমরা বাঙ্গালা (বাংলা) দেশে পৌঁছলাম। এ বিশাল দেশে প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম। পক্ষান্তরে এ একটি অন্ধকার দেশ। খোরাসানের লোকেরা বলে, বাংলা ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ একটি নরক (A Hell Full Of Good Things)।

ইবনে বতুতা জানান, 'এক দেরহামে আটটি মোটাতাজা মুরগি, দুই দেরহামে একটি মোটাতাজা ভেড়া এখানে বিক্রি হতে আমি দেখেছি। তাছাড়া ত্রিশ হাত লম্বা উৎকৃষ্ট ধরনের সূতী কাপড় মাত্র দুই দিনারে এখানে বিক্রি হতে দেখেছি। এক স্বর্ণ দিনারে অর্থাৎ মরক্কোর আড়াই স্বর্ণ দিনারে এখানে সুন্দরী ত্রুীতদাসী বালিকা বিক্রি হয়। সমুদ্রোপকুলে আমরা যে বৃহৎ শহরে প্রবেশ করি তার নাম সাদকাওয়ান।"

ইবনে বতুতা দক্ষিণ ভারত থেকে সমুদ্র পথে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তিনি সদকাওয়ান নামক জায়গায় পদার্পণ করেছিলেন। তার গ্রন্থ 'আর রিহলা'র মতে বিশেষজ্ঞরা সদকাওয়ান জায়গাটিকে চট্টগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, বাংলার আবহাওয়া আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মানুষের জন্য ছিল প্রচন্ড প্রতিকূল। তার কারণ বৃষ্টির পানি ও শীতের কুয়াশা এখানে অসহনীয়। তার উপর এই অঞ্চলে রয়েছে নদীর প্রাধান্য। এই জন্য সেই সময় বাংলায় আসাকে অনেকেই ভয় করতো অথচ বাংলার ভূমি ছিল উর্বর। ফলে বাংলাকে 'দোজখ-ই-পুর-নিয়ামত' বা ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ একটি নরক (A Hell Full Of Good Things) বলার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা এইসব মনে করেন। ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায় মাত্র ১ দিরহামে ৮ টি মোটাতাজা মুরগি এবং ২ দিরহামে ১টি মোটাতাজা ভেড়া পাওয়া যেত। ইবনে বতুতার আশুরা নামে এক সুন্দরী ক্রীতদাসী বালিকা ক্রয় করেন এবং তার এক সঙ্গী লুলু (মুক্তা) নামে অল্প বয়সী দাসী কিনার কথাও তার বর্ণনায় পাওয়া যায়।

ইবনে বতুতা যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলার শাসক ছিল ফখরউদ্দীন। শাসনকর্তা হিসেবে তিনি উৎকৃষ্ট ছিলেন। ফখরউদ্দীন দরবেশ ও সুফিদের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করতেন। ফখরউদ্দীন দিল্লির সুলতানের আনুগত ছিলেন না। কারণ দিল্লির সুলতান তার এক পুত্রকে কারারুদ্ধ করেন এবং সিংহাসন ও রাজত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্তে হন। ইবনে বতুতা সাদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) থেকে কামারু পর্বতের দিকে রওনা হন। সেখান থেকে কামারুর পথ ছিল এক মাসের। ইবনে বতুতা কামারু নামক যে স্থানটি পরিদর্শন করেন সেটি সম্ভবত ছিল খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও ত্রিপুরার পাহাড় বেষ্টিত আসামের অন্তর্গত শ্রীহট্ট (সিলেট)। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার মূল উদ্দ্যেশ ছিল সিলেটের শেখ জালালুদ্দিন নামক এক প্রসিদ্ধ ধর্মপ্রাণ সাধু ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করা। জালালুদ্দিনের বাসস্থান থেকে দুইদিনের পথ দূরে থাকতেই ইবনে বতুতা শেখের দুইজন শিষ্যের সাথে দেখা হয়। শেখ জালালুদ্দিন তার শিষ্যদের ইবনে বতুতাকে অভর্থনা জানানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে বতুতা তার সম্পর্কে কোনো কিছুই জালালুদ্দিনকে আগে থেকে জ্ঞাত করেননি। তবুও শেখ জালালুদ্দিন তার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। এ থেকেই ইবনে বতুতার শেখ জালালুদ্দিনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান।

ইবনে বতুতা শেখ জালালুদ্দিনের কাছে তিনদিনের আতিথ্যে ছিলেন। ইবনে বতুতার শেখ জালালুদ্দিনের একটি ছাগলের লোমের তৈরি আলখেল্লা পছন্দ হয়। ইবনে বতুতা তার গ্রন্থে লিখেছেন, 'শেখের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি ছাগলের লোমের তৈরি আলখাল্লা পরিধান করে আছেন। আলখাল্লাটি দেখে আমার পছন্দ হলে মনে মনে বললাম, আহা, শেখ যদি এটি আমাকে দান করতেন। পরে তার কাছে যখন বিদায় নিতে গেলাম, তিনি উঠে গুহার এক কোণে গিয়ে আলখাল্লাটি খুলে এসে আমার গায়ে পরিয়ে দিলেন এবং নিজের মাথার গোলটুপিটিও আমার মাথায় দিলেন। নিজে এলেন তালি লাগানো একটি পোষাকে।'

ইবনে বতুতা শেখের শিষ্যদের কাছ থেকে জানতে পেরে ছিলেন এই আলখাল্লা শুধু তিনি আসলেই শেখ পরিধান করতেন। শেখ জালালুদ্দিন তার আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমেই জেনে গিয়েছিলেন মরক্কোর এক পর্যটক এই আলখাল্লা চেয়ে নিবেন এবং সেই পর্যটকের থেকে এক বিধর্মী সুলতান সেই আলখাল্লাটি নিবেন। পরিশেষে সেই বিধর্মী সুলতান শেখের ভাই বোরাউদ্দিনকে সেই আলখাল্লাটি দিবেন। শেখ জালালুদ্দিন এই আলখাল্লাটি মূলত তার ভাই সাঘার্জের বোরাউদ্দিনের জন্য তৈরি করেছিল। ইবনে বতুতা 'আর রিহলা' গ্রন্থে এইসব বিবরণের কিছু কিছু বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন।

শেখ জালালুদ্দিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইবনে বতুতা আন-নহর উল-আজরাক (মেঘনা নদী) মধ্যে পনেরো দিনের পথ পাড়ি দিয়ে সোনারকাওয়ানে (সোনারগাঁও) পৌঁছান। এই পনেরো দিনের নদী পথের যাত্রায় বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছিল। তার এই যাত্রাপথে নদীর দুইধারে ফলের বাগান ও গ্রামাগুলো দেখতে পেয়েছিল, যা তিনি বাজারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার তুলনা করেছেন। অসংখ্য নৌকা এই নদীপথে যাত্রা করতো, কিন্তু যখন একটি নৌকা অপর নৌকার সঙ্গে দেখা হতো তখন উভয়ে নিজেদের ঢাক পিটিয়ে অভিবাদন জানাত। সুলতান ফখরউদ্দীন সুফি দরবেশদের চলাচলের জন্য এই নদীতে কোনো ধরণের কর নিতেন না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলজ উপাদান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আন-নহর উল-আজরাক অর্থাৎ মেঘনা নদীকে তিনি মিশরের নীল নদের সাথে তুলনা করেছিলেন।

মধ্যযুগের বাংলা কত সমৃদ্ধ ছিল তা প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ বিবরণে স্পষ্ট। তা থেকে বাংলার অতীত গৌরব সম্পর্কেও আঁচ করা যায়। তদুপরি, বাংলার এই ঐশ্বর্যশালী অবস্থানের কারণেই যে পরবর্তীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখানে হানা দিয়েছিল তা অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না।

তথ্যসূত্র ইবনে বতুতার 'আর রিহলা' গ্রন্থ। ]

মো. তাহমিদ হাসান, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

   

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;