দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল!



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল! বার্তা২৪.কম

দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল! বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সবার চোখ এখন বিপন্ন হাওরাঞ্চলের দিকে। মিডিয়ার ফোকাসে দেখা যাচ্ছে ডুবন্ত হাওরের ক্রন্দনরত কৃষকের করুণ চেহারা। চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে মাঠের সোনালী ফসল। হা-হুতাশ, হতাশার মধ্যেই রাত জেগে চলছে পাহারা। তবুও বাঁধ রক্ষা করা যাচ্ছে না। কৃষকরা সর্বশক্তি দিয়ে ফসল, জীবন, বাঁধ ঠেকানোর লড়াই করছেন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিয়দাংশ নিয়ে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে।

চলতি চাষের মৌসুমে কৃষকরা প্রস্তুত ছিলেন, আশায় বুক বেঁধেছিলেন ফসল ঘরে তুলতে। গোলা ভরা থাকবে ধানে। মুখে থাকবে হাসি। সব যেন চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে। সব হারানোর ভয়ে এখন জীবনের কঠিন রণাঙ্গনে সঙ্কুল পরিস্থিতি পাড়ি দিচ্ছেন হাওরের সংগ্রামী কৃষকগণ।  

হাওরাঞ্চলকে বলা হয় ফসলের ভাণ্ডার। প্রধানত একটিই ফসল হয় হাওরে। আর সেটি হচ্ছে বোরো ধান। প্রথাগতভাবে হাওরের আদিঅন্তহীন মাঠে বৈশাখে কাটা হয় সেই ধান। অথচ হাওরের এই ফসল নিয়ে প্রতি বছরই থাকে শঙ্কা। আকস্মিক বৃষ্টি, বন্যা ও উজানের ঢলে তলিয়ে যায় হাওরের সবকিছু। তখন জমিজমা, ফসলের মাঠ ভাসিয়ে ধাবমান জলস্রোত বাড়িঘর ও জনবসতিকে ভাঙনের মুখোমুখি করে। 

এরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেই শত আশঙ্কায় চলে হাওরের জীবন ও চাষাবাদ। সংগ্রামী কৃষকগণ বৈশ্বিক মহামারিকালে আর্থিক সঙ্কট কাটাতে এ বছর আপ্রাণ পরিশ্রমে উৎপন্ন করেছিলেন যে ফসলের সম্ভার, তা পরিপক্ব হওয়ার আগেই তলিয়ে গেছে আগাম বন্যার পানিতে। ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ। দোকান, বাজার, বাড়ি, স্কুল, সবকিছু। চারিদিকে সমুদ্রের জলকল্লোলে মধ্যে অসহায় দ্বীপের মতো ভয়ে কম্পমান এখন হাওরাঞ্চল ও এর মানুষজন।

অথচ প্রতি বছরই সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরে বাঁধ দেয়। এবারও হাওরাঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের জন্য হাওরের প্রতিটি জেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল কমপক্ষে ১২০/১৫০ কোটি টাকা করে। এমন তথ্য পাওয়া গেছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিয়দাংশ নিয়ে থেকে। যেখানে সব মিলিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার সরকারি উন্নয়ন কাজ হয়েছে। তারপরের বাঁধ টিকে নি। হাওরের মানুষ, ফলস ও সম্পদ রক্ষা পায় নি। 

মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে বিপন্ন কৃষকগণ বলেছেন, 'এবারো হাওরে সরকারের শতকোটি টাকা তলিয়ে গেল পানিতে। এই টাকায় কাজ কিছুই হলো না। বরং পানিভর্তি হাওরে বাঁধ এখন কৃষকদের কাছে চোখের বালি।'

প্রশ্ন হলো, হাওরের বাঁধ কেন কোনও কাজেই আসছে না? স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যানুযায়ী, হাওরে বাঁধ নির্মাণে সব সময়ই সীমাহীন দুর্নীতি হয়, এবারও হয়েছে। কাজ হয়েছে নিম্নমানে। টাকা লুটপাট করা হয়েছে। রাজনীতি ও প্রভাবের খেলায় টাকার বাটোয়ারা হয়েছে বলে বাঁধের কাজ মানসম্মত হয় নি। যার কুফল ভুগছে হাওরের মানুষ। হারাচ্ছে ফসল ও সহায়-সম্পদ।  

সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তি একাধিক মিডিয়া জানিয়েছে যে, প্রায় ১০ দিন আগে হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় থেকে ঢল নামে। এতেই ভীতির সঞ্চার হয় হাওরে।  তখন সুনামগঞ্জে সুনামগঞ্জ সফর করেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রীও। সফরকালেই তিনি সচক্ষে বাঁধের অবস্থা দেখে যান। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কৃষকরা। ধর্মপাশায় এক কৃষক প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে বাঁধ নির্মাণের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন জনতা। ওই কৃষক তার কাঠগড়ায় দাঁড় করান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করায় ওই কৃষকও পরে নেতাদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। তবে- পানি সম্পদ উপমন্ত্রী সুনামগঞ্জে বসেই বাঁধের অনিয়ম পাওয়ায় ঢাকায় গিয়ে অতিরিক্ত সচিব দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিও পরপরই সুনামঞ্জ সফর করে গেছেন। কৃষকরাও তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি ঘুরে যাওয়ার দু’দিন পর পানি মন্ত্রণালয়ের সচিবও সুনামগঞ্জ ঘুরে যান।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কিছুটা ছলনার আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা বলছেন, এক তৃতীয়াংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এদিকে সুনামগঞ্জ সফর করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে হাওরে ধান কাটার উদ্বোধন করেন। তার উদ্বোধনের দু’দিনের মাথায় ডুবে যায় পুরো হাওর। আর বাঁধ নিয়ে টেনশনে থাকেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। 

হাওরের অন্যান্য জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, হাওরের শ’ শ’ একর ধান এখন পানির তিন থেকে চার ফুট নিচে। এখনো ধান কাটার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু তার আগেই হাওর তলিয়ে গেল। আর ক্রমাগত পানি বাড়ার কারণে তারা আর ধান কাটতে পারবেন না। 

দুর্নীতি ও তসরুপের মাধ্যমে টাকা লুটপাটের ঘটনায় হাওরের বাঁধ নির্মাণ নিম্নমানের হওয়া একটি পুরনো সমস্যা। সরকার বদল হলেও বাঁধ নির্মাণের অনিয়মের অবসান হয় নি। তদুপরি হাওরে দুর্নীতি করাও সহজ। কারণ, যত নিম্নমানের কাজই হোক, তা প্রমাণ করা কঠিন। অসৎ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারগণ সব দোষ দেয় ঢলের পানিকে। পানিতে ভেসে গেলে বাঁধ নির্মাণের ভালোমন্দ প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না। বছরের পর বছর প্রকৃতিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেই রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে হাওরের দুর্নীতিবাজ চক্র।   

হাওরের দুর্নীতির পাশাপাশি বিপদ বাড়িয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। হাওরের ভূপ্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের বারোটা বাজিয়ে চলছে সরকারি ও বেসরকারি কাজকর্ম,  যার কুফল দেখা যাচ্ছে হাওরের নানা ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য,  হাওরের সব নদ-নদীর পানির প্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য হাওর এলাকায় নতুন করে আর কোনও সড়ক নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে ওইসব এলাকায় এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ করা হবে। গত সোমবার (১৮ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে হাওর এলাকাতে কোনও রকমের রাস্তাঘাট এখন থেকে আর করা যাবে না। এখন থেকে এলিভেটেড করতে হবে, যদি কিছু হয়। যাতে করে পানি চলাচলে বাধা না আসে।  হাওরের বুকে কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে মিঠামইন হয়ে অষ্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কের কারণে বর্ষায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এখন ওই সড়কে সেতুর সংখ্যা বাড়িয়ে পানি প্রবাহ বাড়ানো যায় কিনা, সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, পারটিকুলারলি এটা দেখতে বলা হয়েছে, সিলেটের (অঞ্চল) পানিটা মূলত নামে অষ্টগ্রামের দিক দিয়ে। এখানে যে রাস্তাটা করা হয়েছে মিঠামইন থেকে অষ্টগ্রাম, সেটাতে কোনো অ্যাফেক্ট হলো কিনা- এটাও দেখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মিটার ব্রিজ করে দেয়া যায় কিনা। এখানে এখনো ব্রিজ আছে, তারপরেও তাদের সার্ভে করতে বলা হয়েছে। এই সড়ক যেটা তারা করেছে, সেটার কারণে পানি যদি আটকে যায়, তাহলে তারা প্রেফারেবলি আধা কিলোমিটার বা আরেকটু লজিক্যাল ডিসটেন্সে, যদি মনে করে যে, এই সড়কটা পানির জন্য বাধা, তাহলে যাতে পানির ফ্লো ঠিক হয়- এ জন্য পর্যাপ্ত ব্রিজ করে দেয়া যায় কিনা, সেটা তারা ঠিক করবে। উজানের ঢলে এবার সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় অন্তত পাঁচটি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিপুল জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

সে প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বছরে প্রায় ৫ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ওই এলাকায়। কিন্তু ১ থেকে ৬ই এপ্রিল হয়েছে ১২০০ মিলিমিটারের বেশি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপর (উজান) থেকে পানি চলে এসেছে। প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর চাষ হয়। যদি আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে ভালো অবস্থায় থাকবে। আগামী কয়েক দিন বৃষ্টি না হলে নতুন করে হাওরে ক্ষতি হবে না আশা প্রকাশ করে সচিব বলেন, হাওরে ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে মোটামুটি সব ধান কাটা হয়ে যায়, এদিকে একটু দেরিতে হয়। হাওরে এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথমেই পানি চলে আসে, এটা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আগামী ৮-১০ দিন যদি বৃষ্টি না হয়, আশা করা যায়- কোনো ক্ষতি হবে না। 

আগাম জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে হাওরে ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে এখানে আর্লি ভ্যারাইটি করা যায় কিনা, যাতে করে এপ্রিল মাসের ১০-১২ তারিখের দিকেই ধান কেটে ফেলা যায়। রোববার (১৭ এপ্রিল) মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাঁধ নির্মাণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী অনুরোধ করেছেন, যে বাঁধগুলো দেয়া হয়েছে, সেগুলো ফ্রুটফুল কিনা বা কোয়ালিটি ঠিক আছে কিনা- এটা দেখতে। এই বর্ষায় তো আর কিছু করা যাবে না। আগামী বর্ষার আগে যেন এটা রিভিউ করে সমাধান করা হয়। আলোচনা হয়েছে যে, নদী-নালা ও হাওরে যেখানে বেশি পলি পড়ে গেছে, সেগুলোকে পুনঃখনন করে আগামী বর্ষার আগেই প্রকল্প শুরু করে কাজ নেয়ার জন্য। রিসেন্টলি একনেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প পাস হয়েছে, সেটি সুনামগঞ্জ থেকে আসবে, সেটিও এলিভেটেড হচ্ছে। শুধু হাওর না যেসব এলাকা লো লাইন এলাকা, সেগুলোতে যত সড়ক হবে সেগুলো এলিভেটেড হবে।

প্রতিবছরের মতো এবারও দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল। সরকার নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে হাওরের কৃষক ও ফসল রক্ষার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু হাওরের বিপদ ও দুর্যোগের স্থায়ী অবসানে টেকসই পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রয়োজন। প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে  'হাওর নীতিমালা' প্রণয়ন করে সেখানে নির্মাণ, উন্নয়ন, ভূমির ব্যবহারকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং হাওরের সামগ্রিক বিশিষ্টতা অক্ষুণ্ণ রেখে হাওরবাসীর নিরাপত্তা ও কল্যাণ সুনিশ্চিত করা। 

   

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;