আলো ছড়াচ্ছে জয়তী সোসাইটি!
যশোর থেকে ফিরে: অসহায় নারী ও শিশুদের আস্থা-ভরসার নাম ‘জয়তী সোসাইটি’। জয়তী সোসাইটি অবহেলিত নারীদের কাছে স্বাবলম্বী হওয়ার অপর এক নাম। ষাটোর্দ্ধ মমতাময়ী মায়েদের কাছে বেঁচে থাকার প্রত্যয়। আর বস্তির সবচেয়ে অবহেলিত শিশুর দু’চোখের স্বপ্ন।
নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে সমাজের অসহায় নারী ও শিশুদের পথ দেখাচ্ছে সাফল্যের। ঘুনে ধরা সমাজের অন্ধকারকে দূর করে ছড়াচ্ছে আশার আলো।
নারী বৈষম্য ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সগৌরবে এখন মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে যশোরের রেলগেটের মুজিব সড়কে নারী ও শিশু উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান ‘জয়তী সোসাইটি’। নিজেদেরকে আলোকিত করার আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী সংগঠনগুলো ছুঁটছেন জয়তী সোসাইটির কাছে।
‘জয়তীর সেবা গ্রহণ করুন, দুঃস্থ নারী ও শিশুদের সাহায্য করুন’ এই স্লোগান নিয়ে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে এই সংগঠনটি। নারীরা গতানুগতিক কাজ না করে একটু ভিন্নভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করবে এমন প্রত্যাশা থেকেই সংগঠনটি শুরু থেকেই তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকে।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত সফলতার সাথে নারী জাগরণে কাজ করে যাচ্ছে একাগ্রচিত্তে। এছাড়াও ষাটর্দ্ধ নারীদের ভরনপোষণেরও দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন এই সংগঠনটি।
সংগঠনটি শুধু নারীদের নিয়েই নয়। এই সংগঠনটি সমাজের অবহেলিত শিশুদের নিয়েও কাজ করছে নিরলসভাবে। কোন শিশুই যেন শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে সেই দিকটা বিবেচনা করে সংগঠনটি সবার জন্য শিক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা আর বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুরা শিক্ষা থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সেজন্য জয়তী সোসাইটি পরিচালনা করছে ১২টি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়।
জয়তী সোসাইটি সামাজিক ও বাণিজ্যিক দুটি কার্যক্রমই পরিচালনা করে থাকেন। যশোরের মুজিব সড়কে ৭ কাঠা জমির উপর নিজস্ব অর্থায়নে ৬তলার ‘জয়তী ভবন’ গড়ে তুলেছেন সংগঠনটির পরিচালক ও বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত সফল নারীনেত্রী অর্চনা বিশ্বাস।
এই একই ভবনের ছাদের নিচে পরিচালনা করা হয় সকল সামাজিক ও বাণিজ্যিক কর্মসূচিগুলো। বাণিজ্যিক কার্যক্রমগুলো থেকে যে অর্থ আয় হয় সেই অর্থই ব্যয় করা হয় সমাজের অবহেলিত নারী ও শিশুদের পিছনে।
কথা হয় জয়তী সোসাইটির ম্যানেজার হাজেরা খাতুনের সাথে। তিনি বার্তা২৪.কমের এই প্রতিনিধিকে বলেন, জয়তী সোসাইটির বাণিজ্যিক ভাবে যে কাজগুলো করে থাকেন সেগুলো হলো- জয়তী হেঁসেল এন্ড রেস্টুরেন্ট (বাংলা ও চাইনিজ) এবং জয়তী ফাস্টফুড।
এই রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডে যে খাবার তৈরি হয় তা একেবারেই নির্ভেজাল ও কীটনাশকমুক্ত। যা আমরা ঘরোয়া ভাবে তৈরি করি। এখানে ১২ মাসই ১৫-২০ রকমের পিঠা ও অনেক প্রকারের আচার পাওয়া যায়। আমরা যশোর শহরের মধ্যে হোম ডেলিভারিও দিয়ে থাকি।
জয়তী বিউটি পার্লার, জয়তী ফিটনেস সেন্টার (শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য) রয়েছে। যেখানে একেবারেই প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে কাজ করেন বিউটিশিয়ানরা। আবাসিক হোটেল, কনফারেন্স রুম, কমিউনিটি সেন্টার ও ভেজালমুক্ত, রংবিহীন বিভিন্ন আচার ও গুড়া মশলা তৈরি।
মোট ৫টি কনফারেন্স কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কনফারেন্স রুমে ৫০জন অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাছাড়া খুব অল্প টাকায় খুবই উন্নতমানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। যা খুবই পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন ও গোছালো।
এ সকল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে যে টাকা আয় হয় সেই টাকা সামাজিক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়। সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- ২০০ শতাধিক ষাটর্দ্ধ অসহায় বৃদ্ধ মাকে সারা বছর বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া এবং তাদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করা। তবে এই কাজে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সোসাইটিকে সহযোগিতা করে থাকে।
দুঃস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করার করার লক্ষ্যে ফিতরার টাকা সংগ্রহ করে এ পর্যন্ত ৫৫টি ছাগল ও ৭৫টি গরু প্রদান করেছে সোসাইটি। তাছাড়া আমাদের অর্থায়নে পরিচালিত যশোর শহরের বস্তিতে ১২টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। গরীব শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়।
এ সময় তিনি আরও জানান, নারীদের আত্নশক্তিতে বলীয়ান করা, নারীদেরকে সুসংগঠিত করা এবং নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। যার জ্বলন্ত প্রমাণ এই জয়তী ভবন। কারন এই ভবনে যতগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সবগুলোই নারীদের দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। শুধুমাত্র আবাসিক হোটেলটি বাদে।
জয়তী সোসাইটির পরিচালক অর্চনা বিশ্বাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি সমাজে নারীরা কতটুকু অবহেলিত। বিশেষ করে অসহায় নারীরা নানা ভাবে বৈষম্য এবং শারীরিক ও মানষিক ভাবে নির্যাতিত হয়। সমাজের অসহায় নারী ও অবহেলিত শিশুদের কথা বিবেচনা করেই আমি পথ এগোতে থাকি।
প্রথম দিকে নানা বাঁধা আসলেও এখন আর কোন বাঁধা নেই। যারা এক সময় এই সোসাইটির বিপক্ষে ছিল আজ আনন্দের সংবাদ হলো এই সোসাইটিকে তারা এখন তাদের নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে। নারী ও শিশুদের নিয়ে আমাদের স্বপ্ন অনেক। আমরা আরো অনেক দূর যেতে চাই।