ফিরে দেখা অপারেশন জ্যাকপট: দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণ



বাশার খান, জ্যেষ্ঠ গবেষক, পিআইবি
অপারেশন জ্যাকপট/ ছবি: সংগৃহীত

অপারেশন জ্যাকপট/ ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। এই অপারেশনের আওতায় অতি অল্পসময়ে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে বাঙালি নৌ-কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তিশালী প্রতিরোধের কথা বিশ্বকে জানান দেয়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ-কমান্ডো দলের এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে পরিচিত। এদিন রাতে নৌ-কমান্ডোরা একযোগে মংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়। পরদিন রাতে আক্রমণ করা হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি ফেরিঘাটে। সেখানে ফেরি, বাজ ও পন্টুন ডুবিয়ে দেয় নৌ-কমান্ডোরা।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ-কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। তার আগে তাদেরকে পলাশীতে ৩ মাসব্যাপী কঠোর প্রশিক্ষণে অত্যন্ত দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৬০ জন কমান্ডো গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীরউত্তম)। তবে চট্টগ্রামে নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালিত হয় ওই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। ১৫ আগস্ট রাত ১২টায় অপারেশন জ্যাকপট অভিযান শুরু হয়। কমান্ডোরা সতর্কতার সাথে জাহাজে মাইন সংযোজন করে ফেরত আসেন। কিছু মাইন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিস্ফোরিত হয়। ১৫ আগস্ট রাত ১- ১.৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর প্রকম্পিত হয়। বন্দরে ‘এম.ভি হরমুজ’ এবং ‘এম.ভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এম.ভি হরমুজে ৯৯১০ টন এবং এম.ভি আল-আব্বাসে ১০,৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল। সাবমেরিনার আহসানউল্লাহ’র (বীরপ্রতীক) নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ-কমান্ডো মংলা বন্দরে অভিযান করেন। বন্দরের ৬টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। চাঁদপুর নদীবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে ২০ জন নৌ-কমান্ডো সফল অপারেশন চালান। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময়ে চাঁদপুর বন্দরে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সাবমেরিনার আবদুর রহমান (বীরবিক্রম) ও শাহজাহান সিদ্দিকের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে কমান্ডো দল যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ও দাউদকান্দি ফেরিঘাটে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

এই অপারেশনের ফল ছিল সুদূর প্রসারী। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে পাকিস্তানিদের এমন প্রচার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এরপর থেকে কোনো বিদেশি জাহাজ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে আসতে রাজি হয়নি।

দাউদকান্দি ফেরিঘাটের গুরুত্ব ও অপারেশন

সামরিক দিক বিবেচনায় দাউদকান্দি ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা শত্রুপক্ষের যুদ্ধের সরাঞ্জমাদি, গোলাবারুদ, অস্ত্র ও রসদ ঢাকাসহ সারা দেশে যেত এই ফেরিঘাট হয়ে। এ জন্য এই ফেরিঘাটটি ধ্বংস করা জরুরি হয়ে পড়ে। ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস দাউদকান্দি ফেরিঘাটের গুরুত্ব সম্পর্কে ঐ অপারেশনের নেতৃত্বদানকারী শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রমকে ৭১’র আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো এক সময় ডেকে বলেন, ‘সামরিক দিক থেকে দাউদকান্দি ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই ফেরিঘাটের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের রাজধানীর ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের যোগাযোগ রক্ষা করাসহ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আনীত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পারাপার করা হয়। তাই পাকিস্তানি আর্মির গুরুত্বপূর্ণ এই যোগাযোগ স্থল দাউদকান্দি ফেরিঘাটটি অচল করে দেওয়া সামরিক দিকে থেকে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।’

ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস নৌ-কমান্ডোর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা শাহজাহান সিদ্দিকী (পরে বীর বিক্রম) কে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমান্ডো দল গঠন করেন। দলটিকে পাঠিয়ে দেন দাউদকান্দি ফেরিঘাটের ৭/৮ মাইল দূরে নদীর পাড়ে অবস্থিত গ্রাম বন্দরামপুরে।

নৌ-কমান্ডো দলের দাউদকান্দির উদ্দেশে রওয়ানা

শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমান্ডো দলকে দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণের জন্য ১১ আগস্ট বাংলাদেশে পাঠানো হয়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার পর আমি আমার কমান্ডো গ্রুপকে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বকসনগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করি। চাঁদপুর গ্রুপটিও আমার সাথেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে। চাঁদপুর গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনের আমিন উল্লাহ, বীরবিক্রম (পরে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট)। আমাদেরকে ২জন করে গাইড দেওয়া হয়। প্রত্যেক গ্রুপের জন্যই ২ জন করে গাইড ছিল। চাঁদনী রাতের আকাশ। তাই পথ চলতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পথঘাট ভালই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে থাকা অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি ম্যাগজিন ও পর্যাপ্ত গুলিসহ ১টি অটোমেটিক মেশিনগান। প্রত্যেক কমান্ডোর জন্য একজোড়া সাঁতার কাটার ফিনস, ১টি লিমপেড মাইন ও কমান্ডো নাইফ।

সে রাতে আমরা কখনো ধান খেতের আইল, আবার কখনো মেঠো পথ হয়ে এগুতে থাকি। কিছুদূর যাবার পর চাঁদপুর গ্রুপ আলাদা হয়ে চাঁদপুরের দিকে যায়। আমরা যাই দাউদকান্দির দিকে। এরপর যাই ময়নামতির উত্তরে অবস্থিত কংশনগর বাজারের দিকে। এই বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে গোমতী নদী প্রবাহিত। গোমতীর পূর্ব পাড়ে উঁচু বেড়িবাঁধ। ভোর নাগাদ আমরা বেড়িবাঁধ হেঁটে নদীর পূর্বপাড়ের নৌকাঘাটে যাই। ২ জন ২জন করে নৌকা পার হই। এরপর কুমিল্লা বি-বাড়িয়া- সিলেট সড়ক পার হয়ে পশ্চিম দিকের একটি গ্রামে ঢুকি। এই সড়কে পাকি সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল থাকত- এজন্যই সড়কটি খুব সাবধানে পার হই। এরপর গাইডের সহযোগিতায় গ্রামটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে গিয়ে সবাই আবার একত্রিত হই। হাঁটি আরও ২ মাইল। এখানে একটি ঘাটে বড় একটি নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। নৌকাটি আমাদেরকে নিয়ে কখনো বর্ষার ধানখেত আবার কখনো খালের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। মাঝিরা জানায়, বর্ষার পানি থাকায় এ এলাকায় পাকি সেনাবাহিনীর তেমন কোনো আনাগোনা নাই। এমনি করেই দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজারের ৩ মাইল উত্তরে অবস্থিত আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত বন্দরামপুর গ্রামের পীর শাহ কামালের বাড়িতে পৌঁছি। বন্দরামপুর গ্রামে আমাদের নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করেন তখনকার ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার। ওখানে পৌঁছানোর পর লম্বা কোর্তা পরা পীর শাহ কামাল আমাদেরকে স্নেহভরে অভ্যর্থনা জানান।

রেকি

তৎকালীন দাউদকান্দির (বর্তমান তিতাস উপজেলা) বন্দরামপুর গ্রামের পীর শাহ কামালের বাড়িতে গোপন আশ্রয় নেন শাহজাহান সিদ্দিকীর বীরবিক্রমের নেতৃত্বে নয় সদস্যের কমান্ডো দল। সেখান থেকে ১৪ আগস্ট সকালে শাহজাহান সিদ্দিকী ও এই অভিযানের ডেপুটি কমান্ডার মতিউর রহমান বীর উত্তম নৌকায় করে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছাকাছি যান অপারেশনস্থল রেকি করতে। শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি ও মতি লুঙ্গি ও হাফ শার্ট পরে ভাড়া করা একটি ছইওয়ালা নৌকায় ১৪ আগস্ট সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের সঙ্গে চটের ব্যাগে ফোল্ডিং করে লুকিয়ে রাখা স্টেনগানটি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী, আর দক্ষিণে গোমতী নদী। তখন ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিম দিকে মেঘনা নদীর মাঝখানে একটি ছোট্ট চর ছিল। চর থেকে ফেরিঘাটের সবকিছু দেখা যেত। চরের পাশে কিছুক্ষণের জন্য নৌকা রেখে আমরা লক্ষ করলাম যে ফেরিঘাটের পন্টুন থেকে একটু দূরে পশ্চিম দিকে নদীতে দুটি ভাসমান ফেরি নোঙর করা অবস্থায় আছে। এ দুটি ফেরি আর পন্টুনই হলো আমাদের টার্গেট। অপারেশন এলাকা ও টার্গেট ঠিক করার সময় আমাদের নৌকাটি চলছিল। একপর্যায়ে নৌকার গতি কমিয়ে আমি একটি গামছা পরে নদীতে নেমে পড়ি। ভাবটা এমন যে- যেন নদীর পানিতে গোসল করতে নেমেছি। নামার উদ্দেশ্য নদীর পানির স্রোতের বেগ ও গতিধারা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ। তখন বর্ষাকাল ছিল। ফেরিঘাটটি মেঘনা ও গোমতী নদীর সঙ্গমস্থলে। আরও লক্ষ করলাম বর্ষাকালের ভরা নদীতে স্রোত তেমন নেই। উজানে এবং ভাটিতে সহজেই সাঁতার কেটে যাওয়া যায়। তবে নদীর তীরবর্তী ফসলের জমিতেও অথই পানি থাকায় কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই।’

শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম ও মতিউর রহমান, বীরউত্তম সেখানে গোসল করার ভান করে রেকি করায় দূরে পাকিস্তানি ফেরিতে পাহারারত সৈন্যরা সন্দেহ করেনি সেদিন। সফলভাবেই রেকি করে দুজন ফিরে যান বন্দরামপুর গ্রামে।

গানের মাধ্যমে অতি গোপন নির্দেশনা এবং অপারেশনের প্রথম অভিযানের প্রতিবন্ধকতা

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধাপে ধাপে প্রচারিত কয়েকটি গানের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণের সাংকেতিক নির্দেশনা দেয়া হয়। গানের মাধ্যমে নির্দেশনার বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে করা হয়। নৌ-কমান্ডোদের টিম লিডার ছাড়া কৌশলগত কারণে এ বিষয়টি অন্য কাউকে জানানো হয়নি। অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় গানে গানে সিগনাল দেয়ার বিষয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী বীরবিক্রম জানান, ‘বাঙালি মাত্রই গান ভালোবাসেন। এর বাণী হৃদয়কে করে পুলকিত ও বিকশিত। আবার এ গানই যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিতে পারে বা রণাঙ্গনে হামলার সিগন্যাল হতে পারে, সে কথা কি কেউ ভেবেছে কোনো দিন? বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও সত্যি যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুটি গান শত্রু পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনার সংকেত বা সিগন্যাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ... ১৩ আগস্ট, ১৯৭১ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই গানটি প্রচারিত হয়। আমার অন্য সঙ্গী কমান্ডোরাও আমার সঙ্গে ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। এ গানের মর্মার্থ তারা না বুঝলেও আমি বুঝে গেলাম। ৪৮ ঘণ্টা পর আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। গানটি শুনে আমি কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। নিজেকে সামলে নেই দ্রুতই। অপারেশনের প্রাথমিক সিগন্যাল পেয়ে গেছি, এটা কাউকেই বুঝতে দিইনি। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আকাশবাণীর নিয়মিত অনুষ্ঠানে হঠাৎ ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি, ও রে! তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গানটি শুনতে পেলাম। তার অর্থ তখন থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর টার্গেটে আঘাত হানতে হবে। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১৫-১৬ আগস্ট মধ্যবর্তী রাত আমাদের জন্য জিরো আওয়ার। ওই সময় এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে হবে। সেই রাতে সঙ্গী কমান্ডোদের কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ থাকলাম। ১৫ আগস্ট সকালে সবাইকে ডেকে বললাম, আজ রাতেই আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া করে, গায়ে সরিষার তেল মেখে, সুইমিং কস্টিউমসহ যার যার লিমপেট মাইন ও ফিন্স নিয়ে একটি খোলা নৌকাযোগে অপারেশনে বের হয়ে পড়লাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পথিমধ্যে প্রচণ্ড ঝড়-তুফানে পড়ে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলি। তার ওপর গাইড ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে শীতে কাঁপতে থাকে। অসুস্থ বোধ করায় সে আমাদের সঙ্গে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। আমরা তাকে কোনোমতেই যেতে রাজি করাতে পারছিলাম না। গাইড আবুল কাশেম প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে নেমে যেতে চাইল। আমরা তো নৌ-কমান্ডো। প্রশিক্ষণে ৩ মাস পানিতেই ছিলাম। ঝড়-বৃষ্টিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। গাইড আবুল কাশেম অসুস্থ হয়ে পড়ায় নৌকা থেকে নেমে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সামরিক কৌশল অনুযায়ী তো তাকে নামানো যাবেই না। তাহলে আমাদের বিপদ হবে। আমরা মাইনসহ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চারদিক জানাজানি হয়ে যাবে। এটা অত্যন্ত গোপনীয় অপারেশন ছিল।

এই অপারেশনের কথা বাঙালিদের মধ্যে শুধু অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানী ও বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার সাহেব জানতেন। এর বাইরে কেউ জানত না। কাশেমকে ছাড়া যাচ্ছিল না যে আমাদের আরও টিম একই সময়ে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মংলায় গেছে। একটা ধরা পড়লে স্বাভাবিক কারণে অন্য কমান্ডো দলগুলোও ধরা পড়ে যাবে। তো কমান্ডার হিসেবে আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে- যে গাইড কাশেমকে আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে হত্যা করে ফেলে অপারেশনে যাওয়া। যদিও আমার সাথে ফল্ডিং করা স্টেনগান ছিল। সেটা দিয়ে গুলি করলে তো শব্দ হবে। এমন করতে করতে রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। পূবাকাশে সুবেহ সাদেক উঁকি দিচ্ছে মনে হচ্ছে। আমার সঙ্গে থাকা ডেপুটি কমান্ডো লিডার মতি ওরফে মতিউর রহমান বলল, স্যার, আজকে অপারেশন না করলেই ভাল হয়। মতি কিন্তু দাউদকান্দিরই লোক। অত্যন্ত সাহসী ছিল সে। সে বেবি টেক্সির ড্রাইভার থেকে নৌ-কমান্ডো হয়। তাঁর পরামর্শ বিস্তারিত বিবেচনা করে সেদিন অপারেশন করা থেকে আমরা বিরত থাকি।

ফাইনাল অপারেশন

পরদিন ১৬ আগস্ট দিবাগত রাত ১টার দিকে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণ করেন শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কমান্ডো দল। মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেন ঘাটে থাকা দুটি ফেরি এবং একমাত্র পন্টুন। এতে, ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান করা হানাদার বাহিনী। সেদিনের স্মৃতিচারণে শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘পরদিন রাতে আমরা দুটি নৌকা করে বের হই। বড় নৌকাটি দূরে রেখে ছোটো আরেকটি নৌকায় এগিয়ে আসি। ফেরিঘাটের কাছাকাছি সুবিধাজনক জায়গায় এসে ৩জন ৩জন করে পানিতে নামি। ফেরিতে থাকা হানাদার বাহিনীর পাহারাদাররা যখন টর্চ ঘুরাতো- আমরা তখন পানিতে নিঃশব্দে ডুব দিতাম। নদীতে স্রোত ও ঢেউ ছিল। গার্ডরা বুঝতেই পারেনি যে পানিতে ডুবে কেউ আসছে।

আরেকটি বিষয় যে, আমাদের সাঁতার তো সাধারণ মানুষের মত না। নৌ-কমান্ডোদের সাঁতার হাতে নয়- পায়ে। হাত দুটো থাকবে ফ্রি। শুধু নাকটি পানির উপর থাকবে। এখন টেলিভিশনে দেখানো হয়- ডুবুরীরা এক ধরণের লম্বা জুতার মত পরে পানিতে নামে। পায়ে যে পরে- ওটাকে বলে ফিনস। ওটা পায়ে দিলে স্বাভাবিক সাঁতারের চেয়ে ৩ গুন বেশি স্পিডে সাঁতরানো যায়। ব্যাকস্ট্রোকে সাঁতার কাটতাম। অর্থাৎ উল্টা পিছনের দিকে সাঁতার। পলাশীতে আমাদের কঠোর প্রশিক্ষণ হওয়ায় ৭/৮ কিলোমিটার এভাবে সাঁতার কাটা আামাদের জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। সেই অপারেশনে ব্যবহৃত আমার ফিনস দুটো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছি।

সে রাতে প্রচুর স্রোত ছিল। প্রায়ই কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল। তো আমরা নাকটা জাগিয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ভেসে যাওয়ার মতই যাচ্ছিলাম। রাতের অন্ধকারে শত্রু পাহারদাররা বুঝতেই পারেনি যে- কচুরিপানার নিচে মানুষ আছে। এমনি করে টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছে যাই। ২০ গজ দূরত্বে এসে ডুব সাঁতার দিয়ে ফেরির কাছে আসি। যেন পাহারাদার বুঝতে না পারে। পানির নিচে ফেরির বডিতে যখন আমরা চলে আসি- তখন আমরা নিরাপদ। ফেরির উপরের লোকজন আমাদের আর দেখছিল না। স্বাভাবিক কারণেই তাদের দৃষ্টি ছিল খানিক দূরে।

এরপর শুরু হল মাইন ফিট করার কাজ। ফেরি বা জাহাজের লোহার বডিতে মাইন সহজে ফিট করার জন্য মাইনের উপর চুম্বক ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, ফেরি দীর্ঘদিন পানিতে থাকায় নিচে শেওলার আস্তরণ জমে ছিল। শেওলা পরিষ্কারের জন্য আগে থেকেই আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে দেওয়া হয়। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ডুব দিয়ে আমরা শেওলা পরিষ্কার করতে থাকি। কয়েকবারে শেওলা পরিষ্কার সম্পন্ন হয়। পাঁচ কেজি ওজনের লিম্পপেড মাইন তো বুকের সঙ্গে বাধা। ডুব দিয়ে গিয়ে খুব সতর্কতার সাথে মাইন ফিট করি। মাইন ফিট করতে গিয়ে শব্দ না করার কৌশল আমাদের আগেই রপ্ত ছিল। মাইনের ভিতরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক। এর উপর ফুটবল পাম্প করে যে- এরকম একটা জিনিস থাকে। এখানে একটা ডেটোনেটর। তারপর একটা স্ট্রাইকার। স্ট্রাইকারটা ভিতরে ডেটোনেটরকে আঘাত করলেই বিস্ফোরিত হয়। পানিতে এটা কি করে সম্ভব ? স্ট্রাইকারের উপরে পরিমাণ মতো কেমিকেল সল্ট ছিল। এটা পানিতে আস্তে আস্তে গলতে থাকে। অনেকটা মোম গলার মত। উপরে একটা রাউন্ড ক্যাপ লাগানো।

কমান্ডোদের জন্য নির্দেশ হচ্ছে- মাইন লাগিয়ে ক্যাপটা খুলে এনে আমাকে দিবা। যাতে বুঝতে পারি যে- মাইন ঠিকমত লাগানো হয়েছে। তো ক্যামিকেল সল্টটা গলে গিয়ে একটা স্পিরিং গিয়ে ডেটোনেটরকে আঘাত করে। তখন মাইন বিস্ফোরিত হয়। মোমের মত কেমিকেলটা গলতে ৪০-৪৫ মিনিট লাগে। এরপর মাইন বিস্ফোরিত হয়। এই সিস্টেমটা এ জন্য যে- কমান্ডোরা মাইন ফিট করে যাতে নির্ধারিত নিরাপদ জায়গায় যেতে পারে। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে- নিজেদের হতাহতের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। তুমি শত্রুকে ধ্বংস করবা এবং নিজেও বাঁচার চেষ্টা করবা- এটাই কৌশল। এ জন্যই এই ক্যামিকেল। তো দাউদকান্দির ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অন্যান্য নৌ-কমান্ডোরা ছিল সরাসরি নৌবাহিনীর লোক। তারা পাকিস্তান নৌজাহাজ ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। আমি একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম- বেসামরিক নৌ-কমান্ডো।

অপারেশন জ্যাকপটের এক অকুতোভয় সৈনিক শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর প্রতীক  

আমাদেরকে বলা হয়েছিল- অপারেশনে নামবা। মাইন ফিট করে স্রোতে অনুকূলে ভাটির দিকে গিয়ে আশ্রয় নিবা। দাউকান্দিতে এসে আমাকে স্পট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্রোতের অনুকূলে দক্ষিণ দিকে তো দাউদকান্দি ফেরিঘাট। সেখানে পাকবাহিনী থাকতে পারে। তারপর এতো রাতে একই বয়সের ৮ যুবক সুইমিং কসটিউম পরে হেঁটে যাবো। সুইমিং কস্টিউম পরা কমান্ডোকে উলঙ্গের মতই দেখায়। আমাদেরকে উলঙ্গ দেখে স্থানীয় লোকজন বুঝে বা না বুঝে হইচই করতে পারে। তাতে তো আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। এ জন্য আমি সিদ্ধান্ত নেই- স্রোতের উল্টা দিক- অর্থাৎ চরের দিকেই আমরা আশ্রয়ে যাবো। এটাকে সামরিক ভাষায় রেসকিউ পয়েন্ট বলে। আমরা সে রাতে মাইন ফিট করে উল্টো সাঁতার কেটে রেসকিউ পয়েন্টে যাই। এর ৬/৭ মিনিট পর ৯টি মাইন এক এক করে বিস্ফোরিত হতে থাকে। পুরো দাউদকান্দি কেঁপে উঠে। লোকজন জেগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনী তখন সমানে মেশিন দিয়ে গুলি করতে থাকে। গুলি করে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিককে টার্গেট করে। তারা মনে করেছে- কেউ পশ্চিম বা দক্ষিণ দিক থেকে এসে আক্রমণ করেছে। উত্তর দিকে তো নদী আর চর। কেউ নেই। তারা এদিকে গুলি করেনি। ঐদিকে ওরা সমানে গুলি ছুঁড়ছে। মর্টারের গোলা মারছে। নদীর পানি ছেঁড়াবেড়া করে ফেলতেছে।

আমাদের চোখে তৃপ্তি আর আনন্দের হাসি। যুদ্ধে জয়ের আনন্দে বলতে থাকি, মার শালারা মার। আমরা পার হয়ে গেছি। ধরতে পারবি না। মাঝিরা নৌকা বাইতেছিল। আমরা ৮ জন নৌকার তক্তা তুলে দিয়ে বৈঠা বাইতে থাকি। খুব দ্রুতই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে থাকি। দ্রুতই আরও দুই কিলোমিটার দূরে চলে গেলাম। আমরা যেহেতু যোদ্ধা- তাই জানি কতটুকু দূরে গেলে সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়া যায়। তো আমরা সে জায়গায় গিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া জানাই। তখন কি যে শান্তি-আনন্দ লাগছিল- বুঝাতে পারবো না। পাকবাহিনী বুঝতেই পারল না- কোন দিকে দিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে। এরপর দেখতে পেলাম যে, ঢাক-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে আর্মির জিপ, লড়ি হেড লাইট জ্বালিয়ে দাউদকান্দি ঘাটের দিকে আসছে। তাদের ধারণা হয়েছে- মুক্তিরা ফেরিঘাট আক্রমণ করেছে। সমানে সৈন্য যাচ্ছে। এরা মনে করেছে ঘাটে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর এদিকে আমরা যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে আসছি। ওরা যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। তাদের তৎপরতা দেখে হাসছিলাম আমরা।’

দাউদকান্দি ফেরিঘাটে সফল অপারেশন করে পরদিনই শাহজাহান সিদ্দিকী ও তাঁর দল ভারতে ফিরে যান। বেবিট্যাক্সি চালক মতিউর রহমান এরপর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি নৌ অপারেশনে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হলে নৌ-যুদ্ধে দুঃসাহসিক অবদানের জন্য মতিউর রহমানকে বীর উত্তম এবং শাহজাহান সিদ্দিকীকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়।

 

বাশার খান : জ্যেষ্ঠ গবেষক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

তথ্যসূত্র:

১। সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাপিডিয়া, খ--১, ভুক্তি- অপারেশন জ্যাকপট, ঢাকা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১১।

২। মো. আল আমিন ও বাশার খান, মুক্তিযুদ্ধে দাউদকান্দি, ঢাকা, দ্যু প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

৩। শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার, গ্রহণ: ৭ অক্টোবর ২০১৫।

   

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৬ মে, ১৯৭৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। সারাদেশে এবছর বৈরী তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় প্রতিটি জীব-প্রাণের মধ্যে ত্রাহি অনুভব শুরু হয়েছে।

শহুরে বিত্তশালী মানুষ শীতাতপ যন্ত্রের ঘেরে বসে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু শহুরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের রৌদ্রজলা মানুষেরা এবছর বেশি নাকাল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের পানির আকাল। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি।

মাওলানা ভাসানি কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে উজান-ভাঁটি দুই দেশের মানুষের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে এজন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশ বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানি এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।

মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দু:খ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।” (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।”... “বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি... সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বন্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।”

এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন।

এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।

মাওলানা ভাসানির বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”

বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তরে গঙ্গা চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাঁটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।

অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। গবেষণার সেসব ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো বিকার কোনো কালেই লক্ষ্য করা যায় না।

এমনিকি তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং-সেনিার, চুক্তি হওয়ার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানির সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি।

আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানির মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দূরদৃষ্টি, দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

রাজনীতির বিভক্তি: মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়নে যে তাগিদ বিশ্লেষকদের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। গেল ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আইলিন লাউবাখেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সফরের পর ডোনাল্ড লু’র এই সফর দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। মি. লু’র এই সফরকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাক্যবাণ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করেছেন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশকে বিদ্যমান এই সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকেই জোর দেওয়া উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও কুটনীতিক অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ডোনাল্ড লু’র এই সফর নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘নতুন সরকার আসার পর ডোনাল্ড লু’র এটি অফিসিয়াল লেভেল রুটিন ভিজিট। আমার মনে হয় নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অংশই এই সফর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোন মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার এই সফরটা হচ্ছে।’

‘তিনি কি বলবেন এই সফরের পর হয়ত জানা যাবে, তাই পূর্বমূল্যায়ন না করেও দৃশ্যত যেটি বোঝা যাচ্ছে, মি. লু’র এই সফর বাংলাদেশকে নতুন করে স্টাডির অংশ। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করবে। আশা করব, দুই দেশই সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে একে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না’-যোগ করেন সাবেক এই পেশাদার কুটনতিক।

বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আরও পরিণত চর্চার তাগিদ দিয়ে একুশে পদকজয়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘নানা বিষয়ে মতামত-মন্তব্য করাটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। এখানে কেউ পরিপক্কভাবে দিতে পারে, কেউ পারেন না। আমেরিকা যেহেতু বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও সেইসব সংস্থার থেকে সাহায্য নিচ্ছে; তাই সচরাচর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক বর্ধিত, এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের রাজনৈতিক চর্চা করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একধরণের দৃশ্যমান এজন্ডা তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) আছেই, যেমন-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করাটাও তাদের রীতি। আবার সম্পর্কটাকে চালিয়ে নেওয়াও তাদের বৈশিষ্ট্য। ডোনাল্ড লু এসেছেন হয়ত সেই চাপকে অব্যাহত রাখতেই। তার মানে এই নয় যে-বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে চলমান সম্পর্ক সেখানে তাত কোন প্রভাব পড়বে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে যেটি দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে রয়েছে। আমেরিকাও তৃতীয় আরেকটি শক্তি-সেই দিক থেকে এটা ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুবিধাও বটে।’

‘বাংলাদেশের তো এখন উপায় নেই-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে। বাংলাদেশ যদি মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দেশ হতো তাহলে হয়ত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ঢুকে গিয়ে চলার কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বড় দেশ। রাজনৈতিক আকাঙ্খাও বহুমুখি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মালদ্বীপের মত স্ট্যান্ড নেওয়া সম্ভব নয়’-বলেন প্রভাবশালী এই কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও। সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

;