সবুজ অর্থনীতি ঘটাতে পারে বাংলাদেশের আরেক উন্নয়ন বিস্ময়



ড. আতিউর রহমান

  • Font increase
  • Font Decrease

হালে পৃথিবীর নানা দেশ সবুজ অর্থনীতি কৌশলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে গতানুগতিক অর্থনীতির প্রভাবশালী এক বিকল্প মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এই সবুজ অর্থনীতি। কারণ সবুজ অর্থনীতি অসমতা দূর করে, দারিদ্র্য কমায় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পৃষ্ঠপোষকতা যোগায়। সম্পদের অভাব দূর করে। পরিবেশের বিস্তৃত ঝুঁকি কমায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা করে। মানুষের কল্যাণ করে থাকে। আর টেকসই উন্নয়নের শক্তিশালী পাটাতন তৈরি করে। তাই সারা বিশ্বেরই মনোযোগ বাড়ছে সবুজ অর্থনীতি বিষয়ে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএন এনভায়রনমেন্ট’-এর তথ্য মতে—অন্তর্ভূক্তিমূলক সবুজ অর্থায়ন এমন এক ব্যবস্থা যা পরিবেশের ঝুঁকি কমায়, জনকল্যাণ বাড়ায়, অভাব কমায় এবং সামাজিক সমতা গড়ে তোলে। ২০০৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা ‘গ্রিন ইকোনমি ইনিশিয়েটিভ (জিইআই)’ নামে শুরু করে সবুজ অর্থনীতি কর্মসূচি। যার উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ-বান্ধব বিনিয়োগে সমর্থন জোরালো করা। বৈশ্বিক ঝুঁকি গবেষণায় দেশীয় পর্যায়ে সাহায্য বাড়ানো, সবুজ অর্থনীতি কর্মসূচি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করা ছিল এই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য।

সাধারণত একটি দেশের আর্থিক খাত সেদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সুতরাং যথাযথ প্রস্তুতি ও আন্তরিকতা নিয়ে খাতটির কার্যক্রম চালানো হলে সবুজ অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে বাংলাদেশের আরেক উন্নয়ন বিস্ময়। সবুজ অর্থায়ন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পরিবার থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে নানা রকম পরিষেবার বিন্যাস ঘটিয়ে বাস্তব অর্থনীতির সেবা দান করা। অর্থনীতিতে স্বল্প মেয়াদ থেকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা জোরদার করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান হিসেবে সবুজ অর্থনীতি বিকাশে উদ্ভাবনমূলক অর্থায়ন কৌশল নির্মাণে আমি স্বদেশে ও বিদেশে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আর সে কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি কৌশলে টেকসই উন্নয়ন ধারণা নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। আর্থিক ও প্রকৃত খাতের ঐতিহাসিক যোগসূত্র এক নুতন মাত্রা পাচ্ছে। এর ফলে, অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈশ্বিক মানচিত্রের সীমানা স্পর্শ করার সুযোগ বাড়ছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা আর্থিক ব্যবস্থায় নতুন চাহিদা তৈরি করছে। এই চাহিদা একসেট ট্রান্সমিশন চ্যানেলের মাধ্যমে আবর্তিত হচ্ছে। ব্যাপক মাত্রায় দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে স্পর্শকাতর এই চ্যানেল পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষেত্রের মূলস্রোতে ঘুরে ফিরে আসছে। সঙ্গে রয়েছে নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাপূর্ণ বাজারের নেতৃত্ব। মানুষ, প্রকৃতি ও অর্থনীতি এক সূতোয় গেঁথে যাচ্ছে এই নয়া ভাবনায়। আর এই নয়া ভাবনাই সবুজ অর্থনীতির পক্ষে জোরালো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে? এক্ষেত্রে পাঁচটি দৃষ্টিভঙ্গির কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বলা যায়। প্রথমত মূলধন পুনর্সংস্থানের প্রচেষ্টাপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে (যেমন নিয়ন্ত্রক ও প্রধান কারবারী) পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগের পক্ষে মূলধন যোগান দেয়া। যেমন, টেকসই লক্ষ্য নিয়ে নতুন করে এগিয়ে আসা বা একাজে নিয়োজিত উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ত সব ধরনের ব্যবসায়ী উদ্যোগের পরিবেশগত সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নির্ণয় করে এগিয়ে যাওয়া। আর্থিক সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের অবক্ষয় থেকে উদ্ভূত ঝুঁকি নিরসনে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এজন্য আর্থিক নীতি কৌশল নির্ধারক রেগুলেশনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। ক্ষয়িষ্ণু পরিবেশ অর্থ-সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এই ঝুঁকির পরিধি বুঝতে তাই উদ্যোক্তা, রেগুলেটর ও অন্যান্যদের মনোযোগী হতে হবে। তৈরি করতে হবে প্রয়োজনীয় আর্থিক নীতি-বিধান। বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে উত্তরণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত পরিবেশগত, সামাজিক এবং সুশাসন সংশ্লিষ্টদের বিনিয়োগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক বোঝানো ও স্বীকার করানোর কাজ করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এসব কাজে বাঁধা বিপত্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় আনা দরকার। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের রেগুলেটরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থত প্রতিবেদন এবং প্রকাশনা। টেকসই আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাহক এবং নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে পারস্পরিক রিপোর্টিং বাড়ানো প্রয়োজন। ‘ডিসক্লোজার’ পর্যাপ্ত হলেই ভোক্তার পক্ষে সঠিকভাবে আর্থিক পণ্য নির্বাচন সহজতর হবে। বাস্তব অর্থনীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে কার্যকর সেতু হিসেবে কাজ করে এই রিপোর্টিং। এই রিপোর্টিং কাঙ্ক্ষিত তথ্যপ্রবাহের উন্নয়ন ঘটায়। সবশেষে যে বিষয়টি মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তা হলো—গোটা অর্থ ব্যবস্থাকে টেকসই উপায়ে সাজানোর জন্য দরকার কৌশলগত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা হতে পারে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী। এক্ষেত্রে পথ নির্দেশনার জন্য রোডম্যাপ থাকাও জরুরি। ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ অনেক দেশ এমন পথ-নক্সা এরই মধ্যে তৈরি করেছে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সামাজিক, পরিবেশগত ও পরিচালনা ঝুঁকি বিষয়ে নীতিমালা চালু করেছে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব ঝুঁকির পরিমাপ ও তার আলোকেই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্যে যথেষ্ট রেগুলেটরি চাপ অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

নিঃসন্দেহে সবুজ অর্থায়নের উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ব্যাংক। এর প্রথম কারণ হলো, ব্যবসায়-উদ্যোগ পরিচালনার জন্য অর্থের যোগান দেয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংক তার গ্রাহকদের সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহার, বাস্তবায়ন ও নীতি-কৌশল নিয়ে জোরালোভাবে প্রেরণা যোগাতে পারে এবং সেই প্রযুক্তির জন্য অর্থ যোগান দিতে পারে। সেই অর্থ ঠিকমতো কাজে লাগানো হচ্ছে কি না তার দেখভালও করতে পারে। এইভাবেই ব্যাংক এবং তার গ্রাহকদের মিথস্ক্রিয়ায় অর্জিত হতে পারে সবুজ প্রবৃদ্ধি। এসব কারণে সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরাসারি জড়িত থাকতে পারে ব্যাংক। আর যেহেতু ব্যবসা ক্ষেত্রের যাবতীয় তথ্যসূত্র থাকে ব্যাংকের কাছে, তাই অতি ক্ষুদ্র পর্যায়েও কী হচ্ছে ব্যাংক তা অবহিত থাকে। সেজন্যে সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো নীতি-উপদেশ দিতে পারে একমাত্র ব্যাংকের কর্মকর্তারাই। সবুজ প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত কাজে ব্যাংকের অপরাপর গ্রাহক কে কী করছেন এ বিষয়ে ব্যাংক তার গ্রাহকদের তথ্যসেবা দিয়ে অবহিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারে। সবুজ উদ্যোগে অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য-জ্ঞান বিনিময়ের কাজও করতে পারে ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন কার্যকর করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উন্নয়নমূলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের সক্ষমতা জোরদারে কাজ করতে পারে। যেমন পুনঃঅর্থায়ন সুযোগ সৃষ্টি করা। মানবিক চেতনার মধ্য দিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রকে সবুজ অর্থায়নে আগ্রহী করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক যথাযথ কাজ করছে কি না সেসব তথ্যের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা কার্যকর করার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও সক্রিয় সবুজ ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্ভূত সমস্যা ও তথ্য সমূহের নীতিমালা তৈরির কাজ নিশ্চিত করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে পুঁজিবাজার ও বীমা বাজারও সবুজ অর্থায়নের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পারে। উন্নত বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্য নিয়ে পুঁজিবাজার ও বীমা বাজারের তথ্য প্রকাশ ও প্রণোদনা প্রদানে বড় মাপের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক ইংল্যান্ড বীমা বাজারকে সবুজ করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বীমা বাজারের মূলস্রোতে ঢুকে পড়েছে। আর সেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাতে ঐ দেশের বীমাখাত দিনে দিনে পারদর্শী হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে সবুজ অর্থায়ন এবং আর্থিক অন্তর্ভূক্তির (বর্তমান সরকারের জোরালো সমর্থনের কারণে) ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উন্নয়নমূলক ভূমিকার কারণে সবুজ অর্থায়নে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে গৌরবময় আসনে স্থান করে নিয়েছে। এই অভিযাত্রাকে টেকসই করার স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে সদা সচেতন ও সক্রিয় থাকতে হবে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিশ্ব আর্থিক মন্দার গোলমেলে পরিবেশের মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি সবুজ অর্থায়ন সহায়ক রেগুলেটর হিসেবে দাঁড় করাবার। একই সঙ্গে জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা ইউনেপের টেকসই অর্থায়ন বিষয়ক উপদেষ্টা মণ্ডলির সদস্য হিসেবেও আমি বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সবুজ পণ্য উৎপাদনের পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি চালু করেছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃঅর্থায়নে প্রায় দ্বিগুণ মূলধন (৪৭৮ মিলিয়ন টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯২০ মিলিয়ন টাকা) যোগান দিয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় সর্বোচ্চ পরিমাণে ঋণ গ্রহণকারী ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে—পরিবেশ বান্ধব ইটের ভাটা, নবায়নযোগ্য জ্বালানী শক্তি এবং তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এজন্যে পরিবেশ ও সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নীতিমালার মাধ্যমে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড উৎপাদনের সাথে জড়িত উদ্যোক্তাদের অর্থযোগানে ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করে সেসব কাটিয়ে ওঠার জন্যে সবুজ অর্থায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্যে ঋণ প্রস্তাবনার শুরুতে উদ্যোক্তার পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয় খতিয়ে দেখার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি সবুজ বিনিয়োগ বা সবুজ অর্থায়নের উদ্যোগকে দৃঢ় সর্মথন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদন (সৌরবিদ্যুৎ), জ্বালানী সাশ্রয়ী দক্ষতার অভিযোজন (যেমন-এলইডি বা লাইট ইমিটেটিং ডায়োড সংযোজন), কারখানায় ন্যূনতম বর্জ্য উৎপাদনের অনুশীলন, সূর্যের আলো বেশি করে ব্যবহার ইত্যাদি। সবুজ পুনঃঅর্থায়ন চালু রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করেছে ‘বিশেষ তহবিল’। বহিরাগত উন্নয়ন সহযোগীরাও এই তহবিলের অংশীদার (যেমন এডিবি ও বিশ্বব্যাংক)। এভাবে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে পরিচালিত সবুজ প্রকল্পগুলো হচ্ছে পারিবারিক সৌরবিদ্যুৎ, সৌর বিদ্যুতের ক্ষুদ্র কেন্দ্র স্থাপন, সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল সংযোজন, জৈব জ্বালানী, বায়োগ্যাস ও ইটিপি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ইটভাটায় পরিবেশ দূষণকারী কাঠ ব্যবহার বা পরিবেশ বিধ্বংসী ইটপোড়ানোর পরিবর্তে জ্বালানী সাশ্রয়ী বিকল্প উপায়ে ইট পোড়ানো, জৈব সার উৎপাদন, ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, পুরনো প্লাস্টিক বোতল পুনর্ব্যবহার, সৌর বিদ্যুতের ব্যাটারি রিসাইক্লিং, লাইট ইমিটেটিং ডায়োড বা এলইডি বাতি, এলইডি মনিটর উৎপাদন এবং সবুজ গার্মেন্টস কারখানা ও বাড়ি নির্মাণের মতো নানামুখী অর্ধশতাধিক সবুজ পণ্যের বিনিয়োগের উদ্যোগ কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতকে কাগজবিহীন ও আধুনিক করে তোলার জন্য লেনদেন ও নজরদারি ব্যবস্থার ব্যাপক ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে যা চূড়ান্ত অর্থে একটি সবুজ উদ্যোগই। অর্থনীতির চাকাকে সবুজ করার জন্য দুশো কোটি টাকার রিভলভিং সবুজ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে রপ্তানি শিল্প যেমন, তৈরি পোশাক, চামড়া ইত্যাদিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত চৌকস পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিশ কোটি ডলার মূল্যের সবুজ রূপান্তর তহবিল। এটি আমাদের নিজস্ব রিজার্ভ থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া, বিশ্বব্যাংক এবং জাইকাও সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ যোগানে এগিয়ে এসেছে। এসব সবুজ অর্থায়ন কর্মসূচির যথার্থ বাস্তবায়ন করা গেলে নিশ্চয় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্যে (যেমন, সবুজ টেক্সটাইল পণ্য, চামড়া) বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নয়া সবুজ ব্র্যান্ডিংয়ের উৎসও হয়ে উঠতে পারবে। সবুজ অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে আমাদের সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। যেমন, সীমিত সম্পদ, চাহিদার অপ্রতুলতা, দক্ষতার অভাব, উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণ, অধিক ব্যয় ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমান পুঁজি বাজারের পরিবেশ এই সবুজ ব্যাংকিং এর অনুকূলে নেই। এক্ষেত্রেও সবুজ অর্থায়নের সূচনার কথা বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোকে সবুজ করার জন্যে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে পুঁজিবাজারের রেগুলেটর। রাজস্ব নীতিতে সে জন্যে যথেষ্ট সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় আর্থিক খাতের ভূমিকা, নীতি-পলিসি তৈরির প্রেক্ষাপটসমূহ নজিরবিহীন মনোযোগ আকর্ষণ করেছে গোটা বিশ্বে। সুবজ অর্থায়ন বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের নীতি-নির্ধারকগণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করেছে। চীনের কথাই ধরা যাক। দেশটির অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে আরো এগিয়ে নিতে উচ্চাভিলাষী সবুজ অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সেদেশের সরকার। চীনের গৃহীত নানাবিধ উদ্ভাবনী উদ্যোগের সঙ্গে পুরোমাত্রায় কাজ করে যাচ্ছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নেদারল্যান্ড সরকার ব্যাংক-বীমা খাতের পাশাপাশি দেশটির পেনশন শিল্পের টেকসই অর্থায়ন আলোচনা জাতীয় কৌশলের অন্তর্ভূক্ত করেছে। জলবায়ু ঝুঁকি সম্পর্কিত বিআইএস টাস্কফোর্সের কাজের জন্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নরকে প্রধান করে আর্থিক স্থিতিশীলতা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া আগেই জানিয়েছি, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমন্বিত ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ঐ দেশের বীমাখাতের রূপান্তর ঘটিয়েছে। এভাবে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রহণ করছে সবুজ অর্থায়ন কৌশল। কেনিয়ার কথা উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে। কেনিয়া এখন ডিজিটাল অর্থায়নে গোটা বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অবশ্য, বাংলাদেশও কম যায় না। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকি বিষয়টি মনে রেখে তারা উদ্ভাবনীমূলক সবুজ ডিজিটাল অর্থায়নের জন্য মোবাইল পেমেন্ট প্লাটফর্মে অ্যাপস যুক্ত করে সবুজ অর্থায়নের ধারণা সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ করছে। ‘নেট মিটারিং’-এর মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। ব্যবহার করছে ব্লকচেইন, ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো আধুনিক ডিজিটাল সবুজ লেনদেন মাধ্যম। বিশ্বের প্রথম টেকসই অর্থায়ন রোড ম্যাপ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার আর্থিক রেগুলেটরি অথরিটি। ব্রাজিলের প্রভাবশালী ‘ব্যাংকার এসোসিয়েশন’ সেদেশের ব্যাংকিং সম্প্রদায়কে সবুজ অর্থায়নে একীভূত করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশের ব্যাংকের মালিকরা সবুজের বদলে উল্টো কাজেই মনে হয় বেশি আগ্রহী।

সবুজ অর্থায়নে আমাদের বাংলাদেশের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, সফলতা এবং অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের এখনো অনেকদূর পথচলা বাকি রয়েছে। বাংলাদেশে সবুজ অর্থায়ন একটি সূচনা মাত্র। গন্তব্য নয়। আর্থিক খাতের সবুজায়ন প্রক্রিয়া বাড়ানোর কাজে দেশের শীর্ষ নীতি-কৌশল প্রণেতাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকরণ, নিরীক্ষায়ন ও বাস্তবায়নের পথে আমাদের আরো অনেক কিছুই করার আছে। সবুজ অর্থায়নের জন্য নিবেদিত একটি ‘উইং’ অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করতে পারে। সবুজ অর্থনীতির স্বার্থে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের জন্যেই এমন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যাদের কাজ হবে সবুজ অর্থায়নে উচ্চতর নীতি কাঠামো প্রণয়ন ও ধারাবাহিকভাবে তার উন্নয়ন করা। দেশের বৃহৎ আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে সবুজ অর্থায়ন বাড়ানোর কাজে তারা নিবেদিত থাকবেন। তবে এ ধরনের যেকোনো প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে তাদের স্থান ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই আমাদের চাহিদা তাড়িত সমস্যার চিহ্নিত সমাধান আমাদের হাতে চলে আসবে। সবুজ প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি খাতের অর্থ তহবিল, বন্ড মার্কেট ও পুঁজি বাজারের ‘লেভারেজ’ বা কর্মকাণ্ড বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রাসঙ্গিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেন্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে নিতে পারে। যেমন, যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবুজ অর্থায়নে মনোযোগী হয়েছে তাদের তালিকা প্রকাশ এবং যথাযথভাবে ‘ক্যামেলস রেটিং’-এর মাধ্যমে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শীর্ষ ১০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবুজ ব্যাংকিংয়ের জন্য প্রতিবছর পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সবুজ অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ এবং সুনাম দুই-ই বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিক্ষেত্রে, বিশেষ করে মশলা ফসল উৎপাদন ও গবাদি পশু পালনের ভর্তূকি ঋণের সহায়তা নিশ্চিত করে নয়া মডেল সৃষ্টি করেছে। মডেলটি সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্যেও অনুসরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সবুজ আর্থিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রবর্তন করেছে সিএসআর। বর্তমানে সিএসআর এর ১০ শতাংশ ব্যায়িত হচ্ছে সবুজ অর্থায়নের উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে এই তহবিল ব্যয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই অনুপাত ২৫ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। সামাজিক উদ্যোক্তারা এই তহবিল থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে। নয়া উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতা করে এই তহবিল থেকে সহযোগিতা নিচ্ছেন। সবুজ অর্থায়ন কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্ভাবনী ক্ষেত্রসমূহের এগিয়ে আসার আরো প্রেরণা জোগাতে হবে। পারিবারিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা থেকে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কিনে ‘নেট মিটারিং’-এর মাধ্যমে অফগ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলার কাজ অনেকটাই সম্ভব করা যেতে পারে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে উৎসাহী করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে সবুজ উদ্ভাবনী কাজে সহযোগিতা করা হলে নিজেদের উৎপাদিত জ্বালানী ব্যবহারের পর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করতে আগ্রহী হবেন আরো বেশি পরিবার। সেজন্যে প্রণোদনা প্যাকেজটি যথার্থ করার প্রয়োজন রয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, সরকার এরই মধ্যে ‘নেট মিটারিং’ নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে করে রুফটপ সোলার প্যানেল ব্যবহার করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির সুযোগ অনেকটাই বেড়ে যাবে। সত্যি সত্যি এটা হবে একটি স্মার্ট কার্যক্রম।

জলবায়ু ঝুঁকি ও টেকসই অর্থায়নের জন্যে নিবেদিত বৈশ্বিক অর্থের উৎস বাংলাদেশের হাতে এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট নেই। থাকলে বাংলাদেশের এইসব প্রত্যাশা পুরণ করতে অনেকটাই সহায়ক হতো। এক্ষেত্রে উচ্চতম পর্যায়ের নীতিগত অঙ্গীকার প্রয়োজন। সংসদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বিশ্বাসযোগ্য শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা নিয়ে এগিয়ে আসা সম্ভব হলে সবুজ বিদ্যুৎ তৈরি ও বিতরণে এক নয়া যুগের সূচনা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারব।

বড়ই আশার কথা, ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’ নামে আন্তর্জাতিক সবুজ জলবায়ু তহবিল, সম্প্রতি ইডকল (ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিডেট বা ইডকল) এবং পিকেএসএফ-কে বাংলাদেশী পরিচয়দানকারী কোম্পানি হিসেবে এনআইই (‘ন্যাশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন এনটিটি’) স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশীয় এই প্রতিষ্ঠান এখন থেকে ওই তহবিলের অর্থ সহায়তা পাবে। সেই অর্থ তারা উদ্যোক্তাদের কাছে সহজলভ্য করবে। সত্যিকার অর্থেই এটি আমাদের সবুজ অর্থায়নের একটি শুভ যাত্রা বৈকি। তাই সবুজ অর্থায়নে আমাদের আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার, আর্থিক নিয়ন্ত্রক বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কৌশলগত ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেজন্যে সামাজিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। নীতি নির্ধারকদেরও মনকে আরো সবুজ করতে হবে। ব্যক্তিখাত, সামাজিক উদ্যোক্তা ও স্থানীয় সরকার মিলেমিশেও সবুজ অর্থনীতি প্রচলনে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। একটি উদাহরণ দিই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. আইভিকে এক অনুষ্ঠানে অনুরোধ করেছিলাম তাঁর করপোরেশনের অধীনে বাড়িগুলোর ছাদে বাগান করার জন্যে মালিকদের উৎসাহী করতে কিছুটা নগর কর ছাড় ও সামাজিক উদ্যোক্তাদের কাজ করার সুযোগ করে দেবার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁর প্রধান নির্বাহীও যথেষ্ট উৎসাহ দেখাচ্ছেন। ছাদ বাগানে জৈব সার ব্যবহৃত হচ্ছে। সূর্যের আলো বেশি করে ব্যবহার, সাশ্রয়ী বাতি, সবুজ বিদ্যুত ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে তিনি উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। একজন সাবেক ব্যাংকার সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এসব কাজ করছেন। আমার ধারণা সমাজ ও স্থানীয় সরকার সচেষ্ট হলে নারায়ণগঞ্জ এক সবুজ নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। আমরা বিআইডিএস ভবনের ছাদে, উত্তরা রাজুক স্কুল ও কলেজের ছাদে অনুরূপ সবুজ ছাদ বাগান গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস এসব উদ্যোগ এখনো চালু রয়েছে। সবাই মিলেই আমাদের সবুজ অর্থনীতির পক্ষে কাজ করে যেতে হবে। সবুজ অর্থনীতিই আগামীর অর্থনীতি।

ড. আতিউর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

   

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;