ভরসার প্রতীক



ড. আতিউর রহমান

  • Font increase
  • Font Decrease

আজকের দুনিয়া প্রযুক্তি-নির্ভর। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা সবই আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভর করেই এগুচ্ছে। কোনো কোনো দেশ প্রযুক্তি হস্তান্তরে খুবই দূরদর্শী ছিল বলেই আজ তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমন এক দেশ। ঊনিশশো ষাটের দশকেও দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় আমাদের ওই সময়ের অবস্থার মতোই ছিল। সে সময় দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল (১৯৮০ সালের মূল্যে) মাত্র ৮৭ ডলার। আর আজ তা তিরিশ হাজার ডলারেরও বেশি। আমাদেরও তখন মাথাপিছু আয় এর ধারে কাছেই ছিল। ওরা এতটা এগিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তি গ্রহণ করার সক্ষমতার জোরে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তি নির্ভর করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে সাহায্য করেছে সরকার। উদ্ভাবন ও উন্নয়ন খরচের ৮৫ শতাংশই আসে ব্যক্তিখাত থেকে। মোট জিডিপির প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ খরচ হয় এই খাতে। অথচ ১৯৮১ সালেও তা ছিল মাত্র .৮১ শতাংশ। বর্তমানে দশ হাজারেরও বেশি পিএইচডি ব্যক্তিখাতের নানা কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেন।

আমাদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি আমরা ঠিকই করছি। কিন্তু এই প্রযুক্তিকে ‘আনবান্ডল’ করে তাকে দেশোপযোগী করে উপযুক্ত উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে আমাদর জনশক্তি খুবই পেছনে। তাই আমাদের উৎপাদনশীলতাও সে হারে বাড়ছে না। তবে সম্প্রতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার যে সংকল্প গ্রহণ করেছে তার ফলে নয়া তরুণ উদ্যোক্তার বিকাশের বেশ কিছু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আর ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যেই এই উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। প্রযুক্তি বাইরে থেকে নিশ্চয় আনতে হবে। তবে তা আমাদের প্রয়োজনমতো গড়ে পিটে নেবার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। যেমন ধরুন, আমাদের মোবাইল আর্থিক সেবা উন্নত বিদেশি প্রযুক্তি নির্ভর একটি ডিজিটাল ব্যবসা। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা বিদেশি ‘আলীবাবা’র প্রযুক্তি গ্রহণের জন্যে অংশীদারত্ব ভাগ করে নিতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আমরা মালিকানার প্রধান অংশ আমাদের হাতেই রেখেছি। ‘কাজ করে করে শেখার নীতি’ গ্রহণ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের উদ্যোক্তাদেরও অনুধাবন করতে হবে যে, উদ্ভাবন ও গবেষণায় তাদেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারও সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে দ্বিধা করবে না। যদিও আমাদের বাজেটে এ বিষয়ে খানিকটা ঘাটতি রয়েছে, তবুও বলব ধীরে ধীরে দিন বদলাচ্ছে। সরকার ও উদ্যোক্তারা মিলে মিশেই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি হচ্ছে আমাদের উদীয়মান উদ্যোক্তারাই। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই শক্তিকে আরো মজবুত করতে আমরা কী ধরনের নীতি-সমর্থন দিতে পারি। সেজন্যে আমাদের পরিসংখ্যান ও ইতিহাস—দুটো দিকেই নজর দিতে হবে। শুরুতেই আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে তাকাই। গত দশ বছরে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেকটাই পোক্ত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়লে ভালো হতো। তাই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে ৭.৬ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের চেয়ে অন্তত সাড়ে তিন শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ফ্লাইওভার মহাসড়কসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগা অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার একনিষ্ঠ রয়েছে বলেই অর্থনীতির চাকা এমন সচল রয়েছে। গত দশ বছরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে এখন প্রায় আঠেরো হাজার মেগাওয়াট। তবে সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আমরা অবশ্য সে পথেই হাঁটছি। কৃষি খুব ভালো করছে। এবছর সারা দেশেই কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল। ধানচাল ছাড়াও মাছ, সবজি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির উৎপাদনের ধারা বাড়ন্ত। অতিদারিদ্র্য কমে বারো শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। দশ বছর আগেও যা প্রায় ঊনিশ শতাংশ ছিল। আমাদের মাথাপিছু আয় এই দশ বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর সমান তালে এগিয়েছে। জীবনের গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু মৃত্যুর হার, নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন—সকল সূচকেই বাংলাদেশ তার পড়শি দেশসমূহের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হবার সবকটি সূচকেই বাংলাদেশ যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখন আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত। আশাকরছি ২০৩০ সালে এমডিজির মতোই এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।

আমাদের আর্থ-সামাজিক এই সাফল্যের পেছনে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের অসাধারণ অবদানের কথা না বললেই নয়। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের সামাজিক গতিময়তার জন্যেই। উদ্যোক্তা তৈরির একটা সহজাত সৃজনশীলতা এই সমাজে রয়েছে। এত ছোট দেশে এত মানুষের বাস। ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্ড’ লাভের একটা স্বাভাবিক সুযোগ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। এর ফলে আমাদের ‘কানেকটিভিটি’ বা সংযোগের সম্ভাবনাও বেশি। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই আমরা এখন জোর কদমে এগিয়ে চলেছি। একই সঙ্গে আমাদের সমাজ খুবই লড়াকু। একাত্তরের প্রতিকূলতা জয় করে এই সমাজ তার ভেতরে এক অভাবনীয় লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছে। আর সেই কারণে অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্যের নানামুখী বাঁধা ডিঙিয়ে ঠিকই বের হয়ে আসছে। সংখ্যার বিচারেও আমাদের জনসংখ্যা খুবই তরুণ। পনের বছরের কমবয়েসী তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৮%। ১৫-২৪ বছর বয়েসী তরুণের সংখ্যার হার ১৯.৫%। চীনে এই হার ১৩%। ভিয়েতনামে ১৬.৯%। ভারতে ১৮.৪%। এই তরুণরাই আমাদের মূল জনশক্তি। এদের অংশগ্রহণেই আমাদের শ্রম বাজার গতিশীল ও সাশ্রয়ী। আমাদের উদ্যোক্তরাও বয়সে তরুণ। তাই এই বৈশ্বিক পরিবেশে প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার করে তারা আমাদের শুধু রপ্তানি শিল্পেরই বিকাশ ঘটাচ্ছে তাই নয়, ই-কমার্স থেকে শুরু করে জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনকে গতিময় রাখতে তারা অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। তবে যথেষ্ট গুণমানের শিক্ষা না পেয়ে তরুণদের বিরাট অংশের কর্মসংস্থান পর্যাপ্ত ঘটছে না। তাই তাদের মনে শঙ্কা ও অসন্তোষ রয়েছে। এর প্রমাণ আমরা হালের সরকারি চাকুরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বেশ খানিকটা দেখতে পেয়েছি। তাই আরো কর্ম-সংস্থান সৃষ্টিই আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারাই বেশি করে করতে পারেন। উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা শতধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব স্নাতক বের করছি তারা আমাদের আধুনিক শিল্পায়ন ব্যবস্থাপনায় অপ্রসাঙ্গিকই থেকে যাচ্ছে। অথচ আমাদের গার্মেন্টস, তথ্য প্রযুক্তি ও চামড়া শিল্পের মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলী শ্রীলঙ্কা, ভারত ও আশেপাশের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। সেজন্যে বছরে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার গুনতে হচ্ছে। আবার দেখুন তেজগাঁওতে অবস্থিত আমাদের টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্নাতকই কিন্তু বেকার নেই। তার মানে আমরা আমাদের অর্থনীতির দক্ষতার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে পারছি না।

প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের এক্ষুনি ব্যবসায় ও শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ট্রেডকোর্স চালু করা, আরো বেশি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে নীতি-সমর্থন জরুরি হয়ে পড়েছে। হালে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণে মনোযোগী হয়েছে। এই ধারা আরো জোরদার করতে হবে। আমরা জিডিপির মাত্র দশমিক এক পাঁচ শতাংশ আয় এন্ড ডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বাবদ ব্যয় করি। চীন এ বাবদ ব্যয় করে দেড় থেকে দুই শতাংশ। আমাদের ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত উদ্ভাবনী কেন্দ্র (‘ইনোভেশন ল্যাব’) রয়েছে? আমাদের ব্যক্তিখাতই বা এই খাতে কতটা খরচ করে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও আমাদের সরকারি খরচ উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড়পড়তা খরচের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। ব্যক্তিখাতও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বরং ব্যবসাই বেশি করছে। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরিতে নজর তেমনটা নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের এতটা নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। সারা বিশ্বেই বস্ত্রখাতের হাত ধরেই উন্নতির মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। মনে রাখা চাই বাংলার উন্নত বস্ত্র শিল্পই সতের শতকে ভারত দখলের অভিপ্রায়ে ইউরোপীয়রা জাহাজ ভাসিয়েছিলেন। ভুল করে কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও উত্তর আমেরিকা পৌঁছুনোর পর ভাস্কো দা গামা ভারতে আসেন। আরব ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই ভারতে আসতেন। তাদের মুখ থেকেই ইউরোপীয়রা ভারতের ধন সম্পদের কথা শোনেন। ১৭৬০ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেই লুটের অর্থ লন্ডনে যেতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন বাংলা অফুরন্ত সম্পদের এক ভাণ্ডার। স্থানীয় বস্ত্রখাত ছিল তার মূলে। আর সেই আকর্ষণেই তারা বাংলা দখল করে। পরে পুরো ভারত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের মূল কাজই ছিল বাংলার সম্পদ আহরণ করে ইউরোপ নিয়ে যাওয়া। এই সময়টায় বাংলার স্থানীয় বস্ত্র শিল্প ধ্বংস করে ইংল্যান্ডে তার প্রসার ঘটানো হয়। এর মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের উৎপত্তি। ম্যানচেস্টার ও ল্যাংকাশায়ারের শিল্পায়নের সাথে বাংলার শিল্পোয়নের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। এই শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে বসে থাকেনি। আরো লাভের আশায় ব্রিটিশ পুঁজি ঊনিশ শতকে মার্কিন শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন পুঁজি আবার ইউরোপের পুনর্নির্মাণে ব্যবহৃত হয় মার্শাল পরিকল্পনার আওতায়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর, হংকংও এই পুঁজির ভাগ পায় এবং মূলত বস্ত্রখাতের শিল্পায়নের হাত ধরে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের সফল মডেল দেশে পরিণত হয়। একই ধারায় ভারত ও চীনও এখন এই বিশ্ব পুঁজির ভাগ পাচ্ছে এবং উন্নতি করছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশ গার্মেন্টেসের হাত ধরে পুঁজি আসতে শুরু করে আমাদের বস্ত্র শিল্পে। সেই বস্ত্র শিল্পের সুবাদেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্ততম বস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আহরিত পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে এই শিল্পের আরো অনেকগুলো রপ্তানিমুখী শিল্পে। বর্তমানে পোশাক শিল্পের সহযোগী হিসেবে জুতো, ওষুধ, সিরামিক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাইসাইকেল, জাহাজ নির্মাণসহ রপ্তানিমুখী শিল্পায়নে বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আর মূলত এই দ্রুত অগ্রসরমান শিল্পায়নের ফলেই গত দশ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে তিনগুণ। এসবই সম্ভব হয়েছে এক দল তরুণ উৎসাহী এবং ঝুঁকি গ্রহণে সাহসী উদ্যোক্তার জন্যে। বাংলাদেশ সরকারের উপযুক্ত নীতি প্রণোদনা, ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনীমূলক সমর্থন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দূরদর্শী রেগুলেশন এই শিল্পায়নের শক্ত পাটাতন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এই ধারার শিল্পায়নের পেছনে পুঁজি ও শ্রমের সম্মিলন ছাড়াও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অনেক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক গতিময়তা এবং সর্বোপরি উদ্যোক্তাদের সক্রিয়তা কাজ করছে। বিশেষ করে, আমাদের চলমান উন্নয়ন অভিযাত্রায় লক্ষ লক্ষ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার কঠোর পরিশ্রম ও এগিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে থেকেই পরবর্তী সময়ে বড় বড় উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও বাংলাদেশের অনুকূলে কাজ করছে। অনেকেই মনে করেছিলেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পে ধস নামবে। কিন্তু আমাদের লড়াকু উদ্যোক্তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংকটককে সুযোগে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সংগ্রামে ক্রেতাদের সংগঠন অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড, উন্নয়ন সহযোগীদের (বিশেষ করে জাইকা ও বিশ্বব্যাংক) সমর্থন, বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ নীতি সমর্থন বড় ধরনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

আমার মনে আছে যেদিন রানা প্লাজা দুর্ঘটনাটি ঘটল ওই দিন সকালে হোটেল সোনারগাঁতে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। আমরা সেদিন বলেছিলাম এই দুর্যোগ বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠবে এবং পরবর্তীতে একে সুযোগে পরিণত করবে। পরের দিন জাপানী রাষ্ট্রদূত আমার বাসায় চলে এলেন। বললেন, এসএমই খাতে যে কমসুদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জাইকা বিতরণ করছে তা থেকে একশো কোটি টাকা আলাদা করে ছোট ও মাঝারি গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে যেন দেওয়া হয়। আমরা দ্রুতই সরকারের সাথে আলাপ করে নয়া এক ঋণ কর্মসূচীর সূচনা করলাম। এই কর্মসূচী এখনো চলছে আরো বৃহত্তর পরিসরে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপর বিশ্বব্যাংকের সাথে আলাপ আলোচনা করে আরো তিনশো মিলিয়ন ডলারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কমসুদের ঋণের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি, আরো দুশো মিলিয়ন ডলার আমরা রিজার্ভ থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র সবুজ বস্ত্র ও চামড়া কারখানার জন্যে নয়া ঋণ কর্মসূচি চালু করি। তাছাড়া, ইডিএফ বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলটি দুশো মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে দুই বিলয়নেরও বেশি পর্যায়ে উন্নীত করেছিলাম। সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় বেশি পরিদর্শক নিয়োগ ছাড়াও নানামুখী তৎপরতা বস্ত্র শিল্পের সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের ব্যাপক উন্নতি করতে নীতি সমর্থন প্রদান করে। এভাবেই বাংলাদেশের মূল রপ্তানি শিল্প একটি সংকট থেকে শুধু উঠে দাঁড়িয়েছে তাই নয় এখন তার প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ এক খবরে জানতে পারলাম যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত চার মাসে প্রায় তিন শতাংশ হারে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি থেকে সরে আসার পর থেকে ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, চীনের কাছ থেকে যে হারে বস্ত্র কিনছে তার চেয়ে বেশি হারে বাংলাদেশ থেকে কিনছে। আর আগেই যেমনটি বলেছি, বর্তমানে মার্কিন খুচরো বিক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের বস্ত্রখাতের ভাবমূর্তি সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের উন্নতির কারণে বেশ উজ্জ্বল। তাই ৫.৬২ শতাংশ ডিউটি দিয়েও বাংলাদেশের শক্তিশালী বস্ত্রখাত মার্কিন বাজারে দিন দিনই তার শক্তিমত্তা দেখিয়ে চলেছে। এ বছর ভারতেও আমাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের পরিশ্রমী ও সাহসী উদ্যোক্তাদের অদম্য প্রচেষ্টার জন্য।

আমাদের তৃণমূলের অসংখ্য ক্ষুদে উদ্যোক্তারা কৃষি, মৎস্য, তাঁত ও কুটির শিল্পের ভীষণ তৎপর। তৃণমূলেও তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অসংখ্য ডিজিটাল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আউটসোর্সিং ব্যবসাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন অর্থায়নের নীতি সমর্থন দিয়ে নারীসহ এসএমই উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকের সাথে সমঝোতা করে কৃষি ও এসএমই ঋণ দেবার জন্যে অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এসব ক্ষুদে উদ্যোক্তার পাশে থাকার অভিনব কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে বাংলাদেশ। লক্ষ লক্ষ বর্গাচাষীরাও এই ঋণ সুবিধে পাচ্ছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র দুই শতাংশ হারে গৃহায়ণ প্রদান করে তাদের আবাসনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সবাই চেষ্টা করেছে বলেই পোশাক শিল্পখাত এমন করে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই খাতকে আরো সবুজ ও সক্ষম করার জন্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব উদ্ভাবনীমূলক নীতি সমর্থন দিতে শুরু করেছিলাম তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে সেই প্রত্যাশাই করছি। একই সঙ্গে এই খাতের ওপর বাড়তি যে তিন শতাংশ করপোরেট করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তা যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় সরকারের কাছে সেই অনুরোধ করছি। তাছাড়া, সবুজ কারখানার ওপর যে দুই শতাংশ বেশি করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তারও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। উল্টো এক্ষেত্রে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করছি। রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ঝুঁকিও অনেক। বিশেষ করে এরফলে নগরায়ন অপরিকল্পিত রূপ নিতে পারে, পরিবেশের অবনতি ঘটতে পারে, শ্রমিকদের জীবনমান চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই বড় বড় উদ্যোক্তারা যেন এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজেরাও সক্রিয় হন এবং সরকারের সহায়তামূলক নীতিসমর্থন পান সেজন্যে সংগঠিত হন।

আমার ধারণা, আমাদের প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তরা এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের বুদ্ধিমত্তা ও সমর্থন স্বস্বার্থেই দেবেন। বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবেলা করেই যে তাদের এগুতে হবে সেটা তারা জানেন। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদেরও সঙ্গে নেবার মতো সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু ক্ষুদে মাঝারি উদ্যোক্তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাদের জন্যেও বড় উদ্যোক্তাদের চেম্বারকে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ ছোট বড় মিলেই শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ বা ‘ইকো সিস্টেম’ গড়ে ওঠে। সেইজন্যেই এই নীতি সমর্থনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ অপরিহার্য।

বস্ত্রখাত ছাড়াও বাংলাদেশের আরো অনেক খাতে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল উদ্যোগের কথা আগেই বলেছি। ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক উৎপাদক, টায়ার উৎপাদক, আসবাবপত্র উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিলে তারাও বস্ত্র উদ্যোক্তাদের মতো বিশ্ব বাজার দখল করতে সক্ষম হবেন। ভারত ও চীনে এখন বড় বড় গাড়ি উৎপাদকরা কারখানা খুলেছে। বছরে ২০ লক্ষ গাড়ি এই দুই দেশে তারা উৎপাদন ও বিক্রি করছে। এসব গাড়ির টায়ার, প্লাস্টিক পার্টস আমরা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করতে পারি। আমাদের পাটতন্তু দিয়ে গাড়ির বডির একাংশ তৈরি করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে চাই নীতি সক্রিয়তা। তাছাড়া, আমরা কৌশলগতভাবে এমন এক স্থানে অবস্থিত যে আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের হার হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইউরোপের এয়ারলাইন্সগুলোকে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারাই এসব বিমানবন্দর গড়ে তুলবে। ভারত ও চীনের পর্যটন বাজারে প্রবেশের জন্যেও তারা তা করবে। সেজন্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা নিয়মনীতি সহজ করা, নিরাপত্তা জোরদার করা, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজতর করার মতো নিয়মনীতি আরো ব্যবসা-বান্ধব করার প্রচুর সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। পাশাপাশি অনেক কষ্টে গড়ে ওঠা আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। একমাত্র স্থিতিশীল পরিবেশেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশকে নির্মাণের লক্ষ্য মাথায় রেখে এখন থেকে আমাদের আরো সম্মুখমুখী দূরদর্শী নীতিসংস্কার ও নীতি সমর্থন দিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় সদা সক্রিয় অংশীজন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আতিউর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

   

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চলমান রয়েছে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে এবং সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ১২ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। তারা সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণে করণীয় সম্পর্কে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় বলে জানায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবে নাগাদ মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা নিশ্চিতে পাশাপাশি রাখাইনে তাদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে, তারা সেখানে হত্যা, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিছু এন জি ও’র সহায়তায় ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণার দায়ে দুটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরপরই এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওগুলো যাতে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না থাকে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ধরার জন্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের আস্তানায় অভিযান চালায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা জীবিকার তাগিদে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত এবং যারা রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আশপাশের দেশেও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দল ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রয়েছে। আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিরাপদ অবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করেছে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা তাদের মত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লানকে (জে আর পি) সমর্থন জানাতে হবে। এতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাহিদা উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন, জাপান ২.৬ মিলিয়ন ডলার এবং নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জে আর পি’কে সমর্থন জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে যাওয়ার ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তোরন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরও তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ। এ এ জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ এ রাখাইনের ১৯ টা টাউন শিপের মধ্যে ১৭ টাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাখাইনে এ এ ৬ মে বুথিডাং শহরের কাছে মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ দখলের জন্য আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর জান্তা সৈন্যরা এ এ’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে সম্প্রতিকালে ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণকারী অনেক রাখাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা জানায় যে, সে সময়ের ঘটনার জন্য তারা অনুতপ্ত এবং তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কারনে তারা এই কাজ করেছিল এবং তা ঠিক করেনি বলে জানায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালালেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের অনেকে তা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, তবে এবার তাদের এই প্রচেষ্টা তেমন কার্যকরী হচ্ছে না। এ এ তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার সেনা ক্যাম্প দখল করার পর সৈন্যদের পরিবারগুলোকে ও নিরাপদে হস্তান্তর করছে। এ ধরনের আচরণ তাদের সহনশীলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।

এ এ’কে তাদের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক গবেষক এই সহস্রাব্দের সশস্ত্র দল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এন এল ডি’র শাসনামলে এ একে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাসরকার সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। আরাকান আর্মি এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগায়। প্রায় দুই বছর তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এ এ’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। মিয়ানমারের সেনা-সরকার এবং এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখিয়ে আসলেও এ এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছিল। বর্তমানে এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা এএ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেও রাখাইনে শান্তিতে বসবাস করতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার সরকারের মতো আরাকানের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতও গুরুত্বপূর্ণ। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে জানায় যে, এ এ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

এ এ জাতিগত রাখাইনদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ও তাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব মিয়ানমারের ফেডারেল কাঠামোর আওতায় একটা স্বশাসিত আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ এ’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের সহযোগিতা দরকার হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশকে এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ এ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এ এ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফেরত নেয়ার বিষয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি থাকতে পারবে না। নিজেদের ভিতরের বিভক্তি দূর করে তাদেকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;