শেখ রাসেল : একটি স্বপ্নের মৃত্যু



প্রফেসর ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন
ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের উত্তেজনায় মুখর। ১৯৬৪ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিসাহিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নার বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। যিনি এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে এনে দেবেন মুক্তির স্বাদ তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু।

ফুফাত ভাই আরিফের কোলে ছোট্ট রাসেল


১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমণ্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে জন্ম নিল শেখ রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। অমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিল আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।”

রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল।

বার্ট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না। বিজ্ঞানী ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্ব নেতাও। বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন—কমিটি অব হানড্রেড। এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি নিরলস। শেখ রাসেলের জন্মের দু’বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেফ-এর মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল।

এক পর্যায়ে সেই স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধটি সত্যিকারের ভয়ংকর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন, বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। মানবসভ্যতা-বিধ্বংসী সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি থামাতে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল রাসেলের যুক্তির পক্ষে। কেনেডি-ক্রুশ্চেফ এক পর্যায়ে যুদ্ধেংদেহী মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে নাম রাখা হয় রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তাঁর মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা।

১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়।

শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দী হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল ঠিক তেমনি তার বাবা বঙ্গবন্ধুও।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তাঁর ভেতরের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকত।

‘কারাগারের রোজনামচা’তে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”

‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।”

শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ দুরন্ত। তাঁর দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাই-সাইকেল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো। বিখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা স্মৃতিকথায় রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, “কদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি।...অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। ...বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনিকরে চক্কর মারত। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। ...এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।”

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সসদ্যদের সঙ্গে ঘাতক খুনীদের হাতে হত্যার শিকার হন তিনি। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে আটক করা হয়। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, “আমি মায়ের কাছে যাব।” পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, “আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন।” মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল? যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল, কী কষ্টই না ও পেয়েছিল!

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কোলে ছোটভাই শেখ রাসেল


“কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল? আমি কি কোনোদিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব?” বঙ্গবন্ধু কন্যার এই আকুতি ভরা ‘কেন’র জবাব কে দেবে? রাসেল স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে এটাই হয়তো ছিল তাঁর একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে শিশু রাসেলকে নিয়ে লেখা দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ কবিতার কয়েকটি লাইন খুব মনে পড়ছে:

তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।

শিশু শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাঁর জীবন কেড়ে নেয়। বেঁচে থাকলে আজ শেখ রাসেলের বয়স হতো ৫৫ বছর। জন্মসাল অনুসারে তিনি আমার ৫ বছরের বড়। আমি এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চিন্তা করছি, কাজ করতে পারছি। তিনিও বেঁচে থাকলে হয়তো বা সামিল হতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে। ভিশন ২০২১, ২০৩০, ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় এখন যেমন দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, তিনি বেঁচে থাকলে নিঃসন্দেহে নিজেকে দেশের জন্য নিয়োজিত রাখতেন। তিনি হয়তো বিজ্ঞানী অথবা প্রফেসর অথবা জাতির পিতার মতো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারি হতেন। কিংবা হতে পারতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল বিশ্বমানবতার প্রতীক।

শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সে সাথে ধ্বংস করেছে তাঁর সকল অবিকশিত সম্ভাবনা।

প্রফেসর ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

   

কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে



মারিয়া সালাম
কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে

কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ আন্তর্জাতিক কফি দিবস। কফি আবিষ্কারের গল্প আর কফি পানের ইতিহাস বেশ মজার আবার গোলমেলে। ধারণা করা হয়, কফি আবিষ্কার হয়েছে ৮৫০ সালের দিকে ইয়েমেন বা ইথিওপিয়ায়। কফির চাষ আর বাজারজাতকরণ শুরু হয় প্রথম ইথিওপিয়ায়। শুরু যেখানেই হোক, ধীরেধীরে কফি সেবন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

প্রথম দিকেত কফি রেস্তোরাঁর কথা জানা যায় চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতকের দিকে। ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে কফি জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

আরব দেশগুলোতে কফি ‘কাবেহ খানাহ’ বা ‘কিভা হান’ নামে পরিচিত ছিল। কফি পান করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় জমজমাট আড্ডা। আড্ডা থেকেই চিন্তার আদান-প্রদান শুরু হয় এবং এই আড্ডা শাসকদের বেশ ভয় দেখিয়ে দেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মক্কায় সব ধরনের কফি রেস্তোরাঁ এবং মুসলমানদের জন্য কফি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যে কফি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেই ভয়ে, সুলতান চতুর্থ মুরাদ একে অবৈধ ঘোষণা করেন। এমনকি কফি পান করা অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার শিরচ্ছেদের নির্দেশও দেওয়া হতো। এতকিছুর পরেও কফি পানকারীকে তার অভ্যাস থেকে বিচ্যুত করা যায়নি।

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ভেনিস দিয়ে ইউরোপে যাত্রা শুরু করে কফি। সেখানে এর প্রচলন আর জনপ্রিয়তা বাড়লে, চার্চও ভীত হয়ে উঠে। তারা কফিকে “শয়তানের নির্মম আবিষ্কার” বলে অভিহিত করে।কফির ইতিহাস নিয়ে পল ক্রিস্টালের একটা বই আছে। বইটির নাম “কফি: আ ড্রিংক ফর দ্য ডেভিল”।

কফি যে 'অলওয়েজ আ ড্রিংক ফর ডেভিল' তাতে আমি মোটামুটি নিসন্দেহ। কেন? সে গল্পটা বলি-  একবার না বুঝেই, বিনা কারণেই একজনকে কফির দাওয়াত দিয়ে ফেললাম। কেন দিলাম, সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহই জানেন। দাওয়াত দিয়েই বুঝলাম মস্তবড় ভুল হয়ে গেল। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলাম দেখা করতে, নির্দিষ্ট সময়ের একঘন্টা পরে। ঝিপঝিপ বৃষ্টি, সেদিন সন্ধ্যা পড়ে গেছে সময়ের অনেক আগেই। আমি রিকশা থেকে নামতেই দেখি সেই অতিথি দাঁড়িয়ে। খুবই নিম্নমানের একটা কফিশপে বসলাম আমরা কারণ, সেখানে এর চেয়ে ভালো কোন রেস্তোরাঁ দেখলাম না। আমি নিজের উপরেই খুব বিরক্ত ছিলাম, কি করব বুঝতেই পারছিলাম না। টেক্সট করে আরেক বন্ধুকে আসার অনুরোধ করলাম। টুকটাক কথা দিয়ে শুরু হয়ে গল্প জমে গেল। উঠব, উঠছি করতে করতে তিনকাপ কফি হয়ে গেল। এরমধ্যেই বন্ধু এসে হাজির। তার তোড়জোড়েই খুব জমে যাওয়া আড্ডা ভেঙে বাধ্য হয়েই রাত এগারোটায় রেস্তোরাঁ থেকে বের হলাম। ফিরতি পথে পুরা রাস্তাই বলতে বলতে আসলাম, কফি অবশ্যই শয়তানি পানীয়। প্রতিদিন সকালে উঠে কফি খেতে খেতে এখনও বলি, অবশ্যই কফি শয়তানি পানীয়।

;

কক্সবাজারে ওভার ট্যুরিজমের আর্থ-সামাজিক প্রভাব



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি মনোরম উপকূলীয় শহর কক্সবাজার দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে হয়ে পরিগণিত হয়ে আসছে। বঙ্গোপসাগর বরাবর ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ অবারিত বালুকাময় উপকূলরেখার জন্য পরিচিত, কক্সবাজার কয়েক দশক ধরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকষর্ণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। যাই হোক, আদিগন্ত সৈকত এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হাজির হয়েছে – আর তা হল ওভারট্যুরিজম বা অতি-পর্যটন।

কক্সবাজারকে প্রায়ই পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর সূর্যস্নাত সৈকত, প্রশান্তিদায়ক তরঙ্গ এবং প্রাণবন্ত স্থানীয় সংস্কৃতি বিশ্বের সমস্ত কোণ থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। শহরটি বিলাসবহুল রিসর্ট থেকে শুরু করে বাজেট-বান্ধব আবাসন, ভ্রমণকারীদের জন্য বিভিন্ন রকম উপাদেয় খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গর্বিত। শহরের আইকনিক সমুদ্রের তীরে প্রমোনেড, যা লাবনি পয়েন্ট নামে পরিচিত, স্থানীয় উপাদেয় খাবার, হস্তশিল্প এবং সীশেল স্যুভেনির বিক্রি করে এমন বিক্রেতাদের দ্বারা ভরা একটি ব্যস্ততাপূর্ণ কেন্দ্র।

তদুপরি, কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করে, যা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রবাল প্রাচীরের আবাসস্থল। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহর থেকে এর প্রবেশযোগ্যতা পর্যটকদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও পর্যটনের বৃদ্ধি অনস্বীকার্য সুবিধা নিয়ে এসেছে, এটি এই বৃদ্ধির স্থায়িত্ব এবং স্থানীয় সম্প্রদায় এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে।

অতি-পর্যটন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এটি এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে অত্যধিক সংখ্যক পর্যটক একটি গন্তব্যে যান, যা পরিবেশ, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানের ক্ষতি করে। অত্যধিক পর্যটনের নেতিবাচক পরিণতি কক্সবাজার বিভিন্নভাবে ভোগ করছে।

প্রথমত, কক্সবাজার ভ্রমণকারী পর্যটকদের বিপুল সংখ্যা এই অঞ্চলের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। সমুদ্র সৈকতের ক্ষয় যা একসময় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিল, সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হোটেল এবং রিসর্ট নির্মাণের কারণে এটি আরও তীব্র হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে এই অঞ্চলের আদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা পর্যটকদের আকর্ষণ করত তা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শহরটির অবকাঠামো পর্যটকদের আগমনের সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। যানজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং কর্তৃপক্ষ পর্যটন শিল্পের চাহিদা পূরণের জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে, যার ফলে এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর এর প্রভাব পড়ছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব জটিল এবং বহুমুখী। যদিও পর্যটন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। পর্যটন নিঃসন্দেহে স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থ যোগান দিচ্ছে। এটি আতিথেয়তা, পরিবহন এবং খুচরাসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি তৈরি করেছে। পর্যটকদের অবিরাম আগমনের কারণে ছোট ব্যবসা, যেমন রেস্তোরাঁ এবং স্যুভেনির শপগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে৷ উপরন্তু, বর্ধিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কিছু বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।

পর্যটন খাতও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ খুলে দিয়েছে। দর্শনার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় উপকৃত হয়ে স্থানীয়রা তাদের নিজস্ব গেস্টহাউস এবং রেস্তোরাঁ চালু করেছে। এর ফলে অনেকের আয় বেড়েছে এবং জীবিকার উন্নতি হয়েছে।

যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এসেছে, এই খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। মৌসুমী পর্যটনের কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছর আয়ের ওঠানামা অনুভব করে। অফ-পিক সিজনে, অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে, যার ফলে ব্যবসার মালিক এবং তাদের কর্মচারী উভয়ের জন্যই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।

কক্সবাজারে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় স্থানীয় জনগণের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন খাত থেকে আবাসন এবং জমির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সম্পত্তির দাম বেড়েছে, সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য বাড়ি ও জমি কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি তৈরিতে অবদান রেখেছে, কারণ তারা তাদের শহরকে প্রাথমিকভাবে পর্যটকদের জন্য পরিবর্তিত হতে দেখেছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটন শুধু শহরের ভৌগোলিক ল্যান্ডস্কেপই পরিবর্তন করেনি বরং এর সাংস্কৃতিক বুননেও প্রভাব ফেলেছে। পর্যটকদের আগমন ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চাকে হ্রাস করেছে। পর্যটক-বান্ধব অভিজ্ঞতার চাহিদা প্রায়ই স্থানীয় রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের পণ্যীকরণের দিকে নিয়ে যায়, যা দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নিছক দৃশ্য পণ্যে পরিণত করে।

অধিকন্তু, বহুজাতিক চেইন হোটেল এবং বিদেশী মালিকানাধীন ব্যবসার উত্থান স্থানীয় সংস্কৃতিকে আরও সংকোচিত করেছে। ঐতিহ্যবাহী বাজার এবং খাবারের দোকানগুলির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলির দ্বারা ছেয়ে গেছে, যা স্থানীয় অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্রতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের পরিচিতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের পরিবেশগত প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। উপকূলরেখা বরাবর হোটেল এবং রিসর্টের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাঠামো উল্লেখযোগ্য সৈকত ক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। এই ভাঙন শুধুমাত্র শহরের পর্যটন আকর্ষণকেই হুমকির মুখে ফেলে না বরং স্থানীয় জেলেদের জীবিকাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে, কারণ সমুদ্রে তাদের প্রবেশাধিকার ব্যাহত হয়।

অধিকন্তু, পর্যটকদের ফেলে দেয়া প্লাষ্টিক কাপ, পানির বোতল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য তৈরি করে, যা প্রায়শই সমুদ্র এবং আশেপাশের অঞ্চলকে দূষিত করে। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকাঠামো এবং অনুশীলনের ফলে সমুদ্র সৈকতে এবং শহরে দৃশ্যমান আবর্জনা দেখা দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র পরিবেশেরই ক্ষতি করে না বরং পর্যটকদেরও নিরুৎসাহিত করে যারা আদি
প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজতে আসে।

কক্সবাজারে অত্যধিক পর্যটন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সাথে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখে। পর্যটকদের আগমনকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার জন্য পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপকূলরেখার কাছাকাছি হোটেল ও রিসর্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর প্রবিধান প্রয়োগ করা এবং দায়িত্বশীল নির্মাণ কাঠামো অনুশীলনের প্রচার করা সৈকত ক্ষয় কমাতে সাহায্য করতে পারে। পর্যটন পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়কে জড়িত করা নিশ্চিত করতে পারে যে তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং তারা শিল্প থেকে উপকৃত হয়।

পর্যটন ব্যতীত অন্যান্য শিল্পকে সমর্থন করে এমন অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে পর্যটনের মৌসুমী দুর্বলতা হ্রাস করতে পারে। সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অভিজ্ঞতার সত্যতা প্রচার কক্সবাজারের অনন্য পরিচয় বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।

দায়িত্বশীল এবং টেকসই পর্যটন অনুশীলন সম্পর্কে পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে অবদান রাখতে পারে। এলাকাটি টেকসইভাবে ধারণ করতে পারে এমন সর্বাধিক সংখ্যক পর্যটক নির্ধারণ করা এবং পিক সিজনে দর্শনার্থীদের অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করা কিছু পরিবেশগত চাপ কমিয়ে দিতে পারে।

একটি শান্ত উপকূলীয় শহর থেকে একটি ব্যস্ত পর্যটন কেন্দ্রে কক্সবাজারের অভিযাত্রা অতি-পর্যটনের কারণে একটি চ্যালেঞ্জের তৈরি করেছে যা এই শহরের টেকসই পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর গভীর আর্থ- সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাবও ফেলেছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে যাতে কক্সবাজার তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল হয়ে থাকে। এই মনোরম উপকূলে টেকসই পর্যটনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসায়ী ও পর্যটকসহ সকল স্টেকহোল্ডারের অন্যতম দায়িত্ব।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;

রোহিঙ্গা সংকটে ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিম্নমুখী এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে আসার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। মানবিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই মহানুভবতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন না করে ইদানিং বাংলাদেশের সমালোচনা করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা কারো কাম্য নয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, ফলস্রুতিতে ৪৫% রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর  জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের(জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে যা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ। এই পরিস্থিতি নিরসনে,  মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি জানায় যে, দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। 

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তাঁরা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি হিসেবে মনে করে। এর ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০% আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থন চলমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারের অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায় এবং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমাতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজতে অবিচল থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সংকট মোকাবেলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রথম নারী সভাপতি এলিসিয়া কিয়ার্নস বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জানান যে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন জানান যে, মিয়ানমারে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের জন্য মিয়ানমারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। এফসিডিও কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ও রান্নার জ্বালানি নিশ্চিত করতে ৩০ লাখ পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দেয়, এই সহায়তা কার্যক্রম ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি মানুষের জন্য ৩৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআর, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টম অ্যান্ড্রুজ জানায় যে,  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদেরকে পর্যাপ্ত সমন্বিত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং  জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে জেনেভাতে আসন্ন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এটি একটি বৃহত্তর মানবিক সংকটে আর্থিক সহায়তার হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি চলমান রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান রেখেছে।  ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেকার ভিসা সেবা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অধীনে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই সর্বাধিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারবে। এই সিধান্তের ফলে সরকারি সফর সহজতর হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ও একটি রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে বলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পর সেখান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে দুই দেশের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হলে তাদেরকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে।

সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী, সেজন্য রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে যাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের  সমর্থন চেয়েছেন। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ এই সাতটি দেশ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮তম এশিয়া কোঅপারেশন ডায়লগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ইস্যু আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখতে অনুরোধ জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা  চেয়েছে বাংলাদেশ। জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য এবং জাপানের বিদেশি সহায়তা কমিটির (ওডিএ) প্রধান নাকানিশি ইয়োসুকে সেপ্টেম্বরে তার বাংলাদেশ সফরের সময় এই আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বন্ধু প্রতীম দেশগুলো ভুমিকা রাখতে পারে। একই সাথে তাঁরা রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে মিয়ানমারে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ত্রান সহায়তা চলমান রাখার জন্য খাদ্য ও অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। 

সম্প্রতি দি ইয়থ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াই সি আর) নামে রোহিঙ্গাদের স্বার্থনিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের কথা জানা যায়। এই সংগঠনটি প্রায় এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনটি প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় তাদের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায় নাই। বহু দশক ধরে পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গাদেরকে প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিণত করা হয়েছিল ও তাদের নাগরিক অধিকার সহ অন্যান্য মানবিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই প্রান্তিক জনগুষ্টিকে কর্মক্ষম শক্তিতে পরিনত করা যেতে পারে। এই সংগঠনটি এসব উদ্যোগ নিতে পারে।  আশা করা যায় তাঁরা রোহিঙ্গাদের ক্রমহ্রাসমান আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে ইতিবাচক ভুমিকা রেখে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও সহানুভুতির বাস্তব রূপ দিবে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন নিশ্চিত করতে তৎপর। এখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মত একটা জটিল সমস্যা চলমান থাকবে তা কারো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ  আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই সংকট সমাধানে আঞ্চলিক, বৈশ্বিক সহ সব ধরনের উদ্যোগে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই ইস্যুটিকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবনতা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি এই সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 

;

ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান



শাহ ইসকান্দার আলী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান

ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান

  • Font increase
  • Font Decrease

শতবর্ষস্পর্শী জীবনেই তিনি পরিণত হয়েছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। তিনি ছিলেন ইতিহাস-পুরুষ। শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাদ জুৃমা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেও শোক, শ্রদ্ধা ও স্মরণের আলোয় অম্লান হয়ে আছেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক।

বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের চিকিৎসা জগত হারিয়েছে প্রবীণতম ব্যক্তিত্বকে আর কিশোরগঞ্জে ইতিহাসে অবসান ঘটেছে একটি গৌরবময় যুগের।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মাহবুবুল হক, লেখক-শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ, নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ড. আনোয়ার সাঈদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ও শিক্ষকমণ্ডলী।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জিল্লুর রহমান শোক জানিয়ে বলেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ছিলেন আমার অভিভাবক ও সিনিয়র নেতা।

গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন শোকবার্তায় বলেন, পিতৃতুল্য স্বনামখ্যাত চিকিৎসক, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ সময় অবদান রাখা ডা: এ. এ. মাজহারুল হক এর মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। আমরা গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্য আত্মীয় স্বজন ও গুণ গ্রাহী দের প্রতি জানাই সহমর্মিতা।

কিশোরগঞ্জের প্রবীন এমবিবিএস ডাক্তার, বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক, নিবিড় রাজনীতিক, সমাজ সেবক, কিশোরগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী আলহাজ্জ্ব ডা. এ এ মাজহারুল হকের ইন্তেকালে কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পদক প্রাপ্ত শিল্পী সৈয়দ নূরুল আউয়াল তারামিঞা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা ডাক্তারী সেবা ছাড়াও একজন সচেতন নাগরিকে হিসেবে দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে তাঁর নিরলস ভূমিকার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারে পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পরিষদ সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম তাঁর বিষয়ে স্সৃতিচারণ করে বলেন- “তিনি কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলের মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে আমাদের স্যার ছিলেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই আমি চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর রোগী হতাম। প্রথম দিন রোগী হওয়ার কথা আমার জীবনে স্মরনীয় হয়ে আছে। তিনি নিজ বাসায় তখন চেম্বার করতেন। ১৯৭৫ সালের কথা। তখন ফিস ছিলো ২০ টাকা।তিনি প্রেসক্রিপশন লেখার পর যখন পকেটে হাত দিলাম টাকা দেয়ার জন্য তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোথায় পড়ি। আমি গুরুদয়াল কলেজে পড়ি বলায় তিনি বল্লেন ফিস লাগবেনা। তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে ফিস নেন না। তাঁর সে ঘটনা আমার জীবন স্মৃতি হয়ে আছে। তিনি অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে সরাসরি ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন যে ইতিহাস আমিই প্রথম ১৯৯১ সালে জাতীয় পত্রিকায় তুলে ধরি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর তিনি ছিলেন নীরব সাক্ষী। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ড.মাহফুজ পারভেজ সহ পরিবারের সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। আল্লাহপাক এ পরহেজগার লোকটিকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।আমিন।”

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ভূঁইয়া মনোয়ার কবির। চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি), শাহ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানি প্রফেসর শেখ জহির আহমেদ, প্রফেসর ড. জিনাত আরা নাজনীন, আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আমানুল্লাহ বুবুল, সাংবাদিক ও চিন্তক মারুফ কামাল খান, সাংবাদিক ও অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, সাংবাদিকতা নিয়ামত মিয়া, কবি শাকিল রিয়াজ, নারীনেত্রী ফাতেমা জোহরা, কিশোরগঞ্জের রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর মোল্লা, সাহিত্যিক সৈয়দ আজিম, সাংবাদিক আহমদ ফরিদ, কিশোরগঞ্জনিউজ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, সাংস্কৃতিকজন মু, আ, লতিফ, লুৎফুন্নেছা চিনু, সৈয়দ শাকিল, সোহেল রানা, ফেসবুক গ্রুপ জন্মভূমি কিশোরগঞ্জ, উজানভাটি কিশোরগঞ্জসহ অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ডা. এ.এ. মাজহারুল হক এর বড় ছেলে বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)'র নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহফুজ পারভেজ ও মেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি শায়লা পারভীন সাথী।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে যোগ দেন।

তিনি মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের গৌরাঙ্গবাজারের বাসিন্দা ডা. এ.এ. মাজহারুল হক প্রায় ৬৯ বছর কিশোরগঞ্জে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহানব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিরন্তর ভূমিকা রেখেছেন। ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ও সমাজসেবী নূরজাহান বেগম প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মরহুম বিভিন্ন জনহিতকর ও সমাজসেবামূলক কাজ করে গেছেন।

এছাড়া বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসাসহ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

ডা. এ.এ. মাজহারুল হক এর মৃত্যুতে কিশোরগঞ্জের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ ভাষ্যে, বস্তুনিষ্ঠ বিবরণে আর মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

আরও শোক জানিয়েছেন আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ ফারুক, ইতিহাসবিদ প্রফেসর আনোয়ারুল ইসলাম, লায়ন হারুন অর রশীদ, কৃষক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বাচ্চু, আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফুল আরেফিন গোলাপ, ছাত্রনেতা আমিনুল ইসলাম তৌহিদ, সাংবাদিক ফারুকুজ্জামান, নিসর্গী প্রফেসর মোহাম্মাদ আলম চৌধুরী, লেখক মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক প্রফেসর ড. সালেহ জহুর, উন্নয়ন সংগঠক রেজাউল ইসলাম পিন্টু, সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্য, সাংবাদিক মোহাম্মাদ শাহনেওয়াজ, মিডিয়া গবেষক ড. কামরুল হক, সামসাদ রানা প্রমুখ।

;