দুর্গাপূজার অনার্য স্বর: সুরলোকে অসুর বন্দনা



রাজীব নন্দী
ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

শরৎ এসেছে বাংলার আকাশে। পথের ধারে কাশফুল, মাথার উপর মেঘ আর দেয়ালের ক্যালেন্ডার বলছে- বাঙালির শারদোৎসব সমাগত। প্রতিবছর সনাতনী বাঙালির এই পূজার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সকল মানুষের মধ্যে। এখানে দুর্গাপূজা যতটা না শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান, তার চেয়েও বেশি উৎসব! সেই উৎসব উদযাপনেরই ভিন্ন চোখে দেখা কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

দেখতে দেখতে বাংলাদেশের সমাজ বদলে যাচ্ছে। দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীতে এখন সধবা ও তরুণীদের মধ্যে সিঁদুর খেলার প্রচলন বাড়ছে। আগে এটা দেখা যেতো না। আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ বিদায়ের সুরে বাপের বাড়ি থেকে কন্যা বিদায়ের ক্ষণে এত আনন্দ কিসের বুঝি না! চার দিনের আনন্দযজ্ঞ শেষে মা চলে যাচ্ছেন, কোথায় বলবো, ‘আবার এসো মা’- তা না।

মা এলেন, চলে যাচ্ছেন, আবার আসবেন; এটাই তো নিরন্তর গতি প্রবাহ। এর সঙ্গে সিঁদুর খেলে মুখ রাঙানোর সম্পর্ক বুঝি না। সিঁদুর হলো সধবা রমনীর স্বামীত্বের গর্ব। স্বামী জীবিত থাকলেই স্ত্রী কেবল সিঁদুর পড়তে পারেন। এমন পুরুষতান্ত্রিক একটি চিহ্ন কেন সর্বশক্তিমান দুর্গার বিদায়ক্ষণের প্রতীক হয়ে উঠবে? ‘গাঁজাখোর স্বামী’কে (মহাদেবের প্রিয় নেশা গাঁজা!) পাত্তা না দিয়ে, কৈলাসে একা রেখে এসে যে দেবী একা অসুর বধ করলো, সেই পূজায় বাঙালি রমণী সিঁদুর খেলায় ব্যস্ততা দেখে করুণা জাগে। দুর্গাই যেখানে স্বামীকে পরোয়া করলেন না, সেখানে দুর্গাভক্ত বাঙালি কূলবধুর এমন সিঁদুরপ্রীতি কেন?

কলকাতার ‘হইচই’ ওয়েবসাইটের ‘হ্যালো’ সিরিজে দুর্গাপূজায় সিঁদুর খেলা


এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ওয়েবসিরিজ একটি মুখ্য ভূমিকা রাখছে। ভারতের দর্শকরা এখন বিনোদনের পর্দা ছেড়ে ছোটপর্দা হয়ে মোবাইল ফোনের ছোটপর্দা থেকে সোজা ওয়েব সিরিজে বুঁদ হয়েছে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনটাই এখন সিনেমার স্ক্রিন! সম্প্রতি হিট হওয়া তেমনিই একটি ওয়েব সিরিজের নাম ‘হ্যালো’। এই ‘হইচই’ ওয়েবসাইটের ‘হ্যালো’ সিরিজে দেখা যায় দুর্গাপূজার বনেদি বাড়িতে পরকীয়া আর প্রেমের মাঝে চলছে সিঁদুর খেলা। মনে প্রশ্ন জাগে, মাঙ্গলিক সিঁদুর মুখে মেখে এবং মাখিয়ে যারা উল্লাস করেন, তারা কি দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন যে আপনারা যখন আনন্দযজ্ঞে রঙিন, তখন আপনারই বিধবা মা বা শাশুড়ি বা বোনটি ঘরের কোণে মুখ লুকিয়েছে মুখপোড়া স্বামীঘাতি কূলবধু বলে?

সিঁদুর তত্ত্ব শেষ। এবার দুর্গা বন্দনার ভিন্ন দিকে চোখে তাকাই। ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা। তাতে থাকে গৌরবগাঁথা। পরাজিতরা মুছে যায়। হিন্দু-মিথলজির রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীর পাতায় রয়েছে মহান চরিত্রদের বিজয়গাঁথা।

মিথলজির জনপ্রিয় বয়ানে কোথাও নেই পরাজিতের বীরত্ববাণী। তাই না? আছে কি রাবণ, দুর্যোধন কিংবা অসুরের স্তুতি? না, নেই। আমার এই আলোচনা দুর্গাপূজার অসুরকে নিয়ে। এই লেখায় ধর্ম ও মিথলজির দ্বন্দ্ব খোঁজা হয়নি। বিশ্বাসকে ‘সাইনআউট’ করে তলিয়ে দেখা হয়েছে বাস্তবতা। বলা যেতে পারে, এই লেখা আর্যদের সৃষ্টি ছলনাময়ী নারীর কাছে একজন অনার্য, কালো-পেশীবহুল ভূমিপুত্র অসুরের পরাজয়ের সুরতহাল।

দেবতারা অপার্থিব মহান ব্যক্তি, অসুর বলতে অত্যাচারী ভয়ানক কিছু বোঝায়। কিন্তু অসুর শব্দের অর্থ বীর, যে যোদ্ধা জাজ্বল্যমান। পুরাণে অসুর কোনো নিন্দা-সূচক শব্দ নয়। বরং বহুবার প্রশংসাসূচক ও অভিবাদন রূপে বর্ণিত। ইন্দ্র,সূর্য, বরুণ তো অসুর। শারদোৎসবের মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গার জয়গান। দুর্গার পদতলে মুমূর্ষু কিন্তু পেশীবহুল প্রবল এক পুরুষ আছেন। যার নাম মহিষাসুর। তিনি আসলে কে? ভয়ানক দানব? যাকে নিধন করেছিলেন দেবী? না কি, এক অসামান্য বীর? ভূমিপুত্র, রাজা? যাকে এই ধরণীর বহিরাগত সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে ‘খুন’ করেছিলেন?

অসুর এই ভূমিজ সন্তান, ভূমিপুত্র আদিবাসী নেতা


পৌরাণিক স্বর্গরাজ্য থেকে নেমে আসা যাক বাস্তবতার মর্ত্যধামে। পশ্চিমবঙ্গের লেখক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর মতে, দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁর বংশধর রয়েছে। ভারতবর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই ভাবেন! দেবী দুর্গা তাঁদের কাছে যমদূতের প্রতিনিধি। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার পাশাপাশি ভারতের প্রায় ৫০০টি জায়গায় দলিত-বহুজন-আদিবাসীরা হুদুড় দুর্গা অর্থাৎ মহিষাসুর স্মরণ দিবস পালন করে থাকে।

আশ্বিনের শারদোৎসবের চারদিন ‘অসুর বংশ’র এরা বাড়ি থেকে পারতপক্ষে বের হন না। আতঙ্ক, দেবী দুর্গার কোপে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হয় বুঝি। এক-দুটি পরিবার নয়, এমন ‘অসুর’-এর সংখ্যাটা হাজার হাজার।

জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুসারে অসুর বংশের সদস্যদের সংখ্যা ১০ হাজারের কিছু বেশি। তাদের ধারণা, দুর্গাপূজার চারদিন দেবী মর্ত্যে আগমন করে অসুর নিধন করেন। সেই ভয় থেকেই আজও তারা নিজেদের ঘরে বন্দি করে রাখেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার কেদারহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ইন্দ্রেরকুঠি গ্রামে রয়েছে অসুরদের বাস। যদিও ছোট একটি দল তারা এবং তাদের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা তথ্য। কারো মতে, ওদের আদিবাস ঝাড়খণ্ডে, কারো মতে আসামের গৌহাটি।

ভারতের কবি ও লোকসংস্কৃতির গবেষক রণজিৎ দেব ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানতে পেরেছেন- এই অসুরবংশীয় মানুষদের আবাস প্রাগজ্যোতিষপুরের আসাম রাজ্যের একটি অংশ এবং উত্তরবঙ্গের একটি অংশে। প্রাগজ্যোতিষপুরের সে সময় সেখানকার রাজা ছিলেন নরকাসুর। যারা মূলত মহাদেবের ভক্ত। ভারত-ভুটানের সীমান্ত আলীপুরদুয়ারের চা-বাগানের কয়েকটি এলাকায় থাকেন অসুরবংশীয়রা।

অসুররা অনার্য-মূলনিবাসী-ভারতীয়, পেশীবহুল শারীরিক গঠন বলে দেয় ওরা পরিশ্রমী জাতি


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক ও লেখক সায়ন্তনই অধিকারীর মতে, ভারতে হুদুড় দুর্গাপূজা নামে অসুর বন্দনা চলে। দেবী দুর্গা আদতে আর্যদের মুখপাত্র। যিনি চাতুরীর দ্বারা অসুররাজকে পদানত করে হত্যা করেন।

ভারতের মত দেশে সংস্কৃতির বহুধারাই যেখানে চিরকালীন ঐতিহ্য, সেখানে পশ্চিমবঙ্গীয় দুর্গাপূজার উন্মাতাল আনন্দযজ্ঞের বাইরে প্রান্তিক পুরুলিয়ায় অসুর জনগোষ্ঠী থেকে পালন করা হয় মহিষাসুর শহিদ দিবস (নবমীর দিন)। খুব আশ্চর্যজনক কি? হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছুটা আশ্চর্যেরই খবর বটে।

ভারতবর্ষের ৪০টি শিডিউল ট্রাইব গোষ্ঠীর মধ্যে একটা হল ‘অসুর’। যারা মহিষাসুরকে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পূর্বপুরুষ মনে করেন। এরা কিন্তু অসুরকে পূজা করে না। আমাদের জনপ্রিয় দুর্গাপূজা তাদের কাছে প্রকৃত অর্থেই ভূমিপুত্রের শহিদ দিবস।

অসুরেরা বিশ্বাস করেন, তাদের পরম পূর্বপুরুষ শ্রীশ্রী মহিষাসুর মহাশয় কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। তাই দুর্গাকে পূজা করা হলেও অসুরের মধ্যে কোনো অলৌকিক ব্যাপার নেই। অসুর সম্প্রদায় সত্যিই এই দাবি করে আসছেন, মহিষাসুর তাদের বীর পূর্বপুরুষ, তাঁকে অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। দুর্গা মূর্তির পদতলে কখনো খয়েরি, কখনো লাল, কখনো বা স্পা করা চুল, কখনো কমেডিয়ান বা জোকার কিংবা শরণাগত আর্ত কোনো চরিত্র নন, বংশধররা মনে করেন, প্রচলিত দুর্গা মহিমায় তাদের বংশের মহান বীরের অপমান।

নিজের আরাধ্য দেবীকে উপাসনা করাটা অধিকার, তাই মহিষাসুরের মত আদিবাসী বীর কি কারো পায়ের তলায় রেখে অপমান করা চলে? উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে কিছু বছর আগেও বাঙালির ‘শ্রেষ্ঠ উৎসব’-এ বাড়ি থেকে বেরতেন না মহিষাসুরের ভক্ত অসুর সম্প্রদায়। জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটার ক্যারন্, গুরজংঝোড়া বাগান, আলিপুরদুয়ার জেলার মাঝেরডাবরি, নিমিতিঝোরা এবং শিলিগুড়ির নকশালবাড়ি চা-বাগানে সর্বমোট ৬০০ জন অসুর জনজাতির মানুষ বসবাস করেন (সূত্র: মহিষাসুরের বংশধর ‘অসুর’ সমাজও এবার পুজোর মণ্ডপে, ৭ অক্টোবর, ২০১৬, এবেলা)। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার খেরওয়াল জনজাতির পালন করে মহিষাসুর শহিদ দিবস। কাঠি নাচ, দাশাই নাচের মাধ্যমে পুরো পূজার সময়টুকু শোক পালন করেন তারা। পুজোর মাসটা তাদের কাছে দাশাই মাস বা দুঃখের মাস। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে এবং কর্ণাটকের কিছু জনজাতিরাও তাই মনে করেন।

আসুন তবে চণ্ডী মতে দেবীনির্মাণের ব্যাখ্যা শুনি। দেবতাদের নানা শক্তি সমন্বয়ে দুর্গা এক অসমান্য দেবী। অর্থাৎ, একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র। বস্তুবাদী ব্যাখ্যায়- নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র। দুর্গাপূজার আগে মহালয়া নামক যে সোয়া-অ্যাকশন ও পৌনে-থ্রিলারে ভরা দুর্গার বায়োপিক আমরা ফি বছর দেখি, সংশয় রয়েছে সেটা কি তবে অর্ধসত্য? কারণ, মহিষাসুর কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে অজেয় হওয়ার বর চাইলেন। ব্রহ্মা তাঁকে খুশি হয়ে দিলেন বর। কি সেই বর? ‘কোন পুরুষই মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না’। অথচ মোক্ষম সময়ে সব দেবতাদের সৃষ্ট ‘যৌথবাহিনী’র শক্তি দিয়ে তৈরি করে ‘লেলিয়ে’ দেওয়া হল দুর্গাকে। মহিষাসুর ‘হা রে রে রে’ করে ছুটে এসে দেখেন, একি! সম্মুখে যে নারী দণ্ডায়মান। তাই যুদ্ধ-নিয়মের ব্যতয় ঘটাননি তিনি। যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম, নারী বা শিশুকে আক্রমণ করা যাবে না, নিরস্ত্রের ওপর অস্ত্র তোলা বারণ, সন্ধ্যের পর যুদ্ধে বিরতি। কিন্তু দেবতারা কি সেসব মানলেন? মহাভারতের অর্জুন কি নিয়ম মেনে ভীষ্মবধ করছিলেন? জয়দ্রথ বধ? কর্ণ বধ? সবই তো ছলনা আর যুদ্ধের রীতি ভেঙ্গে। রামায়ণের লক্ষণ কি মেঘনাদকে বধ করতে পেরেছিলেন নিয়ম মেনে? দুর্গাপূজাতেও আমরা দেখি চূড়ান্ত নিয়মবিরুদ্ধ অসম যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করতে পাঠানো হল এক ছলনাময়ী নারীকে। ফলে, ‘ভিক্টোরিয়ান এথিকস’ মেনে চলা পারফেক্ট জ্যান্টলম্যান মহিষাসুরও নারী দেখে আর অস্ত্র হাতে তুললেন না। ফলে, ঘ্যাচাং। ডাইরেক্ট স্বর্গ!

যদিও মহিষাসুর আজ পৌরাণিক বয়ানে ভিলেন। যেভাবে ছলনাময়ী কৃষ্ণ হয়ে ওঠে পুরাণের ঈশ্বর, যেভাবে আজ্ঞাবহ দাস ভীষ্ম হয়ে ওঠেন মহাভারতের মহান পুরুষ, পক্ষপাতদুষ্ট দ্রোণাচার্য হয়ে ওঠেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, সুবিধাভোগী অর্জুন হয়ে ওঠেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ!

কিন্তু, বহুশ্রুত ও বিচিত্র লোককথা আমাদের জানায়, শরৎকালে যাকে আমরা উৎসব হিসেবে জানি, সেটি এই ভারতবর্ষীয় ভূমিপুত্রকে উচ্ছেদের করুণ কাহিনী হয়তো। আদিবাসী মহিষদের তাড়না করে জলাজমির দখল নেয়ার আখ্যান হয়তো!

দুর্গাপূজার ঝলমলে উৎসব অসহায় অনার্যদের ওপর আর্যদের অন্যায় উৎসবের উদযাপন হয়তো! এরফলে পতন ঘটল 'দখলদার', 'অসুর', 'বর্বর' মহিষাসুরের, যিনি প্রকৃতার্থেই ছিলেন রাজা। আজ আমরা সেই ভূমিপুত্রের পরাজয় আনন্দোল্লাসে পালন করি, আমাদের বুকে-শূলবিদ্ধ, অনার্য অধিপতির। ইতিহাস এভাবেই রচিত হয়। অসুর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে সত্য, কিন্তু শতাব্দী ধরে তাঁকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে সেটি কি ঠিক?


রাজীব নন্দী: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, বার্তা টুয়েন্টিফোর.কম-এর কনসালটিং এডিটর

   

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৬ মে, ১৯৭৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। সারাদেশে এবছর বৈরী তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় প্রতিটি জীব-প্রাণের মধ্যে ত্রাহি অনুভব শুরু হয়েছে।

শহুরে বিত্তশালী মানুষ শীতাতপ যন্ত্রের ঘেরে বসে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু শহুরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের রৌদ্রজলা মানুষেরা এবছর বেশি নাকাল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের পানির আকাল। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি।

মাওলানা ভাসানি কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে উজান-ভাঁটি দুই দেশের মানুষের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে এজন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশ বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানি এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।

মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দু:খ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।” (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।”... “বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি... সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বন্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।”

এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন।

এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।

মাওলানা ভাসানির বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”

বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তরে গঙ্গা চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাঁটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।

অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। গবেষণার সেসব ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো বিকার কোনো কালেই লক্ষ্য করা যায় না।

এমনিকি তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং-সেনিার, চুক্তি হওয়ার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানির সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি।

আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানির মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দূরদৃষ্টি, দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;