কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারব্যবস্থা
![ছবি: বার্তা২৪.কম](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2023/Dec/18/1702896415698.jpg)
ছবি: বার্তা২৪.কম
‘২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার না করলে কি আর এই হরতালের দিন গাড়ি চলত? গণগ্রেফতার ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যেটাই করা হয়েছে, আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি।...তারা (বিএনপি) যদি নির্বাচনে আসে তবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে—এমন কথা নির্বাচন কমিশন থেকে তাদের বারবার বলা হয়েছে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া না, বলা হয়েছিল যে—সবাইকে জেল থেকে মুক্ত করা হবে।’
কথাগুলো আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের। গতকাল রোববার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে ড. আব্দুর রাজ্জাক ওই মন্তব্য করেছেন। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য উদ্বেগের, এই বক্তব্য বিচারব্যবস্থায় নির্বাহী ব্যবস্থার হস্তক্ষেপের প্রমাণ। বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপে কৃষিমন্ত্রী কেবল সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেননি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নির্বাচন কমিশনকে। দেশে-বিদেশে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন।
আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, এবং সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী। তার বক্তব্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। তিনি হুট করে মুখ ফসকে দলের কোন কর্মীসভায় কিছু বলেননি, বলেছেন একটা টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। তিনি জানতেন তার এই বক্তব্য দেশব্যাপী প্রচারিত হবে। দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এটাকে তাই ‘স্লিপ অব টাঙ’ বলার সুযোগ নাই। তিনি নির্বাচন কমিশনের অংশ নন, তবু তিনি তার বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনকে জড়িয়েছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে সবধরনের চেষ্টা করা হয়েছে বলে মন্ত্রীর দাবি। তার এই দাবির সপক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে মন্ত্রী যা বলেছেন সেটা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রতি সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ, একই সঙ্গে আন্দোলন দমনে সরকারবিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারের অন্যায্য দমননীতির পরিষ্কার স্বীকারোক্তি।
গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি দাঁড়াতেই পারেনি। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে যেতে থাকলেও মাঠের তার প্রমাণ মেলেনি। গণগ্রেফতার আর গ্রেফতার আতঙ্কে দলটির নেতাকর্মীরা বাড়িছাড়া। নতুন-পুরাতন মামলায় একের পর এক বিএনপি নেতা গ্রেফতার হচ্ছেন। গ্রেফতার যারা তারা জামিনও পাচ্ছেন না। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারাগারে। যারা কারাগারের বাইরে তাদের কেউ মাঠেই নামতে পারছেন না। দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রান্তের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজ দেশ পরবাসী জীবন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার খবর আছে, কারাগারে যাওয়া বিএনপির সদ্যসাবেক (বহিষ্কৃত) ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপির অভিযোগ তাকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
শাহজাহান ওমরের এই ঘটনাই কেবল নয়, বিএনপির অভিযোগ দলটির নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রলোভন ও চাপ দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ নেতা সেটা গ্রহণ করেননি। যারা গ্রহণ করেননি তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিএনপির দাবি, তাদের ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলটির এই দাবি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ দেখানো পশ্চিম বিশ্ব ও বৈশ্বিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছেও গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এনিয়ে কথাও বলছে, তবে বরাবরের মতো সরকার গণগ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করছে।
গণগ্রেফতার ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধার যে অভিযোগ তা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবু সরকারের পক্ষ থেকে রুটিন অস্বীকার করা হচ্ছে সব। কিন্তু মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর এটা পরিষ্কার যে, সরকার পরিকল্পনা করেই এসব করছে, এমনকি এই পর্যায়ে এসে স্বীকার করতেও দ্বিধা করছে না। এটা যথেচ্ছাচারের উদাহরণ ছাড়া কিছু কি?
‘বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে’—কৃষিমন্ত্রীর এই মন্তব্যের মাঝে খারাপ কিছু দেখি না, এটা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার সদিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এমন সম্ভাবনার কথা শোনাও গিয়েছিল, তবে বিএনপি কোনো পর্যায়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি বলে ভোটগ্রহণের তারিখ পেছায়নি। নির্বাচন পেছানোর বিষয়টি বাংলাদেশে নজিরবিহীন নয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপির জন্যে তারিখ পেছানো হয়েছিল। তবে ‘বিএনপির সবাইকে জেল থেকে মুক্ত করা হবে’—বক্তব্য দিয়ে মন্ত্রী বুঝাতে চেয়েছেন জেলে পাঠানো আর জেল থেকে বের করে আনা কেবল বিচারিক বিষয় নয়, এখানে সরকার অন্যায্য হস্তক্ষেপ করছে। যদিও ইঙ্গিত আছে এর ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের জেলে যাওয়া আর জামিন পাওয়া নিয়ে, তবু প্রমাণের অভাব ছিল বৈকি!
কৃষিমন্ত্রী বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপে এখানে কেবল আওয়ামী লীগকেই জড়িত করেননি, জড়িত করেছেন নির্বাচন কমিশনকেও। এটা নিয়ে সরকার, সরকার-দল আওয়ামী লীগ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া উচিত। একজন মন্ত্রী গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আইন, বিচার, রীতিনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এনিয়ে কথা বলবে না—এমনটা উচিত হবে না! কৃষিমন্ত্রীর রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ বিবিধ অবস্থান তার এই বক্তব্যকে ‘স্লিপ অব টাঙ’ হিসেবে দেখারও অবকাশ রাখে না।
আব্দুর রাজ্জাক সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা। তার বক্তব্যের গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরের বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী সকল মহলের কাছেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবেন। রাজনীতি-আগ্রহীজনেরা মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপির অভিযোগের হুবহু মিল দেখছেন। বিএনপি বলছে—গণগ্রেফতার হচ্ছে, ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন; কৃষিমন্ত্রীও একে অস্বীকার করছেন না। বিদেশিদের কাছে তাই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে বিএনপির বক্তব্যে সংখ্যাগত ভুল নেই, অভিযোগে নেই অতিরঞ্জন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিবিধ চাপে রয়েছে সরকার, চাপে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল স্বীকারও করেছেন বিদেশি চাপের কথা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী-নেতারা বলছেন চাপের কথা। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ নানা দেশ ও বৈশ্বিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে আগ্রহী, এবং অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সরকার সরকারবিরোধীদের রাজনৈতিক আন্দোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, ব্যাপক দমননীতি চলছে বাংলাদেশে—এই অভিযোগ সকল পর্যায় থেকেই। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে বিবৃতি প্রকাশ করেই যাচ্ছে। এমন অবস্থায় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য দেশে-বিদেশে সরকারবিরোধীদের পালে হাওয়া দেবে। এটা সরকারবিরোধী বক্তব্যের সরকারি স্বীকৃতি হিসেবেই বিবেচিত হবে, যা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার শঙ্কা বাড়াবে।
কৃষিমন্ত্রী বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ ও সরকারকে ফেলে দিয়েছেন ভাবমূর্তিসহ বিবিধ সংকটে। এটা ‘সরল বিশ্বাসে’ করা ‘স্লিপ অব টাঙ’ নয়, এটা ভয়ংকর এবং যথেচ্ছাচারের উদাহরণ!