মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর



মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী

মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী

  • Font increase
  • Font Decrease

 

চট্টগ্রাম শহরকে যারা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করে তাঁদের বলা হত ‘মেথর’। তারা যেখানে বাস করত সেই এলাকাকে বলা হত ‘মেথরপট্টি'। মেথর বলতে সমাজের দলিত সম্প্রদায়কে বোঝায়। যারা ছিল একধরনের অচ্যুত। যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম শহরে এই প্রথা চলে আসছে। কিন্তু সমাজের এই উচুঁ নিচু বিভাজনপ্রথা মানতে রাজি নন একজন মেয়র। তিনি চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। যিনি ‘মেথর’দের নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম দেন ‘সেবক’। ইউনিফর্ম হিসেবে তাঁদের দেন হলুদ রঙের পোশাক, এতে লেখা হয় ‘সেবক’ শব্দটি। তাদের বসবাসের জায়গাটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘সেবক কলোনি’।

সেবকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করেন। সমাজে সাধারণ মানুষ হিসাবে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেন। এভাবে মানবিক কর্ম দিয়ে জনমানুষের কাছে মানবতার ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত হয়েছিলেন চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী।

সমাজে চলমান গা ভাসিয়ে দেওয়া রাজনীতির যুগে সবার টার্গেট থাকে দলের পদদখল। দলীয় পদ পেলে দলনেতা হওয়া যায়, কিন্তু জননেতা হওয়া যায় না। জননেতার প্রধান গুণ মানবিক হওয়া, মানবতার জন্য কাজ করা। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানুষ আজও সংকট সংগ্রামে স্মরণ করে, অনুসরণ করে। তাঁরা শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গেয়েছেন মানবতার জয়গান, ধ্ববংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির কথা বলেছেন। চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং একজন পরিপূর্ণ মানবিক মানুষ। তাঁর কর্মের মধ্যে চতুরতা ছিল না, ছিল না অহমিকা, ছিল অদম্য সাহস, কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুরোনাম আবুল বশর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রেলওয়েতে কর্মরত থাকায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর শৈশব  কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। তিনি যখন সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার মনে দাগ কাটে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব দেন মহানগর ছাত্রলীগের। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। নেভাল বেইস টর্চার ক্যাম্পে ধারাবাহিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে বের হয়ে চলে যান ভারতে। হরিনা ইয়ুথ ক্যাম্পে পেঁৗছে দেখেন তাঁর নামেই সেখানে নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’। সহকমীর্রা মনে করেছিল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন পাকসেনাদের হাতে। ভারতের উত্তর প্রদেশের তান্দুয়া কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ শেষে ‘মাউন্ট ব্যাটালিয়ন’র প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন। পরে বিএলএফ এর মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার নিযুক্ত হন তিনি। পার্বত্য এলাকায় তিনশো মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হিসাবে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিজয়ীর বেশে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী দেখতে সুদর্শন ছিলেন না। বক্তৃতার সময় কথার ব্যাকরণ ঠিক থাকত না। যা দিত একদম কাটখোট্টা। প্রয়োজনে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রধানতম নেতা হয়ে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কালুরঘাটে গার্মেন্টসের আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ সবকিছুতেই সর্বাগ্রে ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূল জুড়ে ছিল লাশের স্তূপ, সেই লাশ দাফন ও অসহায় মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে মুসলিম ইনস্টিটিউটে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেন তিনি। এককথায় যখনি চট্টগ্রামের দুর্দিন সেখানে হাজির হয়েছেন বীর মহিউদ্দিন।

তিনি শুধু মৃত লাশের সৎকার করেননি, অনুধাবন করেছেন লাশ পরিবহনে শহরবাসীর বিড়ম্বনার কথা। তাই ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন—এর উদ্যোগে লাশ পরিবহনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যবস্থা করেন। হজব্রত পালনের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে গড়ে তুলেছিলেন মেয়র হজ কাফেলা। তিনি কত বড় মানবিক মানুষ তা শোনা যায় হাজীদের মুখ থেকে। আরাফাতের রৌদ্রতপ্ততায় অস্থির হয়ে তিনি হাজিদের জন্য নিজে ড্রামে করে শরবত বানাতেন। অসুস্থ হাজিদের মলমূত্র পরিস্কার, দুর্গন্ধযুক্ত পোশাক ধৌত করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। মননে, চিন্তায় ও কর্মে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শের মূর্তপ্রতীক। যেমন মুসলিমদের মসজিদ নিয়ে ভেবেছেন, তেমনি হিন্দুদের শ্মশান নিয়ে ভেবেছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকারে তিনি অভয়মিত্র মহাশ্মশান এবং বৌদ্ধদের সৎকারে কালুরঘাটে স্থাপন করেছেন গ্যাসচুল্লি। হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য তীর্থ ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর কাছে মানবতাই ছিল পরমধর্ম।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছেন। আপন হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন  নগরের অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। নতুন আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গড়ে তুলেন মাতৃসদন হাসপাতাল ও আরবান হেলথ ক্লিনিক। পৌর চেয়ারম্যান নুর আহমদ চট্টগ্রাম শহরে শিক্ষাব্যবস্থার যে অগ্রগতির সূচনা করেন, তাতে নতুন গতি সঞ্চার করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হেলথ টেকনোলজি সেন্টার। উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ জনমানুষের শক্তিশালী প্লাটফর্ম গড়ে তোলেন।        

চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আপষহীন। আমেরিকার এসএসএ কোম্পানি ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের মোহনায় পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিলে মহিউদ্দিন চৌধুরী তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তা বন্ধ করে দেন। একইভাবে বছরে মাত্র ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে শাহ আমানত বিমানবন্দর থাই কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে গর্জে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এখন রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান বছরে শতকোটি টাকার বেশি আয় করে প্রমাণ করেছে যে, সিদ্ধান্তটি ছিল হঠকারী। তিনি ভাবতেন চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বন্দর, কর্ণফুলী নদীসহ বৃহৎ চট্টগ্রামের অমূল্য সম্পদ ভাণ্ডার নিয়ে। মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করেছিলেন কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণের জন্য। আজ কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মিত হয়েছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। চট্টগ্রামের উন্নয়ন অগ্রগতি সংকটে সংগ্রামে একাকার ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই নেতা বা নায়কের স্থান করে নিতে পারে না। ইতিহাসে নায়ক হওয়ার মতো মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদে নায়কের উদ্ভব ঘটায়। চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তেমনি এক অবিসংবাদিত নেতা, যার সৃষ্টি ইতিহাসের প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের একনিষ্ঠ কমীর্ মহিউদ্দিন চৌধুরী। আজ থেকে হাজার বছর পরে যখনি চট্টগ্রামের উন্নতি ও সমৃদ্ধির ইতিহাস লেখা হবে, তখনি লেখক ও গবেষকদের ফুটনোটে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী নামটি।

লেখক: ইতিহাস বিষয়ক গবেষক ও প্রাবন্ধিক, [email protected]

   

মিয়ানমার সংকট

বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে



ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রোহিঙ্গা সংকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে রাখাইন ও চিন রাজ্যে চলমান সংকটে দেশটি সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারছি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি চিন সমস্যা নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে। সেজন্য ভারতের মিজোরাম সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য আমাদের পাঠক জানতে পারছে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও রাজ্যগুলো সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা আরও স্পষ্ট ও তথ্য সমৃদ্ধ হওয়ার অবকাশ আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অশান্ত প্রতিবেশী সৃষ্ট সংকটের কারণে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের মধ্যেকার সীমান্তের নিরাপত্তা বর্তমানে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে টেনে চলছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইনে মর্টারশেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের জনপদে গোলাগুলির কারণে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। সে সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা স্থলসীমান্ত ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, বাংলাদেশের আকাশসীমায় বিমানবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং বাংলাদেশে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এ ধরনের আচরণ দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অন্তরায় এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ। এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ও সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ সে সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণু মনোভাব দেখিয়েছিল।

বর্তমানে এই ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান যুদ্ধে একের পর এক মর্টার শেলের শব্দে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষের কারণে এপারের সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের সীমান্ত এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু ও নয়জন আহত হয়। এপ্রিল মাসে নাফ নদীতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে দুই বাংলাদেশি জেলে আহত হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে অবস্থানরত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজকে বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে গুলি না করার সংকেত দেওয়ার পরেও তারা তা উপেক্ষা করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীর (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার কারণে পরবর্তীতে প্রায় ৩০০ জেলে তাদের নৌকা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। এছাড়াও বিজিপি সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে ফেরার পথে একটি যাত্রীবাহী ট্রলার আটক করে প্রায় দুই ঘণ্টা তাদেরকে আটকে রাখে। গুলিতে বাংলাদেশি জেলেদের আহত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনা প্রতিবেশী দেশের মধ্যেকার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর আরাকান আর্মির সাথে বিজিপি’র সংঘর্ষের তীব্রতায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদেরকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত বিজিপি সদস্যদেরকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

আরাকান আর্মির সাথে চলমান সংঘর্ষে মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আরও ২৮৮ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার দ্বিতীয় দফায় ২৩ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর থেকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়। ২৪ এপ্রিল জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় এসে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেই জাহাজে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয় যারা বিভিন্ন মেয়াদে মিয়ানমারের জেলে বন্দী ছিল। মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সাথে কয়েক দফায় বৈঠক করে তাদেরকে ফেরত পাঠায়। ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বিজিপি সদস্য, চারজন সেনা সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্যসহ মোট ২৮৮ জনকে বিজিপির কাছে হস্তান্তর করে ও তারা সেই জাহাজে মিয়ানমারে ফিরে যায়। বিজিবি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বিজিপি, সেনা সদস্য ও অন্যান্যদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম নীতি মেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।

রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের থান্ডওয়ে টাউনশিপে আরাকান আর্মি এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের সময় কাছাকাছি থাকা জান্তা নৌবাহিনী ও আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেনাবাহিনী এই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে থান্ডওয়ে টাউনের সমস্ত প্রবেশপথে আরও সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে। সামরিক চেকপয়েন্টগুলো বাসিন্দাদের চাল ও জ্বালানি বহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে এবং চকপিউ টাউনশিপ ঘিরে রেখেছে, তারা অ্যান শহরে জান্তার ওয়েস্টার্ন কমান্ড এলাকার কাছেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী স্কুল, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় স্থানসহ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করছে এবং পরিবহন, ইন্টারনেট এবং ফোন সংযোগ বন্ধ রেখেছে।

১১ মার্চ আরাকান আর্মি রাখাইনের দক্ষিণে রামরি শহর দখল করেছে। বর্তমানে সংঘর্ষ চলমান অঞ্চলের জনগণ খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক সুবিধার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী দখলের জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং সংঘর্ষ বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে জান্তা রাখাইন জনগণকে ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করতে বাধা দিচ্ছে। রাখাইন মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্য এবং এখানে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৬০ হাজার রাখাইনের অভিবাসী বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কাজ করে। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ জারির পরপরই, সরকার রাখাইন থেকে ইয়াঙ্গুনে আসা বিমান যাত্রীদের ওপরও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আরাকান আর্মি এখন পর্যন্ত ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিসহ ১৮০টির বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। তবে সমগ্র রাখাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, সেইসাথে আরও অনেক রক্তক্ষয় হবে।

মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিরোধ, রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশেকে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাপ দিচ্ছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে জান্তা বাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে পালিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এবং আশ্রিত রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশকে সব সময়ই মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মূলত এই এলাকা থেকেই এসেছে এবং প্রত্যাবাসন শুরু হলে তারা এখানেই ফিরে যাবে। ভবিষ্যতে যাই হউক না কেন এই এলাকা আরাকান আর্মির প্রভাব বলয়ে থাকবে। মিয়ানমারের সংকট ও সংঘাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের জন্যেও বিপদের কারণ হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। রাখাইনে চীন, ভারত, জাপান ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। চীন জানুয়ারি মাসে আরাকান আর্মি ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য বৈঠক করেছে।

ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় প্রতিনিধি আরাকান আর্মির সাথে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করছে। থাইল্যান্ডও সীমান্ত বাণিজ্য চলমান রাখতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সংকট সত্ত্বেও মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং আন্তর্জাতিক আইন কানুন মেনে সুআচরণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমন্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের চলমান সংকটের কারণে স্থানীয় জনগণ আতঙ্কে আছে এবং আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আচরণে আমাদের জলসীমায় এখনও বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় এই সংকটের সমাধান জরুরি। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুগ যুগ ধরে চলা রাখাইনে ও রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের ইতিহাস তুলে ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি এন ইউ জি ও আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মত বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অব.) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

রাজনৈতিক দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ও হাস্যকর বাস্তবতা



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক কোনো কর্মসূচি সেই অর্থে নেই বললেই চলে। তবু দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। এর প্রমাণ মেলে গ্রামাঞ্চলে পাড়া-মহল্লার মোড়ে কিংবা বাজারের চায়ের দোকানে। গেল রোজার ঈদের পূর্বে গ্রামের এক বাজারে গিয়ে দেখা গেল চায়ের দোকানের জমজমাট আড্ডা। কোনো আসন খালি না থাকায় পেছনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যা বোঝা গেল-তাতে সারাদিন মাঠে-ঘাটে কৃষি কাজ করা মানুষগুলো দেশের খবরাখবর শহুরে মানুষদের চেয়ে কম রাখেন না!

কোন দলের কোন নেতা কবে কী বলেছেন, কোন নায়িকার সংসার ভেঙে গেছে, ক্রিকেট খেলায় কোন দেশ কাকে হারিয়েছে ইত্যাদি বিতর্ক ছাপিয়ে পুতিন-বাইডেন কি বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধসহ গোটা বিশ্ব পরিস্থিতিই যেন তাদের মুখস্থ! এসব চায়ের স্টলেরও আবার দলীয় পরিচয় আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের জন্য পৃথক স্টল। আর অন্য দলগুলোর সমর্থকরা সবগুলোতে মিলেমিশে থাকেন। আড়াই দশক পূর্বে গ্রাম ছেড়ে আসার যে স্মৃতি তাতে গ্রামের মানুষের এমন রাজনৈতিক সচেতনতা আগে কখনও দেখিনি। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারে মানুষের মাঝে এই সচেতনতা এসেছে। চা-স্টলের এসব আড্ডা আবার অনেক সময় সহিংসতাতেও গড়ায়।

এতে করে প্রতীয়মান হচ্ছে-দেশে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় কর্মসূচি না থাকলেও সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনীতিমনস্কতা বিলীন হয়নি। বরং মিডিয়ার কল্যাণে দেশে-বিদেশে ঘটে যাওয়া সব খবরা-খবরই তারা রাখেন এবং নিজেদের চা-আড্ডায় স্ব-স্ব ভাবনা-চিন্তা উগড়েও দেন। সেখানে দলের সমর্থক হলেও অনেক সময় নিজ দলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতার অসংযত বক্তব্য নিয়েও সমালোচনায় ছাড়েন না অনেকে। ‘পাবলিক পার্লামেন্ট’ বলে বহুল শ্রুত যে টার্মটি ব্যবহার করা হয় তা বোধহয় গ্রামের এই চা-স্টলগুলির প্রতিচ্ছবি।

রাজনৈতিক দলগুলিতে রাজনীতিহীনতার মাঝেই আবারও এসেছে এক নির্বাচনী উপলক্ষ্য। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকারের সক্রিয় প্রতিষ্ঠান হতে না পারলেও উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে দলগুলির স্থানীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহের কমতি নেই। নির্বাচিত পদ-পদবি হলেই কিছু সুযোগ-সুবিধার অংশীদার হওয়া যায়, সেইসঙ্গে কর্মী-অনুসারীদের প্রতিপালনও করা যায়-যা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। এমন বাস্তবতার দৌড়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাও শামিল হয়েছেন উপজেলা নির্বাচনে। এমপি হওয়ার দৌড়ে যারা ছিটকে পড়েছিলেন, লজ্জাশরম ভেঙে আকাঙ্ক্ষার অবনমন ঘটিয়ে অনেকেই উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন।

ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে থাকা দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ‘হাইকমান্ড’ এর কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি এই নির্বাচনকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে উপজেলা নির্বাচনে দলের কিছু অনুশাসন মেনে চলার ‘কড়া’ নির্দেশনা শুনিয়েছেন। এই কড়া বার্তাটি হচ্ছে, এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের এই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়া।

গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাসীন দলের অন্দরে তো বটেই, গোটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই এ নিয়ে নানা শোরগোল চলছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও এমপিদের সঙ্গে হাইকমান্ডের অনানুষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত দেনদরবার ব্যাপকভাবেই চলছে। দলের ‘কঠোর অবস্থান’ এর সঙ্গে দ্বিমত ও স্বজনদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কায় কোনো কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনাও নাকি ঘটেছে!

রাজনৈতিক সূত্রের খবর অনুযায়ী, দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাকি এও বলেছেন যে, তার ছেলে চেয়ারম্যান না হলে এলাকার উন্নয়নই নাকি হবে না!

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশের অধিকাংশ জেলাতেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করে এমপি ও মন্ত্রীদের স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন এবং তাদের প্রার্থিতা বৈধ বলেও ঘোষিত হয়েছে। আমরা বিগত জাতীয় নির্বাচন ও তারও পূর্বে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন, এমনকি উপ-নির্বাচনগুলিতেও বহু নেতাকেই দলের সিদ্ধান্ত অমান্যের কারণে নোটিশ-বহিষ্কার, স্থায়ী বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে দেখেছি। আবার পরবর্তীতে দলের পক্ষ থেকে সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরাতেও দেখেছি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে বহিষ্কৃত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে ফের দলে ফেরানোর সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীদের মাঝে বিস্ময়ও পরিলক্ষিত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের হাই কমান্ড থেকে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ার ‘কড়া নির্দেশনা’ সাধারণ মানুষ, এমনকি মাঠের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ‘হাস্যকর’ প্রতিপন্ন হচ্ছে কিনা তাও বোধহয় ভেবে দেখা দরকার।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক কর্মসূচিহীন অবস্থায় কিছু সংবাদ সম্মেলন আর বিদেশি কুটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে সীমাবদ্ধ বিএনপি’র দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলের ৭৩ জনকে বহিষ্কার করেছে। তাদের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৮ জন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন ২১ জন। দলের হাই কমান্ডের অদূরদর্শী ও হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘদিন ধরে মাশুল গুণতে থাকা বিএনপি’র নেতা ও কর্মীরা যে অধৈর্য হয়েই দলীয় সিদ্ধান্তের থোরাই কেয়ার করছেন এও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না পেলে নেতা বা কর্মীদের মাঝে যে এক ধরনের রাজনীতিহীনতা ভর করেছে তা দলটির তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে টের পাওয়া যায়।

স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয়ে দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করা এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতারা স্ট্যান্ডবাজি আর অন্যদলের লেজুড় হতে গিয়ে বর্তমানে এসে এমন গুরুত্বহীন অবস্থায় পর্যবেশিত হয়েছে যে এই দলের নেতাদের কথা মানুষ কতটা গুরুত্ব দেন তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া দলটির অন্তর্কোন্দল এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে দলের বর্তমান প্রধান নিজেই হতাশ। তাহলে সেই দলের কর্মী ও সমর্থকরা কতটা দিশাহীন তা সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। সুতরাং উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের প্রবক্তা জেনারেল এরশাদের দলের কোনো ঠিকানাই পাওয়া যাচ্ছে না আসন্ন প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে।

এই অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলির হাই কমান্ডের ‘বিচার-বিবেচনা’ নিয়ে জনমানসে যে ‘হাস্যকর’ অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা মোটেও শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। যারা দলগুলির সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের এই আত্ম-উপলব্ধি অত্যন্ত জরুরি যে, দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছেন। গ্রামের সেই ‘পাবলিক পার্লামেন্ট’-গুলোতে প্রতিটি দলের ছোট-বড় সব নেতারই আমলনামার পোর্স্টমর্টেম হয়। ভালো ও সৎ কাজের প্রশংসার সঙ্গে বিতর্কিত ও জনস্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপের কারণে সংশ্লিষ্টদের পিণ্ডি চটকাতেও তারা দ্বিধা করেন না। সাধারণ মানুষের এসব উপলব্ধি ও মতকে যারা গুরুত্বহীন মনে করে তাদের আত্মচিন্তার প্রসার ঘটাতে তৎপর সেইসব ‘রাজনীতিকদের’ ভবিষ্যৎ যে মোটেও শুভ নয়, ইতিহাস তা বার বার প্রমাণ করেছে। তাই জনগণের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়ার কর্ম থেকে দূরদর্শী ও স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা রাজনীতিতে খুবই জরুরি।

;

এক জায়গায় সবাই একাকার!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলেবেলার এক বন্ধু এসেছিল আমাদের বাসায় বেড়াতে। বহুদিন আগে সে এই রাজধানীতে এসেছিল। তখন রাস্তাঘাট এত উঁচুনিচু ছিল না। তাই, বাসা চিনতে তার কষ্ট হতো না।

এবার দুপুর বেলা কমলাপুরে ট্রেন থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসার কাছাকাছি এসেও বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই, মোবাইল ফোনে বার বার কল দিচ্ছিল। অটোরকিশাওয়ালা বন্ধুটির অসহায়ত্ব বুঝে ফেলে বোধহয় মওকা খুঁজছিল কীভাবে তার যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করা যায়।

আড়াইশ’ টাকার ভাড়া মেটাতে গিয়ে খুচরা টাকা না থাকায় একটি এক হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সে আবার আমাকে কল দেওয়ার সময় অটোরকিশাওয়ালা একহাজার টাকার নোটটি নিয়ে বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে দ্রুত অটো চালিয়ে পালিয়ে যায়!

এই, থামো, থামো বলে বাকি টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

এরকম চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাকিং, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুর্নীতি আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ বাহিনীরা তদারকিতে দিনরাত ব্যস্ত রয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতিদমনকারী সংস্থার কার্যক্রম প্রচলিত রয়েছে। তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে আরো অনেক গোয়েন্দা উইং।

সব ধরনের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিদর্শন বিভাগ নামক শাখা রয়েছে। কিন্তু দমনকারীরাই যখন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়, তখন সমস্যা আরো জটিলতর রূপ ধারণ করে ফেলে।

সেগুলো পরিদর্শনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন শত শত পরিদর্শক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে নিজস্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে স্কুল, কলেজ পরিদর্শন শাখা-উপশাখা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শকগণ মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি তদারকি করে থাকেন। এজন্য তাদের ট্যুর প্রোগাম নির্ধারণ করা হয়।

সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে, এই ট্যুর প্রোগাম ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার ঘটছে। এসব ট্যুর প্রোগাম করতে যাওয়া বেশ লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় এটা বিক্রয় করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কারণ, এখানে ‘নাই’কে ‘হ্যাঁ’ বা মন্দটাকে ভালো বলে রিপোর্ট প্রদান করলেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। ফলে, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও চাকরি করা যায় অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি, ভবন, খেলার মাঠ, ল্যাবসুবিধা না থাকলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি মেলে। এসব অনুমতি মেলার পেছনের শক্তিকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন দুর্নীতিবাজ দায়িত্বশীলরা।

দেশে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বহুলাংশে পরিচালিত হচ্ছে, বড় বড় নির্মাণকাজগুলো। অনেক ঠিকাদারের ঠিকাদারি সনদ নেই। অনেকের সনদ আছে কিন্তু ভেজাল অথবা ধার করা। এখানে কাজ প্রাপ্তির আগে টাকা ভাগ-বাটোয়ার বিনিময়ে কাজ বাগানো হয়। অভিজ্ঞ একজনের নাম ভাঙিয়ে অনভিজ্ঞ আরেকজন বা বহুজন সেসব কাজের অংশীদার সেজে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে সরকারী অর্থের অপচয় ঘটিয়ে বাজে বাড়িয়ে দেবার আন্দোলনের নামে কাজ বন্ধ করে রাখেন।

এটা আমাদের দেশের নির্মাণ সরকারি কাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এজন্য জাপান বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের দেশে নির্মাণ কাজের খরচ বেশি গুণতে হচ্ছে।

এখনও নতুন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ সমস্যা টাকা ছাড়া সমাধান হবার নজির নেই। সরকারি চাকরি পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্তা হবার ঘটনা আমাদের দেশে স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এজন্য একজন বিসিএস ক্যাডারকেও প্রমোশনের জন্য ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেতে অবৈধ অর্থ খরচ করার নজির রয়েছে।

কিছুদিন আগে একজন এমপি ঘোষণা দিলেন, তার ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নির্বাচনি খরচের কথা! যেটা নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার কথা। কিন্তু নির্বাচনক কমিশন সেটাকে পাশ কাটিয়ে গেছে!

এসব লেখা নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিলো। তা হলো- র‌্যাবের সাবেক এক মহাপরিচালকের অর্থিক নিয়মের বিষয়টি।

পত্রিকাটিতে নানান অনিয়মসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট, স্থাপনা ক্রয় এবং একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির জন্য ছবিসহ নানা তথ্য।

পত্রিকাটি আবাদি জমিতে রিসোর্ট তৈরির জন্য লিখেছে, ‘কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্রমাগত চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ভয়ভীতিতে কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। গভীর গর্ত করে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে থাকায় তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি জমির মালিকরা।’

পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘শুধু তাই নয়, রিসোর্টটির নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি না হলেও এই রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে সাত কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে সরকারি খরচে।’

এছাড়া ওয়াসার সাবেক এমডি, কতিপয় সাবেক ভিসি, মহাপরিচালক ইত্যাদির দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর বেশ চাউর হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াতে খুবই ধীরগতি লক্ষণীয়।

এদেশে ছাত্র সংসদের নেতা হওয়া বেশ লাভজনক। তাই ছাত্রনেতা হবার দৌড়ে লবিং, তোয়াজ-তোষণ, তোড়জোর, নির্বাচনি প্রচার খরচের বাহুল্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে কি না তা জানা যায়নি। দেশের টেকনিক্যাল ও গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান কেউ কর্ণপাত করছেন না।

দেশের সিংহভাগ আমলা ও রাজনীতিবিদরা সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠান। স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়ার এত টাকা একজন সরকারি চাকুরে কীভাবে জোগাড় করেন!

একসময় রেলে ‘কালো বিড়াল’ ছিল বলে তৎকালীন মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই কালো বিড়ালের অস্তিত্ব ডিজিটাল টিকিটসহ গোটা রেল পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘কালো বিড়াল বনের মধ্যে বসতি গেড়েছে’!

কিন্তু আমার তো মনে হয়, ‘কালো বিড়াল’ দেশের সব জায়গায় ওঁৎ পেতে থেকে গোঁফে তা দিচ্ছে। তাদের গায়ে ঢিল ছোড়ার কেউ নেই। কারণ, এই পৃথিবীতে যে যত বড় অপরাধী, তার নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী। এর সঙ্গে থাকে সমকালীন রাজনৈতিক যোগাযোগ ও ভাগ-বাটোয়ারা অর্থনীতির যোগসাজশ।

পদবিধারী ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা’ চটকদার কথা বলে নানান কায়দায় জাল বিস্তার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের ভোগবিলাসের পথ প্রশস্ত করছেন। বিপদ আঁচ করে এসব মাফিয়া স্মার্টরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরো বেশি প্রচারে অর্থ খরচ করে ও মেগাদুর্নীতি শুরু করে দিয়েছেন।

দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’… আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘… কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে অবশ্যই সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের এ বিষয়ে বিশদভাবে অনুসন্ধানে নামা উচিত।

তিনি আরো বলেন, সরকারের যেকোনো পর্যায়েই চাকরি করুন না কেন, বৈধ উপায়ে কোনোভাবেই এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়।...যদি সত্যিই এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি বিস্ময়কর। ...তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান।’

অন্য এক পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে ...অনেকে ষড়যন্ত্র বা সন্দেহও প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কারো দুর্নীতি কিংবা রাজকীয় আবাসস্থল, রিসোর্ট, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার এসবকে তো আর বায়বীয় বলা যাবে না। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যার মাসিক বেতন এক লাখ টাকাও নয়, তিনি কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এত সম্পদের মালিক হলেন! এমন প্রশ্নের জবাব তো দেশের মানুষ চাইতেই পারে’।

সেদিন এক ভিক্ষুক প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দড়িতে পা বেঁধে রাজপথে বস্তা গায়ে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে থালা পেতে ভিক্ষা করছেন… নিকটস্থ এক দোকানি দীর্ঘসময় সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে তিনি রাজী হননি। কিন্তু একটি লাঠি হাতে নিয়ে তাড়া করতেই সেই ভিক্ষুক উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল!

এদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ ও মেগা-অপরাধীদের অমিল কোথায়! মিল একজায়গায় অবশ্যই আছে। তা হলো ভিক্ষুকেরা ভিক্ষার পয়সা দিয়ে চাঁদা দেয় মাস্তানদের। আর বড় অপরাধীরা বড় অংকের ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের নীতি-নির্ধারকদের।

আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট, সব দুর্নীতিবাজরাই এক জায়গায় সবাই একাকার হয়ে গেছেন! তা হলো, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন।

স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, চাঁদাবজি, পরিদর্শন, জালিয়াতি, চুরি, ভেজালকরণ ইত্যাদি যেন সবার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলবাজ অপরাধীরা সবসময় দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে ছাড় পাবার নিয়ম আমাদের কৃষ্টিতে নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে হেডলাইন সংবাদ বের হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তেও দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রচরিত হচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’ পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। তাই, এখন শুধু অপেক্ষা এসব মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখার।

*লেখক- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিনE-mail: [email protected]

;

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কী করা হচ্ছে



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন (অবঃ)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ সাতবছর ধরে মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা বহন করে চলছে। বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এ এ) এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যেকার সংঘর্ষে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং এর পাশাপাশি এ এ’র তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী (বিজিপি) এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এদেশে পালিয়ে আসা একটা নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে এবং এর ধারাবাহিকতায় তাদেরকে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম ও অন্যান্য প্রাশাসনিক কাজ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ২৮৫ জন সদস্যকে মিয়ানমারের জাহাজে নৌপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহনের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কে এন এফ) সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষের ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোন থেকে এই ধরনের ঘটনা আদৌ কাম্য নয়। বাংলাদেশের এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, পার্বত্য চত্তগ্রামে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাত পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিরসন করায় বেশ কয়েক দশক ধরে সেখানে শান্তি বিরাজ করছিল এর ফলে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন বেগবান হয়েছিল।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুনরায় এই এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলো এবং কক্সবাজার জেলার সাথে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে। কক্সবাজার ও এই অঞ্চল পর্যটনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এই অঞ্চলের বিশেষ ভুমিকা আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক শান্তি ফিরিয়ে আনা জরুরি।

কক্সবাজারে গত সাত বছর ধরে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার কার্যক্রম ও উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হলে ও সেখানে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের জন্য একটা সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম সেনাঅভিযানের আগে তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল এবং এর পেছনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে জাতিসংঘের তদন্তে উৎঘাটিত হয়েছে। ফেসবুক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২০২১ সালে রোহিঙ্গারা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মামলা করে। এখন জাতিসংঘের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) তথ্য থেকে প্রমানিত হয়েছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গোপনে ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারণা চালিয়েছিল।

তদন্তকারীদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী 'নিয়মতান্ত্রিক ও সমন্বিতভাবে' সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও ঘৃণা ছড়ানোর জন্য পরিকল্পিত উপাদান ছড়িয়েছিল। এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিষয়বস্তু প্রায়ই রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রচলিত বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে চালানো হয়। রোহিঙ্গারা সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ বা 'ইসলামীকরণের' মাধ্যমে মিয়ানমারের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেখানে জানানো হয় এবং তারা বার্মিজ জাতিগত বিশুদ্ধতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। এসব প্রচারণার কারণে রাখাইনের সাধারণ জনগণও রোহিঙ্গা নিধনে অংশ নিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারণার কারণে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুকে মারধর, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যা করা হয় ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এখনও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এই মনোভাব দূর করতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বা হয়েছে বলে জানা যায় নাই।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক ব্যবহার করে বুথিডং শহর জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টদরা জানায় যে, রাখাইন রাজ্যে জাতিগত বিভাজনের বীজ বপন করতে জান্তা রোহিঙ্গা রিক্রুটদেরকে রাখাইনদের বাড়িঘর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে বাধ্য করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতার আইন ঘোষণার পর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের আটক করে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে রোহিঙ্গাদের ফ্রন্টলাইনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যে গত বছরের নভেম্বরে এ এ’র অভিযান শুরুর পর থেকে বেশ কিছু শহর এবং অনেক সেনা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মার্চ মাসে বুথিডং, মংডু ও সিতওয়েতে এ এ’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা বিক্ষোভের আয়োজন করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভোলকার টার্ক সতর্ক করে জানিয়েছেন যে, রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই ও উত্তেজনা বেসামরিক জনগণের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলে অতীতের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্রুপ অব সেভেন (জি-সেভেন) দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯ এপ্রিল ইতালির ক্যাপ্রিতে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে সহিংসতা বন্ধ, নির্বিচারে আটক সব বন্দির মুক্তি এবং একটি অর্থবহ ও টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে সব অংশীজনের সঙ্গে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের আহ্বান জানায়। এটা একটা গঠনমূলক উদ্যোগ কিন্তু এর বাস্তবায়ন কবে হবে এবং রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে এর ভুমিকা তেমন স্পষ্ট নয়। আসিয়ান নেতৃবৃন্দ থাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মায়াওয়াদ্দি অঞ্চলে তীব্র সংঘর্ষের পর সাম্প্রতিক সংঘাত বৃদ্ধিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সংঘাতময় মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আসিয়ান মিয়ানমারের চলমান সঙ্কট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গা গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত এবং তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থমকে আছে। মিয়ানমারে চলমান সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করায় আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায় এবং তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সীমান্ত এলাকা ঘেঁষে আরাকান আর্মির তৎপরতার পাশাপাশি নতুন করে কেএনএফ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় সীমান্ত এলাকা অস্থির হয়ে উঠতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সীমান্তের অস্থিরতার সুযোগে কেএনএফ বেপরোয়া আচরণ করছে ও হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্যাঞ্চলের আশপাশের সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার কাজ করছে। অনেকের মতে এ এ’র সাথে কেএনএফের ভালো যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গেও কেএনএফের যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেএনএফসহ তিন দেশীয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সীমান্তে অস্থিরতার সুযোগ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও নিতে পারে। এর ফলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্ত্রের লেনদেন এবং পরস্পরকে সহায়তা করার বিষয়টিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। কেএনএফ পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকায় তৎপর, তারা ‘কুকিল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতের মণিপুর ও মিজোরাম এবং মিয়ানমারে রয়েছে। ওই দুই দেশেও তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা আছে। কেএনএফ ভারতের মণিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারে সক্রিয়। ওই সব এলাকায় চলমান অস্থিরতার প্রভাবে কেএনএফ ফের তৎপর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলমান প্রেক্ষাপটে সীমান্ত এলাকায় আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ সহনীয় অবস্থায় আনার জন্য পদক্ষেপ নেয়া জরুরি এবং গত সাত বছরে ও রোহিঙ্গাদের প্রতি সামরিক জান্তার মনভাব পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি যে রকমই হোক না কেন স্থানীয় জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রত্যাবাসনের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সকল পক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। রাখাইনের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু ও তা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে দারিদ্র পীড়িত জনগণের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় । অর্থনৈতিক মুক্তি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কের সুন্দর সমাধান হতে পারে। মিয়ানমার ও রাখাইনের রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবাইকে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন একটা সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে শক্তহাতে এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে হলে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে তাই এ বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;