হোচিমিন, নর্থ সাউথ এবং ‘আমরা’

  • ড. শামীম আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এত পরিমাণ শিক্ষার্থী হোচিমিন ইসলামকে অতিথি হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানিয়েছে, বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি নিজে কখনও নর্থ সাউথে পড়িনি, বরঞ্চ দেশের সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যতম সেরা প্রাইভেট ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। নর্থ সাউথে না পড়েও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার এক ধরনের শ্রদ্ধা কাজ করে। দেশের প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তারা একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বে হাতে গোণা দু'চারটা বাংলাদেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই কাতারে নর্থ সাউথ আর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গণ্য করা হয়। আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির মাস্টার্সকে ক্যানাডায় মাস্টার্সের সমমান গণ্য করা হয়নি, কিন্তু ব্র্যাকের পাবলিক হেলথের মাস্টার্সকে ক্যানাডার মাস্টার্সের সমমান গণ্য করা হয়েছিল। নর্থ সাউথের ডিগ্রিকেও পশ্চিমা বিশ্বে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয়।

এখন হোচিমিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আসতে না দিতে চাওয়া বিস্ময়কর হলেও তার প্রতিক্রিয়ায় নর্থ সাউথের বিরুদ্ধে মানুষের উল্লাস, গালিগালাজ আমাকে বিস্মিত করেছে। অর্ধেক মানুষ হোচিমিনকে মারতে চায়, অর্ধেক মানুষ মারতে চায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে।

বিজ্ঞাপন

খেয়াল করে দেখেছি জাতি হিসেবে আমরা কোন কিছু সমাধান করতে চাই না, আমাদের মূল আগ্রহ সবকিছু ভেঙেচুরে ধ্বংস করে ফেলায়। লালনের গান ভাল লাগে না, তার ভাস্কর্য ধ্বংস করে ফেলো, সরকার ভাল লাগে না, নিজেদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বাস পুড়িয়ে ফেলো। প্রতিবেশীকে ভাল লাগে না, তার পুকুরের মাছ বিষ ছড়িয়ে মেরে ফেলো। কর্মক্ষেত্রে কারও মতাদর্শ ভাল লাগে না, তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে ফেলো। নিজেরা খেলতে পারো না, অন্যের ব্যর্থতায় উৎসব করো। জীবনে সফলতা আনতে পারো না, নিরীহ পশু-পাখির উপর অত্যাচার করো।

চারিদিকে কেবল ধ্বংস আর ধ্বংস। হোচিমিনকে কেন্দ্র করে যে বিবাদ, তার প্রতিক্রিয়ায় এত সামাজিক মাধ্যমে শত শত পোস্ট দেখলাম, একটাতেও উল্লেখ করতে দেখলাম না, চলুন হোচিমিন আর প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসি। সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি। চিন্তার উন্মেষ ঘটাই।

আমি হোচিমিনের সাথে ফেসবুকে সংযুক্ত আছি অনেকদিন। তার জীবনদর্শন, বিশ্বাসকে আমি সম্মান জানাই। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজকরা যে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদেরও আমি স্বাগত জানাই। কই, কয়টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, টিভি চ্যানেল, পত্রিকা অফিস, করপোরেট হাউজ, হোচিমিনকে তাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়? হতে পারে কিছু, কিন্তু সবাই কি? যারা সমালোচনা করছেন নর্থ সাউথের, তাদের ক'জন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন?
যার যার ধর্ম তার তার কাছে এই যে একটা বিশ্বাস ছিল আমাদের সমাজে, যেটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস নিয়ে আমি থাকি, তোমারটা নিয়ে তুমি থাকো—এর চাইতে সাদাসিধে জীবনদর্শন আর কী হতে পারে? তা না, আমাদের সবাইকে নিজেদের বিশ্বাসে নিয়ে আসতে হবে। না হলে দা-কুমড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে কল্লা ফেলে দিতে হবে।

আমার সাথে আরেকজনের দ্বিমত মানেই আমাদের শত্রু হতে হবে? সবাইকেই ব্রাজিলের সাপোর্টার হতে হবে? কেউ আর্জেন্টিনা করবে না? সবাইকেই অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্টার হতে হবে? কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজ হবে না? কেউ আস্তিক, কেউ নাস্তিক; কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিস্টান—এটাই তো একটা আদর্শ সমাজের চিত্র হবার কথা। অন্যকে আঘাত না করে হোচিমিন কীভাবে তার জীবনকে গোছাবেন সেটা নিয়ে কেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতটা প্রতিক্রিয়াশীল হবে? তাদের এইসব প্রতিক্রিয়া কি চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জন্ম নিতে পারে?

মানুষের মনে একটা বিশ্বাস জন্মাতে, সেটি বেড়ে উঠতে ও গেড়ে বসতে বছরের পর বছর লাগে। সে শিশুকালে কোন পরিবেশে বড় হয়, স্কুলে কী শেখে, বাড়িতে কী শেখে, তার বাসায় রাতের খাবারের টেবিলে কী আলোচনা হয়, সেগুলো তার অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান; কিংবা ঘৃণা, বিতৃষ্ণা জন্মাতে ও বেড়ে তুলতে সাহায্য করে।

নর্থ সাউথের কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে যে অসহিষ্ণু আচরণ, তা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু কেবল নর্থ সাউথের চিত্র নয়; আপনি দেশের যে কোন সরকারি, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি যান, একই চিত্র দেখবেন। মূলত আমাদের সমাজে সর্বক্ষেত্রে যে বিভাজন; হয় এই পক্ষ নাহলে ওই পক্ষ, হয় কালো নাহলে শাদা—এই যে অবস্থান, এটি আমাদের আজকের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে এসেছে। যারা সরাসরি কারও বিরুদ্ধাচরণ করে না, তাদের বলা হয় সুবিধাবাদী! ডিপ্লোম্যাসিকে আমাদের সমাজে বিবেচনা করা হয় কুটিলতা হিসেবে!

হোচিমিন, যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনি গেছেন, তা আপনি ডিজার্ভ করেন না। একটি পতিত সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতার শিকার আপনি। পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের বন্ধু কম থাকে, পরিবার থাকে আরও ছোট, সামাজিক জীবন হয় প্রায় অদৃশ্য। ছোট থাকতে আমাদের শেখানো হয়েছে পশ্চিমারা স্বার্থপর, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, বুঝতে পারছি; এটিই আরাধ্য জীবন। মানুষ অন্যের জীবনে যত নাক গলানো বন্ধ করবে, সমাজ ততই সুন্দর হবে। আমাদের নাক আর আঙুলটা আমরা অন্যের কাছে ইজারা দিয়ে রাখি বলেই, এত হানাহানি।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পরিবর্তন আসবে। বড় ধরনের পরিবর্তনের আগে একটা ভাঙচুর হয়, আমাদের সমাজে এখন সেই কাঙ্ক্ষিত ভাঙচুরটা চলছে। হোচিমিনসহ অনেকেই সেই আরাধ্য পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবেন। সেই পথে বাধাও থাকবে অনেক। তবে একসময় সেইসব বাধা কেটে যাবে; অন্যের জীবন থেকে নিজের নাক ও আঙুল মানুষ নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনবে। কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু হবে। আমি বিশ্বাস করি অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় খুব শীঘ্রই হোচিমিনকে তাদের ক্যাম্পাসে বক্তা হিসেবে নিয়ে আসবেন। শুধু হোচিমিনই নন, যে কোন ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গে বিশ্বাসী মানুষ তার মত প্রকাশ করবে দ্বিধাহীনচিত্তে, এটি স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন দিয়ে দেওয়া দেশে খুব বড় কোন স্বপ্ন হওয়ার কথা নয়; তাই এর বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এই চলমান প্রক্রিয়ায় হোচিমিন আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজকরা আরও সাহসী হবেন এবং যারা কলম হাতে লিখে যান তারা সমাজে রক্ত না ঝরিয়ে, বিরোধিতা ও হানাহানি না বাড়িয়ে, যুক্তি, ভালোবাসা ও সমাধানের পথ বাতলাবেন, এই কামনা করি।