বিভাজন, তবু স্বস্তির আশা



কবির য়াহমদ
বিভাজন, তবু স্বস্তির আশা

বিভাজন, তবু স্বস্তির আশা

  • Font increase
  • Font Decrease

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দানের শেষ তারিখ। তফসিলের প্রথম সপ্তাহে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, নতুন নিবন্ধিত দল তৃণমূল বিএনপি দলীয় মনোনয়ন বিতরণ/বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। নামসর্বস্ব অনেকগুলো দল জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক বিষয়ক ইসির চিঠির জবাব দিয়েছে, আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিও দিয়েছে। বিএনপি ও সমমনা দল ও জোটগুলো ইসির চিঠির জবাব দেয়নি।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনোকিছুতে বিএনপির না থাকার প্রথম কারণ দলটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে আছে দলটি। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর দলটি আছে হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলনে। তার ওপর দলটির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা রয়েছেন কারাগারে, বাকিরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে। বিএনপি চলছে মূলত জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে। এরবাইরে আছে স্রেফ ঝটিকা মিছিল, চোরাগোপ্তা হামলা শেষে সেটা গণমাধ্যমে প্রেরণ।

দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি ও এর সমমনা দল আর জোটগুলো। আন্দোলন চলাকালে বিএনপির নেতৃত্ব শূন্যতার পাশাপাশি এখানে রয়েছে সরকারের কঠোর নীতি। প্রশাসনের ভূমিকা, আওয়ামী লীগের মাঠ দখলের ঘটনা এড়িয়ে বিএনপি পারেনি নিজেদের উপস্থিতি প্রমাণে। প্রবল নেতৃত্ব সংকটে থাকা দলটি এখন স্রেফ অপেক্ষা রয়েছে কাকতালীয় কিছু ঘটে যাওয়ার আশায়। আন্দোলনের এই তিন সপ্তাহে বিএনপির পক্ষে যায় এমন কিছু এখনো ঘটেনি। বরং হয়েছে তার উলটো। বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ দোহাই দিয়ে ইসি ঘোষণা করেছে নির্বাচনের তফসিল। আওয়ামী লীগ ও এর সমমনারা নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। বিএনপির আশা-ভরসা প্রতীক হয়ে ওঠা বিদেশি পক্ষগুলোর তৎপরতাও কমে গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বরং আগের চাইতে কম আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। ওখানকার যা আলোচনা সেটা একপ্রকার চর্বিত চর্বণ, ফলে দেশে গণমাধ্যমগুলোতেই মার্কিন অবস্থান আগের মতো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হলেও পাঠক সেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না।

আন্দোলন শুরুর পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, মির্জা আব্বাস, শামসুজ্জামান দুদুসহ বিএনপি কয়েকজন নেতা নাশকতা মামলাসহ অপর বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে চলে গেছেন আত্মগোপনে। গ্রেপ্তারের তালিকায় আগে থেকেই ছিলেন আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ আরও কয়েকজন নেতা। কিন্তু বিএনপির মতো বিশাল দল শীর্ষ কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারে নেতৃত্ব সংকটে পড়ে যায়। আন্দোলনের নেতৃত্ব এককভাবে চলে যায় রুহুল কবীর রিজভীর হাতে। তার বিরুদ্ধে মামলা এবং তিনি গ্রেপ্তার আতংকে থাকলেও তাকে ধরতে প্রশাসনের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। তিনি আগের মতো প্রেস বিজ্ঞপ্তি আর সংবাদ সম্মেলন সর্বস্ব আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির আগের আন্দোলনের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, আগেও তিনি এমনভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। অন্য অর্থে আবার এও বলা যায়, সরকার রুহুল কবীর রিজভীকে বড়ধরনের হুমকি বলে মনে করছে না, ফলে তার প্রতি অন্যদের মতো কঠোর নীতি দৃশ্যমান নয়।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপির সাফল্যের ইতিহাস নেই। তবু বিএনপির আন্দোলন চলমান। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে দাবিতে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া দলটির গত্যন্তরও নেই। আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এবার বিএনপির ‘বড় ভরসা’ হয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ যে বিদেশি শক্তিগুলো, তারাও শেষ মুহূর্তে এসে বিএনপির সঙ্গে আগের মতো আছে কিনা এনিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হুট করে ছুটিতে গেছেন গত কয়েক মাস ধরে নির্বাচন নিয়ে অতি-তৎপর ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। যদিও তিনি পূর্বনির্ধারিত ছুটিতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন, তবে তার এই ছুটি বিএনপির মাঠ-পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকটাই হতাশ করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আলোচিত হয় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। জাতিসংঘ ও মার্কিন সেই ব্রিফিংয়ে বিএনপির পক্ষে নিয়মিত প্রশ্ন করে থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারি। আছেন আরও কয়েকজন। তাদের নিয়মিত প্রশ্নবাণে উত্তর দিতে হয় মার্কিন ও জাতিসংঘের মুখপাত্রদের। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ও  প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল প্রতিবারই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে বলছেন, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোন দল-সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন নেই। তাদের লক্ষ্য একটাই বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সাংবাদিকেরা তাদেরকে বারবার টানছেন বলে তারা একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, এই ধরনের প্রশ্নকে তারা স্বাগত জানান, কিন্তু এনিয়ে তারা মন্তব্য করবেন না। বিএনপির নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও এর বৈধতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বাড়াবে কিনা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল ম্যাথু মিলার বলেছেন, আমি আগেও বলেছি, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হোক, সবসময় এটাই আমাদের চাওয়া। কালও মিলার বলেছেন, নির্বাচন প্রসঙ্গে তাকে যতই টানা হোক না কেন তিনি এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবেন। নির্দিষ্ট দল ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সকল প্রশ্নে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাই বলছেন।

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খানিক অবস্থান পরিবর্তন সত্ত্বেও বিএনপি তাদের আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রেখেছে। সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের চারদিনই রাখছে কর্মসূচি, মাঝে একদিন থাকছে বিরতি। এই কর্মসূচিগুলো পালিত হচ্ছে মিনিট খানেকের ঝটিকা মিছিল, কয়েক মিনিটের পিকেটিং আর বাসে আগুন দিয়ে তার ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ পর্যন্তই। এভাবে কি আন্দোলন চলে? এভাবে কি সফল হওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়!

এটা পরিষ্কার যে, আন্দোলনে থেকে অর্জনের কিছু নেই বিএনপির। এদিকে, আন্দোলন সত্ত্বেও একতরফাভাবে হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই একপাক্ষিক নির্বাচন দিয়েও আবার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো যাবে না। বিপুল সংখ্যক নাগরিক ভোট থেকে বিরত থাকলে সেই নির্বাচনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠবে। যদিও এই প্রশ্ন নিয়েও আগামীর সরকার তার মেয়াদ পূরণ করে ফেলবে, এতে দেশের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে, রাজনৈতিক সহনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেশিরভাগ সাধারণ নাগরিক এই পন্থা শোভন মনে করছে না।

উদ্ভূত পরিস্থিতি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইঙ্গিত না দিলেও ধারণা করা হচ্ছে বরফ ক্রমে গলছে। গতকাল সোমবার নিজের দপ্তরে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলে পুনঃতফসিল দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে আসার কথা জানাতে হবে।’  বিএনপি নির্বাচনে আসার কথা জানালে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সেটা বিবেচনা করবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে আমার জানামতে, ওনারা আসছিলেন। ওই নির্বাচনে কিন্তু ওনাদের জন্য একটু স্পেস তৈরি করা হয়েছিল। যেভাবে আইনে আছে, আমরা সেভাবেই করব।’ এরবাইরে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি গত রোববার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পুনঃতফসিলের অনুরোধ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার এই প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।

আন্দোলনে, নেতৃত্ব সংকটে, নেতারা আত্মগোপনে থাকায় এই মহূর্তে বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি নেই। নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সক্রিয় নেতাও নেই এখন দলটির। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানি ছিল, কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটর অসুস্থ ও তার আইনজীবীরা এক সপ্তাহ সময় প্রার্থনা করায় শুনানি হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে আসছে সপ্তাহে জামিনসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে নতুন কোন সিদ্ধান্ত আসতেও পারে।

মাঠের রাজনীতি, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশনারের ইঙ্গিত, রওশনের অনুরোধকে রাষ্ট্রপতির ইতিবাচকভাবে গ্রহণ, মির্জা ফখরুলের জামিন নিয়ে নানা ঘটনা বলছে, আসছে সপ্তাহ হতে যাচ্ছে নতুন এবং আশাবাদী হওয়ার মতো। বিভাজনের রাজনীতি আশাবাদকে উলটপালট করে দেয় সত্য, তবে কথায় আছে—‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই,পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’! আমাদের সামনে ‘অমূল্য রতন’ নাই ঠিক, তবে যা আছে তার মূল্য কিন্তু কম নয়!

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান: হাতে পাঁজি মঙ্গলবার



অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান, লেখক ও গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
ছবি: অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

ছবি: অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

  • Font increase
  • Font Decrease

গোঁয়ার্তুমি না করে, কোটা সংস্কার আন্দোলন কতদূর যেতে পারে সুচিন্তিতভাবে সেটা আওয়ামী লীগ ও সরকারের আগেই বোঝা উচিত ছিল। সরকারের প্রতি একশ্রেণির মানুষের ক্ষোভ আছে, ফলে এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আন্দোলন দমনের বিষয়ে 'অতিআস্থা' নামক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া সেটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না। এ বিষয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, আমি নিজেও ছিলাম তারমধ্যে একজন। কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা মানসিক সমর্থন ছিল। এই নির্দোষ সমর্থনটা যতটা না ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি, তারচেয়ে বেশি সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও অনাস্থার জায়গা থেকে উত্থিত।

আওয়ামীবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনকারীদের ব্যানারকে পূঁজি করে সরকারবিরোধী নাশকতা করবে সেটা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধিমান হবার দরকার ছিল না। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা, হেফাজতের সমাবেশ, নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাই বলে। আগের ওসব সরকারবিরোধী ইভেন্টগুলিতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারবিরোধী সংগঠনগুলির বপু যতো বিশাল‌ই হোক-না-কেন তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোটায়। এদের অবস্থা ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো, অন্যের ঘাড়ের উপরে বসে ছাড়া স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা এরা রাখে না। ফলে সাংগঠনিক ক্ষমতাহীন এসব সংগঠনসমূহ ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ নিয়েছে। এরা যা করেছে তা ঠিক করেনি, খুবই অন্যায় করেছে।
সরকারবিরোধী কাজ করতে গিয়ে এরা রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়েছে। রাষ্ট্রের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তবে আওয়ামী লীগ‌ও এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না; কারণ, এই আন্দোলনকে এই পর্যায় পর্যন্ত গড়াবার ব্যর্থতার দায় তাদের আছে। এটা কোনোভাবেই এই পর্যায় পর্যন্ত আসার কথা নয়। 'হাতে পাঁজি মঙ্গলবার' বাগধারার অর্থ, সমাধানের সহজ পথ থাকতে জটিল পথের অবতারণা করা। আওয়ামী লীগ সেই কাজটাই করেছে। এই সমস্যার সমাধান সহজ ছিল যা অঙ্কুরেই সমাধান করা যেতো।

সরকার হয়তো হেফাজতের আন্দোলন দমনের অভিজ্ঞতা থেকে এই আন্দোলন দমনে এক‌ই কৌশল প্রয়োগ করে সফল হবার কথা ভেবেছিল। কিন্তু হেফাজতের আন্দোলন আর এই আন্দোলন যে এক নয়, সেই সহজ হিসাবটা বোঝেনি। হেফাজতের আন্দোলনের সময় গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তি যুগপৎভাবে মাঠে ছিল। তারা জানপ্রাণ দিয়ে সকল অপপ্রচার, অপকৌশল, স্যাবোটাজ ইত্যাদি প্রতিহত করেছিল। সে সময়ে সাইবার যুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কোনোভাবেই যুত করে উঠতে পারেনি।

গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে সারাপৃথিবীর বাঙালি সমাজ তাদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। ফলে অনলাইন, অফলাইন ও রাজপথে জনমত ছিল সরকারের পক্ষে। স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য। গণজাগরণ মঞ্চকেও নানা ছুতোয়, নানা বাহানায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ফলে আজ সেই সময়ের অধিকাংশ সাইবার যোদ্ধা‌ই এই সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে লেখেনি, তারা নীরব ছিল। এবার সাইবার জগত চলে গিয়েছে আওয়ামীবিরোধীদের দখলে। সে সময়ে যে ইন্টারনেট ও সাইবার জগত ছিল আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ, নিজেদের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকদের আপন না ভাবার ব্যর্থতায় এবার তা হয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য অভিশাপ। এ কারণে উপায়ন্তর না পেয়ে সরকারকে ইন্টারনেট বন্ধ করে পিঠ রক্ষা করতে হয়েছে। এভাবে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে সরকার দেশের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে। এই কয়েকদিনে দেশের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুদ্ধের সময়ের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বেশি বলে প্রতীয়মান। আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকরা দেশের স্থিতিশীলতা ও সম্পদ রক্ষায় যে কতোটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে সেটা এবার প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমার মতে, আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো সময়োপযোগী করা উচিত। বর্তমান সময়ে 'অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখক লীগ' জরুরি ভিত্তিতে গঠন করা উচিত। রাজপথের আন্দোলনের চেয়ে অনলাইনের আন্দোলন এখন বেশি জরুরি। তাছাড়া অনলাইনের এক্টিভিস্টরা যে রাজপথেও অগ্রগামী থাকে, গণজাগরণ মঞ্চ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

গণজাগরণ মঞ্চ চলার সময়ে রাস্তা বন্ধ করার জন্য যে রোড-ব্লকগুলো দেওয়া হয়েছিল সেখানে লেখা ছিল 'রাস্তা বন্ধ, জাতি সংস্কারের কাজ চলছে'। গণজাগরণ মঞ্চ জাতি গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্লিয়ার মেসেজ সম্বলিত 'ব্ল্যাংক চেক' দিয়েছিল। মেসেজটা ছিল- এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের, কখনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের হবে না। আওয়ামী লীগ সেই ব্ল্যাংক চেককে কাজে লাগাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের পক্ষে যুদ্ধ করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধ করে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের এই আওয়ামী লীগের সময়েই জীবন বাঁচাতে দেশের বাইরে গিয়ে এসাইলাম নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। যারা দেশে আছেন তারাও সবাই অবমূল্যায়িত। অথচ রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় সাপোর্ট দেবার জন্য এনাম মেডিকেলের মালিককে কেবিনেটে স্থান দেওয়া হয়েছিল।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরাও সাভারে গিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমি নিজেই একটানা তিনদিন সাভারে ছিলাম। যে রক্তক্ষয়ী পথে গিয়ে কোটা সমস্যার সমাধান হলো এমন সাংঘর্ষিক ও রক্তক্ষয়ী পথ কাম্য ছিল না। কাম্য ছিল সহজ সমাধান এবং সেটা সম্ভবও ছিল। এখন যেভাবে সমাধান হলো তাতে সমাধানের সাথে আরও কিছু ক্ষোভ, হতাশা, আশঙ্কা, অনাস্থা, অবিশ্বাস ইত্যাদি যোগ হয়ে সমাধান হলো। এগুলো সহজে নির্মূল হবে না, জনমনে থেকে যাবে। পরবর্তীতে ছোটখাটো কোনো সমস্যা দেখা দিলেও সেখানে এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সমস্যা সমাধান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। মুখে যা-ই বলুক-না-কেন আওয়ামী লীগের কপালেও চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে।

যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে আওয়ামী লীগের অন্ন সংস্থান হয়, অতিআস্থায় একগুঁয়েমি করে সেটাকে এমন রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সমাধান করলো যে, নতুন প্রজন্মের কাছে সেই মুক্তিযুদ্ধ‌ই কিছুটা হলেও সম্ভ্রম হারাল। ফলে শুধু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের অন্ন জুটবে বলে মনে হয় না। এ কারণে আওয়ামী লীগের আমলানির্ভরতা আরও বাড়বে। গণমানুষের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া একটি পুরানো ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের জন্য এটা একটা বড়ো নৈতিক পরাজয়। যদিও ইতোপূর্বেই তাদের এই নৈতিক পরাজয় হয়ে গেছে, এখন সেটার পুরুত্ব অবিচ্ছেদ্য স্তরে চলে গেলো।

আওয়ামী লীগ একটা অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল, উপরন্তু তারা সরকারে আছে। যে নাশকতাগুলো করা হয়েছে সেগুলোর তথ্য কেন আগে থেকেই সরকার পেলো না, এটি খানিকটা বিস্ময়ের। সুযোগসন্ধানী ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুদেরকে বলি- এভাবে আন্দোলন করে সফল হ‌ওয়া যায় না। এ মানুষগুলোর মৃত্যুর দায় আপনাদেরও। এটি প্রতীয়মান যে, বিতর্কিত ইশ্যুগুলিকে সরাসরি নিজেরা না করে আদালতের মাধ্যমে করানো আওয়ামী লীগের একটি কৌশল। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ছিল, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ‌ই আদালতের মাধ্যমে কবর দিয়েছে। কোটা ইশ্যুতেও আওয়ামী লীগ একই কৌশল নিয়েছিল। কোটা নির্ধারণের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। নির্বাহী বিভাগ থেকে আইন বিভাগ হয়ে এটা বিচার বিভাগে যাবার কথা। আওয়ামী লীগ আগেই সেটা বিচার বিভাগের হাতে তুলে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। ফলে কোটা আন্দোলন শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের ভাবটা এমন যেন- আমি কিছু জানি না, ভাজা মাছটা কেমনে উল্টে খেতে হয় তাও জানি না, আদালত সব জানে। যদিও সরকার চাইলে ৩৬৫ দিনের যে-কোনো দিন, যে-কোনো সময় আদালত বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই করা উচিত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধপ্রীতি প্রমাণের বহু অপশন আছে। আওয়ামী লীগ অনেককিছুই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের অনুভূতি ছুঁয়ে মনে দাগ কাটতে পারে এমনভাবে কাজগুলো করতে পারেনি। নিজেদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর নামে এতো বেশি কিছু করে ফেলেছে যে, মানুষ তাতে ত্যক্তবিরক্ত হয়েছে, ফলে অন্য সবকিছু এই বিরক্তির নিচে চাপা পড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা- ইত্যাদি ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো সব অর্জনকে খেয়ে ফেলেছে। এই 'না-পারার' ব্যর্থতা ঢাকতে দলটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা অতিরিক্ত রেখে মুক্তিযুদ্ধপ্রীতি প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই সমাধানটা আওয়ামী লীগের জন্য নাকে খত দিয়ে নিজেদের ফেলানো থুথু নিজেদের জিহ্বা দিয়ে চেটে খাবার মতো হয়ে গেলো।

বাকশাল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এক সর্বনাশ হয়েছিল, কোটা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বের কারণে এবার আরেক ক্ষতি হলো। সেইসাথে এ দেশের সেরা অর্জন, সেরা ত্যাগ একাত্তরের অর্জন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা প্রশ্নসাপেক্ষ হলো। আওয়ামী লীগের এই জেদ, নতুন প্রজন্মের কাছে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার নামকে কিছুটা হলেও এক‌ই কাতারে নামিয়ে আনতে ভূমিকা রাখল। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাকে এমন অশ্রদ্ধার জায়গায় আনার দায় আওয়ামী লীগের আছে। কোটা সংস্কারের মতো একটি 'তিল' আওয়ামী লীগের জিদ, গোঁয়ার্তুমি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার কারণে 'তাল' হয়ে তালগোল পাকিয়েছে। এরপর যে সমাধান হয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগ বুক চিতিয়ে যেভাবে কৃতিত্ব দাবি করছে তা বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্ব, বিবেকহীন ঔদ্ধত্য ও নির্লজ্জতা। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। অনেকগুলো তরুণ তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দায় কে নেবে? দায় নিলেই-বা কি! যে গেছে সে গেছে, যার গেছে সে বুঝতেছে কষ্ট কাকে বলে!

এই দেশে, যে ছাত্র আন্দোলনের ফসল ভাষা আন্দোলন এবং তার‌ই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, সেই ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার রাজপথ। যে তরুণ সমাজ স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসিত ভূখণ্ডে রক্ত দিয়েছে, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করার জন্য রক্ত দিয়েছে, সেই তরুণ সমাজকে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে একটা চাকরির জন্য রক্ত দিতে হচ্ছে! ধিক্ দেশের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

অতিআত্মবিশ্বাসে আহাম্মকি করে নিজেদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের কোন নেতারা মাঠে নামিয়েছিল জানি না। তাদের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে মানুষ বিরক্ত হলো, নিজেদের সহযোগী সংগঠনটির নেতাকর্মীদের‌ও প্রাণ গেলো, খালি হলো অনেক মায়ের বুক। কেউ কারো না, যে যায় সে যায়‌ই। পরে যদিও ছাত্রলীগকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে কিন্তু তার আগেই এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির ভয়াবহরকম ক্ষতি হয়ে গেছে। ফলে ছাত্রলীগ থেকে দল ত্যাগের হিড়িক‌ও লক্ষ করা গেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির রুম ভাঙচুর হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের কোমর অনেকটাই ভেঙে গেলো। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার পথ কঠিন হয়ে গেলো। ছাত্র সংগঠন হয়েও এখন ছাত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের ঐতিহ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হলো।

তৃণমূল পর্যায়ে সম্পৃক্ততাহীন লোকজনকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নৈকট্য এবং নেত্রী-জিকির কোটায় নেতা বানানোর খেসারত তো দিতে হবে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বগুলো তার‌ই ফল। বর্তমান নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলল। যে রক্তাক্ত ইতিহাস তৈরি করল তা দলটির জন্য কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। বর্তমান নেতৃত্ব আগামীর নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ রেখে গেলো। জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে দুর্নীতিবাজদের দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার একজন দুর্নীতিবাজের প্রাণ‌ও নিতে পারেনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে থাকা তরুণদের তাজা প্রাণ কেড়ে নিতে পেরেছে। কোটা সংস্কারের দাবি করা তরুণটি আওয়ামী লীগের শত্রু, কিন্তু দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়া দুর্নীতিবাজরা আওয়ামী লীগের শত্রু নয়। তারা আঁচলের তলে বেড়ে ওঠে।

সরকারি চাকরির বাইরে কর্মনিশ্চয়তা সৃষ্টি করুন। প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পাচ্ছে গড়ে ৩ হাজারের‌ও কম, যা মাত্র ০.১৪%, বাকি থেকে যাচ্ছে ৯৯.৮৬%। যে তরুণ আজ গবেষণা করবে, সমাজ গড়বে সেই তরুণ আজ চাকরির জন্য জীবন দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে দেশের এ অবস্থার জন্য এই তরুণ সমাজ দায়ী নয়। এ দায় আপনাদের। আপনারা স্বাধীনতার বেনিফিসিয়ারি, ওই তরুণ সমাজ নয়। স্বাধীন ভূখণ্ড ছাড়া সে আর কিছু পায়নি। একটা জীবন পেয়েছিল সেটাও বিলিয়ে দিয়ে গেলো!

;

সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এতো মৃত্যু, এতো রক্ত, এতো ধ্বংস, এতো তাণ্ডবের সম্মিলিত চেহারাটা বড় বীভৎস এবং করুণ। মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দগ্ধ ও রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশবাসীর তাজা স্মৃতি ছুঁয়ে রয়েছে আতঙ্ক, ভীতি ও উদ্বেগ, যা ক্রমশ স্বস্তির দেখা পেলেও একটি প্রশ্ন সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই সংঘাতময় নজিরবিহীন নৈরাজ্যে কার জয় হলো? কার হলো পরাজয়?

সহজে বা এককথায় উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, নৈরাজ্য এক বিকারগ্রস্ত পরিস্থিতির নাম। যুক্তি ও বুদ্ধি কাজ করে না নৈরাজ্যবাদী সংঘাতে। আর সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া। দুষ্টচক্রের মতো বাড়তে থাকে। এক সংঘাত আরেক সংঘাতকে ডেকে আনে। সংঘাতে আচ্ছন্ন করে ফেলে সবকিছু।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের কারণে কোনও কাজ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন আর স্বরূপে স্থির থাকতে পারে না। পরিণত হয় ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিটি ধারাও নিয়মের সীমারেখার ভেতর থাকতে পারে না। চলে যায় নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলাফল সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অগণিত মৃত্যু, সীমাহীন রক্তপাত। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন। ক্ষতির মাত্রা কল্পনার চেয়েও অধিক।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে একটা লাগামছাড়া আক্রোশ সওয়ার হয়। ক্ষোভ ও হিংসা দখল করে পুরো পরিস্থিতি। উন্মত্ততা তেড়ে আসে বন্য পশুর মতো। গণউন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞে। কেন এমন হয়েছিল কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে? হয়তো কখনও জানা যাবে সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা করা হলে। হয়তো এর রাজনৈতিক কার্যকারণও জানা যাবে। কিন্তু মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতির পূরণ সম্ভব হবে না কোনোও দিনও। হয়তো ধ্বংসের পর নির্মাণ হবে। মৃত্যুর পর নবজন্ম হবে। তথাপি সহজে মুছবে না দগদগে ক্ষতির চিহ্ন ও রেশ।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের সংগঠিত রূপ হলো গণউন্মত্ততা। প্রায়ই যে ছেলেধরা বা কথিত চোর সন্দেহে অবলীলাক্রমে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়, তা আসলে এক ধরনের গণউন্মত্ততা, যা সংঘাতময় মনোবৃত্তি ও নৈরাজ্যজনক মানসিকতার ভিন্নধর্মী বহিঃপ্রকাশ। সমাজ ও মানুষ অস্থিরতার কবলে নিপতিত হলে বিস্ফোরণ ঘটে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।

সেজন্যই সমাজে শান্তি, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা জরুরি। আর শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক সমাজের স্বার্থে ও মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গণউন্মত্ততা বড়ই বিপদজনক। এর প্রকৃত কার্যকারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার। নচেৎ বিষফোঁড়া হয়ে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে ফেটে বের হবে এবং সংঘাত ও নৈরাজ্যের ধারাকে পুষ্ট করতে থাকবে অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, যার শুরু থাকলেও শেষ থাকবে না। বরং এর থেকে জন্ম নেবে আরও সংঘাত। আরও নৈরাজ্য। আরও তাণ্ডব ও উন্মত্ততা।

মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের ধ্বংস-চিহ্নিত ও রক্ত-মথিত ঘটনাপ্রবাহে সংঘাত ছিল। নৈরাজ্য ছিল। তাণ্ডব ছিল। গণউন্মত্ততা ছিল। সবই ছিল। শুধু অনুপস্থিত ছিল বিবেক, যুক্তি, মানবিকতা, সহনশীলতা। যার পরিণতি ভোগ করতে হলো পুরো দেশ ও জাতিকে। প্রচুর মূল্য দিয়ে এবং শঙ্কার কৃষ্ণপ্রহর পেরিয়ে মানুষকে ফিরতে হয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।

বিশ্বের দেশে দেশে সংঘাত এক ভয়ঙ্কর বিপদের নাম। রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক বিভেদে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, জাতিগত দ্বন্দ্বে, মতাদর্শিক মতপার্থক্যে বহু দেশ সংঘাতে নিমজ্জিত হয়ে পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংঘাত-কবলিত সমাজ হচ্ছে রক্তাক্ত, মানুষ হচ্ছে বিপন্ন।

ক্ষুদ্র আয়তনে বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংঘাত কতো মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ মধ্য জুলাইয়ের নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ। এই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সংঘাত-মুক্তির পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক। বিভেদ ও বিতর্কের গতিপথ আর যেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সংঘাতকে সংঘাত দিয়ে নয়, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে উত্তীর্ণ করার কৌশল অবলম্বন করাই সুবিবেচনার কাজ। প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে ঠেলে দিয়ে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাবে কাছে টেনেই বরং সঙ্কট সমাধান ও সঙ্কট প্রশমন করা লাভজনক, শান্তিপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদ্ধতি।

উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশকে সামনে এগুতে হচ্ছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। লড়তে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, চাকরি প্রাপ্তির অনিয়ম ও নানা রকমের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই যাত্রাপথ মসৃণ নয়। এতে যদি সংঘাতের দৈত্য এসে হানা দেয় তাহলে কষ্টার্জিত সকল অর্জনই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অগ্রগামী বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকবে।

এমন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে কার লাভ হবে? কে জিতবে? কে হারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের আপামর মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। আসলে সংঘাত, নৈরাজ্য, উন্মত্ততা পরিশেষে কাউকেই লাভবান করতে পারে না। এক অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো সবাইকে এক সমাপ্তিহীন ধ্বংসের গহ্বরে ফেলে দিতে পারে শুধু

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

উদারবাদিতার সীমা



সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার আগে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনুষ্যত্বের দুর্দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতাটিতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” তাঁর চোখ সেদিন অশ্রুসিক্ত ছিল, জানিয়েছেন তিনি। সেটা ১৯৩১-এর ঘটনা। তার পরে প্রায় এক শ’ বছর কেটে গেছে কিন্তু মনুষ্যত্বের দুর্গতি মোটেই কমেনি। ১৯৩৯ আবার একটি বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরাই ঘটিয়েছে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে; তারপরে তৃতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ পীড়ন লুণ্ঠন অসংখ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। তারা আজ কেবল যে বায়ু ও আলোকে বিপন্ন করছে তা-ই নয়, পানিও দিয়েছে নষ্ট করে, ধরিত্রীকে তপ্ত করেছে দুঃসহ রূপে। খবর বলছে ২০২৩ সালে গ্রীষ্ম ছিল গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ; এবং শঙ্কা নাকি এই রকমের যে চলতি বছরের উষ্ণতা ওই রেকর্ডও ভেঙে ফেলবে।

রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটা ছিল ভগবানের কাছে। এযুগে ইহজাগতিকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রশ্ন নিয়ে মানুষ এখন আর ভগবানের দ্বারস্থ হয় না, জিজ্ঞাসা করে মানুষকেই। এ ক্ষেত্রে মানুষই এখন ভগবানের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। মানুষের নাকি অনেক ক্ষমতা; বিশেষ করে এই জন্য যে তারা ভোট দিতে পারে, ভোট দিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। কিন্তু পছন্দ করবার মতো সক্ষমতা মানুষের আছে কী? গণতন্ত্রের জন্য ‘আদর্শ’ ভূমি আমেরিকা; সেখানে একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে; জনগণ পুনরায় ক্ষমতা পাবে পছন্দের মানুষটিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাবার। কিন্তু তারা কাকে বসাবে? হয় বাইডেনকে নয়তো ট্রাম্পকে। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কতটা? সে তো উনিশ বিশের।

ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তাদের অবস্থান দেখলে তো বোঝা যায় যে উনিশ বিশের নয়, সাড়ে উনিশ ও বিশের বটে। ট্রাম্প বলেছেন তিনি নির্বাচিত না হলে আমেরিকাই থাকবে না; অর্থাৎ যে বর্ণবাদী আমেরিকা একদা কলম্বাসের ইউরোপীয় সহযোগীরা তাদের জবরদখল-করা ভূমিতে কায়েম করেছিল সেটা থাকবে না। ট্রাম্পের আওয়াজটা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের শাসন যদি টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে আমাকে ভোট দাও। কথাটা বাইডেন ঠিক ওই ভাবে বলেন না, কিন্তু তিনিও যে শ্বেতাঙ্গ-শাসনই অক্ষুন্ন রাখতে চান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত যে ভারত, সেখানেও তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, দুটি ভিন্ন দলের কাঁধে ভর দিয়ে, তবে উন্নয়নের ডঙ্কা বাজিয়ে নয়, যেটা আগেরবার বাজিয়ে ছিলেন; এবার সেটা করেননি কারণ উন্নয়ন তেমন ঘটাতে পারেননি, তার চেয়ে সহজ এবং তাঁর ধারণা অধিক কার্যকর পথ হচ্ছে তিনি না এলে মুসলমানরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, দেশের ধনসম্পত্তি সব দখল করে নেবে ভৌতিক এই ভয়টাকে প্রচার করে।

বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মোটামুটি পৃথিবী জুড়েই অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে তো দেখলাম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধেই। স্থানীয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে দলের লোকদের মধ্যেই। নির্বাচনে বিজয়ীরা যা খরচ করেন তার বহুগুণ তাঁরা যে তুলে নেবেন সেটা তাঁরা জানেন আমরাও জানি; স্থানীয় নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই কী ঘটেছে সে সম্পর্কে ঠাকুরগাঁওয়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা ঠিকই জানিয়েছেন : “ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারাদিন দুই-তিনটা ভোট পড়েছে, বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজার” [আজকের পত্রিকা, ১৭ মে]। ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজারের ভেতর একটি মাত্র শূন্যের ব্যবধান বৈকি; ব্যাপারটাও দাঁড়াচ্ছে শূন্য কুম্ভের মতোই। শূন্য কুম্ভের আওয়াজ বেশি, কারণ ভেতরের জিনিস কম।

মোক্ষম সত্যটা অবশ্য প্রকাশ পেয়েছে একটি দৈনিকের শিরোনামে : “যেখানে এক আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি”। সংবাদে-উল্লেখিত মিলের জায়গাগুলো হলো উপজেলা নির্বাচনে (ক) দলীয় সিদ্ধান্ত মানছে না দুই দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারা, (খ) নির্দেশনা অমান্য করার শাস্তি হয়নি সরকারি দলের কারও; এবং (গ) বিএনপি বহিষ্কারের পথে হাঁটলেও পাল্টা দায় দিচ্ছেন বহিষ্কৃত নেতারা”। মূল ঐক্যটা যেখানে তার কথা অবশ্য এই সংবাদ-তথ্যে নেই; সেটা হলো পুঁজিবাদী উন্নয়নে দীক্ষা। এক্ষেত্রে উভয় দলই সহযাত্রী, তাঁরা সেই উন্নয়নই সমর্থন করে থাকে যে-উন্নয়ন বৈষম্য বৃদ্ধি করে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়, নিচের দিকে ঠেলে দেয় দেশপ্রেমকে। উন্নয়নের ওই নীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’তে কোনো ফারাক নেই, যেমনটা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায়, যেখানে দুইদলের নেতারা পাবলিকের জমি দখল করে একত্রযোগে একটি দোকান গড়েছেন।

উদারনীতিকেরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন বুনো হাঁস নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪০ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কী ভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণা ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তাঁর বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসাতে; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু দশ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহ পরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই পুত্র হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-পিতা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারতো। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে।

জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল। এই পুত্র বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীর ভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইলো অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়ালো এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিল।, স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করলো।

১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারলো না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসেন না, সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মা’র সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসলো। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কার-চেষ্টার সমস্তটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরূপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট পিতা ওয়ারল টাকার জোরে যে-পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী পুত্র তাদেরকেই দিল ছিন্নভিন্ন করে।

বিখ্যাত এই নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর এই বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট পিতার আদর্শবাদী পুত্র গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনলো তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হবার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারতো সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে-পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

;

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্যে হলো যে ক্ষতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুরুর দিকে এটাকে পাত্তা দেয়নি সরকার। দাবিদাওয়া কিংবা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো আন্দোলনকে শুরুর দিকে সচরাচর পাত্তা দেয় না আওয়ামী লীগ সরকার। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকার নানা সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের মুখে পড়েছে তারা, কিন্তু কোনো আন্দোলনকেই শুরুর দিকে পাত্তা দেয়নি তারা। বিভিন্ন ভাবে আন্দোলন বানচালের চেষ্টা চালিয়ে এরপর শক্তি প্রয়োগে সে সব আন্দোলনকে স্তব্ধ কর দিয়ে এসেছে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থী আন্দোলনও এক পর্যায়ে এই ধারাবাহিকতার মধ্যে পড়েছিল।

প্রথমে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে। ছাত্রলীগই মার খেয়েছে, ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে এটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়েছে। পুলিশের লাঠি-বন্দুকে ভয় না পেয়ে বরং দুর্দমনীয় সাহসে পেতে দিয়েছে বুক। পুলিশ গুলি করেছে, তবু সরেনি পুনর্বার গুলির শঙ্কা থাকলেও। ফের গুলি করেছে পুলিশ। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ এভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। তার প্রাণ বলিদান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দেয়নি। উপরন্তু এক মৃত্যুতে মরণের সমূহ ভয় কেটে গেছে অন্য সবার। বন্দুক-লাঠি-বেয়নেট-টিয়ার গ্যাস তখন হয়ে গেছে মামুলি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও শক্তি প্রয়োগের দিকে গেছে সরকার। বিজিবি নামিয়েছে। পরে সেনাবাহিনী।

দাপ্তরিক আদেশে বন্ধ করেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্যাম্পাস থেকে কৌশলে এবং জোর করে বের করে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তবু আন্দোলন থামেনি। বরং ক্যাম্পাসের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে সাধারণ মানুষও। অনেকেই রাস্তায় নেমেছে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনী।

ছাত্র-শক্তির এই তুমুল রূপের সামনে আওয়ামী লীগ এবারই প্রথম পড়েনি। ২০১৮ সালের পর পর দুইটা আন্দোলনের মুখে পড়ে তখনো পিছু হটেছিল। কোটা বিরোধী আন্দোলনে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে একই বছরের অপর এক আন্দোলনেও বিজয়ী হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। লক্ষণীয় যে, এবারের কোটা আন্দোলন শুরু করেছিল যারা তাদের হাত ধরেই গড়ে ওঠেছিল সড়ক নিরাপত্তার আন্দোলন। তখন তারা ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

কোটা বাতিলের এবারের যে আন্দোলন এবং যে দাবি তাতে সরকারের দ্বিমত ছিল না। বরং সরকারের জারি করা ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করেছিল হাইকোর্ট, এবং পরিপত্র বাতিলের কারণে ফিরে এসেছিল কোটা ব্যবস্থা। যদিও সরকার ছয় বছর আগে আন্দোলনের মুখে বাতিল করেছিল কোটা, তবে হাইকোর্টের ভিন্ন রায় এবং অব্যবহিত পরও সরকার ছিল কোটা বাতিলের পক্ষেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল তার প্রমাণ। এরপর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি। ফলে আপিল পর্যন্ত থেমে থেকেছিল বিষয়টি। শুনানি এগিয়ে আনতে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কোন উদ্যোগের দেখা মেলেনি। তবে যখনই আন্দোলন ক্রমে বড় হতে থাকল, তখন হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিলেন আপিল বিভাগ, এবং পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্যে এক মাসের অপেক্ষার জন্যে রেখে দেওয়া হলো। এরপর পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল, তখন আপিল এগিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, এবং সর্বশেষ ফুল কোর্ট শুনানিতে আসল চূড়ান্ত রায়। আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় দেন আদালত।

চূড়ান্ত রায়ের আগে সরকারের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ আসায়, আন্দোলনকারীরা ভাবল, এই বুঝি কোটা ফিরে এলো। যেখানে দেশে রাজাকারের কোন তালিকাই নাই সেখানে রাজাকারের নাতিপুতির প্রসঙ্গ এনে যে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছিল তা হচ্ছে ৩০ শতাংশের মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এই সুযোগে অনেকেই একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের সুযোগ ছাড়ল না। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলল। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা কেন বিশেষ সুবিধা পাবে, এই প্রশ্ন তুলল।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিষয়টিকে ইগোর লড়াই হিসেবে দেখল বলেই কিনা ক্ষীণ স্বরে হলে কোটা ফিরিয়ে আনার একটা আওয়াজ ওঠল। বিষয়টি যদিও আনুষ্ঠানিক ছিল না, তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে সন্দেহ দানা বাঁধল। ফলে কোটা ফিরে আসার যে ইঙ্গিত, তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠল শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার হালকাভাবে দেখল, এবং ভাবল ছাত্রলীগ আর পুলিশকে দিয়ে নস্যাৎ করে দেওয়া যাবে এটা। তাদের এই অভিসন্ধি ফুটে ওঠল ওবায়দুল কাদেরের নানা বক্তৃতায়। তিনি আন্দোলনকারীদের বিষয়টি ছাত্রলীগ দেখবে বলে যে কথা উচ্চারণ করেছেন, সেটা ক্ষোভের সঞ্চার করেছে আন্দোলনকারীদের মাঝে। এরপর তিনি বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলার কথা জানিয়ে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দেন দলীয় নেতাদের। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে গেছে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তার বক্তব্য ও নির্দেশনা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করার বিষয়টি এসেছে মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে মোকাবেলা করার সাম্প্রতিক ইতিহাস। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার বিএনপি-জামায়াতসহ সকল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করে, তাদের বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনের আগে আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি অনেক শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নির্বাচন করে এবং ফের সরকার গঠন করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলা করে সরকারের এই পথ চলায় তাদের মধ্যে অহংবোধ জেগে ওঠায়, কোন শক্তিকেই পাত্তা না দেওয়ার একটা মানসিকতা গড়ে ওঠেছে। এই মানসিকতা কাল হয়েছে শিক্ষার্থী আন্দোলনকেও একইভাবে দেখার মধ্য দিয়ে।

সরকার ভেবেছিল নির্বাহী আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ক্যাম্পাস খালি করে দিয়ে পুলিশি ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরও দমিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কারণে আন্দোলন ক্যাম্পাস থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাস্তায় নেমে আসে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র অভ্যুত্থানে।

যদিও আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে থাকেনি, তবে যথাসময়ে এর সমাধান করলে বিপুল প্রাণের অপচয় আর সরকারি-বেসরকারি সম্পদহানির ঘটনা ঘটত না, দেশ অর্থনৈতিকসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। যে অনিয়ন্ত্রিত, অস্থির এবং অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে দেশে, সেটা এমন নাও হতে পারত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে।

টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ কাউকেই পাত্তা দেয় না বলে যে অভিযোগ, এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে যে সঠিক নির্দেশনার দরকার ছিল সে নির্দেশনা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত দিতে হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এবং রাষ্ট্রকে। সাধারণ এক শিক্ষার্থীকে আন্দোলনের এমন ভয়াল রূপে এখন আঙুল তোলা হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে। নাশকতায় তারা জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু এই আন্দোলনকে সেই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়কে কি অস্বীকার করা যাবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন দায়-চাপানোর রাজনীতিতে মনোযোগী হওয়ায় একদিকে যেমন সাংগঠনিক দুরবস্থাকে আড়াল করা হচ্ছে, অন্যদিকে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও।

শিক্ষার্থীরা যতই বিক্ষুব্ধ হোক, তারা অন্তত নাশকতায় জড়াবে না। কেপিআই ভুক্ত এলাকায় আগুন দেবে না, মেট্রোরেলের ক্ষতি করতে যাবে না, টেলিভিশন ভবনে হামলা করবে না, রাতভর সংঘর্ষে জড়াবে না, কারাগারে হামলা করে অস্ত্রাগার লুট করে বন্দি ছিনতাই করবে না; এসবে অন্য কেউ থাকবেই। এদেরকে প্রতিরোধ করতে পারেনি সরকার; না রাজনৈতিক ভাবে, না প্রশাসনিক ভাবে। এই ব্যর্থতার দায় তারা অস্বীকার করলেও এটা অস্বীকারের বিষয় নয়। এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সামনে আসছে, সরকারই এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ দেখানো হচ্ছে। এতে কি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে না বিপুল প্রাণের অপচয়? অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজতের দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি দায়িত্বও তাদের নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের একটা পর্যায়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো প্রমাণ করে ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করা উচিত হয়নি। তবে আশঙ্কা হচ্ছে, সরকার না আবার এটাকে এই ভাবতে বসে—শেষ পর্যন্ত আমরা হারিনি! আওয়াজ ওঠতে শুরু করেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছেন কথাটা। এবার অন্যরা বলতে শুরু করলে শক্তির খেলায় হার-জিতের প্রসঙ্গ নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে!

;