মানুষের প্রত্যাশায় 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি'
![ছবি: সংগৃহীত](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2023/Nov/16/1700134145537.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। একদল আশাবাদী। অন্যদল হতাশাবাদী। হতাশাবাদীদের নিয়ে যন্ত্রণার শেষ নেই। তাদের শুশ্রূষা ও উদ্ধারের জন্য কাজ করেন মনস্তত্ত্ববিদ ও মানসিক রোগের চিকিৎসকগণ।
আশাবাদীদের নিয়ে এতোসব হ্যাপা পোহাতে হয় না। তারা পাথরেও ফুল ফুটাতে পারেন। মরুভূমিতে আবাদ করতে পারেন শ্যামলিমা ও মরুদ্যান। সঙ্কুলে তারা বিহ্বল হন না। সঙ্কটে ধৈর্যহীন হন না। অন্ধকার টানেলের শেষপ্রান্তে তারা আশার আলোর একটি বিন্দু দেখেও এগিয়ে চলেন জীবনের সবুজ সড়কের সন্ধানে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমজনতার মধ্যে চলছে আশা ও হতাশার দোলাচল। মানুষকে ঘিরে ধরেছে অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থা। এমতাবস্থায় হতাশ হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও আশাবাদী হওয়া জরুরি ও কাম্য।
উল্লেখ্য, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যই সঙ্কটের মূল। এ কারণে বিগত কিছুদিন ধরে রাজনীতি উতপ্ত। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতেও বিরাজ করছে টেনশন। তারই মধ্যে অনেক কথা, জল্পনা, কল্পনা, আলোচনা, পরামর্শ ও সমালোচনার মুখেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপিসহ অন্যান্য সমমনা দলগুলো তফসিল প্রত্যাখান করেছে। বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস হরতাল ঘোষণা করেছে বাম জোট। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই রাজপথে আন্দোলন করছে, যা তফসিল ঘোষণার পর নতুন মাত্রা পেয়েছে।
দেশীয় নানা পক্ষের পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সরব রয়েছে বিভিন্ন পরাশক্তি। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে শর্তবিহীন সংলাপে বসে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। চীন, রাশিয়া, ভারত 'নির্বাচনকে বাংলাদেশের নিজস্ব ও আভ্যন্তরীণ বিষয়' উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সক্রিয় না হয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে ও নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে।
এমতাবস্থায়, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বাংলাদেশকে বিরোধীদের আন্দোলন ও বিভিন্ন দেশের নানামুখী মতামতের ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতির জটিলতার মধ্যেই নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনে শেষপর্যন্ত কতগুলো রাজনৈতিক দল অংশ নিবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হয়ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যেতে পারে। তবে জাতীয় পার্টি এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু বলেনি।
এর ফলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা, সে প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। পাশাপাশি, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার বিষয়টিও রয়েছে, যার উপর নির্ভর করে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। আর নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নেওয়াও সম্ভব হবে। ফলে তফসিল ঘোষণার পাশাপাশি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার করার বিষয়ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলগুলো শেষপর্যন্ত নির্বাচনে আসবে নাকি আন্দোলন অব্যাহত রাখবে, এই প্রশ্ন এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণর ন্যূনতম আলামতও স্পষ্ট নয়। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা ঘোষণা দিয়েই এবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে মাঠে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র কোনও বিষয়ে সক্রিয় হলে পশ্চিমা জোটের অন্যান্য শরীকরা পক্ষে না থাকলেও বিপক্ষে যাবে না। এমনকি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া কথা বলেছে। কানাডার সংসদেও কথা হয়েছে। সবাই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছেন। সবাই বলছে, যদি সব দলের অংশগ্রহণ থাকে তবেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি ভালো নির্বাচন অপরিহার্য। দলমত নির্বিশেষে সকলেই এ ব্যাপারে একমত। আর ভালো নির্বাচন বলতে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকেই মানদণ্ড ধরা হয়। এই মানদণ্ডের বাইরে গেলেই সৃষ্টি হয় নানা বিপত্তি। কোনও গণতান্ত্রিক দল এবং গণতন্ত্রমনস্ক মানুষ এহেন বিপত্তি কামনা করে না। আশাবাদী মানুষ আলোর আশা নিয়েই যাপিতজীবনে বেঁচেবর্তে থাকতে চায়। সঙ্কট ও সন্ধিক্ষণকে আলিঙ্গন করতে চায় না।
বাংলাদেশের নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলের জাতক, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮ - ১৮ মার্চ ১৯৭৪)-এর 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি' নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ আছে, যাতে 'ক্লাইভ স্ট্রিটে চাঁদ' নামে একটি রচনা রয়েছে। কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত 'ক্লাইভ স্ট্রিট' বর্তমানে নেতাজি সুভাষ রোড (সংক্ষেপে এন এস রোড) হিসাবে পরিচিত। কলকাতার বিবাদীবাগে মূলত উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ককে আবর্তিত লেখায় বুদ্ধদেব নক্ষত্রে আলো ও নস্টালজিয়ায় জীবনের উদ্ভাসন দেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১-৭ আগস্ট ১৯৪১) শেষজীবনে 'শেষের কবিতা' নামক বিখ্যাত রচনায় লিখেছেন, 'হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে/ঝলমল করে চিত্ত।' যে রচনাতেই রয়েছে একটি প্রসিদ্ধ লাইন, 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি'।
আশাবাদী মানুষ আলো ও পথের সন্ধানে জীবনব্যাপী ব্যস্ত থাকেন। অচলাবস্থা ও অচলায়তন মেনে নেন না কখনোই। পাষাণের বাঁধ ভেঙে মুক্তধারার মতো প্রবাহিত হয় আশাবাদী মানুষের জীবন ও চৈতন্য। আশাবাদী মানুষ সর্বত্রই মুক্তির পক্ষে এবং বন্ধনের বিপক্ষে। ইতিহাসের পর্বে পর্বে মুক্তির জন্য মানুষ কাজ করেছে, চঞ্চল, অস্থির হয়ে উঠেছে।
আশা ও হতাশার ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষও আশাবাদীই হতে চায়। অন্ধকার সুড়ঙ্গ পেরিয়ে খুঁজতে চায় আলোকরশ্মি। রাজনীতির অনিশ্চিত ও অশনিসংকেত কাটিয়ে দেখতে চায় 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি'। আর যে আলোয় 'ঝলমল করবে চিত্ত'। কেটে যাবে অনিশ্চয়তার কালো অন্ধকার, শঙ্কা ও স্থবিরতা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।