রোহিঙ্গা সংকটে ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিম্নমুখী এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে আসার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। মানবিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই মহানুভবতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন না করে ইদানিং বাংলাদেশের সমালোচনা করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা কারো কাম্য নয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, ফলস্রুতিতে ৪৫% রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর  জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের(জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে যা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ। এই পরিস্থিতি নিরসনে,  মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি জানায় যে, দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। 

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তাঁরা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি হিসেবে মনে করে। এর ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০% আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থন চলমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারের অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায় এবং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমাতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজতে অবিচল থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সংকট মোকাবেলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রথম নারী সভাপতি এলিসিয়া কিয়ার্নস বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জানান যে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন জানান যে, মিয়ানমারে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের জন্য মিয়ানমারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। এফসিডিও কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ও রান্নার জ্বালানি নিশ্চিত করতে ৩০ লাখ পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দেয়, এই সহায়তা কার্যক্রম ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি মানুষের জন্য ৩৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআর, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টম অ্যান্ড্রুজ জানায় যে,  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদেরকে পর্যাপ্ত সমন্বিত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং  জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে জেনেভাতে আসন্ন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এটি একটি বৃহত্তর মানবিক সংকটে আর্থিক সহায়তার হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি চলমান রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান রেখেছে।  ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেকার ভিসা সেবা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অধীনে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই সর্বাধিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারবে। এই সিধান্তের ফলে সরকারি সফর সহজতর হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ও একটি রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে বলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পর সেখান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে দুই দেশের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হলে তাদেরকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে।

সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী, সেজন্য রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে যাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের  সমর্থন চেয়েছেন। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ এই সাতটি দেশ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮তম এশিয়া কোঅপারেশন ডায়লগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ইস্যু আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখতে অনুরোধ জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা  চেয়েছে বাংলাদেশ। জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য এবং জাপানের বিদেশি সহায়তা কমিটির (ওডিএ) প্রধান নাকানিশি ইয়োসুকে সেপ্টেম্বরে তার বাংলাদেশ সফরের সময় এই আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বন্ধু প্রতীম দেশগুলো ভুমিকা রাখতে পারে। একই সাথে তাঁরা রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে মিয়ানমারে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ত্রান সহায়তা চলমান রাখার জন্য খাদ্য ও অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। 

সম্প্রতি দি ইয়থ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াই সি আর) নামে রোহিঙ্গাদের স্বার্থনিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের কথা জানা যায়। এই সংগঠনটি প্রায় এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনটি প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় তাদের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায় নাই। বহু দশক ধরে পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গাদেরকে প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিণত করা হয়েছিল ও তাদের নাগরিক অধিকার সহ অন্যান্য মানবিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই প্রান্তিক জনগুষ্টিকে কর্মক্ষম শক্তিতে পরিনত করা যেতে পারে। এই সংগঠনটি এসব উদ্যোগ নিতে পারে।  আশা করা যায় তাঁরা রোহিঙ্গাদের ক্রমহ্রাসমান আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে ইতিবাচক ভুমিকা রেখে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও সহানুভুতির বাস্তব রূপ দিবে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন নিশ্চিত করতে তৎপর। এখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মত একটা জটিল সমস্যা চলমান থাকবে তা কারো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ  আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই সংকট সমাধানে আঞ্চলিক, বৈশ্বিক সহ সব ধরনের উদ্যোগে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই ইস্যুটিকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবনতা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি এই সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 

   

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা



শরিফুল হাসান সুমন
ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির বিষয় ছিল—‘বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি’ বিষয়ে সংকলিত প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রতিবেদন যদিও সারাবিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, তারপরেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই স্মারকলিপির লক্ষ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রম ইস্যু (গার্মেন্টস কর্মীর মৃত্যু) উল্লেখ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেটস উনার স্মারকলিপি প্রকাশ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে। এই নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম ইস্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজস্ব কূটনীতিক বা মিশন প্রধানেরা যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের উপর এই নীতি আরোপ হতে পারে, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার হরণ হচ্ছে।

এই নীতির অনেক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে যা বিপদ সংকেত এর কারণ হতে পারে। এই নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষ, এবং যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এটার ব্যবহার করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের জন্য একটা সতর্কবার্তা যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে কী কী করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং এটি অবশ্যই বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

এই ছিল ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রেরিত চিঠির সারসংক্ষেপ। গত ১৬ নভেম্বর সান ফ্রান্সিসকোতে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এপিইসি) একটি আয়োজনে ওই স্মারকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। শ্রম অধিকার হরণ করে এমন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত শ্রমনীতির প্রেক্ষিতে প্রতিটা দেশের রাষ্ট্রদূতই সম্ভবত নিজ নিজ দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে।

কী ছিল মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত শ্রমনীতিতে?
১. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান রক্ষা ও প্রচারের জন্য আমরা সারা বিশ্বে সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতকে যুক্ত করব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রদূত, সমস্ত লোক যারা বিশ্বজুড়ে আমাদের দূতাবাস চালাচ্ছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে, ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকবেন যাতে তাদের কণ্ঠস্বর আমরা যা কিছু করি তাতে প্রতিফলিত হয়।

২. যারা হুমকি দেয়, যারা ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রম অধিকার রক্ষাকারী, শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে—নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো জিনিস ব্যবহার করে, আমাদের এখতিয়ারের সবকিছু প্রয়োগ করে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

৩. আমরা শ্রম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মচারীদের জন্য বৃহত্তর কাজের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানার জন্য, অপব্যবহার খোঁজা এবং প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মীদের অধিকারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ফেডারেল সরকারের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করব।

৪. আমরা শ্রম অধিকার এবং মান উন্নীত করার জন্য সরকার এবং জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, জি-২০ এর সাথে কাজ করব। এটি সেই কাজের অংশ হবে যা আমরা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে করি, যেখানে অনেকগুলো নিয়ম সেট করা আছে।

৫. আমাদের নিজস্ব বাণিজ্য চুক্তি, সরবরাহ চেইন, শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং আমরা জোরপূর্বক শ্রম দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানি করছি না—তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের যথাযথ পরিশ্রম এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা করব।

সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

১৬ নভেম্বর এই শ্রমনীতি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতি সংবাদপত্র একের পর এক স্যাংশনের ভয় দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। তারা এমনভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিছে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর যেন বিশাল কোন দুর্যোগ নেমে আসতে যাচ্ছে, যা সর্বৈব মিথ্যা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র বা অল্প জানার কুফল।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক প্রেরিত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি প্রকাশ করে সেটার ভুল ব্যাখ্যা করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে শিক্ষিত ও স্মার্ট সাংবাদিকরা। ভিসা স্যাংশনের পর যে শুরু হয়েছে আমেরিকার স্যাংসনের জুজু, সেই জুজু দেখিয়ে বর্তমান সরকারের উপর অনাস্থা সৃষ্টি করতে এই প্রতিবেদনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে টুইস্ট করে প্রচারিত হচ্ছে। নির্বাচন পূর্ব সংবাদমাধ্যমের রাজনীতির এই খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আর ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে।

তৈরি পোশাকশিল্প কি পশ্চিমা শ্রমনীতির বাইরে?

বিগত ৪ দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গার্মেন্টস বিদেশি বায়ারের সকল নীতি, যেটাকে বলা হয় কমপ্লায়েন্স, সেটা মেনেই পোশাক প্রস্তুত করে। এছাড়া বড় বড় পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনেক নির্দেশনা থাকে তৈরি পোশাক নির্মাতাদের জন্য। এগুলোর মধ্যে কাজের পরিবেশ থেকে শুরু করে, পণ্যের মান, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শ্রমিকদের বয়স, অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিবিধ নির্দেশনা থাকে; এবং সেগুলো মেনে চলছে কিনা সেটা নিয়ে আবার প্রতিটা বায়ার নিজস্ব লোক দিয়ে প্রতিটা গার্মেন্টস পরিদর্শন করায়। এই সকল পরিদর্শন শেষে, ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই সেই গার্মেন্টসে পণ্য প্রস্তুত করতে রাজি হয় পশ্চিমা বায়াররা। বাংলাদেশের কিছু কিছু গার্মেন্টস বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে কথা মাথা রেখে গাছপালা আচ্ছাদিত সবুজ গার্মেন্টস (green factories) তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশের সবচেয়ে বেশি সবুজ গার্মেন্টস এখন বাংলাদেশে অবস্থিত, এবং এই সংখ্যাটা ২০০’র উপর। আর এই নির্দেশনাগুলো মেনেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে বিশ্ব নন্দিত ব্র্যান্ডগুলো পোশাক তৈরি করে নিয়ে যায়। এতদিন ধরে মেনে আসা OCS & RCS Certificate, WRAP Certificate, ACCORD Recognition, H&M Gold Supplier, ISO 9001:2015, Compliance Certificate-সহ সকল সার্টিফিকেশন আর শ্রমনীতি মেনেই বাংলাদেশে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে আর সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত শ্রমনীতি এর বাইরের কিছু না। এটা শুধুমাত্র একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে পারে সেই সকল দেশের ওপর, বা প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যক্তির যারা উক্ত শ্রমনীতি অনুসরণ করছে না।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত "বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি" নিয়ে নতুন করে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আমূল বদলে গেছে। তবে ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী একটু সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। কেননা এটা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়ে গেছে যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা নোংরা খেলায় নেমেছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং অনমনীয় নেতৃত্ব চক্ষুশূল হয়েছে আমেরিকার জন্য। তাই তারা যেমন ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, তেমনি তারা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর শ্রমিক অধিকারের দোহাই দিয়ে শাস্তি আরোপ করতেও পিছপা হবে না। তাই আমাদের সচেতন আর সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

ভুল, মিথ্যা খণ্ডিত তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার এই যে অসাধু প্রক্রিয়া চলমান, এতে দেশের কোন লাভ হবে না বা হচ্ছে না। এতে লাভবান হবে বাংলাদেশবিরোধী শত্রুরা, যাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি সহ্য হয় না, যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে দেখতে চেয়েছিল!

;

মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ

মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পাশের দেশ মিয়ানমারে কঠোর ও নিবর্তনমূলক সামরিক শাসনের বজ্রআঁটুনি ভেদ করে সব খবর বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে আসতে পারেনা। প্রবল সেন্সরকৃত খবরের তলানি থেকে যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে দেশটির স্বৈরতন্ত্রী, অগণতন্ত্রী ও মানবাধিকার বিরোধী কুশাসনের রক্তরঞ্জিত মুখচ্ছবি বিশ্ববিবেককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই নয়, জাতিগত ও ধর্মগত অপরাপর জনগোষ্ঠীকেও কচুকাটা করা হচ্ছে দেশটিতে। মিয়ানমারে গৃহদাহের আগুন প্রশমিত করতে সামরিক জান্তাকে অবশ্যই প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনায় বসতে এবং ক্ষমতা থেকে সরতে হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও সেখানে সামরিক জান্তার বলদর্পিত নিপীড়নকারী আচরণ মোটেও কমছে না এবং আমজনতার অবর্ণনীয় দুর্দশারও অবসান ঘটছে না।

গত মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের বিভিন্ন অংশে সে দেশের উপজাতিগত জনগোষ্ঠী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করে। এর থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেশটিতে সামরিক শাসকদের হাত ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে ও শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত থ্রি ব্রাদারহুড নামের একটি সংগঠন চীন সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের একাধিক এলাকা দখল করেছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেখানে নাকাল হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।

একইভাবে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত, অস্থিরতার পরিপূর্ণ রাখাইন স্টেট এবং চীন স্টেটেও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে পিছু হটতে বাধ্য হওয়ার পর সামরিক জান্তা এবার পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে যুদ্ধবিমান থেকে নিজদেশের জনগণের উপর নারকীয় হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু সাধারণ মানুষ।

এহেন গৃহদাহের চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সেনা কর্তৃক নিয়োজিত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, 'এই সমস্যাটি তথা প্রতিবাদকারীদের আন্দোলন ও তৎপরতা সাবধানতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।' মুখে বললেও কার্যক্ষেত্রে সামরিক জান্তা মানবাধিকারের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন নয়। দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে যে নির্মমতার মাধ্যমে জাতিগত নিধনের মুখোমুখি করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, সেভাবেই অন্যান্য সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদকারীদের নির্মূল করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে সেনা কর্তারা যখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আং সান সুকির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়, তখন তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম করতে শক্তির অবাধ ব্যবহার করা। সেনা কর্মকর্তারা সু কি সহ অধিকাংশ গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদদের কারাবন্দী করে এবং বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক বলপ্রয়োগ শুরু করে। তারপর থেকে সেনার আক্রমণে ৪,০০০-এরও বেশি নাগরিক এবং গণতন্ত্রপন্থী নেতার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ২০,০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। নানা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এমনটাই দাবি করেছে। খোদ জাতিসংঘের অনুমান, মিয়ানমারে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।

সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিজেদের পক্ষে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সামরিক জান্তার হিংসাত্মক পদক্ষেপ কোনও কাজে আসছে না। বরং আক্রমণের মুখে সাধারণ মানুষ, বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আরও কোণঠাসা হয়ে মরিয়া মনোভাবে লড়ছে। অবশেষে সবাই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।

দেশ হিসেবে মিয়ানমারের ইতিহাস বড়ই রক্তরঞ্জিত। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু উপজাতি সম্প্রদায় হিংসার মুখোমুখি। তবে অতীতে মূল জনগোষ্ঠী বার্মিজ সমাজের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সু কির নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে সু কির শান্তিপূর্ণ বাধা প্রদানের উপায় খারিজ করা হয়। তার পরিবর্তে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সরকার, সামরিক শাখা তৈরি করা হয় এবং তারা উপজাতিগত বিদ্রোহীদের সাথেও হাত মিলিয়েছে। এই পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, সামরিক শাসকরাও সেটা আগাম আন্দাজ করতে পারেননি। বিগত দুই বছর ধরে সেখানে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখা দিয়েছে। বিদ্রোহীরা দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভুখণ্ডে নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। একাধিক ফ্রন্ট উন্মুক্ত রেখেছে, সামরিক জান্তার উপর সামরিক চাপ বজায় রেখেছে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা ক্রমশ সমালোচনার মুখে পড়ছেন। জেনারেল মিন আং লাইঙ্গের প্রশাসন যে ক্রমশ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তা বিদ্রোহীদের নয়া আক্রমণ এবং ভুখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।

সামরিক জান্তার হাতে কোনো সহজ বিকল্প নেই। সামরিক সমাধানের সম্ভাবনাও আর নেই। সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ আলোচনা উন্মুক্ত রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে পথেও অগ্রসর হয়নি। যদিও বৈচিত্রপূর্ণ নয়া প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা সামরিক কর্মকর্তাদেরকে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তারপর শান্তি ফেরাতে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এমন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয়, গণতান্ত্রিক সিস্টেম তৈরি করা, যেখানে সংখ্যালঘু উপজাতিদের আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন থাকবে।

কিন্তু যদি মিয়ানমারে শান্তি না এসে অব্যাহতভাবে হিংসা চলতে থাকে, বিশেষত ভারত এবং চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, তাহলে এর আঞ্চলিক প্রভাবও দেখা যাবে। আসিয়ান সহ অন্যান্য প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও তখন সংঘর্ষবিরতি আনতে, সেদেশে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতে ফিরিয়ে আনতে অর্থপূর্ণ আলোচনার পথ সুগম করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হবে।

এহেন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে সরকারি টিভি চ্যানেল ‘গ্লোবাল নিউজ লাইট অব মিয়ানমার’-এ প্রচারিত এক খবরে বলা হয়েছে, চীন ও মিয়ানমারের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, দু’দেশের জন্য লাভজনক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সীমান্তে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকের বিষয়ে চীনা দূতাবাস বা সে দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থার তরফে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ ফেরানোর অছিলায় মিয়ানমারে চীনা পিললস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ঢুকতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের অনেক সামরিক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে চাপে থাকা জান্তা সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমারকে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারে চীনের শি জিনপিং সরকার। যা নয়াদিল্লির পক্ষে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কেননা, ভবিষ্যতে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর ধাঁচে রাখাইন প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিয়াউকফিউ বন্দর মারফত বঙ্গোপসাগরেরর ‘নাগাল’ পেয়ে যাবে চীনের লালফৌজ।

এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ, সীমান্ত পেরিয়ে মিজ়োরামেও মিয়ানমারের সমস্যার আঁচ লাগে প্রায়ই আর গৃহযুদ্ধের জেরে পাঁচ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন মিজ়োরামে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের অন্তত পাঁচটি প্রদেশ দখল করেছে বিদ্রোহী জোট। চীনগামী মূল সড়কটিও তাদেরই দখলে। এর ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতএব, মিয়ানমারে জান্তা শাসনে সৃষ্ট গৃহদাহের বিপদ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ার আগেই সকলে মিলে থামানো দরকার। আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি



মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ
বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

  • Font increase
  • Font Decrease

গণতান্ত্রিক চর্চা ধরে রাখতে হলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করাকে যদি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন আমার বিবেচনায় সেটি ভুল রাজনৈতিক কৌশল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য যে শঙ্কাটা তৈরি হয়েছে সেটি হল এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কি হবে না? যারা বিরোধী মতবাদের লোক আছেন তারা বলছেন, বিএনপিকে বাদ নির্বাচন করলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর সরকারের কথা হলো নির্বাচনে কোন দল অংশগ্রহণ করল কি করল না সেটি বিষয় না, বিষয় হলো জনগণ অংশগ্রহণ করছে কিনা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কিনা তা দেখতে হবে-যাচাই করতে হবে জনগণের অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে। বিএনপি’র নির্বাচন বিমূখতা তৈরি হয়েছে, তারা মনে করছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের আর অন্য কোনো রাস্তা আছে কিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, সেই রাস্তা খুঁজতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  এবং পশ্চিমা বিশ্বের ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তারা। বিএনপি’র সঙ্গে তাদের সখ্যতা দেখা যাচ্ছে এবং পশ্চিামাদের সঙ্গে সে সখ্যতার কারণে নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক করার অজুহাতে মার্কিনিরা আমাদের এই নির্বাচনে নগ্ন হস্তক্ষেপ করতেও উদ্যত হয়েছে, যা এরই মধ্যে দৃশ্যমান।

যদি আমরা দেখি অতীতে যেখানে মার্কিন হস্তক্ষেপমূলক নির্বাচন হয়েছে সেখানে বিএনপি সুবিধা পেয়েছে। পুরনো পথে দলটির সেই রাজনৈতিক কৌশল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটি হল নির্বাচনে তারা সরাসরি যেতে প্রস্তুত না। তাদের রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপমূলক পরিস্থিতির মধ্যে তারা নির্বাচনে যেতে চায়, যাতে করে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হয়। সেক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার একটি গুরুতর অভিযোগ, বাংলাদেশের বিরোধী দলের সাম্প্রতিক সংঘাতমূলক অবরোধ-হরতাল সহিংসতার রাজনীতির পরিকল্পনায় বিএনপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় রাষ্ট্রদূতকে জড়িয়ে ফেলেছেন। এটি নিশ্চিতভাবেই একটি দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরণের হুমকি। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে প্রভাবিত করার জন্য যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূত আমাদের রাজনীতিবিদদের নিয়ে একসঙ্গে পরিকল্পনা করেন বা সরকার উৎখাত এর পরিকল্পনা করেন; তাহলে তা জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। সেরকম একটা বাস্তবতার ভেতর আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২৮ অক্টোবর সমাবেশের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ। সেই দৌড়ঝাঁপ থেকে মানুষের মনে বিএনপি’র মার্কিন সংযোগের বিষয়ে এই বিশ্বাস আরও প্রবল হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে সমর্থন করছে, এই কারণে বিএনপি ক্ষমতায়িত হবে-এটা যখন মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে তখন অনেক মিথস্ক্রিয়া তৈরি হতে দেখব জনগণের মধ্যে।

নির্বাচনে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধু রাষ্ট্ররা হস্তক্ষেপমূলক আচরণের মাধ্যমে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হতে পারে না। অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা অস্ত্র’ ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা যেতে পারে এই অস্ত্রগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির একাংশকে ভয় দেখানোর জন্যই হয়তো ব্যবহার করা হয়েছে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে যখন কোনো নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয় তখন সেটাকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কোনো সহায়ক ভূমিকা বলে মনে করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অপতৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশের অন্য ব্ন্ধু রাষ্ট্ররা পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরকম হস্তক্ষেপ সর্মথন করে না। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মোটামুটি বিভাজিত, এক রকম স্নায়ুযুদ্ধের মতো।

আমরা মনেকরি, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি হচ্ছে সম্পূর্ণ আমাদের জনগণের বিষয়। এর কোনো সংকট তৈরি হলে সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশের জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলো ভূমিকা রাখবে। এখানে বিদেশিদের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যেটা দেখছি, প্রথমে তারা মনে করেছিল, বিদেশি হস্তক্ষেপের হুমকি দেখে হয়তো বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পিছিয়ে দেবে। এই উত্তেজনার মধ্যে যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েই গেল তখন তারা মনে করল তফসিল তো বন্ধ করা গেল না! যদি নির্বাচন সময় মত না হয় তবে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। ২৯ জানুয়ারি হচ্ছে সর্বশেষ সময়, এর ভিতরে নির্বাচন না হওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক অপকৌশল হয়তো চলছিল আন্তর্জাতিকে যোগসাজশে।

নির্বাচন যদি না হয় তখন সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকট উত্তরণ ঘটানোর জন্য একটি অনির্বাচিত সরকার দেশের ক্ষমতা নেবেন-এই রকম চিন্তাধারা থেকেই এই রাজনৈতিক কৌশল ‘নির্বাচনে না যাওয়া’। প্রথম যে ধাপটি আছে আমার মনে হয়, যারা নির্বাচনের পক্ষে নন, তারা এখানে তাদের যে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্যায় হলো এই নির্বাচনের আগে দেশের যে শান্তিশৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটানো। সেই জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, হরতাল-অবরোধের নামে সহিংসতা করা হচ্ছে। গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, মানুষের মৃত্যু ঘটছে, ট্রেনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে। তবে জনগণের কাছে তা একেবারেই সর্মথন পায়নি। ফলশ্রুতিতে এসব কর্মসূচির প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে। আন্দোলন-কর্মসূচির নামে সহিংসতার এই অস্ত্রটি আগামী দিনে খুব সফল থাকবে বলে মনে হয় না।

এখন তৃতীয় ধাপ হলো নির্বাচন নির্বাচনকে প্রতিহত করা। সেই প্রতিহত করতে গেলে বড় ধরণের সহিংসতা করতে হবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। সেই কৌশল চরিতার্থ করতে বাংলাদেশে যে একটা বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভাজিত হয়ে পড়েছে তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। একপক্ষ নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠু করার জন্য তারা তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা এটি সুসম্পন্ন করতে সহায়তাও করছেন। আরেক পক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচনের পরিবেশকে জটিল করে তুলতে উদ্যত। তবে অতীতের ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণে দেশের জনগণ নিজেরাই ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সাল থেকে যতগুলো ক্রাইসিস বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে সবগুলোতেই জনগণের স্বতোস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সেখানে বিদেশের ওপর ভর করে রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করা ভোটের রাজনীতি নয়। যারা ভোটের রাজনীতিতে না গিয়ে বিদেশনির্ভর রাজনীতির কৌশল করছেন তারা ভোটের পক্ষে থাকবেন না সেটাই স্বাভাবিক। 

যারা বাংলাদেশের নির্বাচনের অতি আগ্রহ দেখিয়ে এখানে একটি অচলাবস্থা তৈরি করার পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, তাদের বিপরীতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক স্টেটমেন্ট মানুষ বিশ্বাস করছে। আমরা এও দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের একটি মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিমাদের যেসব তথ্য সরবরাহ করেছিল বলে শোনা গেছে, এর অনেক কিছুরই সত্যতা নেই তা বিলম্বে হলেও তারা (পশ্চিমারা) হয়তো বুঝতে পারছে। এখানে অনেক গল্প হয় এবং নির্বাচন কেমন হয়েছে-এসমস্ত আলোচনা হয়। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগের যে অধিকার সেটি যদি থামিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেটি আমাদের ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করবে। 

সেক্ষেত্রে জনগণ এবং যে-সব রাজনৈতিক দল দেশের কথা চিন্তা করেন, স্বার্থের কথা চিন্তা করেন তাদেরকে অবশ্যই দেশের মানুষ ভালোভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুক-এটি নিশ্চিত করেই তার পক্ষে হাঁটতে হবে। এখন ভোটের সমর্থন থাকলেও ভোটের ফলাফল উল্টে দেওয়ার যে ঘটনার কথা বলা হয় সেটিতো আমরা ১৯৭০ এর নির্বাচন যদি দেখি, যেটি পাকিস্তান সামরিক জান্তার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল-সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনেই তার উত্তর মিলবে । ভোটের সুনামি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিল বলেই তিনি ঐ অবস্থাতে নির্বাচনে গেছেন। সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার রীতি থেকে বুঝা যায়, জনসমর্থনের সংকটের একটা ভীতি রয়েছে, সেই ভীতি থেকেই নির্বাচন বানচালের একটা রাজনীতির উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই  রাজনীতিকে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এগুলোর মাধ্যমেই সহিংসতার জন্ম হয়েছে। আমি মনে করি, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ প্রশন্ত করার মধ্য দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও প্রগতির দিকে আমরা ধাবিত হবো। সেজন্য এটি বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।  জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটারদের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ যেমন কাম্য নয়, তেমনি নির্বাচন প্রতিরোধে সহিংসতার ব্যবহারও সমানভাবে পরিত্যাজ্য। এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিকল্প নেই বলেই মনে করি।

নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি দেশ চায় তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা যদি বলি; বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে-সেখানে দেখব কিভাবে অতীতে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের বিরুদ্ধে অস্থিরতা তৈরি করেছে। সম্ভবত সেই নিরাপত্তা ক্ষেত্রে, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যদি দুই দেশ শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির পথে হাঁটতে চায় তাহলে অবশ্যই প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প নেই। আমরা দেখে আসছি, ভারত এ বিষয়ে বরাবরই সচেষ্ট থেকেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ, জঙ্গিমুক্ত এবং বিদেশি উপস্থিতি মুক্ত একটি দেশ। এরকম একটা বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতীম ভারত প্রত্যাশা করে। বিশেষ করে যখন নতুন করে কোনো সরকার গঠন হয় তখন সর্বাগ্রে সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি ভারতীয় সীমানা বা আধিপত্য এলাকার মধ্যে হলে নিশ্চিতভাবেই এটি ভারতের ঝুঁকি তৈরি করবে। 

আরেকটি হলো, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল বা সেভেন সিস্টারের উন্নয়নে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশটির জন্য। শুধু বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে হবে না, ভারতের এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে হবে। এবং এই অতীতের বেশ কিছু ঘটনা যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমরা দেখব, বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখে উন্নয়নের পথে যে কৌশল তৈরি করেছে সেটি দু’দেশেরই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। অহেতুক সামরিক শক্তিতে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের একটা ভূমিকা থাকলেও পরবর্তীতে আমাদের সাথে ভারতের যে অমিমাংসিত বিষয় আছে। সেই অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো বিপাক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পেরেছে। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। ছোট যে বিষয়গুলো আছে সেসব বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়। এগুলোকে ইস্যু করে বিবাদের একটা সূত্র হিসেবে গণ্য করার যে রাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেখা যায় সেটিও কিন্তু ভুল রাজনীতি।

কারণ যদি ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করি সেখানে আমি দেখেছি পাকিস্তানে ভারতের ইতিবাচক সম্পর্ক না থাকার ফলে দেশটি একটি পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা এবং ভারত যদি একসাথে উন্নয়নের কৌশল নিই এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি আন্তরিক থাকি তাহলে সেটি উভয় দেশের জন্য মঙ্গল হবে। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের মতামত প্রকাশের সময় সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে এ অঞ্চলে তারা দ্বিতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ চায় না এবং বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে নির্বাচনকালে কোনো সংকট তৈরি হলে সমাধান করার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগণের-এটাতে তারা বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে একটা ভিত্তি দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বন্ধু রাষ্ট্রগুলি যখন শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের পক্ষে ভূমিকা নেয় তখন সম্ভবত সেটি অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে একটি মাত্রা তৈরি করে। সেখানে প্রভাবশালী অন্য দেশগুলির হস্তক্ষেপের জায়গাটি সংকুচিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখছি, বিদেশিনির্ভর রাজনীতি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে একধরণের হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে আসছিল, তারা সেই জায়গা থেকে অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টায় রয়েছে। তা হয়ত বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষে দুঃসংবাদই বয়ে আনতে পারে। অবস্থার বাস্তবতায় বিদেশনির্ভর রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন অলীক কল্পনা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা দেখতে পেলাম দেশের প্রধান তিন দলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং এর আগামী দিনের পথচলার ম্যাপ সঠিকভাবে পড়তে পারেনি । এর কারণ হয়তো-যারা তাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট। এবং এ পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যের শিকার হয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই অ্যাক্ট বা রিয়্যাক্ট করেছে। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, নির্বাচন সঠিকভাবে হওয়ার ক্ষেত্রে হঠাৎ করে ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পরে যে চিঠি আসলো, উন্মুক্ত আলোচনার যে রিকোয়েস্ট, এটা কোনো দলকে খাদ দিয়ে উঠিয়ে আনার রিকভারি প্ল্যান ছিল হয়তো, যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই উপলব্ধিটা দেশের সব রাজনৈতিক দলের নিজেদের স্বার্থেই বিবেচনায় নেওয়াটা জরুরি।

লেখক: সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ‘ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইসিএলডিএস)

;

আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভাবনা নাকি নতুন চ্যালেঞ্জ? 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ কি? নির্বাচনকে বহির্বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে উপযোগি পরিবেশ তৈরি, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, দল ও জোটে সমন্বয় নাকি নাাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দেওয়া? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে অন্ততঃ আজকের দিনে ক্ষমতাসীন দলের জন্য এর চেয়ে বড় এক নতুন চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এমনকি দলের অনেক নেতাকর্মীদের কাছেও আওয়ামী লীগের এই মুহূর্তের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা। কারণ কমবেশি প্রতিটি আসনেই এবার ক্ষমতাসীন দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন। অতীতের নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেশি।  

নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণার আগে রোববার সকালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মতবিনিময় করেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী মোট ৩ হাজার ৩৬২ জনের সঙ্গে। এদিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গণভবনের প্রবেশ পথে দেখা গেছে তাদের দীর্ঘ লাইন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পারেন, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কেউ বিনা ভোটে (প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো এই খবর দিয়েছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামীলীগের এই স্ট্যান্ড ও সাম্প্রতিক বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলিতে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সহিংসতার যে স্মৃতি তা পর্যালোচনা করলে সামনের সময়গুলোতে স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি! আজকের মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তাতে তারা স্ব-স্ব এলাকায় এমপি হওয়ার লড়াইয়ে মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে সম্ভাব্য বিবাদের সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে বলেই ধারণা তাদের। যেখানে অন্য সময়ে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে যাওয়াকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হতো সেখানে খোদ দলীয় প্রধানের এমন নির্দেশনা তাদের হতবাকই করেছে।

আমরা ইতিপূর্বে একাধিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা সংসদীয় উপ-নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় অনেক নেতাকে বহিষ্কার হতে দেখেছি। এমন ‘অপরাধে’ অনেক দলীয় এমপি বা মন্ত্রীকেও সতর্ক করতে দেখেছি হাইকমান্ডকে। সেখানে দলীয় সভাপতির এই নির্দেশনায় পূর্বের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা এখন দলের ডামি প্রার্থী হিসেবে দায়মুক্তি লাভ করলে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও করছেন তৃণমূলের অনেক কর্মী। 

দ্বাদশ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার তাগিদ দিয়ে সরকার ও দলীয় প্রধান বলেছেন, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাশ করে আসতে পারবেন না’ এমনকি তিনি এও বলেছেন, ‘অন্য দলের প্রার্থী না থাকলে প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখতে হবে’।

এই বক্তব্যের মাধ্যমে দলের অবস্থান পরিস্কার করা হয়েছে বটে কিন্তু স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণে সুযোগে আরও যারা প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতায় নামতে পারেন, সেখানে দলীয় অনৈক্যের ফসল ক্ষমতাসীন দলই পাবে-এমনটাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

অপরদিকে, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামীলীগে স্থানীয় আধিপত্য রক্ষার লড়াই কতটা তীব্র হয়েছে তা সংবাদপত্রগুলো দেখলে বোঝা যাবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দলীয় অন্তর্কোন্দোল নেই এমন সংসদীয় আসন খোঁজে পাওয়া কঠিন। দলের অনেক শীর্ষ নেতা একে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বললেও বাস্তবে এটি যে আধিপত্য ও স্বার্থ রক্ষার লড়াই তা অরাজনৈতিক যে কেউ স্বীকার করবেন। এমন বাস্তবতায় নেতৃত্বের এই প্রতিযোগিতা যদি ‘বৈধ’ বলেই গণ্য হয় তবে নির্বাচনের পূর্বে আধিপত্য ও গোষ্ঠিগত দ্বন্ধ বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীন এই সংঘাত বৃদ্ধি পেলে সমাজবিরোধী অপশক্তিগুলো ভোটের মাঠে সাবোটাজ করবে না তা হলফ করে কে বলতে পারবে? এবং এই কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এর দায় ক্ষমতাসীনরা এড়াতে পারবেন না। তাতে করে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রতিদ্বন্ধিতায় নামিয়ে আওয়ামীলীগ লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই কি বাড়লো না?

;