মিয়ানমার পরিস্থিতি ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ৫ সেপ্টেম্বর, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ৪৩তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমার বিষয়ক পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়নের বিষয়ে আসিয়ান নেতারা পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করে। তাঁরা মিয়ানমারে ক্রমাগত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানায় এবং এই সংকট জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগ, মানবিক সংকট এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে তাদের মত ব্যক্ত করে। তারা একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে মিয়ানমারকে সহায়তা করার ব্যাপারে আসিয়ানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। মিয়ানমারের জনগণের প্রয়োজনে মানবিক সহায়তা প্রদান সহজতর করতে এবং সহিংসতা বন্ধে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থা এবং পার্থক্য দূর করা জরুরি। আসিয়ান সদস্যারা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পাঁচ দফা ঐকমত্য বজায় রেখে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সহিংসতা কমাতে এবং বেসামরিক, ঘরবাড়ি এবং জনসাধারণের উপর লক্ষ্যবস্তু হামলা বন্ধ করতে অনুরোধ জানাতে হবে। আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূতের প্রতি আস্থা তৈরি করতে হবে। মানবিক সহায়তার নিরাপদ এবং কার্যকর বিতরণ চালিয়ে যেতে হবে এবং মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহায়তায় নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানবিক সহায়তা সশস্ত্র সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আইডিপিদের কাছে পৌঁছে। এজন্য প্রয়োজনে বহিরাগত অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও সমর্থন জোগাড় করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মিয়ানমারের সংকট ও এর প্রভাব মোকাবিলায়, মাদক ও মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসিয়ান সদস্য দেশগুলির মধ্যে এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। সদস্য দেশ হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার, সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এই আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়নি।

মিয়ানমারের সরকারবিরোধী দলগুলো জান্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করেছে। মিয়ানমারের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিভক্ত করার জান্তার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার পর সামরিক একনায়কতন্ত্র নির্মূল এবং একটি ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির দুটি প্রধান সরকারবিরোধী সংগঠন। দেশটির জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) এবং এর উপদেষ্টা সংস্থা

ন্যাশনাল ইউনিটি কনসালটেটিভ কাউন্সিল (এনইউসিসি) জানিয়েছে যে জান্তার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি ফেডারেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা। ফেডারেল ইউনিয়ন গঠন করার জন্য সামরিক একনায়কত্বকে নির্মূল করার পাশাপাশি দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা এবং অভ্যুত্থানের প্রবণতাও মুছে ফেলতে হবে। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক সরকার উৎখাত করে একটি ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকারের নির্বাচিত আইন প্রণেতারা এবং তাদের জাতিগত মিত্রদের নিয়ে এনইউজি গঠন করেছিল। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স গ্রুপের (পিডিএফ) নেটওয়ার্ক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের (ইএও) পাশাপাশি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের অনেক মানুষ এনইউজিকে তাদের বৈধ সরকার এবং পিডিএফ গ্রুপগুলিকে তাদের সেনাবাহিনী হিসাবে বিবেচনা করে। সরকার ও বিরোধী শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের পথ প্রশস্ত করতে কিছু প্রাক্তন সামরিক জেনারেলের নেতৃত্বে একটি সামরিক-পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে জানা যায়। এনইউজি তাদের বিবৃতিতে বলেছে যে একটি ফেডারেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ নির্ধারণ করেছে তা থেকে বিচ্যুত করে এমন যে কোনও রাজনৈতিক পদক্ষেপকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তারা কেবল বর্তমান সরকারই নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ এবং জাতিগত জাতীয়তার বিরুদ্ধে তাদের নৃশংসতা মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলক ও বাস্তবায়ন করবে।

মিয়ানমারের অন্যতম প্রাচীন ও শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান পাদোহ সাও তাও নি জানায় যে, একনায়কতন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে এনইউজির অবস্থান কেএনইউর মতোই। কেএনইউ’র সশস্ত্র শাখা, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গানাইজেশন এনইউজির পিডিএফের পাশাপাশি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের জান্তা দেশটির জনগণকে দমন করার জন্য ক্রমবর্ধমান সহিংস বিমান হামলা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক হামলায় অনেক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। সামরিক জান্তা অভ্যুত্থানের পর থেকে ৩ হাজার ৯০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলো বেশ কয়েক ধাপে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও বিরোধীদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন চলছে, একই সঙ্গে বিভিন্ন ফ্রন্টে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ও প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার হচ্ছে।

জান্তা সরকার এই নৃশংসতার কথা অস্বীকার করে বলেছে যে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জান্তা সরকারকে দুর্বল করতে মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের জেট ফুয়েল সেক্টরের সঙ্গে জড়িত বা সহায়তাকারী বিদেশি কোম্পানি ও ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে এই নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করা হয়েছে এবং এটি বাস্তবায়ন হলে এই সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। মার্কিন সন্ত্রাসবাদ ও আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ব্রায়ান নেলসন জানায় যে, নাগরিকদের নিপীড়ন করতে সক্ষম এমন সম্পদ থেকে জান্তা সরকারকে বঞ্চিত করার জন্য নতুন এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জুন মাসে মুদ্রা বিনিময়ের জন্য মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজসহ রাজস্ব উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জান্তা নিয়ন্ত্রিত অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান মিয়ানমা ফরেন ট্রেড ব্যাংক (এমএফটিবি) ও মিয়ানমা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (এমআইসিবি) ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তি সোনালী ব্যাংকে ছিল যা গত জুনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় জব্দের তালিকায় পড়ে। ডলারের বিপরীতে মিয়ানমারের মুদ্রা চ্যাটের মান কমে যাওয়ায় বর্তমানে মিয়ানমার চীনের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই ব্যাংক থেকে মিয়ানমার ইতিপূর্বে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল, চায়না এক্সিম ব্যাংক মিয়ানমারকে ৫% সুদে এই ঋণ দেয়।

এসব কারণে মিয়ানমার কিছুটা অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জব্দ করার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের মংদু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে চাল ও পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায় যে, চাল, সয়াবিন, বাদাম ও পেঁয়াজসহ খাদ্যপণ্য শুধুমাত্র সিতওয়ের বাণিজ্যিক জোন দিয়েই রপ্তানি করা হবে। অনেক ইউরোপীয় কোম্পানি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারনে মিয়ানমার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ও নিচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে ভোক্তাপণ্য খাতে সৃষ্ট সে শূন্যতা পূরণ করছে এশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, তারা সেখানে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, থাইল্যান্ড ও জাপানের মতো দেশগুলোর সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকার কারণে এসব দেশের বাণিজ্যিক তৎপরতা বাড়ছে। বেসরকারি থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে মিয়ানমার সরাসরি ৫.৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে যার মধ্যে হংকংসহ চীনের সম্পদের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বা ৩ বিলিয়ন ডলার। চলমান পরিস্থিতিতেও চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে।

চীনের ইউনিয়ন রিসোর্সেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইউনান এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট দক্ষিণ মিয়ানমারে আইয়ারওয়াদি অঞ্চলে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০২৭ সাল থেকে উচ্চক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে। এটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে চলবে এবং প্রায় ১.৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ প্রকল্প এবং চীনা কোম্পানিগুলোর নেতৃত্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রেল ও বন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। মিয়ানমারের তৈরি পোশাক শিল্পে চীনের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মিয়ানমারে বর্তমানে তিন শতাধিক চীনা পোশাক শিল্প-কারখানা রয়েছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত মোট পোশাকের প্রায় অর্ধেকই চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উৎপাদন হয় । পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারে থেকে চলে যাওয়ার থাই কোম্পানিগুলোও এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসছে, তারা মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিনিয়োগ করছে। থাই জ্বালানি কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল ও গ্যাস গ্রুপ পিটিটি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন, ফরাসি জ্বালানি সংস্থা মিয়ানমার থেকে চলে যাওয়ার তাদের দায়িত্ব গ্রহন করে। মিয়ানমার এই অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইল্যান্ডের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে মিয়ানমার। থাই পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সেখানে ব্যবসা বাড়াচ্ছে। স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে তারা কারখানা স্থাপন করছে। থাই কোম্পানিগুলো নিজেদের দেশে মজুরি বাড়ার কারনে তারা স্বল্প মজুরির মিয়ানমারে বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। জাপান ও মিয়ানমার ঐতিহাসিকভাবেই মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ। জাপানের কিছু কোম্পানি মিয়ানমার থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও এখনো অন্তত ৪০০ জাপানি প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মিৎসুবিশি করপোরেশন ও মিৎসুবিশি এস্টেট তাদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মিয়ানমারে টয়োটা মোটর তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্বেও এশীয় কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধি মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান রাখতে সহায়তা করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করে। বাংলাদেশের মত থাইল্যান্ড ও চীন মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ। থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের উদ্বাস্তু সমস্যা, মাদক, মানবপাচার ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। থাইল্যান্ড নিজেদের এইসব সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও আলোচনা চালায়। চীনের সঙ্গেও মিয়ানমারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি দেশগুলো মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতেও তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করে লাভবান হচ্ছে। চলমান রোহিঙ্গা সংকট ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভাল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ চাল, ডাল সহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানি করতে পারে, এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ঔষধের একটা বড় বাজার হতে পারে মিয়ানমার। বাংলাদেশের আটটি শিল্প গ্রুপ এখন বিলিয়ন ডলার ক্লাবে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হলে ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তা থেকে যেভাবে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারে।

   

সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ফল জলবায়ু তহবিল



শরিফুল হাসান সুমন
সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ফল জলবায়ু তহবিল

সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ফল জলবায়ু তহবিল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এশিয়ায় প্রথমবারের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন ও মানিয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য ৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। আর এই সম্মিলিত তহবিল প্রদান করা হবে আইএমএফের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে।

আইএমএফের এমডি ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এক বিবৃতিতে বলেছেন, "অরক্ষিত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চতর ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনে তাদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিল বাংলাদেশ।" দেশটি জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা, অভিযোজন, প্রস্তুতি এবং সংরক্ষণকে শক্তিশালী করার জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, তিনি দুবাইতে অনুষ্ঠিত কপ২৮ এর সাইডলাইনে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে বলেছেন, "আমরা বাংলাদেশের জলবায়ু এজেন্ডার দৃঢ় বাস্তবায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত পদক্ষেপের প্রচারে অক্লান্ত প্রচেষ্টার প্রশংসা করি।"

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বলেন, "জলবায়ু ঝুঁকি বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করছে। দেশটি দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং অভিযোজনে নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছে। আজকের ঘোষণা আবারও জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখায়। এর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি, এবং আমাদের সকলকে জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার জন্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলিকে অর্থায়ন প্রদানের জন্য একসাথে কাজ করতে হবে।"

এডিবি প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া বলেছেন, "জলবায়ু ঝুঁকি বাড়ছে এবং এটি মোকাবেলায় প্রগতিশীল পদক্ষেপ এবং শক্তিশালী অংশীদারত্ব প্রয়োজন। প্রতিশ্রুতি এবং নেতৃত্বের সাথে বাংলাদেশ তার জলবায়ু এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এনসিইসিসি জলবায়ু এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি সম্পূর্ণ-সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে এবং বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন অংশীদারত্ব বাংলাদেশকে বর্ধিত ও সমন্বিত সহায়তার সুবিধা দেবে। এডিবি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে সকল উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে কাজ করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

জলবায়ু খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা

বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন প্ল্যাটফর্মের (বিসিডিপি) জন্য যে উন্নয়ন সহযোগীরা একত্রিত হয়েছে তারা হলো— এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি); বিশ্বব্যাংক; ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি); বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ); এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি); এজেন্স ফ্রান্স ডি ডেভেলপমেন্ট (এএফডি); ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি), টিম ইউরোপের অংশ হিসাবে; সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ), দক্ষিণ কোরিয়া সরকার; জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং ইউ.কে।

জলবায়ু খাতে বাংলাদেশের হুমকিসমূহ

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বাংলাদেশে চরম জলবায়ু প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনাগুলো ঘন ঘন ঘটছে এবং তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গড় তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০-২০২১ বছরে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ১৫৩ মিমি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, এবং পরবর্তী গবেষণায় শীতকাল বাদে তিনটি ঋতুতে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা পাওয়া গেছে, যা শীতল এবং শুষ্ক হয়ে উঠছে, যখন বছরের বাকি সময় উষ্ণ এবং আর্দ্র হচ্ছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং নদী উপকূলীয় সম্প্রদায়গুলো তাদের কম অভিযোজিত ক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সরাসরি সংস্পর্শে আসার কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নদীতীর ক্ষয় এবং অন্যান্য জলবায়ুগত বিপত্তি এই সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করেছে।  এই বিপদের কারণে অনেক লোক তাদের পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছে, এবং জলবায়ু-প্ররোচিত অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত বেশিরভাগ লোককে চর জমিতে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে- মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং পার্শ্ববর্তী নদী দ্বারা বেষ্টিত। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, চরের জমিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকি প্রদর্শন করে। চরের জমিতে বসবাসকারী লোকেরা একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আর্থ-সামাজিক দুর্বলতার সম্মুখীন হয় যা তাদের এক চর থেকে অন্য চরে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য করে।

সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি

তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মতান্ত্রিক বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা সব কিছু পরেও জলবায়ুগত যে প্রভাবটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে হুমকি হয়ে দেখা দেবে সেটা হচ্ছে সমুদের স্তর বৃদ্ধি।  স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এসএলআর প্রক্ষেপণের উপর পরিবেশ অধিদপ্তর দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অলটাইমেট্রি ডেটা দেখায় যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গত ৩০ বছরে ৩.৮-৫.৮ মিমি/বছর করে বেড়েছে। সমীক্ষাটি আরও দেখায় যে আগামী ১ শতাব্দীতে প্রায় ১২.৩৪%-১৭.৯৫% উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি (এসএলআর)-র কারণে তলিয়ে যাবে। অনুসন্ধানগুলি আরও দেখায় যে ৫.৮%-৯.১% ধান উৎপাদন হ্রাসের জন্য এসএলআর দায়ী হবে।

জলবায়ু খাতে বাংলাদেশের গৃহীত জাতীয় নীতিসমূহ হচ্ছে — Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP), 2009; National Adaptation Programme of Action, 2005, updated in 2009; Bangladesh Climate Change Trust Act, 2010; Nationally Determined Contributions (NDC), 2015, Enhanced & Updated in 2021; NDC Implementation Road Map, 2018; Bangladesh Delta Plan, 2100; Mujib Climate Prosperity Plan 2030 (Draft); National Disaster Management Policy, 2015; Standing Orders on Disaster 2019; Plan of Action to Implement Sendai Framework for Disaster Risk Reduction 2015-2030; National Strategy on Internal Displacement Management 2021; National Plan for Disaster Management 2021-2025; Bangladesh Energy Efficiency and Conservation Master Plan up to 2030; Renewable Energy Policy of Bangladesh, 2008; Bangladesh National Action Plan for Reducing SLCPs, 2012, Updated in 2018

 বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

বাংলাদেশ সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো নিজস্ব তহবিল থেকে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড গঠন করে। এটা ছিল অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম কোন দেশ যারা জলবায়ু খাতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড ৮০০’র মতো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষাকল্পে গৃহীত হয়েছে। এই ১৪ বছরে বাংলাদেশ ৪৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার এই খাতে খরচ করে যার মধ্যে রয়েছে অভিযোজন, প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণা।

জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীলতার লক্ষ্যে অভিযোজন প্রকল্প সমূহ

৩৫২.১২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ; ৫৯০.৬০ কিমি খাল খনন/পুনঃখনন; ৮২টি পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকাঠামো/বাঁধ স্লুইসগেট নির্মাণ; ১৪টি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ; ১৪ হাজার ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক এবং উপকূলীয় জেলেকে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি প্রশিক্ষণ; ১৯ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন চাপ সহনশীল বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ; ৮ হাজার ৫২৯টি জলবায়ু সহনশীল ঘর নির্মাণ; ২ হাজার ৪৫১টি পানি পরিশোধন সৌর প্ল্যান্ট স্থাপন; ২১০ গ্রামে ১২ হাজার ৯০০টি ভাসমান সবজির বিছানা; ৩টি রাবার ড্যাম নির্মিত এবং ২টি স্পার পুনর্গঠিত; ৯০ কিমি নদী-তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজ সম্পন্ন; ১৮টি নিয়ন্ত্রক, ১৬টি আউটলেট এবং ১২টি খাঁড়ি নির্মাণ; ২০০.৬৪ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ; ১২৮.৭ কিমি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি; ৪ হাজার ১৮৪টি গভীর নলকূপ স্থাপন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন প্রকল্পসমূহ

৭১.১৪৬ মিলিয়ন গাছ লাগানো হয়েছে; ৬ হাজার ৯২১.৭ হেক্টর বনভূমি বনায়নের আওতায় আনা হয়েছে; ৬ হাজার উদ্যোক্তার মাঝে ৯ লক্ষ  উন্নত রান্নার চুলা বিতরণ; ১০ হাজার ৯০৮ সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে; অফ-গ্রিড এলাকায় ২টি সোলার মিনি-গ্রিড প্ল্যান্ট রিমোটে ইন্সটল করা হয়েছে; ১ হাজার ৭৫১টি সোলার স্ট্রিটলাইট স্থাপন করা হয়েছে; ২ হাজার ৪৫১টি সোলার ওয়াটার পিউরিফায়ার স্থাপন করা হয়েছে; ১৩টি সৌর সেচ পাম্প বসানো হয়েছে; ৭ হাজার ৯০১টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট গৃহস্থালিতে স্থাপন করা হয়েছে, এবং ১৩টি কমিউনিটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গবেষণাসমূহ হচ্ছে—১২ ধরনের চাপ এবং তাপ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে বন ব্যবস্থাপনা, হার্ডওয়্যার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপন সম্পন্ন

জলবায়ু পরিবর্তন খাতে এই পর্যন্ত প্রাপ্ত সহায়তাসমূহ

২০০৯-১০ সাল থেকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে নীতি প্রণয়ন সহ গবেষণা ও প্রকল্প উন্নয়ন লক্ষ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে আসছে। এই খাতে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অনুদান যেমন পেয়েছে, তেমনি ঋণও নিয়েছে বাংলাদেশ।

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) থেকে ৫টি প্রকল্পে ১০১.১৪ মিলিয়ন দলা অনুদান এবং ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ; স্বল্পোন্নত দেশ তহবিল (এলডিসিএফ) থেকে ৭টি প্রকল্পে ৩৪.৪১ মিলিয়ন ডলারের অনুদান; অভিযোজন তহবিল (এএফ) থেকে ১টি প্রকল্পে ৯.৯৯ মিলিয়ন ডলারের অনুদান; গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) থেকে ৮টি প্রকল্পে ২৪.৬৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান; এবং ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ড থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান। মোট ২০০.২০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের সাথে এইসকল আন্তর্জাতিক সংস্থা ৭৪৭.২২ মিলিয়ন ডলারের সহ-অর্থায়ন করেছে।

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ২৮ সামিটে বাংলাদেশ হঠাৎ করেই জলবায়ু খাতে এই ৮ বিলিয়ন ডলার পায়নি, গত জানুয়ারিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও সহনশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যে প্রকল্পসমূহ এডিবিতে জমা দেওয়া হয়েছে সেটারই ফল প্রকাশিত হলো ৩ ডিসেম্বর এই তহবিল ঘোষণার মাধ্যমে। শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে বিজ্ঞ পরিবেশবিদদের সাথে দিয়ে দিনের পর দিন সেমিনার, সভা, কনফারেন্স করার পর সেই পরামর্শ মোতাবেক নীতি প্রণয়ন, সেই নীতির অধীনে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সেই লক্ষ্যে অর্থের সংস্থান এই সবই হয়েছে পরিকল্পিত উপায়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে।

দীর্ঘদিনের লাগাতার পরিশ্রমের ফসল হচ্ছে এডিবির এই জলবায়ু তহবিল, এবং একইসঙ্গে এটি নতুন এক চ্যালেঞ্জও। আগামীদিনের উপকুল সংশ্লিষ্ট এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো হয়তো এই তহবিলের কল্যাণে বিশাল সফলতা দেখাতে যাচ্ছে।

;

কিসিঞ্জার পাঠ ও মূল্যায়ন যথার্থ হচ্ছে কি?



কাজল রশীদ শাহীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

হেনরি কিসিঞ্জার, শতায়ু পেরিয়ে ইহলোককে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। একশ বছরের পার্থিব জীবনের পঞ্চাশ বছরই তিনি আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী তিনি। অধ্যাপক, গবেষকের অভিজ্ঞতা থাকলেও একজন কূটনীতিক হিসেবে তিনি কেবল মার্কিন মূলুকে নয়, বিশ্বব্যাপী রেখেছেন নানামুখী অবদান। যা ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ংকর রকমের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়য়েছে।

বাংলাদেশের মানুষেরা এই ব্যক্তিটিকে অন্যরকমভাবে চেনেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার ভূমিকার প্রশ্নে এবং ‘বটমলেস বাস্কেট’ উক্তির কারণে। সেই থেকে মৃত্যুাবধি-এমনকি মৃ্ত্যুর পরও উনার প্রতি প্রচ্ছন্ন নয় প্রকাশ্য বিরাগও প্রদর্শিত করেন বহু মানুষ। ব্যাপারটা দুই-দশজনের মধ্যে কিংবা বিশেষ কোন বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে-ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের ব্যতিক্রম বাদে সকলেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত।  কারণ সেটা মিথ, কিংবদন্তি বা বাগধারার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে কেউ যদি বেশি চালাকি করে। বুদ্ধি খাটিয়ে কাউকে ধোঁকা দেয়। কৌশলে কোন মুস্কিলের আসান করে তাহলে এদেরকে একবাক্যে ‘কিসিঞ্জার’ বলে। এই এই ধরনের বুদ্ধিকে, ‘কিসিঞ্জারি বুদ্ধি’ বা ‘কিসিঞ্জারি প্যাঁচ’ জ্ঞান করা হয়। ব্যাপারটার মধ্যে ঠাট্টা, বিদ্রুপ বা রসিকতা হয়তো রয়েছে। কিন্তু বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। নেয়াটা যৌক্তিকও নয়।

এদেশের মানুষেরা কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে দু’রকমভাবে দেখে- এক. বুদ্ধি খাটিয়েও সফল না হওয়া বা, বেশি চালাকি করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া। দুই. অনেক চেষ্টা তদবির করে সফল না হওয়ায় হেয় করা বা বাজে ও অযৌক্তিক মন্তব্য করা। এখন আসা যাক, প্রথম প্রসঙ্গ। কেনো কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে এভাবে দেখা হয়। এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিসিঞ্জারের হিংসাত্মক মনোভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যেন জয়ী হতে না পারে তার জন্য কিসিঞ্জার এমন কোন চেষ্টা বা পদক্ষেপ নেই তিনি করেননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতায় ভারতকে বিরত রাখতে কিসিঞ্জার আগ্রাসী কূটনীতির আশ্রয় নেয়। উনার কারণেই মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ক্ষমতাসীন প্রশাসন বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তাদের পক্ষে নেয়ার কূটনীতি শুরু করে। এই কূটনীতির স্রষ্টা হল হেনরি কিসিঞ্জার। যার অংশ হিসেবে তিনি চীনকেও তাদের পক্ষে নেয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ককে আর বেশি গাঢ় করে তোলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নানাভাবে নিজেদের মতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনভাবেই যখন উনাকে পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় কিসিঞ্জার অভ্যাসবশত ইন্দিরাকে নিয়ে বাজে মন্তব্যও করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, যা বঙ্গোপসাগর অবধি এসেও ছিল। কিসিঞ্জারের কূটনীতির কারণেই এসব হয়েছিল।

যতভাবে ও যতপ্রকারে সম্ভব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দাবিকে পরাভূত ও পরাজিত করতে যা যা করণীয়, তার সবটাই করেছিল মার্কিন প্রশাসন-যার কূটনৈতিক মন্ত্রদাতা ছিলেন কিসিঞ্জার। কিন্তু কোন চেষ্টায় সফল হয় বাঙালির লড়াকু মনোভাব ও ভারত-রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আমাদের পাশে থাকার জন্য। এতে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে, যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন এবং ষড়যন্ত্রকারী যতই শক্তিধর হোক না কেন, ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্যতাভিত্তিক কোন দাবিকেই ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না। এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ আজও কেউ যখন অন্যায়ভাবে কিছু করে, তাকে কিসিঞ্জার বলে এবং এধরণের বুদ্ধিধরদের কিসিঞ্জারি বুদ্ধি বলে চিহ্নিত করে।

কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশে এবং বিদেশে। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের দেশের গুণীজনরা যেমন রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নরাও উপস্থিত আছেন। গার্ডিয়ান, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতো আন্তর্জাতিক প্রভাবশারী দৈনিকের লেখাও এই বিবেচনার মধ্যে পড়ে। সবগুলো লেখারই মৌল স্বর এক ও অভিন্ন। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা কি উনার বুদ্ধিমত্তা ও কূটনীতিক ক্ষমতার কথা ভুলে গেছি? কূটনীতি দিয়ে তিনি ক্ষেত্র বিশেষে কিছু জায়গায় কিংবা বেশীরভাগ জায়গায় শঠতার পরিচিয় দিয়েছেন । যা অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উনার বিচারের দাবি উঠেছে। কিন্তু কিসিঞ্জারের কুটনীতির পাল্টা পাঠ মেলেনি। কূটনৈতিক কিসিঞ্জারকে কূটনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা দেখা যায়নি।

এ লেখায় আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কিসিঞ্জার নামটা শুনলেই বা উচ্চারিত হওয়া মাত্র বহুল উচ্চারিত সেই বাক্যটাই সামনেই আসে, ‘বটমলেস বাস্কেট’। কোন প্রেক্ষাপটে কী বিবেচনায় তিনি এ কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেলের বাস্তবতাকে ঘিরে তিনি ওকথা বলেছিলেন। হ্যাঁ, ওই কথার মধ্যে-বিদ্রুপ, শ্লেষ, অবমাননা সবই ছিল। যা মেনে নেয়া বা সহ্য করা কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিসিঞ্জার যা সেদিন বলেছিল, আজ তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দেখিয়েছে সে বটমলেস বাস্কেট নয়। এখন এই প্রসঙ্গ আমরা যদি একটু উদারভাবে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে কোন্ সত্যে আমরা হাজির হব। সত্যিই কি সেদিনের বাংলাদেশ বটমলেস বাস্কেট ছিল না? যদি তাই-ই না হবে তাহলে আজকের অবস্থানে আসতে আমাদের এত সময় কেন লাগলো? আবার এই প্রশ্ন ওঠা কি সঙ্গত নয়, পঞ্চাশ বছরে একটা স্বাধীন দেশের যে অবস্থায় যাওয়ার কথা ছিল সেখানে কি পৌঁছানো সম্ভব হল? গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তায়, বাক্ স্বাধীনতার চর্চায়, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রশ্নে, নীতি ও ন্যায্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকারে আমরা কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারলাম?

আমরা সকলেই জানি, আমেরিকা-চীনের সম্পর্ক মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বৈরিতায় ভরা। তারপরও কিসিঞ্জার নিজস্ব কূটনীতি দিয়ে সেই সম্পর্ক এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন যা, দুইদেশের কাছে প্রশংসনীয়। চীনের কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে আমেরিকান তিনি হলেন কিসিঞ্জার। উনার শতবর্ষের জয়ন্তী যখন আমেরিকায় উদযাপিত হয়, তখন চীনেও তার ছোঁয়া লাগে। চীনারাও নিজেদের মধ্যে আয়োজন করেন একজন আমেরিকানের জন্মদিন। যখন ‍দুটো দেশ একে অপরের প্রতি উষ্মা প্রকাশে সিদ্ধ ও রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তখন এ ধরনের আয়োজন বিস্ময়ের শুধু নয়, একজন কূটনীতিকের সুদূরপ্রসারী সাফল্যেরও অংশ।

নোবেল কমিটি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল দিয়েছেন। বলা হয়, নোবেলের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত পুরস্কার ছিল এটি। কমিটির দু’জন সদস্য প্রতিবাদে পদত্যাগও করেন। ভিয়েতনাম-মার্কিন যুদ্ধ অবসানে পদক্ষেপ নেয়ায় তিনি নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। এরপর আরও দু’বছর লেগে যায় যুদ্ধ নিরসনে। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের ওই উদ্যোগ কি ভুল ছিল। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের কোন মার্কিন রাষ্টপতিকে নোবেল না দিয়ে কেন উনাকে দেয়া হল? উনি কি সত্যিই কোন পদক্ষেপ রাখেননি যুদ্ধ বন্ধে? এসব পশ্নের যৌক্তিক উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

বলা হয়, কিসিঞ্জারের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বেধেছে। আবার একথাও সত্য যে, তিনি কোনো কোনো যুদ্ধ বন্ধেও সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিসিঞ্জারের যত দোষ-ত্রুটি ধরা হয়, একজন আমেরিকানের কাছে কিন্তু তিনি এসবের ঊর্ধ্বে। সকল মার্কিনীদের কাছে তিনি বন্দিত। উনার কূটনীতির তারিফ করেন সবাই, তা তিনি ডেমোক্রেট হোক অথব রিপাবলিক। এখানেই কিসিঞ্জারকে বিবেচনায় নিয়ে সমালোচনা করা উচিৎ। তিনি হয়তো আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু দেশপ্রেমিক হিসেবে, একজন আমেরিকান হিসেবে কি অনন্য নন?

কিসিঞ্জারের সমালোচনা যতটা করা হয়, বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করা হয়, সেভাবে উনার কূটনীতির প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি কিন্তু সেভাবে দেখা যায় না, নেই বললেই চলে। সমালোচনা করা সহজ। প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়া কঠিন। কিসিঞ্জার প্রশ্নে আমরা কি সহজ পথটাই বেছে নেয়নি? আমেরিকার মোকাবেলা যেমন আমেরিকার মতো হয়েই করতে হবে, তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা জারি রাখতে হবে। তেমনি কিসিঞ্জারের যা কিছু অপছন্দ, যা কিছু ঘৃণা ও বিবমিষার তার মোকাবেলা করতে হবে প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে-তাকে ছাড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কেবল বিদ্রুপ, সমালোচনা আর কটুকথা দিয়ে কোন অর্জন হয় না, বরং আরও শক্তিধর করে তোলা হয়। কিসিঞ্জারের মূল্যায়নে-কিসিঞ্জারে পাঠে আমরা কোনটা করছি, সেটা কি একবার ভেবে দেখছি?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

[email protected]

;

ওই জিনিসটাই নেই- সেটা নৈতিক মূল্যবাধ!



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সেদিন একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তাদের বিতর্ক শুনে সবাই অনেকটা বিমোহিত। আমিও কিছুটা অবাক হয়েছি উভয় দলের তার্কিকদের ভাষা ও বচনভঙ্গি শুনে। বিতর্ক শেষে নির্বাচিত আলোচকবৃন্দ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির উপর বক্তব্য দিলেন। দশ-বারটি সুপারিশ উঠে এলো। কিন্তু একজন ক্ষুদে বক্তা কিছু সময়য়ের জন্য তাকে বিতর্কের বাইরে আরো কিছু বলার সুযোগ দিতে অনুরোধ করলো। সেটা শুনে উপস্থিত সবার চোখেমুখে ভিন্নকিছুর আভাস ফুটে উঠলো।

তার্কিক বললো, সবার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সবারটা মানতে চেয়েও পারছি না। কারণ, সবাই একটি কথা বলতে গিয়েও অস্পষ্টভাবে বলছেন কেন তা বোধগম্য নয়। এই অস্পষ্টতার আড়ালে যেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে তা হলোওই জিনিসটা। আর ওই জিনিসটার বড় আকাল লেগেছে। শুনতে চান আপনারা- ওই জিনিসটা কি? আমাদের মধ্যে ওই জিনিসটাই নেই- সেটা ওপেন সিক্রেট, সবার জানা গোপন কথা। তা হলো সততা-নৈতিকতা! ওর সুস্পষ্ট কথায় বলিষ্ঠ সুর শুনে সবাই ভিমড়ি খাবার যোগাড়।

এবার তার বক্তব্য আরো বেগবান হলে সে গড় গড় করে বলতে লাগলো- আমরা ছোট মানুষ। আমাদেরকে গণমাধ্যমে কেন বিতর্কের নামে বড়দের ঝগড়া, খারাপ কথা শুনতে হয়? বর্তমানে দেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে যে বাকযুদ্ধ ও শক্তিপ্রয়োগের মহড়া শুরু হয়েছে তার মূল কারণ হলো- ‘নিশীথের ভোট’যেটা বহুবার বহু জায়গায় বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে, ছাপা হয়েছে। এমনকি এজন্য দেশ ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতেও তোলপাড় হয়েছে। মামলা-হামলা হয়েছে, কারাবরণ হয়েছে এবং সেগুলো চলছে। কিন্তু সেই কারণগুলোর তদন্ত হয়নি, নিষ্পত্তি হয়নি। এখন ভাবনা হচ্ছে, ‘আমি আছি থাকবো, যেভাবেই হোক নির্বাচন হবে।’এজন্য ‘নিজের পরীক্ষায় নিজে নিয়ন্ত্রক হবার অপবাদ ও  গ্লানিটুকুও কাউকে স্পর্শ করে না। ফলত: সেগুলোর পৌণ:পুনিক আশঙ্কা থেকেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে আয়োজনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা জটিলতা তৈরী হয়েছে।’

সেদিন একটি বৃহৎ মহাসমাবেশ ভন্ডুল করার উদাহরণ দিয়ে সে বলতে চেষ্টা করলো- ‘এতবড় জনসমাবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে আয়োজনের ঘাটতি ছিল না। মহাসমাবেশ শেষ না হতে মাঝপথে হঠাৎ বিকট সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ে কেন আতঙ্ক তৈরী করা হয়েছিল? সমস্যা সেখান থেকেই নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হয়। সেই শব্দ ও গ্যাস ছোঁড়া না হয়ে জনসভাটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবার সুযোগ পেত এবং সেখানে কোনরুপ গোলযোগ হতো না। একজন নিরীহ পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। হাজারো গ্রেনেড, গুলি, গ্যাস শেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার কি দরকার ছিল?’

‘সেদিন নিযুক্ত হাজার হাজার নিরাপত্তাকর্মীর মধ্যে রহস্যজনকভাবে একজন সদস্যকে রেখে অন্য নিরাপত্তা সদস্যরা সবাই কেন দৌড়ে পালিয়ে গেলেন তাও বোধগম্য নয়। টিভিতে দেখা গেছে মোটামুটি ফাঁকা রাস্তার ফুটপাতে কতিপয় উচ্ছৃংখল জনতা তাকে পেটাচ্ছিল। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্বেও কেন তারা মাত্র একজন সহকর্মীকে ফেলে রেখে সবাই উধাও হয়ে গেলেন- সেসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এমনকি সেই সদস্যের আহত হয়ে দীর্ঘক্ষণ রাজপথে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তড়িৎ কোন এম্বুলেন্সও আসেনি তাঁকে উদ্ধার করতে। এরপরের ঘটনা তো আপনারা সবাই বেশ কদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছেন। সেগুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’

তার দলের আরেক সদস্য তাকে সাপ্লিমেন্ট করার সুযোগ চেয়ে বলতে লাগলো- তবে এসব দেখে মনে হয় দেশের অর্থনীতির বড় ধরণের ক্ষতি করার জন্য এই হীন পরিকল্পনা অত্যন্ত সুকৌশলে সাজানো হয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনের ঘটনার ১২ দিন পর জানানো হচ্ছে- প্রতিদিন অবরোধে দেশের ৬.২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এর মূল কারণ রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মহাসমাবেশে আতঙ্ক তৈরী করে ‘মব’বা উচ্ছৃংখলতা সৃষ্টি করা। দেশে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান কখনই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।’

গেল অক্টোবরে ঢাকার কাওলায় এবং ১১ নভেম্বর ২০২৩ মাতারবাড়ির জনসভায় শোনা গেছে- ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন এদেশে হবে।’গণমাধ্যমের কল্যাণে ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন’নিয়ে উৎসাহ বেড়েছে। দ্য গার্ডিয়ান (১০.১১.২০২৩) এটাকে ‘প্রি ইলেকশান ব্রুটাল রিপ্রেশন... দেয়ার আর নো মোর রুম লেফ্ট ইন দা প্রিজনস’বলেছে। দেশ-বিদেশ ভেদে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সবার চাওয়া। মূল কথা হলো- জনগণ নির্বাচন চায়, কিন্তু যেনতেন নির্বাচন চায় না।’

‘এই অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে জনাতঙ্ক ও ভয়ংকর ভীতি সৃষ্টির দায়টা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু এ ধরণের জনভোগান্তিমূলক অন্যায় কাজের জন্য রাষ্ট্র সবসময় তাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকে।

অপরদিকে আগামী নির্বাচনের এখনও তপসিল ঘোষিত হয়নি অথচ রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য আয়োজিত নানা জনসভায় ক্ষমতাসীন দল একাই সাড়ম্বরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় যানবাহন ব্যবহার করে অফিসিয়াল কাজের জন্য নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে তপসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনের জন্য নিজের মার্কায় জোরগলায় ভোট চাওয়া নিশ্চয়ই ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। নতজানু পরাধীন নির্বাচন কমিশন এখানে কিছুই বলার ক্ষমতা রাখেন না। এখানে কারুরই ওই জিনিসটা নেই। তাহলো- নৈতিকতা।’এথেকে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যা বুঝি তা স্বাথর্পরতা শেখাচ্ছে।

এভাবে দ্বিতীয় তার্কিকের বক্তব্য শুনতে শুনতে উপস্থিত সবাই খানিকটা চুপ হয়ে গেল। সেদিন কেউ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো না।

বিষয়টা হলো একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চ্চার পথে যেসব কন্টক ওঁৎপেতে থেকে জনগণের কন্ঠকে রোধ করতে সহায়তা করছে তার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল বিভিন্ন শাখা বহুলাংশে দায়ী। সেসব দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হীন ভূমিকা আজকাল বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা নিজস্ব পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে দলীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি শুরু করে দিয়েছে। এদের অনেকের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিঁটেফোটাও নেই। এদের অনেকের ছাত্রজীবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়- তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হীন ছাত্ররাজনীতি করতো এবং হলের ডাইনিংরুমে ‘ফাও’খাওয়া দলের সদস্য ছিল। অনেকে ‘কালো বিড়াল’পদ্ধতিতে চাকুরী জুটিয়ে নেবার পর দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়াতো। এসব ‘বানরের গলে মুকুতার হার’জোটায় তারা দেশের কল্যাণের কথা মোটেও চিন্তা করে না। তারা অনেকই পরিবার দেশের বাইরে রাখা দ্বৈত নাগরিক। অথবা দেশের আপামর মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করার অর্ন্তর্নিহিত শক্তি তাদের মধ্যে নেই।

তাইতো আমাদের দেশের অদূরদর্শী, ব্যবসায়ী, লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের ফাঁদে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরো দীর্ঘায়িত করে তুলেছে। এউ উভয়বিধ শক্তি একসংগে মিলিত হয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেবার নীলনক্সা তৈরী করেছে। এই নীলনক্সার ফাঁদে এখন বাংলাদেশের অসম উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও চরমভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ শ্রমিকদের কর্মহীনতা ও কর্মঅসন্তোয় শুরু হয়েছে। কারণ, শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনলেই উন্নতি হয় না। সেই গাড়িতে চড়ার মতো ও গাড়ি মেইনটেইন করার মতো ও উপযুক্ত মানুষ তৈরী করতে হয়। যার ইতিবাচক প্রচেষ্টা নেই আমাদের দেশে। অগণতান্ত্রিক কূটকৌশলে দেশের ৭৫-৮০ ভাগ মানুষকে সেই সুবিধার বাইরে রেখে চলার চেষ্টার ফলে যে সামাজিক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা রুখে দেবার মত সামাজিক শক্তি রাষ্ট্রের হাতে কোন দেশে কস্মিন কালেও ছিল না। বরং ইতিহাসে সেসব দেশে গণবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়ে ভয়ংকর নাজুক পরিস্থিতিতে গণেশ উল্টে যেতে দেখা গেছে।

তাদের হীন পরিকল্পনার জন্য জনগণ শুধু বিব্রতই নয়- বড় নাজেহাল হয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব হীনতা, দীনতা, নিচতা শুধু বইয়ের কথা নয়। এগুলোর সংগে চরম বাস্তবতা জড়িত। এই বাস্তবতাকে যারা দু’একবার অস্বীকার করে এবং সঠিক পথে ফিরে আসে তারা রক্ষা পায়। আর যারা ক্রমাগত এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আরো এগিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলতে চায় তারা চরমভাবে হোঁচট খায় ও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। যুগে যুগে এটাই সঠিক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

আলোচ্য বিতর্ক অনুষ্ঠানের কিশোর তার্কিকদের মুখ থেকে উচ্চারিত বক্তব্য সেদিন উপস্থিত সদস্যরা এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে যারা পরবর্তীতেও শুনেছেন তাদের কপালের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা চিন্তার বলিরেখা ভেসে উঠেছে। আমাদের দেশে চারদিকে অনৈতকতার চর্চ্চা এবং এর প্রভাবে যেসব অনাচার, দুর্নীতি, অসততা ও জনভোগান্তির ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অতি সহজ ব্যাপার নয়।

তাই সেই কিশোর তার্কিকদের মতো মনে রাখতে হবে, আপনি যাই বলুন না কেন- যাই করুন না কেন সেখানে সবার আগে অপরের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না সবাইকে সেটি মনে রাখা। কারণ, আমরা এমন একটি সমাজের মধ্যে বাস করছি সেখানে মুখের কথায় সবার সবকিছু আছে বলে ফুলঝুরি তোলা হলেও অনেক দায়িত্বশীল মহারথীদেরও শুধু ‘ওই জিনিসটাই থাকে না, তা হলো-  নৈতিক মূল্যবোধ।’

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

E-mail: [email protected]

;

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা



শরিফুল হাসান সুমন
ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির বিষয় ছিল—‘বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি’ বিষয়ে সংকলিত প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রতিবেদন যদিও সারাবিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, তারপরেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই স্মারকলিপির লক্ষ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রম ইস্যু (গার্মেন্টস কর্মীর মৃত্যু) উল্লেখ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেটস উনার স্মারকলিপি প্রকাশ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে। এই নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম ইস্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজস্ব কূটনীতিক বা মিশন প্রধানেরা যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের উপর এই নীতি আরোপ হতে পারে, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার হরণ হচ্ছে।

এই নীতির অনেক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে যা বিপদ সংকেত এর কারণ হতে পারে। এই নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষ, এবং যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এটার ব্যবহার করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের জন্য একটা সতর্কবার্তা যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে কী কী করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং এটি অবশ্যই বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

এই ছিল ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রেরিত চিঠির সারসংক্ষেপ। গত ১৬ নভেম্বর সান ফ্রান্সিসকোতে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এপিইসি) একটি আয়োজনে ওই স্মারকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। শ্রম অধিকার হরণ করে এমন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত শ্রমনীতির প্রেক্ষিতে প্রতিটা দেশের রাষ্ট্রদূতই সম্ভবত নিজ নিজ দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে।

কী ছিল মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত শ্রমনীতিতে?
১. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান রক্ষা ও প্রচারের জন্য আমরা সারা বিশ্বে সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতকে যুক্ত করব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রদূত, সমস্ত লোক যারা বিশ্বজুড়ে আমাদের দূতাবাস চালাচ্ছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে, ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকবেন যাতে তাদের কণ্ঠস্বর আমরা যা কিছু করি তাতে প্রতিফলিত হয়।

২. যারা হুমকি দেয়, যারা ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রম অধিকার রক্ষাকারী, শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে—নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো জিনিস ব্যবহার করে, আমাদের এখতিয়ারের সবকিছু প্রয়োগ করে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

৩. আমরা শ্রম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মচারীদের জন্য বৃহত্তর কাজের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানার জন্য, অপব্যবহার খোঁজা এবং প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মীদের অধিকারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ফেডারেল সরকারের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করব।

৪. আমরা শ্রম অধিকার এবং মান উন্নীত করার জন্য সরকার এবং জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, জি-২০ এর সাথে কাজ করব। এটি সেই কাজের অংশ হবে যা আমরা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে করি, যেখানে অনেকগুলো নিয়ম সেট করা আছে।

৫. আমাদের নিজস্ব বাণিজ্য চুক্তি, সরবরাহ চেইন, শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং আমরা জোরপূর্বক শ্রম দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানি করছি না—তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের যথাযথ পরিশ্রম এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা করব।

সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

১৬ নভেম্বর এই শ্রমনীতি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতি সংবাদপত্র একের পর এক স্যাংশনের ভয় দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। তারা এমনভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিছে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর যেন বিশাল কোন দুর্যোগ নেমে আসতে যাচ্ছে, যা সর্বৈব মিথ্যা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র বা অল্প জানার কুফল।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক প্রেরিত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি প্রকাশ করে সেটার ভুল ব্যাখ্যা করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে শিক্ষিত ও স্মার্ট সাংবাদিকরা। ভিসা স্যাংশনের পর যে শুরু হয়েছে আমেরিকার স্যাংসনের জুজু, সেই জুজু দেখিয়ে বর্তমান সরকারের উপর অনাস্থা সৃষ্টি করতে এই প্রতিবেদনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে টুইস্ট করে প্রচারিত হচ্ছে। নির্বাচন পূর্ব সংবাদমাধ্যমের রাজনীতির এই খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আর ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে।

তৈরি পোশাকশিল্প কি পশ্চিমা শ্রমনীতির বাইরে?

বিগত ৪ দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গার্মেন্টস বিদেশি বায়ারের সকল নীতি, যেটাকে বলা হয় কমপ্লায়েন্স, সেটা মেনেই পোশাক প্রস্তুত করে। এছাড়া বড় বড় পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনেক নির্দেশনা থাকে তৈরি পোশাক নির্মাতাদের জন্য। এগুলোর মধ্যে কাজের পরিবেশ থেকে শুরু করে, পণ্যের মান, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শ্রমিকদের বয়স, অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিবিধ নির্দেশনা থাকে; এবং সেগুলো মেনে চলছে কিনা সেটা নিয়ে আবার প্রতিটা বায়ার নিজস্ব লোক দিয়ে প্রতিটা গার্মেন্টস পরিদর্শন করায়। এই সকল পরিদর্শন শেষে, ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই সেই গার্মেন্টসে পণ্য প্রস্তুত করতে রাজি হয় পশ্চিমা বায়াররা। বাংলাদেশের কিছু কিছু গার্মেন্টস বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে কথা মাথা রেখে গাছপালা আচ্ছাদিত সবুজ গার্মেন্টস (green factories) তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশের সবচেয়ে বেশি সবুজ গার্মেন্টস এখন বাংলাদেশে অবস্থিত, এবং এই সংখ্যাটা ২০০’র উপর। আর এই নির্দেশনাগুলো মেনেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে বিশ্ব নন্দিত ব্র্যান্ডগুলো পোশাক তৈরি করে নিয়ে যায়। এতদিন ধরে মেনে আসা OCS & RCS Certificate, WRAP Certificate, ACCORD Recognition, H&M Gold Supplier, ISO 9001:2015, Compliance Certificate-সহ সকল সার্টিফিকেশন আর শ্রমনীতি মেনেই বাংলাদেশে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে আর সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত শ্রমনীতি এর বাইরের কিছু না। এটা শুধুমাত্র একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে পারে সেই সকল দেশের ওপর, বা প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যক্তির যারা উক্ত শ্রমনীতি অনুসরণ করছে না।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত "বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি" নিয়ে নতুন করে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আমূল বদলে গেছে। তবে ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী একটু সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। কেননা এটা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়ে গেছে যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা নোংরা খেলায় নেমেছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং অনমনীয় নেতৃত্ব চক্ষুশূল হয়েছে আমেরিকার জন্য। তাই তারা যেমন ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, তেমনি তারা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর শ্রমিক অধিকারের দোহাই দিয়ে শাস্তি আরোপ করতেও পিছপা হবে না। তাই আমাদের সচেতন আর সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

ভুল, মিথ্যা খণ্ডিত তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার এই যে অসাধু প্রক্রিয়া চলমান, এতে দেশের কোন লাভ হবে না বা হচ্ছে না। এতে লাভবান হবে বাংলাদেশবিরোধী শত্রুরা, যাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি সহ্য হয় না, যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে দেখতে চেয়েছিল!

;