শিল্প বিপ্লব: স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট এভিয়েশন



মো. কামরুল ইসলাম
শিল্প বিপ্লব: স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট এভিয়েশন

শিল্প বিপ্লব: স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট এভিয়েশন

  • Font increase
  • Font Decrease

বিপ্লব, বিপ্লব শব্দগুলো শুনলেই কেমন জানি আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ, বিগ্রহ এর কথা মনে পড়ে যায়। আর শিল্প বিপ্লব সে তো এক মহাযজ্ঞ। বর্তমান বিশ্ব আধুনিকতায় ভরপুর। পুরো বিশ্ব যেন হাতের মুঠোয়। অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আলোতে আলোকোজ্জ্বল হয়েছে আধুনিক বিশ্ব।

ধাপে ধাপে এগিয়ে চলা বিশ্ব আজ ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সময়কাল অতিক্রম করছে। সেই ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের উন্মেষ ঘটেছিলো, যা প্রথম শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। প্রায় শত বছর পর ১৮৭০ সালে বিদ্যুতের আবিষ্কার বিশ্বই যেন নতুন বিশ্বকে খুঁজে পেয়েছে। রাতের অন্ধকারকে নিমিষেই দূরে ঠেলে এগিয়ে চলেছে। সব আবিষ্কারের সূঁতিকাগারই যেন বিদ্যুতের আবিষ্কার। বিদ্যুত বিনে কোনো কিছু কল্পনাই করা যায় না। বিদ্যুত আবিষ্কার ছিলো শিল্পের ২য় বিপ্লব।

বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে ১৯৬৯ সালে আবিষ্কার হয় ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক সূতায় গেঁথে উঠে সারা বিশ্ব। তাতেও যেন তৃপ্তি মিটছিলো না। শিল্প বিপ্লবের তৃতীয় ধাপ শুরু হয় ইন্টারনেটের আবিষ্কারের কারনে। ২০১১ সালে অপার সম্ভাবনা নিয়ে যে বিপ্লব সাধিত হয় তার নাম ডিজিটাল বিপ্লব। ডিজিটাল বিপ্লবই হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ডিজিটাল বিপ্লবের মাধ্যমে নিমিষেই সব খবরাখবর বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। ২০২০ সালে মহামারি করোনার ছোবলে সারা বিশ্ব যখন থমকে যাওয়ার উপক্রম তখন এই ডিজিটাল বিপ্লবের কল্যাণে বিশ্ব যেন দেখতে পায় অন্য এক বিশ্বকে।

ফেসবুক, হোটাসআপ, জুম, ইন্টারনেট কিংবা নানাবিধ স্যোসাল মিডিয়ার বদৌলতে বিশ্ব যেন চলার গতি পায়। কোভিডে থমকে যাওয়া পৃথিবী গতির সঞ্চার পেয়েছিলো ডিজিটাল বিপ্লবের কারনে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার আধুনিকীকরনের চলমান প্রক্রিয়া।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরী করতে পারে। বাস্তবিক চিত্র ‘কম দক্ষতা স্বল্প আয় বনাম বেশী দক্ষতা উন্নত আয়’ কাঠামো অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লবের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছে। এক একটি শিল্প বিপ্লব পরিবর্তন করেছে সারা বিশ্বের শিল্পের উৎপাদন, বাজার ও ব্যবসার গতিপথ, পরিবর্তন করেছে মানব সভ্যতার ইতিহাস ও সমাজের জীবনাচারণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ছাড়িয়ে যাবে আগের তিনটি শিল্প বিপ্লবকে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিবেচনায় বাংলাদেশের সার্বিক সূচক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলা করতে হলে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট এর উপর জোর দিতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্মেন্ট, স্মার্ট সিটিজেন ও স্মার্ট সোসাইটি তৈরীর কথা বিবেচনা করতে হবে।

ডিজিটালাইজেশন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় একটি প্রচলিত শব্দ। বর্ডার, ইমিগ্রেশন, এভিয়েশন, সাইবার সিকিউরিটি সব জায়গায় ডিজিটাল হতে হবে।স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা বিশেষ করে বিমান শিল্পের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলা করা যেতে পারে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দ্বারা উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো কিভাবে বাংলাদেশের কর্মীবাহিনী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের এই নতুন যুগে নেভিগেট করার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারে সেই বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশের এভিয়েশনকে এগিয়ে যেতে হবে। স্মার্ট এভিয়েশন গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর সঙ্গে বন্ধ বিমানবন্দর সমূহ চালু করতে হবে।

বাংলাদেশের ৮টি চালু বিমানবন্দর এর মধ্যে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে। খুব সহসাই আরো দু’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখার সুযোগ আছে। ৫টি বিমানবন্দর আছে যেগুলো পূর্বে চালু ছিলো এখন বন্ধ। সেইগুলো পুনরায় চালু করলে দেশের বৃহদাংশ জনগোষ্টি আকাশ পরিবহনের সুবিধা পাবে। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশের জিডিপিতে কন্ট্রিবিউশন বাড়বে। সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকের প্রবৃদ্ধি ঘটবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৩১টি অব্যবহৃত এয়ারফিল্ড বা এয়ার স্ট্রিপ আছে সেগুলোকে ন্যূনতম স্টল এয়ারপোর্ট হিসেবে যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা যায় দেশের সব অঞ্চলের জনগন আকাশপথের সুবিধা ভোগ করতে পারবে। দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক হেলিপোর্ট ও ওয়াটারপোর্ট নির্মান করলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগনও আকাশপথ ব্যববহার করতে পারবে। সাথে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী পথের সাথে আকাশ পথের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে উন্নয়নের অগ্রগতি সুষ্পষ্ট দৃশ্যমান। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অন্য রাষ্ট্রের কাছে ঈর্ষনীয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমানে অগ্রগতির সকল সূচক উর্ধ্বমূখী। আর এই অগ্রগতির মাইলফলককে আরো বেশী সুসংহত করছে দেশের এভিয়েশন শিল্পের অগ্রসরমান অবস্থান।

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

   

এই প্রথম অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
এই প্রথম অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

এই প্রথম অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

  • Font increase
  • Font Decrease

 

১৯৪৯ সালের ৩১ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ক্যারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে বার্মায় সংঘাত শুরু হয়। মে ১৯৪৯ সালে ১১২ দিন যুদ্ধ শেষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী  ক্যারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গানাইজেশনকে হারিয়ে ইয়াঙ্গুন শহরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধ ছিল ক্যারেন এবং ভামারদের মধ্যেকার সুযোগ সুবিধার সমতা আনার জন্য ক্যারেনদের সংগ্রাম, তারা তাদের এই যুদ্ধ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০ এর দশকে কাচিন, কায়াহ, মন এবং শান প্রদেশে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়। কিন্তু সেই সময়েও আর ও ২০ টি নতুন সশস্ত্র জাতিসত্তার দল আত্মপ্রকাশ করে। নব্বুই এর দশক থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চলাকালীনও এই দলগুলো তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যায়। মিয়ানমারের সামরিক সরকার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান সংঘাতের মধ্যে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (ইএও) সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৫ অক্টোবর সামরিক সরকার বহুপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি (এনসিএ) স্বাক্ষরের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায়। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল করার পর এই অনুষ্ঠানটি ছিল সামরিক সরকার এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নেতাদের সাথে প্রথম এই ধরনের আনুষ্ঠানিক সমাবেশ৷

বর্তমান সেনাসমর্থিত শাসনের বিরোধিতাকারী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, এই তিনটি স্বাক্ষরকারী দল এই অনুষ্ঠানটি বয়কট করে। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা জানায় যে, সরকার চলমান সহিংসতা বন্ধ না করা পর্যন্ত তারা এনসিএ শান্তি আলোচনায় যোগ দেবে না। এই তিনটি দল গণতন্ত্রপন্থী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পি ডি এফ) সাথে জোট করে  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের শিকার এবং তা এখনও চলমান। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে আটটি জাতিগত সশস্ত্রগোষ্ঠী এনসিএ স্বাক্ষর করে, পরবর্তীতে ২০১৮ সালের  ফেব্রুয়ারী  মাসে  আরো দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী অং সান সু চির সরকারের অধীনে যুদ্ধবিরতিতে যোগ দেয়ায়  মোট ১০ টি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহের অবসানের একটি পদক্ষেপ হিসাবে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর ২০২২ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দশটি ই এ ও’র সাথে তিন দফা শান্তি সংলাপ আহ্বান করে এবং এই শান্তি আলোচনার ফলে চারটি সাধারণ চুক্তি হয়। এই প্রক্রিয়ায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১২১টি শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

২০২৩ এর অক্টোবরের শেষভাগে জাতিগত সংখ্যালঘু তিনটি গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) একত্রে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে জোট গঠন করে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত হামলা শুরু করে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স যৌথ অভিযান চালিয়ে চীন -মিয়ানমার বাণিজ্য কেন্দ্র বলে পরিচিত সীমান্তবর্তী চিন শওয়ে হাও শহর দখল করে নেয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স চীনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দেয় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং দখল করে। নভেম্বরে ২০২২ থেকে চলমান অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে এএ রাখাইনের তিনটি জনপদের পাঁচটি স্থানে হামলা চালায়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য এএ  রাখাইনের রাথেডাং এবং মিনবিয়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর কয়েকটি চৌকি দখল করে। এএ’র হামলায় জান্তা বাহিনী ও পুলিশ ৪০টি অবস্থান হারিয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বিদ্রোহীরা দুটি সামরিক শিবিরে হামলা চালিয়েছে। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ) জান্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতীয় সীমান্ত শহর দখলের পর ১২ নভেম্বর ফালাম টাউনশিপের ভারতীয় সীমান্ত শহর রেহ খাও দাহ শহর দখল করে, এটি উত্তর চিন রাজ্যে ভারতের প্রধান বাণিজ্য রুটে অবস্থিত। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স থাই সীমান্তের কাছে পূর্ব কায়াহ রাজ্যের রাজধানীর অদূরে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করছে। ৩ নভেম্বর, পিডিএফ সহ একটি প্রতিরোধ জোট সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহর দখল করে, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আক্রমনে ৭ নভেম্বর সাগাইংয়ের তামু জেলার কাম্পাটের পতন ঘটে। কায়াহ (কারেনি) রাজ্যে, কারেনি প্রতিরোধ বাহিনী লোইকাও নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে তারা জান্তার প্রায় নয়টি অবস্থান দখল করে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দশকের পর দশক ধরে ইএও’দের সাথে সংগ্রাম করে আসছিল। এবারের মত পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা কখনও হয়নি।মিয়ানমার সেনাবাহিনী দশকের পর দশক ধরে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (ইএও) সাথে সংগ্রাম করে আসছিল। এবারের মত পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা কখনও হয়নি। মিয়ানমারজুড়ে একাধিক ফ্রন্টে ক্রমাগত সেনাবাহিনীর পরাজয়ের মধ্যে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বেসামরিক জনগণের দুর্দশার জন্য দেশটির ইএও’কে দায়ী করে তাদেরকে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে। চলমান সেনা শাসনের শুরু থেকে মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিলেও এই পরিস্থিতি তাদের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন জনজীবনের উপর প্রভাব ফেলায় সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন কমে গেছে। অনেক বিশ্লেষক অপারেশন ১০২৭-এর সাফল্যের জন্য চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করে,  অনেকের মতে বার্মা এক্টের কিছুটা প্রভাব এই সমন্বিত আক্রমনের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে যাই হোকনা কেন, এবারের সংগ্রামে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকমনা জনগুষ্টি বিশেষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামার জনগোষ্ঠীর সমর্থন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সামর্থ বাড়িয়েছে। দেশের মুল জনগোষ্ঠী ভামারদের সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন কমে যাওয়া এবং ভামার সংখ্যাগরিষ্ঠ সামরিক বাহিনীতে ভামার তরুনদের যোগদানে অনিচ্ছা এই পরিস্থিতির উপর বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। তরুন ভামার যুবকদের  কাছে বহু বছর ধরে চলা সেনাশাসনের অবসান ও গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার  কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেটা নিভে গেলে তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে ও অনেকে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়।

মিয়ানমারে বহু দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন সেনাবাহিনীর মনোবল ও সক্ষমতা  বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে আসছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিভক্তি ও সেনাবাহিনীর প্রতি একতরফা সমর্থন হ্রাসের কারনে অনেক সাধারন মানুষও সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থন থেকে সরে এসেছে। মিয়ানমারের সব ভিক্ষু সেনাশাসন সমর্থন করে না। এখন বৌদ্ধ মঠগুলিতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় অনেক মানুষ জড়ো হয় এবং সেখান থেকে অনেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দেয়। অনেক নেতৃস্থানীয় ভিক্ষু মনে করে যে, মা বা থা ভিক্ষুরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ঘৃণা না ছড়িয়ে রাখাইনের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হলে জনগণের জীবনমানের উন্নতি হতো ও দেশে শান্তি বিরাজ করত। চলমান প্রেক্ষাপটে ভিক্ষুরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে, তাদের নিজস্ব অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং বার্মার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে ছাত্রদের সাথে অল বার্মা ইয়াং মঙ্কস ইউনিয়ন নামে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধে অংশ নিচ্ছে।

এতদিন সেনাবাহিনীর সাথে সংগ্রামরত দলগুলোর মধ্যে মতের মিল, আস্থা ও ঐকের অভাব থাকায় সশস্ত্র গুষ্টিগুলো সম্মিলিতভাবে কিছু করতে পারেনি। বর্তমানে তারা অনেকগুলো ফ্রন্টে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে। চলমান সশস্ত্র প্রতিরোধের ব্যাপক বিস্তৃতমাত্রা মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সেনাবাহিনী নিম্ন মনোবল ও নিয়োগ জটিলতায় ভুগছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলিতে পুরো ইউনিট আত্মসমর্পণ বা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সমন্বিতভাবে সেনাবাহিনীর অবস্থানে একযোগে হামলা শুরু করায় তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। মিয়ানমারের ইতিহাসে আঞ্চলিক গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এরকম সমন্বয় এই প্রথম। সমন্বিত এই আক্রমনে সেনাবাহিনী স্থলযুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে বিমান হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মিডিয়ার মাধ্যমে তা বহিঃবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিধায় জান্তা সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপও বেড়ে যাচ্ছে।

বিদ্রোহীদের হাতে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে মিয়ামনারের রাজধানী নেপিদোর নিরাপত্তা  রক্ষায় ১৪ হাজার সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এখানে সেনা সদস্যদেরকে আনতে হবে, ফলে বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষরত সেনাবাহিনীর জনবলের উপর চাপ পড়বে। প্রায় দু বছর ধরে দেশব্যাপী চলমান সহিংসতার কারনে সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর বিপরীতে সময় মত সেনাবাহিনীর সদস্য নিয়োগ দিতে না পারা, কোটা পুরনে ব্যর্থতা সেনাবাহিনীর  সামর্থের উপর প্রভাব ফেলেছে।

মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের মধ্যে চীনের নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ার জন্য ইয়াঙ্গুনের থিলাওয়া বন্দরে পৌঁছেছে। এতে চীনের নৌবাহিনীর টাস্কফোর্সের প্রায় ৭০০ নাবিক এসে পৌছায়। এর আগে মিয়ানমার ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনী আন্দামান সাগরে তিন দিনের যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় তানিনথারি অঞ্চলের মেইক টাউনশিপের কাছে পরিচালিত এই মহড়ায় রাশিয়ার তিনটি ডেস্ট্রয়ার ও ৮০০ নাবিক অংশ নেয়। মিয়ানমারের পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, চীন ও রাশিয়া এই উপস্থিতির মাধ্যমে তাদের সমর্থন জানান দিয়েছে এবং এর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তাদের  নৌবাহিনীর উপস্থিতি এ অঞ্চলের প্রতি তাদের আগ্রহের বিষয়টিও স্পষ্ট করেছে।

বহু দশক ধরে সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে এখনও চীন ও রাশিয়া সমর্থন করে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে তারা দ্রুত সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে এটা ভাবা কখনই ঠিক হবে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের রনকৌশলে পরিবর্তন এনে বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরনের চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে এটাই স্বাভাবিক। চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সামনের দিনগুলো কেমন হবে তা নিয়ে এখনও মন্তব্য করার সময় আসেনি। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই প্রথমবারের মত এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা কিভাবে তা সামলে উঠে এখন এটাই দেখার বিষয়।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি,  এএফডব্লিউসি,  পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াই ও বৈশ্বিক তাগিদ



ড. মিল্টন বিশ্বাস
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াই ও বৈশ্বিক তাগিদ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াই ও বৈশ্বিক তাগিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দুর্নীতি বিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ৩১ অক্টোবর ২০০৩ সালে জাতিসংঘে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনভেনশন পাস হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস’ পালন করা হয়। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- Engage in Transparency: Advocate for transparency and accountability in government and business practices. স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা সমুন্নত রেখে জনগণের জন্য কাজ করার এই প্রত্যয় শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম নীতি।

২০২০ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদের অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বলেছিলেন, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িতদের দলীয় পরিচয় বিবেচনা না করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। ‘কে কোন দলের সেটি (আমাদের কাছে) বড় কথা নয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে গিয়ে সরকারকে উল্টো দুর্নীতির দোষ দেয়া হচ্ছে। ‘আমরা (দুর্নীতিবাজদের) ধরছি। আর চোর ধরে যেন আমরাই চোর হয়ে যাচ্ছি।’ তবে, সেদিন আওয়ামী লীগ সরকার অনিয়ম বন্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা মিডিয়ায় আসার পরের দিনই স্বাস্থ্য খাতে বিগত ১০ বছরের দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় একটি বিশেষ সংস্থাকে। গ্রেফতার করা হয় কোভিড-১৯ নিয়ে প্রতারণা ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে। বিশেষত করোনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির খলমানব রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম এবং একইভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার টেস্ট না করেই রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী ও অন্যতম সহযোগী তার স্ত্রী জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হয়। যারা আজকে কারাবন্দি।

অতীতে করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সম্পর্কে যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোচ্চার হয়েছিলেন, তেমনি দুস্থ মানুষের ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বারবার; যথাযথ ব্যবস্থাপনার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীকে। আসলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি সরকার গঠন করেন ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ থেকেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেন।

২০১৯ সালে তাঁর জন্ম মাস (সেপ্টেম্বর) জুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সাধারণ জনগণকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আশান্বিত করে তুলেছিল। ক্যাসিনো কিংবা জুয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং যুবলীগে শুদ্ধি অভিযান তখন সকলের কাছে প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে গণ্য হয়েছে। সেসময় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণও ছিল দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সঙ্গে ওই নেতারা জড়িত হয়ে পড়েছিল। এজন্য তাদের পদত্যাগও করতে হয়।

কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ জানুয়ারি নিজের কার্যালয়ে প্রথম কার্যদিবসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত এবং এর অর্জনসমূহ সমুন্নত রাখতে সরকার দুর্নীতি বিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখবে। এরপরই ১৪ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের অবস্থান নিতে আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘ঘুষ যে নেবে ও দেবে দুজনই সমান অপরাধী; বরং যে দেবে সে বেশি অপরাধী। এটা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে।’

সেসময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানেও একই কথা পুনঃউচ্চারণ করেন- ‘যে ঘুষ খাবে সে-ই কেবল অপরাধী নয়, যে দেবে সে-ও সমান অপরাধী। এ বিষয়টা মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিলে এবং এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ হলে অনেক কাজ আমরা দ্রুত করতে পারব।’ উপরন্তু চতুর্থ মেয়াদে জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হলে ১২ জুন (২০১৯) সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা দুর্নীতির প্রতি তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। পুনরায় বলেছিলেন, দুর্নীতি ও অপরাধ যে করবে এবং যে প্রশ্রয় দেবে- তারা সবাই অপরাধী। ঘুষ নেওয়া যেমন অপরাধ, দেওয়াটাও সমান অপরাধ। অপরাধী যে দলেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অপরাধ করে ছাড় পাচ্ছে না।

 তিনি মনে করেন, কেবল আইন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে দুর্নীতি ও অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়; এ জন্য সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কল্যাণ এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দুদক এখন শক্তিশালী একটি সংস্থা। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিনিয়ত তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করছে। এতে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের দুর্নীতির প্রবণতা কমে এসেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে দুর্নীতির মাত্রাও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনি ইশতেহারের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারের মধ্যে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছিল। ইশতেহার ঘোষণাকালে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি নিজে এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসী আপনাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরো সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব।’

প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার অনুসারে টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য দরকার ছিল ‘স্বচ্ছ প্রশাসন’। আর সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে তখনই যখন জবাবদিহিতামূলক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এজন্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ : এই উপশিরোনামে বলা হয়- ‘দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে।

আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ভবিষ্যতে আরো জোরদার করা হবে।’

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের সদিচ্ছার প্রমাণ রয়েছে ৫ জানুয়ারি (২০১৪) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে ঘোষিত নির্বাচনি ইশতেহারেও। ‘আমাদের এবারের অগ্রাধিকার : সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন’ শীর্ষক উপবিভাগের ১.৮ অনুচ্ছেদে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে, আইনি, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা আরও বাড়ানো হবে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিজেদের সম্পদ, আয়-রোজগার সম্পর্কে সর্বস্তরের নাগরিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।’

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিগত মহাজোট সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলেন জনগণের প্রত্যাশা আসলে কী? জনগণ শেখ হাসিনার পাশে দুর্নীতিবাজদের দেখতে পছন্দ করে না। একারণে তাঁর মন্ত্রী পরিষদে পূর্বের অনেকেই ঠাঁই পাননি। উপরন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) বিগত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য তদন্ত শুরু করলে সরকার প্রধান হস্তক্ষেপ না করে নীরবে তা পর্যবেক্ষণ করেছেন। একথা ঠিক যে সরকার প্রধান নির্লোভ হলেও তাঁর নির্ভরযোগ্য বা আশেপাশের অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে মেতে উঠতে পারেন; জনগণের প্রত্যাশা ধূলিস্যাৎ করে নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। অথচ বর্তমান সরকার অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে, জনগণের সেবা নিশ্চিত ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে আগামী সংসদে ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেই প্রত্যাশা ফলপ্রসূ করতে হলে জনগণ যে আশা-ভরসা নিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সেটা রক্ষা করতে হবে। কোনো ধরনের অন্যায়কে এই সরকার প্রশ্রয় দিলে তা হবে আত্মঘাতী। এজন্য কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার প্রশংসার দাবিদার।

মনে রাখা দরকার বিএনপি-জামায়াত আমলে আমরা দুর্নীতির স্রষ্টাদের দুর্নীতি বিরোধী বয়ান শুনে শুনে আতঙ্কিত হয়েছিলাম। এমনকি দুর্নীতি নিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অনেক মুখরোচক কথা চালু রয়েছে। কথাবার্তায় আমরা প্রায় সবাই দুর্নীতিবিরোধী হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা দরকার সেই প্রচেষ্টা গ্রহণ করি না। এমনকি দুর্নীতির নীতিগত উৎসাহদাতা অনেক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা প্রায়শ বলে থাকে দুর্নীতির কারণে এদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির স্রষ্টাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ প্রতিনিয়ত মুক্তবাজার, বেসরকারিকরণ, বাজার উন্মুক্তকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সরকারি সেবাগুলোর ওপর ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চাপ প্রয়োগ করছে।  এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে অকার্যকর করার জন্য এবং দেশের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করতে রাজনীতিবিদদের ক্রয়-বিক্রয়ে মেতে উঠছে অনেকেই- এ সম্পর্কেও রাজনৈতিক দলকে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক গবেষকই বলে থাকেন মুক্তবাজারের

প্রতিযোগিতাকে অবাধ করার অর্থই হলো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। মুক্তবাজার নিজেই দুর্নীতির স্রষ্টা, এটাকে বজায় রেখে যারা ব্যক্তি দুর্নীতিবাজ ধরার প্রচেষ্টা চালায়, তারা অনেকটা জল ঘোলা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের পথ খুঁজে ফেরেন। তারা চান অর্থনৈতিক সক্ষমতায় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে নামমাত্র পুতুল সরকার বজায় রেখে বিশ্বব্যাপী ধনী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে। ১/১১-এর সময় দেশ থেকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের হঠানোর যে হঠকারি আয়োজন হয়েছিল, সে ঘটনাও মনে রাখা দরকার। এছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে এমনভাবে যেন তারা মনে না করে টাকা থাকলেই সমাজ সম্মান করবে। কারণ লেখাপড়ার উদ্দেশ্য যদি ভাল চাকরি পাওয়া হয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি কখনো উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে।’ কিন্তু আমরা জানি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিধি রাখা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে গ্রেফতার করতে হবে। ফলে ‘দুদক’-এর কাজে এসেছে চ্যালেঞ্জ। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন করেছে। দুর্নীতির তদন্ত, অনুসন্ধান, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুদক প্রয়োজনে মন্ত্রী, আমলাসহ যে-কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদের নজির স্থাপন করেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসমুখগুলো বন্ধ করার লক্ষ্যে অনলাইনে টেন্ডারসহ বিভিন্ন সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী প্রকোপ কমেছে। মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য অনিয়ম ও দুর্নীতি করলে প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এ প্রত্যাশা সকল প্রতিষ্ঠানের। অতীতের অনিশ্চয়তা, সংকটের চক্রাবর্ত এবং অনুন্নয়নের ধারা থেকে বের করে এনে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শান্তি, গণতন্ত্র  ও উন্নয়নের গতিপথে পুনঃস্থাপিত করতে হলে তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই লড়াই করে চলেছেন।

আসলে দুর্নীতি প্রতিরোধে ও রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানই অনন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের ৫২ বছরের ইতিহাসে সেই স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। জাতির পিতার শাহাদাত, সামরিক শাসন এবং স্বৈরাচারী, গণবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ক্ষমতা দখল জনগণের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নকে বারবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে। জনগণের জীবনে এ ধরনের শাসনের কুফল প্রতিফলিত হয়েছিল অনুন্নয়নে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবদমনে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায়, দুর্নীতিতে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শুদ্ধাচারের অভাবে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই যুদ্ধকে শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর শাসনামলে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।

`শেখ হাসিনাও তাঁর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কাজে আত্মশুদ্ধি ও চরিত্রনিষ্ঠার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’

 স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং এগুলির ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে।  ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ শীর্ষক দলিলে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেয়া হয়।

দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :

`সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’,  ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯’, ‘চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০’,

জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’, ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’, ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’-এর আওতাধীন অপরাধও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুর্নীতিকে কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের United Nations Convention Against Corruption (UNCAC)-এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দুর্নীতি নির্মূলের জন্য ‘ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়াও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই কনভেনশনে। ২০২৩ সালের যুদ্ধ ও বিশ্ব সংকটের কঠিন সময় অতিক্রম করে আগামী দশকে এ

দেশে ক্ষুধা, বেকারত্ব, অশিক্ষা, বঞ্চনা ও দারিদ্র্য দূর হবে; দেশে বিরাজ করবে সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’হবে, ‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ হবে। এই লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য-কর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল।

দুর্নীতিগ্রস্ত যেসব অপরাধী দেশের নানা দুর্যোগের মধ্যেও দুর্নীতিতে নিয়োজিত থেকেছে তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ এবং সংসদ ও সংসদের বাইরে বলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তবে কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়। দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে- তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুবই দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রচেষ্টা যুক্ত থাকা দরকার। তাহলেই ‘দুর্নীতি করব না, করতেও দেব না’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম। email: [email protected]

;

মিজোরামের ভোট, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম



ড. মাহফুজ পারভেজ
মিজোরামের ভোট, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

মিজোরামের ভোট, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম লাগোয়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামে ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ঘটেছে ক্ষমতার পালাবদল। পুরনো ও সশস্ত্র-অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে আসা নেতাদের স্থলে নির্বাচিত হয়েছেন নতুন ও উন্নয়নমুখী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বের সঙ্গে সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক নেই। তারা জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নের মাধ্যমে মিজোরামের ভাগ্য বদলের পক্ষে। মিজোরামের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে পাশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। যার প্রতিফলন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।  

মিজোরামের নির্বাচনে জয়ী জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) ৩৭.৯% ভোট পেয়েছে। ক্ষমতায় থাকা মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) ৩৫.১% ভোট পেয়ে মসনদ থেকে ছিটকে পড়েছে। পুরনো দল কংগ্রেস ২০% ভোট পেয়েছে এবং দেশে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পেয়েছে ৫.১% ভোট।

আপাতদৃষ্টিতে যদি মিজোরামে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ভোট শেয়ারের উপর নজর দেওয়া যায়, তাহলে স্পষ্ট হবে যে জেডপিএম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। রাজ্যের মোট ৪০টি আসনের মধ্যে তারা ২৭টি আসন পেয়েছে। ভোট ভাগাভাগি ও জাতিগত মেরুকরণের কারণেই এমন ফলাফল হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। এই ফল মিজোরামের রাজ্য রাজনীতির পরিবর্তনশীল ধারার ব্যাপারে একটা প্রাথমিক ধারণা প্রদান করে। একই সাথে, এই রাজ্যটির ক্ষমতা যে মূলত এমএনএফ এবং কংগ্রেসের হাতেই ঘোরাফেরা করেছে এতদিন ধরে, তার অবসানের চিত্রটিও তুলে ধরে।

অবাক করা বিষয় হলো, এবারের নির্বাচনে জয়ী আঞ্চলিক দলটি ক্ষমতাচর্চার ৩৬ বছরের প্রতিষ্ঠিত ট্রেন্ড ভেঙে দিয়েছে। এমএনএফ-কে পরাজিত করাও সহজ ছিল না। তার কারণ নানা সংঘাতে জড়িয়ে পড়া মণিপুরের কুকি-চীন উপজাতি এবং প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের চীন সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে সংহতি প্রদর্শন করার মাধ্যমে জনজাতিগত জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দিয়েছিল জোরামথাঙ্গার নেতৃত্বাধীন দল। কংগ্রেস মূলত প্রচার চালিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ভোটারদের মন জয় করতে। চেষ্টা করেছে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্যটিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচার করা বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের আটকাতে। আর আঞ্চলিক দল এমএনএফ'কে নিয়ে বিজেপি যথারীতি ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করেছে।

এহেন জটিল রাজনৈতিক আবহে ভারতের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন জনসংখ্যা সম্বলিত মিজোরাম রাজ্যের ৮.৬ লক্ষ ভোটার নির্বাচনে অংশ নেন। যাদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ভোটার জাতিগত জাতীয়তাবাদ বা সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতির অংশীদার। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-মুক্ত সরকার এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতি রাজ্যের যুব ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে, যার ফলেই মিজোরামে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিজোরামে পরিবর্তনের হাওয়াকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে জেডপিএম। তারা মিজোরামের নাগরিক সমাজের অনেক সদস্যকে দলের সমর্থনে শামিল করতে সক্ষম হয়েছে, এমনকি অনেককে প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। এই বিষয়টি প্রাক্তন আইপিএস অফিসার এবং রাজ্যের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমার নেতৃত্বাধীন দলকে বাকিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে এবং জেডপিএম নিজেদের সংখ্যার জোরেই ক্ষমতায় আসে। মূলত, জেডপিএম-কে একটি স্বচ্ছ এবং স্বতন্ত্র সরকার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্য তৈরি করতে সমর্থ হওয়ার কারণেও নির্বাচনী বিজয় অর্জন করেছে।

উত্তরপূর্ব ভারতের ছোট রাজ্যগুলোর রিসোর্স সংগ্রহের উপায়গুলো খুবই সীমিত এবং তারা নিজেদের আর্থিক কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর একটু বেশিই নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসাবে, ভারতে সর্বাধিক রেভেনিউ রিসিট রেশিও রয়েছে মিজোরামে, যার পরিমাণ ৮৫.৭%। ফলে জেডপিএম'কে ক্ষমতায় বসেই কৃষির বাইরে, পরিবেশ-বান্ধব পর্যটনের মতো এরিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তোলার উপর নজর দিতে হবে।  যদি রাজ্যের জনসংখ্যার উচ্চ স্বাক্ষরতা, জনদক্ষতা এবং শিক্ষাকে প্রয়োগ করে মূল্য-যুক্ত পরিষেবাকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে দলটি রাজ্যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ঠিক পাশেই অবস্থিত মিজোরাম উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। আইজল মিজোরামের রাজধানী। মি (জাতি), জো (পাহাড়) এবং রাম (ভূমি), এই তিনটি শব্দ থেকে উদ্ভূত মিজোরাম বলতে "পাহাড়ি জাতির ভূমি" বোঝায়। ভারতের উত্তর-পূর্বে, এটি সর্বদক্ষিণের স্থলবেষ্টিত রাজ্য এবং ভারতের সপ্তভগিনী রাজ্যসমূহের ত্রিপুরা, আসাম, মণিপুর এই তিনটি রাজ্যের সাথে যার সীমানা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের প্রায় ৭২২ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মিজোরামের সীমানা অবস্থিত।

ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে মিজোরাম আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭২ সালে আসাম পুনর্গঠনে মিজোরাম কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ১৯৮৬ সালে এটি ভারতে একটি 'পূর্ণ রাজ্যের' মর্যাদা পায়। রাজ্য মর্যাদার পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২২ বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই রাজ্যের ক্ষমতায় থাকে। লাল থানহাওলা এখানকার অন্যতম নেতা।

মিজোরাম মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে কিছু সামরিক পরিকাঠামো রয়েছে যা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অংশ। খ্রিস্টান অধ্যুষিত ভৈরেংতে তে সামরিক প্রশিক্ষণ হয়। সম্প্রতি ভারত -জাপান এখানে যৌথ মহড়া করে।

আদমশুমারী অনুসারে মিজোরামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮৭%) মিজো খৃস্টান ধর্মালম্বী যারা প্রধানত প্রেসবিটারিয়ান। বাকি জনসংখ্যার ৮.৩% বৌদ্ধ, ৩.৬% হিন্দু ধর্মালম্বী। কয়েক হাজার মানুষ রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নৃতাত্ত্বিক মিজো, যারা ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ১.১% মুসলিম। মিজোরামে বেশিরভাগ মুসলমান জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা। অবশিষ্ট ৩,০০০ মানুষ শিখ, জৈন এবং অন্যান্য ধর্মালম্বী।

ভারতের বাকি রাজ্যকে পিছনে ফেলে হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এইচআইভি প্রসারে শীর্ষে উঠে এসেছে মিজোরাম। মিজোরাম স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি (এমএসএসিএস)-এর একটি রিপোর্ট থেকে রাজ্যে রোজ গড়ে ৯ জনের রক্তপরীক্ষায় এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ছে। এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণ প্রবণতা যে রাজ্যগুলেতে সব থেকে বেশি, সেই তালিকায় মিজোরাম শীর্ষ স্থানে রয়েছে (২.৪ শতাংশ)।

সেই মিজোরাম আবার ভারতের সংঘাতপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর একটি, যেখানে সুপ্ত রয়েছে জাতিগত সশস্ত্র সংঘর্ষ। মিয়ানমারে চলমান জাতিগত সংঘাতের প্রভাবও মিজোরামে পড়েছে। চীন ও কুকি উপজাতির প্রচুর শরণার্থী মিজোরামে আশ্রয় পেয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র নাশকতায় লিপ্ত কুকি-চীন গোষ্ঠীর সমগোত্রীয় বহু মানুষও সেখানে বসবাস করে। ফলে মিজোরাম রাজ্যের ঘটনাবলি আশেপাশের অঞ্চলের জন্যেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্বের দিক থেকে মিজোরাম আরেকটি কারণে সবার নজরে। আর তা হলো, রাজ্যের ভূকৌশলগত অবস্থান। মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত ছাড়াও উত্তরে চীন আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় ইন্দোপ্যাসিফিক বলয়ের প্রান্তীয় জনপদের তাৎপর্য রাখে। পাহাড়ি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিশাল ভূগোলের পক্ষে সমু্দ্রপথে যেতে মিজোরাম গেটওয়ে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আশ্চর্যজনক ভাবে একমাত্র খ্রিস্টান প্রধান মিজোরামের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বাড়তি আগ্রহ ও মনোযোগ রয়েছে। আর এখানেই অদ্ভুতভাবে একদল মানুষ ইহুদি ধর্মগ্রহণ করায় ইসরায়েলের সাথেও মিজোরাম সম্পর্কিত।

মিজোরামের মতো এমন বিচিত্র বিন্যাস ভারতে তো বটেই, সারা দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনও এলাকার নেই। যদিও সেখানে রয়েছে সুপ্ত কিছু সমস্যা, তথাপি দীর্ঘ জাতিগত সংঘাত থেকে উন্নয়নের পথে চলেছে রাজ্যটি। মিজোরামের ভোটের ফলেও দেখা গেছে চমক। সশস্ত্র পথ থেকে যারা  নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে এসে বহু বছর রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল, তারা পরাজিত হয়েছে নতুন এক দলের কাছে, যে দল উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাণ্ডরী। মিজোরমের ভোটের পর পরই পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত হতে চলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে মিজোরামের অভিজ্ঞতা সারা বাংলাদেশে না হলেও সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রভাব বিস্তার করবে। বিশেষত, মিজোরামের অভিজ্ঞতায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও সংঘাত-বিরোধী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উন্নয়নমুখী নেতৃত্বের এগিয়ে আসার সম্ভবনা প্রবলতর হয়েছে। যদি বাংলাশের পাহাড়ে নতুন ও উদ্যোগী নেতৃত্ব আসে, তাহলে তারা বাংলাদেশের পাহাড়ে মানবসম্পদ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করতে পারবেন এবং পাশের ভারতীয় পার্বত্য রাজ্যগুরোর সঙ্গে শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করে আঞ্চলিক নবজাগরণের সূচনা ঘটাতে পারবেন।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তির পর থেকেই যাবতীয় স্তরের নেতৃত্ব রয়েছে সশস্ত্র রাজনীতি থেকে উত্থিত নেতাদের হাতে। তারা চুক্তির পর দীর্ঘ ২৬ বছর রে শান্তির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সন্ত্রাস থেকে শান্তিতে রূপান্তরে এবং ধ্বংস থেকে উন্নয়নে অভিমুখে যত্রাপথে তাদের অবদান অসামান্য। কিন্তু বয়সের কারণে এই নেতৃত্ব এখন শেষজীবনে উপনীত। অনেকেই মারাও গেছেন। আবার অনেকে প্রাচীন চিন্তা ধরে আছেন। এমতাবস্থায় শান্তিচুক্তি-পরবর্তী ২৬ বছরে যে শিক্ষিত, দক্ষ ও বাস্তবতার বোধ সম্পন্ন তরুণ-যুবক প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, তাদের দায়িত্ব রয়েছে নেতৃত্বের জায়গায় এসে পাহাড়ের মাটি ও মানুষের মধ্যে সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক ধারা শান্তি, সম্প্রতি ও উন্নয়নের রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়া। তাদেরকে পাহাড়ের আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সেতুবন্ধের মতো কাজ করতে হবে। জাতীয় থেকে স্থানীয় স্তরের নেতৃত্বের শূন্যতাকে পূর্ণ করতে হবে তাদের মাধ্যমেই। আর বর্তমানে দেশের মোট ভোটারের সিংহভাগই নতুন ও তরুণ প্রজন্মের। ফলের এদের প্রত্যাশা ও চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে তরুণদের মধ্য থেকে উঠে আসা তরুণ-যুবক নেতৃত্ব।

দ্বাদশ জাতীয় সংস নির্বােচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে দলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র ও জনপ্রিয় প্রার্থীদেরও এগিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেখা যাক, পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন ও সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্ম এই সুযোগকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)

;

গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার সেই প্রতিধ্বনি



আশরাফুল ইসলাম
গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার সেই প্রতিধ্বনি

গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার সেই প্রতিধ্বনি

  • Font increase
  • Font Decrease

 

৬ ডিসেম্বর ২০২৩। প্রতি বছরের মতো এবারও নানা আয়োজনে গতকাল বুধবার পালিত হলো ঐতিহাসিক মৈত্রী দিবস-বাংলাদেশ ও ভারতের গভীরতম সম্পর্কের ঐতিহ্যিক পরম্পরার নবউদযাপন। কিছু মানুষের কাছে হয়তো দিনটি আর দু’চারটি দিবসের মতোই কিছু আনুষ্ঠানিকতা আর বক্তৃতার ফুলঝুড়ি। কিন্তু অনেকের কাছেই এদিনটি আরও বেশি কিছু। সমকালীন বিশ্বে তো বটেই গত শতাব্দির বিশ্ব সমীকরণের মারপ্যাচ ডিঙিয়ে এই শতাব্দির দুই দশকও পেরিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ভাতৃত্বপূর্ণ বিরল সম্পর্কের সমান কোন উদাহরণ আজও সৃষ্টি হয়নি! নিন্দুকদের ভাষ্যে এনিয়ে যতো কথাই হোক না কেন, দুই দেশের মৈত্রীময় সম্পর্কের দৃষ্টান্তে আজও কেউ সমকক্ষ হতে পারেনি, এ কথা জোর দিয়েই বলা যাবে।

জীবন্ত হয়ে থাকা অতীতের ইতিহাসই আমাদের এই বিরল সম্পর্কের আখ্যান মেলে ধরবে। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই সমগ্র বাঙালি জাতি তথা ভারতবর্ষের জন্য ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চিরকালের গৌরবের প্রতীক। সেই সময়কার জীবন্ত হয়ে থাকা ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, কী বিস্ময়কর এক ঐক্যে গোটা ভারতবর্ষ সেদিন নিপীড়িত পূর্বপাকিস্তানের পূর্ণ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল! আমার কাছে অন্ততঃ মনে হয়, অভূতপূর্ব সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহকে স্মরণে আমরা এই সময়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি না। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে তখনকার গণমাধ্যমে আমরা খুঁজতে চেষ্টা করি, দুই দেশের এই মৈত্রীময় সম্পর্ক কেনইবা এতো শক্তিশালী?


৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। স্বীকৃতি প্রদানের পরদিন ‘বাঙলাদেশ মুক্তি পেল/জয়বাংলা ধ্বনির মধ্যে লোকসভায় ঘোষণা’ শীর্ষক শিরোনামে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর লেখে, ‘ভারত সরকার আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই স্বীকৃতির ফলে এই উপ-মহাদেশে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণ তন্ত্রের অভ্যুদয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হলো।’

‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী আজ সকালে সংসদের যুক্ত অধিবেশনে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদানের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি করেন এবং উভয় সভার সদস্যগণই দাঁড়িয়ে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানান। সেইসঙ্গে সংসদ কক্ষে প্রবল হর্ষধ্বনি উত্থিত হয় এবং সদস্যবর্গ উৎসাহ আবেগে মিলিত ধ্বনি তুলেন ‘জয় বাংলা’ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।’

ওইদিনই ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক’র ভবিষ্যত নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়, আমরা বর্তমানেও তার প্রতিফলন দেখতে পাবো। সেখানে লেখা হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরার এই বিশ্বাস যে, ভবিষ্যতে ভারত সরকার ও বাংলাদেশ এবং এই দুই দেশের জনগণ সম-আদর্শ ত্যাগ-ধর্মের অনুসারী বলে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, যার ভিত্তিতে থাকলে পারস্পারিক সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখ-তা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সমভাবে পোষণ ও পারস্পারিক কল্যাণ। এই মহৎ লক্ষ্যগুলি বাস্তবে রূপায়িত করতে উভয় রাষ্ট্রই মিলেমিশে কাজ করবেন। আমরা প্রতিবেশি হিসাবে বসবাস করবার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করব আর এতে এই অঞ্চলের শান্তি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়ে উঠবে।’


আমরা যদি জনগণের ওইদিনের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল তা জানার চেষ্টা করি তবে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতেই হবে তখনকার জনগণের প্রতি। ‘স্বীকৃতিতে কলকাতায় উল্লাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আমরা হৃদয়মথিত সেই প্রতিক্রিয়া জানতে পারছি। তাতে লেখা হচ্ছে, ‘দিল্লিতে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ঘোষণা এবং শহর কলকাতায় তার জন্য আজ আনন্দ ও উল্লাসের জোয়ারÑদুই-ই ঐতিহাসিক, দুই-ই অভূতপূর্ব। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের খবর শহরময় ছড়িয়ে পড়ে, রাস্তায় রাস্তায় আনন্দের বাণ ডাকে। কলেজপাড়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে রাস্তায় নেমে পড়েন, আনন্দ করতে করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে স্লোগান দিতে দিতে মিছিল এগিয়ে চলে। মুজিবর ও ইন্দিরাজীর জয়ধ্বনিতে মিছিল হয় কল্লোলিত। স্বীকৃতিদানের খবরে বহু স্কুল-কলেজ ছুটি হয়ে যায়’

গণমাধ্যমগুলো এক নিরঙ্কুশ ঐক্যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য অব্যাহত রাখতে সমর্থন যুগিয়ে যায়। ‘স্বাগত বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখব আমরা তাতে আঁচ করতে পারব, তখনকার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ প্রশ্নে কতোটা আবেগপ্রবণ ছিলেন।


‘সোমবার ৬ ডিসেম্বর। ইতিহাসের এক যুগান্তকারী দিন। অধীর আগ্রহের বাঞ্ছিত অবসান। বাংলাদেশকে কুটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছেন নয়াদিল্লি। প্রায় আট মাস আগে সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে যার প্রথম আবির্ভাব, আজ তার পূর্ণ অভিষেক সমাপ্ত। নবজাতকের মাথায় কল্যাণ বারি বর্ষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি নরনারীর অন্তরের শুভেচ্ছা মিশান রয়েছে তার সঙ্গে। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা করছিলেন ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত তখন আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল পরিষদ কক্ষ। দলমত নির্বিশেষে সবার কণ্ঠ গিয়েছিল মিশে। স্বাগত জানাচ্ছিলেন তারা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রটিকে। উচ্ছল হৃদয়ের এই সাদর অভিবাদন গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার প্রতিধ্বনি’

আমরা ভারতের সরকার ও জনগণের এই সহমর্মিতা পরবর্তী কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহে যেন আরও গতি লাভ করতে দেখব। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের অন্ধ কারাগার থেকে স্বদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনতে ভারতের সরকার এহেন তৎপরতা নাই যা তারা চালাননি। বঙ্গবন্ধু তখন গোটা ভারতের ঘরে ঘরে এক নন্দিত ও বন্দিত নাম।


শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মর্মস্পর্শী লেখায় আমরা আঁচ পাবো, কি গভীর ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুকে ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ কলকাতায় আলিঙ্গন করেছিল সাধারণ মানুষ।

‘স্বপ্ন ও জাগরণের নায়ক’ শীর্ষক প্রবন্ধে শ্রী গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আপনার বিমান সরাসরি ঢাকা উড়ে গেল। যদি নামেন-সেই আশায় আমরা এক লক্ষ মানুষ দমদমের আকাশে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের স্বপ্ন ও জাগরণের নায়ক-বঙ্গবন্ধু আজ আপনি কলকাতায় আসছেন’

‘প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে আমরা দীর্ঘদিন ভারত নামক দেশটির যে মানচিত্র ভূগোল পড়তে গিয়ে এঁকেছি তা নানাদিক থেকে বহু মিলনে এক। ভাষা, সঙ্গীত, রুচি, খাবারের অভ্যাস অভিন্ন। আন্তর্জাতিক সীমান্ত তো সেদিনের ব্যাপার’

‘জনগণমন অধিনায়ক হয়েও খালি স্লেটখানি হাতে নিয়ে আপনি রাষ্ট্রপতির আসন থেকে নেমে স্বেচ্ছায় ভোটে বদলানো যায় এমন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ঢাকায় পা দিয়েই বাঙালীর নয়নের নয়ন নিজের নামের আগে ভালবাসার বিশেষণগুলি নির্মমভাবে ছাঁটাই করেছেন’

‘...এই মিরাকলের সরল জাদুকর আপনি বৈষম্য ঘোচানোর পাঠ নিয়েছেন সহজভাবে। ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ আপনার কণ্ঠেই যেন আবেগ পুষ্প হয়ে ফুটে উঠে’

বঙ্গবন্ধুকে যেভাষায় চিত্রিত করা হয়েছে তা অতুলনীয় বললেও কম বলা হবে..‘আমাদের দেশের যা কিছু জীর্ণ-অন্যের যা-কিছু মহান-এই রোগে আমরা যখন ভুগছিলাম তখন আপনি স্বদেশ, মাতৃভাষাকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের শূন্য মন্দিরে পূর্ণকুম্ভ বসিয়েছেন। আপনি দ্বিজোত্তম। আপনার ভিতরকার উত্তম সংগ্রামের ভিতর যাচাই হয়ে আপনি অর্জন করেছেন। আপনি এই দশকের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। আমাদের দুই দেশ ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ।’


বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর যে চিরকালীন বন্ধন তৈরি হয়েছে তার নির্মাতা বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতী গান্ধী। আমরা যদি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কলকাতায় পা দিয়ে বঙ্গবন্ধু হৃদয়মথিত যে অভ্যর্থনা লাভ করেন জনগণের কাছ থেকে তার ইতিহাস বহু যুগেও মুছে ফেলা যাবে না। আজকের সম্পর্কের এই ভিত তাদের হাতেই নির্মিত।

তখনকার খবরে, ‘ইতিহাসের মহানায়কের ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা/ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে উত্তাল জনসমুদ্র। মহামানবের তীর্থক্ষেত্র-ইতিহাসের অন্যতম মহামিলন কেন্দ্র মহানগরী কলকাতা মাঘের শেষের দুদিনের বর্ষণকে কাটিয়ে উঠে রবিবার রৌদ্রস্নাত হয়ে গঙ্গা আর পদ্মার মিলিত উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আর পূর্বদিগন্তে এই নতুন সূর্যোদয়ের অন্যতম রূপকার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এদিন মহানগরীতে একই সঙ্গে উপস্থিত। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর দুই প্রধানমন্ত্রীকে একই সঙ্গে সম্বর্ধনা।’

‘কলকাতা মহানগরী বারংবার আকাশ বাতাশ মুখরিত করে ধ্বনি তুলছে, ‘ইন্দিরা মুজিব জিন্দাবাদ’ ‘ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক’।

কলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে আধুনিককালের বিশালতম সমাবেশে দুই প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেও একই ধ্বনি ‘‘ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী দৃঢ় হোক।’’

‘দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় একই সুর-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা-এই দুই রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও নীতি। তাই এই বন্ধুত্ব। বিশ্বের কোন শক্তির কোন ষড়যন্ত্র এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে পারবে না।’

‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অটুট থাকবে’-বঙ্গবন্ধু। ‘বাংলাদেশের জন্য কর্তব্যই করেছি’ -ইন্দিরা এমন মন্তব্যের ৫ দশক পরে আমরা যথার্থ উপলব্ধি করছি যে যুগস্রষ্টা এই দুই রাজনীতিবিদ কি গভীরভাবে এই সম্পর্কের ভিত রচনা করে গেছেন!

‘ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডের ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সম্বর্ধনা ভাষণের প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে ভারত সরকার, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের জনগণ ও সেনাবাহিনীর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, চারটি আদর্শ ও লক্ষ্য-ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রবাদের উপর ভিত্তি করে ভারত আর বাংলাদেশের মৈত্রী গড়ে উঠেছে। এই আদর্শ অনুসরণ করেই এই মৈত্রী গড়ে উঠেছে। এই আদর্শ অনুসরণ করেই এই মৈত্রী চিরকাল অটুট ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। কোনো দেশের কোনো চক্রান্ত এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে পারবে না। এই মৈত্রীর উপর ভিত্তি করেই দুই দেশ তার ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলবে সুখ ও সম্বৃদ্ধির পথে’

‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে। আদর্শের দিকে লক্ষ্য রেখেই ভারত এই মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে, লাভের দিকে লক্ষ্য রেখে নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিজয়ে লাভ হয়েছে ভারতের। ভারত চিরদিন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। এই ধর্মনিরপেক্ষতার পথ আরো সুগম হয়েছে।’

সেই সময়কার একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় নিবন্ধের এক স্থানে লেখা আছে, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রিক সীমানায় স্বতন্ত্র দেশ, কিন্তু যেখানে আত্মিক বন্ধন সেখানে এক অভিন্ন সত্তার জীবন্ত প্রকাশ’-আমরা এই লাইনটি উচ্চারণ করে বলতে চাই দুই দেশের অভিন্ন সত্তার জয় হোক। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরজীবী হোক। জয় বাংলা। জয় হিন্দ। 

লেখক: ইতিহাস গবেষক

;