‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদন: যে প্রশ্ন, যে উত্তর



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপির হাতেই ক্ষমতা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দু’দলের প্রধান হিসেবে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, করছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথে সেখানে এ দুই দলের প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হতে থাকবেন, এই ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। মাঝখানে ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসহ বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা ছিল, তবে এই মুহূর্তে স্বাভাবিক রাজনীতির মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের অন্যায়, অনিয়ম, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়। পাকিস্তানের আদর্শিক অনুসারী সামরিক শাসকেরা বারবার দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে সত্য, তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ফিরেছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেই। দেশের গণতন্ত্র কতখানি গণতান্ত্রিক সেটা ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু দেশ যে গণতন্ত্রের পথেই আছে সেটা সুখের বিষয়। স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদের পতনের পর প্রথমে বেগম খালেদা জিয়া, পরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। এরইমধ্যে আবার একাধিকবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। এখন টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী।

দলীয় প্রধানের প্রতি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার প্রতি আওয়ামী লীগ এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি বিএনপি নেতাদের রয়েছে সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওয়ান-ইলেভেনের ‘বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ’ বাদে এটা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপির কিছু নেতা দল-প্রধানের বিরুদ্ধে গেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। বিএনপির ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ কয়েকজন পৃথক দল গঠন করলেও, আওয়ামী লীগের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতারা এতদূর যেতে পারেননি। বিএনপির একটা অংশ ‘কিংস পার্টি’-অনুরূপ দল গড়লেও সেটাও টেকেনি। এদিকে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ ক’জন নেতার বিরুদ্ধে ‘মাইনাস’ ফর্মুলার অনুসারী হওয়ার আলোচনা থাকলেও দলটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতায় কিছুই আলোর মুখ দেখেনি। ওয়ান-ইলেভেনের মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারাই হয়েছিল। নির্বাচন করতে এসে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের ওপর ‘সিন্দবাদের ভুতের’ মতো চেপে বসেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারেনি, তাদেরকেও সরে যেতে হয়েছে। যেভাবেই হোক দেশ ফিরেছে সেই গণতন্ত্রের পথে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার চিরতরে বিদায় নিয়েছে। এখন সংবিধানে নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে; আওয়ামী লীগের অধীনে। ওই দুই নির্বাচন নিয়ে দেশে নানা আলোচনা-সমালোচনা-বিরোধিতা আছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি আছে সত্য, তবে এই দাবির পক্ষে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই রাজনৈতিক অবস্থানে আগামী নির্বাচনও যে দলীয় সরকারের অধীনে হতে যাচ্ছে সেটা বলাই যায়।

গণতন্ত্র ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গের উল্লেখের কারণ মূলত যতই আলোচনা-সমালোচনা থাকুক আমরা গণতন্ত্রে রয়েছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি বলেই আমরা গণতন্ত্র ও বিধিবিধান অনুশীলন দেখতে আগ্রহী। রাষ্ট্রীভাবে রাষ্ট্রাচারের অনুশীলন দেখতে আগ্রহী।

সাতই মার্চ ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস। এই দিবস ‘ক’ শ্রেণির জাতীয় দিবস। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা থেকে মো. সাজ্জাদুল হাসান সাক্ষরিত এই পরিপত্রে এই দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসাবে পালনের কথা জানানো হয়। পরিপত্রে বলা হয়, “সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে প্রদত্ত ভাষণের দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ হিসাবে ঘোষণা এবং দিবসটি উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন/ পালন সংক্রান্ত পরিপত্রের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসাবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে ‘ক’ ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত হলেও দিবসটির ক্ষেত্রে সাধারণ ছুটি প্রযোজ্য হবে না।” এতে আরও বলা হয়, “সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয় হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। তবে, বিষয়ভিত্তিক বণ্টনের আওতায় প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি উদযাপনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত এবং দিবসটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সচেতনতা আগামী প্রজন্মের মধ্যে যথাযথভাবে সঞ্চারণের লক্ষ্যে উক্ত কর্মকাণ্ডে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করতে হবে।” এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ‘জাতীয় পতাকাবিধি ১৯৭২’ সংশোধনে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। অর্থাৎ এই দিবসটিকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৭ই মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে এবারও দেশে উদযাপিত হয়েছে। তবে একটা বিষয়ে এসে খটকা লেগেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদন। রাদওয়ান মুজিব কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন স্বাভাবিক, কিন্তু বলা হচ্ছে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তিনি। জাতীয় বার্তা সংস্থা ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা- বাসস’ ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। (ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২৩)”। বাসসের এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দেশের সবক’টি গণমাধ্যম ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা জানায়। এদিকে বাসস যখন ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা জানিয়েছে, তখন তথ্য অধিদপ্তরের (পিআইডি) প্রকাশিত ছবিতে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের তথ্যের উল্লেখ নেই।

এছাড়া দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস’ উদযাপনে স্টিয়ারিং কমিটির গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখের বৈঠকে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ তৃতীয় কারো শ্রদ্ধা নিবেদনের সিদ্ধান্ত হয়নি। বস্তুত ধানমন্ডির শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির বাইরেই রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণ থাকতে পারে এমন এক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত আছে ওই সভায়। সেটা হচ্ছে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন অনুষ্ঠান, যেখানে বলা হয় রাষ্ট্রীয়কাজে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় তাঁর পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।

জাতীয় ঐতিহাসিক দিবসে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের যে তথ্য বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসের সূত্র ধরে গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে সেটা সত্য নয়। এটা বাসসের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের অতি-উৎসাহ থেকে লিখিত সংবাদ কিনা সন্দেহ, কারণ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সরকারের অংশ নন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নন, জাতীয় সংসদের সদস্যও নন, মন্ত্রিসভার সদস্য নন; বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর বদলে কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারেন এমন অবস্থানের নন। এই দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এবং তারা এইধরনের কোন কর্মসূচি দেয়নি দিবসে। এখানে বাসস থেকে প্রধানমন্ত্রী ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে ঘিরে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে সঠিক নয়।

সশরীর উপস্থিতি ছাড়াও রাষ্ট্রপতির পক্ষে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনও রাষ্ট্রাচারের অংশ। করোনাকালীন আমরা দেখেছি এমন অনেক কিছু। প্রতি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রাচারের যথাযথ অনুশীলন আমরা দেখেছি। এবার রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের যে সংবাদ সেটা রাষ্ট্রাচারের অংশ নয় বলে আমরা মনে করি। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পুত্র হতে পারেন, কিংবা জাতির পিতার পরিবারের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা ও নিরাপত্তা পেতে পারেন; কিন্তু তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ দায়িত্ব পালনের যথাযথ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান নন। তার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়ে মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সংসদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা উপস্থিত থাকতে পারেন, তবে এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি নয়। এখানে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এটা সরকারকে বিব্রত করছে নিশ্চিত। বিষয়টিকে তাই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলে বিভ্রান্তির অবসান হবে বলে আমরা মনে করি।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ ও করণীয়



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র প্রবাহকে ব্যতিক্রমীভাবে তাপ তরঙ্গের উচ্চ তাপমাত্রা এবং দীর্ঘায়িত সময়কাল দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এটি একটি বর্ধিত সময়ের জন্য স্থায়ী হতে পারে, প্রায়ই এক সপ্তাহ বা তার বেশি। টেকসই চরম তাপের কারণে তীব্র তাপ তরঙ্গ প্রায়শই মানব স্বাস্থ্য, কৃষি এবং অবকাঠামোর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশ এখন ঘন ঘন তীব্র বা চরম তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে তীব্র বা চরম তাপপ্রবাহ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অবদান রাখতে পারে এমন কিছু কারণ রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী চরম তাপপ্রবাহের প্রাথমিক চালক হল জলবায়ু পরিবর্তন। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা, বর্ধিত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে, আরও ঘন ঘন এবং তীব্র তাপ প্রবাহে অবদান রাখে। বাংলাদেশ, একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়ায়, চরম উত্তাপের ঘটনা সহ উষ্ণায়ন জলবায়ুর প্রভাব অনুভব করে।

বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ঋতু পরিবর্তন রয়েছে এবং নির্দিষ্ট আবহাওয়ার ধরণ তীব্র তাপপ্রবাহে অবদান রাখতে পারে। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে, উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, মেঘের আচ্ছাদন হ্রাস এবং সীমিত বৃষ্টিপাতের মতো পরিস্থিতি গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়া তৈরি করতে পারে, যা চরম তাপ ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও তীব্র তাপপ্রবাহে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশটি ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর দ্বারা প্রভাবিত একটি অঞ্চলে অবস্থিত। বৃহৎ জলাশয়ের সান্নিধ্যের ফলে উচ্চ আর্দ্রতার মাত্রা হতে পারে, যা অস্বস্তি বাড়ায় এবং চরম তাপের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়।

বাংলাদেশের শহুরে এলাকা, যেমন শহর এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব অনুভব করে। কংক্রিট কাঠামো, অ্যাসফাল্ট এবং সীমিত সবুজ স্থানের উপস্থিতি সহ নগরায়ন তাপ শোষণ এবং ধরে রাখার দিকে নিয়ে যায়। এই প্রভাবটি শহরাঞ্চলে তাপ তরঙ্গকে তীব্র করতে পারে, যা আশেপাশের গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় তাদের আরও গরম করে তোলে।

এল নিনো-সাউদার্ন অসিলেশন (ENSO) হল একটি প্রাকৃতিক জলবায়ুর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণকে প্রভাবিত করতে পারে। এল নিনোর ঘটনার সময়, যা প্রতি কয়েক বছরে অনিয়মিতভাবে ঘটে, নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণকে প্রভাবিত করে। এল নিনো বাংলাদেশে শুষ্ক এবং উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অবদান রাখতে পারে, সম্ভাব্য তাপ তরঙ্গের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই কারণগুলি একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং তীব্র বা চরম তাপ তরঙ্গের নির্দিষ্ট কারণ এবং বৈশিষ্ট্যগুলি ঘটনা থেকে ইভেন্টে পরিবর্তিত হতে পারে। তীব্র তাপ তরঙ্গের কারণ এবং অবদানকারী কারণগুলি বোঝা তাদের প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য কার্যকর কৌশলগুলি তৈরি করার জন্য এবং বাংলাদেশে চরম তাপের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চরম তাপ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এটি তাপ ক্লান্তি, হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং অন্যান্য তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতার কারণ হতে পারে। দুর্বল জনসংখ্যা, যেমন বয়স্ক, শিশু এবং প্রাক-বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবস্থার ব্যক্তিরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাপ তরঙ্গের সময় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা এবং সংস্থানগুলির বর্ধিত চাহিদা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে চাপ দিতে পারে।

তীব্র তাপপ্রবাহ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা, সীমিত বৃষ্টিপাত এবং খরা পরিস্থিতির সাথে মিলিত হওয়ার ফলে ফসলের ফলন কমে যেতে পারে, শুকিয়ে যেতে পারে এবং এমনকি ফসল নষ্ট হতে পারে। গবাদি পশুর উপর তাপের চাপ তাদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

তাপপ্রবাহ বাংলাদেশে পানির ঘাটতির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা বাষ্পীভবনের হার বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, বিশেষ করে নদী, হ্রদ এবং জলাশয়ে। এটি কৃষির জন্য সেচ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অ্যাক্সেস এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে।

তীব্র তাপ তরঙ্গ প্রায়শই শীতল করার উদ্দেশ্যে, বিশেষত এয়ার কন্ডিশনার জন্য শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি করে। এই বর্ধিত চাহিদা বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিং হতে পারে যদি শক্তির পরিকাঠামো উচ্চতর লোডের সাথে মানিয়ে নিতে না পারে।

বাংলাদেশের শহুরে অঞ্চলগুলি, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং কংক্রিট অবকাঠামো দ্বারা চিহ্নিত, তীব্র তাপ তরঙ্গের সময় শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব অনুভব করতে পারে। সবুজ স্থানের অভাব এবং তাপ-শোষণকারী পৃষ্ঠের প্রাচুর্য শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাবকে তীব্র করে তুলতে পারে, শহরগুলিকে আশেপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় আরও গরম করে তোলে এবং মানুষের স্বাস্থ্য এবং আরামের উপর প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে।

তীব্র বা চরম তাপ তরঙ্গের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য, তাপ তরঙ্গ প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা, জনসচেতনতা প্রচার, প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা, শীতল কেন্দ্র স্থাপন, শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য নগর পরিকল্পনার উন্নতির মতো পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক কৃষি অনুশীলনের উন্নয়ন করা।

গরম আবহাওয়ায় হাইড্রেটেড থাকার জন্য প্রচুর পানি এবং তরল পান করুন। ক্যাফিনযুক্ত বা অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন কারণ তারা ডিহাইড্রেশনে অবদান রাখতে পারে।

দিনের উষ্ণতম সময়ে, সাধারণত দুপুর থেকে শুরু করে বিকাল পর্যন্ত বাড়ির ভিতরে বা ছায়াযুক্ত এলাকায় থাকুন। বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাবলিক স্পেস যেমন শপিং মল, লাইব্রেরি বা কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার কথা বিবেচনা করুন। গ্রামাঞ্চলে গাছ বা ছায়া ঘেরা জায়গায় অবস্থান করুন।

বসার জায়গা ঠান্ডা করতে ফ্যান বা পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনার ইউনিট ব্যবহার করুন। সরাসরি সূর্যালোক আটকাতে দিনের বেলা পর্দা বা খড়খড়ি বন্ধ করুন। আপনার শরীরের তাপমাত্রা কমাতে ঠান্ডা ঝরনা বা গোসল করুন।

হালকা ওজনের, ঢিলেঢালা ফিটিং এবং হালকা রঙের পোশাক পরুন যা আপনার শরীরকে শ্বাস নিতে দেয় এবং তাপ অপচয়ে সাহায্য করে। রোদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে টুপি, সানগ্লাস এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।

দুর্বল ব্যক্তিদের উপর নজর রাখুন, যেমন বয়স্ক, শিশু এবং যারা আগে থেকে বিদ্যমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার সাথে। সহায়তা অফার করুন এবং নিশ্চিত করুন যে তারা শীতল এবং হাইড্রেটেড রয়েছে।

চরম তাপ তরঙ্গের সময়, বিশেষ করে দিনের উষ্ণতম অংশগুলিতে কঠোর বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপগুলি হ্রাস করুন। আপনার যদি বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপগুলিতে জড়িত হওয়ার প্রয়োজন হয়, তাপমাত্রা শীতল হলে সকালের বা শেষ সন্ধ্যার জন্য সেগুলি নির্ধারণ করুন।

পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখুন যাতে তাদের সুস্থতা সম্পর্কে জানা যায় এবং তাপ তরঙ্গ নিরাপত্তা সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করা যায়।

তাপ তরঙ্গের সময় ত্রাণ এবং সহায়তা প্রদান করে এমন সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অংশ নিন বা সমর্থন করুন, যেমন শীতলকরণ কেন্দ্র স্থাপন বা প্রয়োজনে জল বিতরণ করা।

তাপ প্রবাহের অন্তর্নিহিত কারণগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং অভিযোজন ব্যবস্থাগুলির জন্য অ্রাডভোকেসি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে৷ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, শক্তি দক্ষতা, এবং টেকসই নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এমন উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করুন।

মনে রাখবেন, এই পরামর্শগুলি সাধারণ নির্দেশিকা। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্থানীয় সুপারিশ এবং নির্দেশনা অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

জীবন ও পরিবেশ রক্ষার্থে প্লাস্টিক দূষণ রুখতে হবে



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার অর্ধেক শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। উৎপাদিত প্লাস্টিকের ১০ শতাংশেরও কম পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক পণ্যের তিন-চতুর্থাংশ ল্যান্ডফিল বা প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হয়। সারা বিশ্বে বছরে আনুমানিক ১৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রদ, নদী, সাগর এবং সমুদ্রে মিশে যায়, যা প্রায় ২,২০০টি আইফেল টাওয়ারের ওজনের সমান। উল্লেখ্য যে, আইফেল টাওয়ারের মোট ওজন ১০,১০০ টন।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে এ বছর সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। নেদারল্যান্ডের সহায়তায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট এ বছর দিবসটির আয়োজক দেশ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির থিম বা প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে “Solutions to Plastic Pollution”। আর স্লোগান ঠিক করা হয়েছে “Beat Plastic Pollution”। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলায় নির্ধারিত প্রতিপাদ্যহলো “প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে” আর স্লোগান হলো “ সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ”।

এখানে উল্লেখ্য যে, এ বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)এর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সরকারকে পরিবেশগত উদ্যোগে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম এবং অনুষ্ঠান হয়। কিছু সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে বৃক্ষ রোপণ অভিযান, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, পরিবেশগত প্রদর্শনী, এবং টেকসই অনুশীলনের বিষয়ে সেমিনার। এই ক্রিয়াকলাপগুলির লক্ষ্য পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ কমানো, টেকসই জীবনযাত্রার প্রচার এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের চাপ প্রয়োগ এবং সচেতনতা বাড়াতে ব্যক্তি ও সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করা।

আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন পার্কসিন। এটি নাইট্রিক অ্যাসিডের সাথে উদ্ভিদ সেলুলোজ বিক্রিয়া করে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯০৭ সালে, লিও বেকেল্যান্ড একটি সম্পূর্ণ সিন্থেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্রম বির্বতনের ধারায় প্লাস্টিকের বহু রূপ ও ধরন আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লাস্টিক হল মনুষ্যসৃষ্ট পলিমার, যা মূলত রাসায়নিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি হয়। প্লাস্টিক সাধারণত নমনীয়, ক্ষয় প্রতিরোধী, টেকসই এবং সস্তা। মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিধায় একে সাধারণত প্লাস্টিক দূষণ বলা হয়।

প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে মানুষ প্রতি মিনিটে প্রায় এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করে এবং প্রতি ঘন্টায় এক বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে । স্বল্প খরচ, স্থায়িত্ব, প্রক্রিয়াকরণের সহজতা, হালকা ওজন এবং উচ্চ তাপ ও বৈদ্যুতিক নিরোধক প্লাস্টিককে ব্যক্তি এবং বিপুল সংখ্যক শিল্প খাতের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্লাস্টিকের অসংখ্য সামাজিক সুবিধা অনস্বীকার্য হওয়া সত্ত্বেও, এটি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য দ্রুত বাড়ছে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। এটি ইতিমধ্যে বাস্তুতন্ত্র, মানব সম্প্রদায়, প্রানীকুল এবং পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে একটি গুরুতর হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

ইউরোপ্লাস এর তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বেশিরভাগই "পলিমারাইজেশন বা পলিকনডেনসেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেলুলোজ, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, লবণ এবং অপরিশোধিত তেলের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে" তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যগুলি পচতে দীর্ঘ সময় নেয় কারণ পণ্যগুলিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলি আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান নেই, এবং প্রাকৃতিকভাবে এমন কোন জীবানু কণা নেই যা তাদের কার্যকরভাবে নষ্ট করে ফেলতে পারে। প্লাস্টিক পণ্যগুলি নষ্টের সময় তাদের ধরন এবং গাঠনিক অবস্থা বিবেচনা করে আলাদা হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ১০ থেকে ১,০০০ বছরের মধ্যে পচে যেতে পারে। আবার একটি প্লাস্টিকের বোতল যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, এটি ক্ষয় হতে ৪৫০ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে । অপরিশোধিত প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থ যোগ করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এবং বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করে।

স্তূপ করা প্লাস্টিক বর্জ্য খুবই উদ্বেগজনক কারণ এটি মারাত্মক পরিবেশগত পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। যখন সূর্য এবং এর তাপের সংস্পর্শে আসে, তখন এগুলি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করতে পারে। এটি অবশ্যই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যা ইথিলিন এবং মিথেনসহ আরও ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরিতে সহায়তা করে যা তাপমাত্রাকে আরও বেশি বৃদ্ধি করে ধ্বংসের একটি দুঃস্বপ্নের চক্র তৈরি করে।

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল, ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী প্লাস্টিক আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থাকেও প্রভাবিত করছে। মোট প্লাস্টিক পণ্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত হয় যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের একটি প্রধান কারণ। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানিয়েছে যে বর্তমানে বিশ্বের কার্বন বাজেটের ৩.৪ শতাংশ প্লাস্টিক রয়েছে এবং আগামী বিশ বছরে তা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে ৮.৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড যোগ হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ১০ থেকে ১৩ শতাংশ ঘটছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর কারণে । ২০২২ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ভেসে যেতে পারে এবং মেঘের গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে।

সামুদ্রিক পরিবেশ প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রতি বছর ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি এবং ১০০,০০০ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন যে বর্তমানে সমুদ্রে ৫.২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো এবং ম্যাক্রো প্লাস্টিক কণা জমা রয়েছে। প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে প্লাস্টিকের ৪৬,০০০ কণা জমা হয়েছে। সাগরে জমে থাকা প্লাস্টিকের মোট ওজন দুই লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন টুকরো প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে জমা হচ্ছে। এভাবে সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিশাল অংশ জমেছে।

বর্তমানে, প্রশান্ত মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য প্যাচ প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। প্লাস্টিক বর্জ্যের অনুরূপ জমা অন্যান্য মহাসাগর ও সাগরেও তৈরি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশই নয়, ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রের পানির কমবেশি ৮৮ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণে দূষিত। প্লাস্টিক বর্জ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্রতি মিনিটে আমরা ১ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের পরে ফেলে দিই। প্রতি বছর আমরা অজান্তে সমুদ্র সৈকতে ৮.৩ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের টুকরো নিক্ষেপ করি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক পণ্য ও কণার সংখ্যা মাছের সংখ্যার চেয়েও বেশি হবে। বর্তমানে সাগরে ধরা পড়া প্রতি তিনটি মাছের মধ্যে একটির পেটে প্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিক পণ্যে মাইক্রোবিড থাকে, যা সহজেই পরিবেশকে দূষিত করতে পারে।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং শিল্পটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্লাস্টিক হল বিদেশী রপ্তানি বাণিজ্য থেকে আয়ের ১২তম সর্বোচ্চ উৎস এবং আমাদের তৈরি পোশাক সেক্টর, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বয়ংচালিত শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৫,০০০ প্লাস্টিক তৈরি কারখানা রয়েছে এবং এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছোট ও মাঝারি কারখানা। এসব কারখানায় প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় বাজারে সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং প্লাস্টিক উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্লাস্টিক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১১৫.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে বলে আশা করছে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ বছরে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি থেকে তিনগুণ বেড়ে ২০২০ সালে ৯ কেজি হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২২.২৫ কেজি হয়েছে। সংখ্যাটি শহরাঞ্চলের জাতীয় গড়ের তিনগুণ বেশি। ঢাকায় ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দৈনিক প্লাস্টিক বর্জ্য ১৭৮ টন থেকে ৬৪৬ টন পর্যন্ত বেড়েছে। ঢাকার প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩৭.২ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র হতাশাজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অপর্যাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে একটি। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারী প্লাস্টিক দূষণকে আরও খারাপ করেছে।

যদিও বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল এবং প্রতিবেশী দেশের তুলনায় কম, তবে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা এমন একটি সমস্যা যা আমাদের দেশকে বৈশ্বিক অবস্থানে দশম স্থান দিয়েছে । বিশ্বব্যাপী অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ২.৪ শতাংশের জন্য বাংলাদেশ দায়ী।

টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ যা আমাদের সামগ্রিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এবং শুধুমাত্র ঢাকা শহরে একই সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যগুলির বেশিরভাগই তাদের প্রথম ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হয় এবং ভুল বা অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলি রাস্তা, ড্রেন, খাল, নদী এবং রাস্তার পাশের খোলা জায়গায় অপরিশোধিত থেকে যায়।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ব-দ্বীপ এবং এই নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ভূমিভিত্তিক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, প্রতিদিন প্রায় ৭৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনা নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে যা আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। প্লাস্টিক পণ্যগুলি কখনই সম্পূর্ণরূপে পচে যায় না বরং কণা আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলো খুব অল্প দূরত্ব অতিক্রম করে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটাতে পারে। অন্যদিকে, পোড়ানো প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও কণা মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ জটিল রোগব্যাধি তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মৃত্যুর প্রায় ৩২ শতাংশ পরিবেশগত অবনতির সাথে জড়িত। বিশেষ করে বাইরের বায়ু দূষণ, অপর্যাপ্ত পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি মান এবং প্লাস্টিক দূষণের মাধ্যমে সীসার আধিক্য এই মৃত্যুর কারণ।
বিশ্ব ব্যাংক আরো উল্লেখ করেছে ২০১৯ সালে পরিবেশগত কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য আনুমানিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪.৪ ট্রিলিয়ন টাকা। প্লাস্টিক বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ধ্বংস করে, জলাবদ্ধতা তৈরি করে যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরির অন্যতম কারণ যা ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বাহিত রোগের ঘটনা ঘটায়। এছাড়াও, চিকুনগুনিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মত রোগের প্রার্দুভাবের জন্য প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে দায়ী।

সুতরাং, প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী একটি জটিল সমস্যা; যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ, শুধুমাত্র এশিয়ার দেশগুলিতে উৎপাদিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিবেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্ত হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের ৮০ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সামগ্রীক জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। ইউএনইপি’র একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি দেশ ও কোম্পানিগুলো সঠিক নীতি ও বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাজার পরিবর্তন করে তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

“Turning off the Tap: How the world can end plastic pollution and create a circular economy” শীর্ষকএই প্রতিবেদনে বিশ্ব কীভাবে প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটাতে পারে এবং একটি বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরি করতে পারে তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সঠিক অনুশীলন, বাজারের পরিবর্তন এবং নীতিগুলির সমাধান-কেন্দ্রিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা রাষ্ট্র বা সরকারগুলিকে চিন্তাভাবনা এবং ব্যবসায়িক পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।

ইউএনইপি বলছে, প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে বায়োডিগ্রেডেবল নয়, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একমাত্র উপায় হল একটি বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করা। প্লাস্টিকের সার্কুলার ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে, 3R কৌশলের (রিডুস, রিইউজ, রিসাইকেল) উপর ভিত্তি করে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা। এর ফলে প্লাস্টিক দূষণজনিত সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।

শুধুমাত্র একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেলের মাধ্যমেই আমরা প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার 3R পদ্ধতিকে সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করতে এবং একটি জাতি হিসেবে আমাদের প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সক্ষম হব। এই পরিস্থিতিতে, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা করতে এবং সবুজ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের একটি নতুন প্রতিবেদনে(Towards a Multisectoral Action Plan for Sustainable Plastic Management in Bangladesh) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য মাল্টি সেক্টরলাল কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেখানে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।

এ কথা সত্য যে, প্লাস্টিক পণ্যগুলি মানুষের জীবনকে আরও স্মার্ট করে তুলেছে কিন্তু একই সময়ে, প্লাস্টিকের অব্যবস্থাপনা আমাদের এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে যেখানে আমাদের গ্রহ ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি, আগামী বছরগুলিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় আরো বাড়বে, মানব জীবন এবং অন্যান্য জীবিত প্রাণীকে প্রভাবিত করবে। কাজেই এখনই সচেতন হতে হবে।

আমাদের দেশে নীতি ও আইন প্রণয়নের চর্চা থাকলেও সেসবের কার্যকর প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। সরকারের কার্যকরী প্রবিধান ও প্রয়োগের উদ্যোগ ছাড়াও, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সচেতনতাও এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এই দিনে আমরা সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই এবং আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষায় “সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ”।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

;

ভাসানচর- এক টুকরো পরিকল্পিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়



ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সামিয়কভাবে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সে কারণে ভাসানচরে তাদের জন্য নতুন ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী কর্মকর্তা জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরকিল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিল যে, এই দ্বীপ মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে না। রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হলে তা নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের ১৮ সদস্যের একটি দলকে ভাসানচরে চার দিনের সফরে নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিনে দেখার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ‘মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার চাহিদার’ স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৮ মে, ইউএনএইচসিআর এবংআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা এবংসার্বিক অবস্থাস ম্পর্কে অবগত হয়।

পরিদর্শন শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইউএনএইচসিআর ৯ অক্টোবর ২০২১, একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর ভাসানচরে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে।বর্তমানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউ এফ পি ও অন্যান্য এন জি ও সেখানে তাদের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ণ-৩ নামের এই প্রকল্প হাতে নেয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। নৌ বাহিনী সফলতার সাথে এই প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জন্য ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেলটার স্টেশন রয়েছে। ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে আছে ১২টি হাউজ। এখানে সব মিলিয়ে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবংপ্রতিটি কক্ষে দুটো ডাবল বাঙ্কার বা দোতলা খাট আছে যাতে একটি পরিবারের চারজন থাকতে পারে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য দুটো কক্ষ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী আবাসনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গা দরকার, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশি জায়গা রাখা হয়েছে। প্রতি ৮টি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দু'টি গোসলখানা রয়েছে, নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে।সেখানে সিলিন্ডারে এল পি জি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।রান্নায় গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একটা এন জি ও বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করছে। রান্নাঘর, গোসলখানা এবং টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে। প্রতিটি হাউজের ওপরে রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল।

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য আছে একটি করে শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে বড় ধরনের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা মোকাবিলায় গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভাসানচরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় হলেও টিকে থাকতে সক্ষম এই শেলটার স্টেশন। ভাসানচরে কর্মরত ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসি’র প্রতিনিধি জানায় যে, কিছুদিন আগে সাইক্লোন মোখার সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে ভাসানচরের সবাইকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছিল, এবং তারা সবাই নিরাপদ ছিল, এটা ভাসানচরের জন্য একটা বড় অর্জন।

ভাসানচরে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ, এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার আছে। সেসব বাজারে নোয়াখালী হাতিয়া ও অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করছে এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় পুকুর এবং লেক কাটা হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখানে মাছ ধরে এবং এখানে মাছের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে ও ১০ ফুট গভীর একটি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টার একই আকৃতিতে বানানো হয়েছে, এখানকার সব ঘর দেখতে একই রকম। ঘরের পাশের অল্প ফাঁকা জায়গায় মহিলারা শাক সবজি চাষ করছে। প্রতিটি ঘরের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সব গ্রামে এত সুন্দর মজবুত ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখা যায় না। প্রকল্পের ভেতরে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার আছে। এনজিওদের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গারা সমস্ত আবর্জনা সেখানে এনে জমা করছে। এর ফলে এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে এবং এই আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে তা কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসান চরে ৪৩২ একর জমিতেরোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনানির্মিতহয়েছে।ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য বাঁধের ভেতর ৯১৮ একর এলাকা খালি রাখা হয়েছে।

ভাসানচরে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর তুলনায় অনেক টেকসই ও উন্নতমানের। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাসানচরে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ১৭০২ একর জমির চারপাশে ৯ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তীর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সেই পাশেই শোর প্রোটেকশন দেওয়া হয়েছে। শোর প্রোটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক শক্তিশালী ঝড় এই চরের উপর দিয়ে গেলে ও মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।

১৩,০০০ একরের এই দ্বীপে সারাবছর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদামঘর, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, একটি পুলিশ স্টেশন, বিনোদন ও শিক্ষা কেন্দ্র, খেলার মাঠ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে।ভাসানচরে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে, পাইলট প্রকল্প আকারে ই ভাউচারের মাধ্যমে এখন ৫০০০ রোহিঙ্গা কে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবাইকে এই সুবিধার আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলি থেকে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে নিরাপদ আর স্বস্তিতে আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলি রয়েছে যা বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে ভাসানচরের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও কক্সবাজারের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির সুবাতাস হিসেবে দেখছে। ভোর থেকেই ভাসানচরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের কেউ সাগরে কিংবা চরের ভেতরের পুকুর বা লেকে মাছ ধরতে যায়। কেউ ভ্যান কিংবা রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেউ তাদের জন্য বরাদ্দ কৃষি জমিতে চাষ করতে চলে আসে। কিছু রোহিঙ্গা তাদের পশুদের চড়াতে বের হয়। এক সময়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ভাসানচরের উপর তাদের আস্থা রাখতে পারেনি আজ সেখানেই নিরাপদে উন্নত পরিবেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা যা বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন গবাদিপশু লালন পালন, মাছধরা ও চাষাবাদের মত জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আছে। ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলো সেলাই, পাটজাত পণ্য তৈরি, ব্লকের কাজ, স্কিন প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং আরও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার নিশ্চয়তা, মৌলিক অধিকার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ভাসানচরের স্কুলগুলো এখন কলরব মুখর, শিশুরা সকাল বেলা সেখানে যাচ্ছে এবং সামনে তাদের কেন্দ্রিয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

সবশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এক টুকরো বাংলাদেশ এই ভাসানচর যা এখন রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়।

;

সোনায় অযৌক্তিক ভ্যাটে বিদেশমুখী ক্রেতা



রিপুনুল হাসান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পুত্র-সন্তানের বিয়ের সময় উপহার দেওয়ার জন্য ডায়মন্ড ও গোল্ডের অর্নামেন্ট কেনার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক বিত্তবান ও সম্পদশালী ভারতে যান। সেখান থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী দামে সব গহনা কিনে আনেন। শুধু ভারতেই যান না। বাংলাদেশিরা সোনার গহনা কিনতে দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যান। আর প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন সেখান থেকে দেশে ফেরার সময় সোনার সোনার গহনা নিয়ে আসেন। প্রতি বছর সোনার গহনা রফতানি করে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে ভারত। তারপরও তারা দেশের ভোক্তার প্রতি বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কোন ভাবেই ভারতীয় ক্রেতারা সোনার গহনা ও ডায়মন্ড কিনতে বিদেশ না যায়। জুয়েলারী ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রূপা বা রূপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৩ শতাংশ। ভারতের সোনার বাজার এবং অর্থনীতির তুলনায় আমাদের দেশে বিক্রি ও ক্রেতার পরিমাণ বেশি না। তারপরও আমাদের ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ। ক্রেতারা বলছেন, ৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এটা আমাদের জন্য বেশি।

ভোক্তাদের বিদেশমুখী বন্ধ করতে হলে প্রতিযোগীতামুলক ভ্যাটের হার নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবেশি দেশটির এত বড় বাজার হওয়ার পর ক্রেতাদের জন্য ভ্যাট মাত্র ৩ শতাংশ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে জুয়েলারি খাতে আরোপিত শুল্ককর ও ভ্যাট হার কমানো এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। এতে যেমন সরকারের বৈদেশিক আয় আসবে। তেমনি বাড়বে রাজস্ব আয়। বিপুল পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত তৈরি হবে। বর্তমানে জুয়েলারী ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রূপা বা রূপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হোক। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের বিনিময় মূল্যের কারণে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম বা প্রতি এক ভরি ২২ ক্যারেট সোনার মূল্য ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা। এরসঙ্গে নূন্যতম মজুরি ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। তারসঙ্গে নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে বা ৫ হাজার ১৩২ টাকা ভ্যাট যুক্ত হলে, মোট মূল্য হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭৫ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি ভরিতে ভ্যাট দিতে হয় ৫ হাজার ১৩২ টাকা। অন্যদিকে ভারতে সমপরিমান সোনার অলঙ্কার কিনতে ৩ শতাংশ হারে বা ২ হাজার ৭৯১ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। যার প্রভাব স্বর্ণালংকার ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সু¯পষ্ট বিদ্যমান। অথচ বাংলাদেশের অলংকার শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। ভ্যাট আহরণে আগামী দিনে সরকারের একটি বড় খাত হতে পারে জুয়েলারী শিল্প। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের কাছে সহনীয় আকারে ভ্যাট নির্ধারণ করা জরুরি। বাজুস মনে করে সোনা একটি মূল্যবান ও ¯পর্শকাতর ধাতু হওয়ায় মোট বিক্রয়ের উপর ভ্যাট হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমান আরও বাড়বে।

ভ্যাট হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের ক্রেতারা যেন বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে অলংকার ক্রয়ে নিরুৎসাহিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন সময়ে উচ্চবিত্তদের একটা বড় অংশই বিদেশে গিয়ে অলংকার ক্রয় করে থাকেন। যার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে আমাদের স্থানীয় বাজারের সাথে দামের পার্থক্য। যার কারণে যাদের সামর্থ্য থাকে একসাথে বেশী পরিমাণে সোনা ক্রয় করার, তারা বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বা আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার করে দেশে সোনা আনছেন। এতে একদিকে যেমন দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দেশে যারা কেনাকাটা করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ করহারের কারণে ভ্যাট প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন। এতে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। আবার জুয়েলারি পণ্য রফতানি সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারের প্রাথমিক হিসাবে বাংলাদেশের সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। তবে প্রকৃত চাহিদা নিরুপণে সরকারের সমীক্ষা প্রয়োজন। বৈধভাবে সোনার চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা কাঁচামালের উচ্চ মূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্প সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সকল ধরণের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ। যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারী ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশের মহান স্থাপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজুসের প্রেসিডেন্ট জনাব সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে আমরা বদ্ধ পরিকর। আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ তুলবে চায় জুয়েলারি শিল্প। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ্যভাবে জুয়েলারি শিল্পে আনুমানিক ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আগামীতে এই শিল্পে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু এডিশন করে সোনার অলঙ্কার রফতানি সম্ভব। দুবাই যেমন সোনার ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিলো জাতির পিতার। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জুয়েলারি শিল্পে ৩ শতাংশ ভ্যাট ও করমুক্ত সুবিধা চাই। সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়তে জুয়েলারি শিল্পে সকল সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

লেখক: রিপুনুল হাসান, ভাইস-প্রেসিডেন্ট-বাজুস

;