বাংলা ভাষার বিবিধ বৈচিত্র ও শক্তি
বলেন, প্রকৃত অর্থে একটি ভাষা হল, অনেক উপভাষার (ডায়ালেক্ট) সমন্বয়। আর উপভাষা হল, ব্যক্তি মানুষের ভাষিক বিকাশের নির্দিষ্ট স্তরে থাকা ভাষাজ্ঞান বা স্বভাষা (ইডিআলেক্ট)। এই স্বভাষার কারণেই এক ভাষাভুক্ত কোটি কোটি মানুষ কোটি স্টাইলে কথা বলেন এবং লেখেন।
ফলে প্রতিটি ভাষার ভেতরে থাকে `ভেতরের বিচিত্রতা` (ইনটারনাল ভেরিয়েশন)। থাকে পদযোজনা বা কথা গঠনরীতি আর রূপতত্ত্বের বিচিত্রতা, যা ভাষার বৈচিত্র ও শক্তি বৃদ্ধি করে। ভাষাকে অধিকতর মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
একই ভাষায় বিষয়ে দুই জন মানুষের কথা বলা ও রচনার এই ব্যবধান বিচিত্রতার পরিচায়ক। একই ভাষার বিবিধ বিচিত্রতা একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। ব্রিটিশ ইংরেজির সঙ্গে আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজির সূক্ষ্ম পার্থক্য আসলে বৈচিত্র্যের পরিচায়ক। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বিচিত্রতা সামাজিক জীবনে বরণ করে নিলে বাঙালির ভাষাগর্ব আরো সার্থক হত। কিন্তু ভাষাস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষার বিবিধ বিচিত্রতার স্বীকৃতি দিতে এবং বিকশিত করতে পারেনি।
ফলে আমাদেরকে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে ও উত্তর খুঁজে বের করতে হবে যে, আমরা বাংলা ভাষার বৈচিত্র কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি? দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ কাজ কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছে?
দৃষ্টান্তরূপে বলা যায়, বৃহত্তর বাংলা ভাষা অঞ্চলের পশ্চিমাংশের বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাংলার পাশে এদিকের ‘নোয়াখাইল্যা’ বা ‘সিলটি’ বা 'বরিশ্যাইলা' বাংলাকে সমান উৎসাহে স্বীকার করে নিলে তো কোনো ক্ষতি নেই। এতে ভাষার বৈচিত্র, সক্ষমতা ও শক্তিই বরং বৃদ্ধি পায়। মেদিনীপুর কি গঙ্গাসাগরের বাংলার সঙ্গে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ বা ফরিদপুরের বা রংপুরের বাংলাকে মিলিয়ে দিতে পারলে বুক চিতিয়ে বাংলা ভাষা তার শক্তি ও গভীরতা আরো ব্যাপকভাবে দেখাতে পারতো ।
সমাজমনের উৎসাহ না পেলে, স্রেফ ভাষাতাত্ত্বিকের আগ্রহে ভাষা বাঁচে না। বহু ভাষা সমাজ-বিযুক্ত হওয়ায় অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাকে তাই রাজধানী বা মাসোয়ারা-ভোগী পণ্ডিতদের ঘেরাটোপ ছিন্ন করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভাষাভঙ্গিকে আলিঙ্গন করতে হবে। মানুষের মুখে উচ্চারিত প্রান্তিক জনপদ ও জনগোষ্ঠীর ভাষা যদি অবহেলিত হয়, তাহলে ভাষার মূলস্রোত দুর্বল হতে বাধ্য। বাংলা ভাষাকেও আমরা বিবিধ বিচিত্রতা থেকে বিমুখ রেখে এবং জনবিচ্ছিন্ন ও স্বার্থবাদী পণ্ডিতদের কব্জাবন্দি করে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ণ করছি।
বইমেলায় রেকর্ড ভিড়, পদক-পুরস্কারের জোয়ার, রেকর্ড বই বিক্রির খবরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যপ্রেম ফুটে বেরোচ্ছে বটে। দরিদ্র ও প্রান্তিকজনের ভাষার বেহাল দশা ফলে কারো চোখেই পড়ছে না। আঞ্চলিক ভাষা-প্রবাহ সমালোচকদের হিংসায় অনাদরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজির হ্যাংওভারের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিকৃতি ভাষাকে বিকৃত করছে। এসব বিপদ নিয়ে ভাবনাচিন্তার ফুসরত উদ্বাহু নৃত্যরত পণ্ডিতদের নেই। হয়তো আবার একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ জন্ম নিলে তিনি ভাষার আত্মা ও বৈচিত্র স্পর্শ করতে পারবেন!
উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের রূপকারদের সামনে কোনও ‘লেগ্যাসি’ ছিল না, পথ করে নিতে হয়েছিল সংস্কৃত আর ইংরেজি এই দুই ভাষার প্রবল প্রতাপের মধ্য দিয়ে। বিশ্বায়নে যুগেও ভাষাকে পথ চলতে হচ্ছে নানা দুর্বিপাক এড়িয়ে। ভাষার বৈচিত্র স্বীকার করলে আমরা লড়াইয়ের শক্তি পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলা ভাষার বিবিধ বৈচিত্রকে আমরা স্বীকার করলাম না।
নিজের ভাষার মধ্যে নানা উপভাষা ও বৈচিত্র নিয়ে হীনম্মন্যতাবোধকে অতিক্রম করতে কী করণীয়? বহিরঙ্গে ভাষা নিয়ে আহাউহু করাই একমাত্র কর্তব্য হতে পারে না। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই কতকগুলো জিনিস নিয়ে মাতামাতি করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ‘বাংলা ভাষার’ লেখকের অন্তিম দুর্দশার কাহিনি, ভাষাগৌরব নিয়ে অতুলপ্রসাদ থেকে শামসুর রাহমানের কবিতা উচ্চারণ অবশ্যই জরুরি। পাশাপাশি ভাষার বর্তমান সঙ্কট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতিও আবশ্যক। ভাষাকে মানুষের আরো কাছাকাছি নেওয়ার প্রচেষ্টাও অতীব জরুরি, যার মাধ্যমে আঞ্চলিক ও প্রান্তিক উপভাষা এবং অবহেলিত মানুষ বৃহত্তম ভাষাকাঠামোতে সম্মানের সঙ্গে জায়গা পান।
ভাষাকে সমুদয় জনগোষ্ঠীর ভাবপ্রকাশের মাধ্যম যেমন করতে হবে, ভাষার প্রকৃত ভাবটা বোঝাতে ও বুঝতেও হবে সকল মানুষকে। যে ভাষা জাতিসত্তার সেতুবন্ধ হওয়ার কথা ছিল, তাকে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আঞ্চলিক স্বার্থে আমরা যদি 'পাঁচিল' করে তুলি, তাহলে ভাষার প্রসারণের বদলে সঙ্কোচন ধেয়ে আসবে। সাতচল্লিশ, বাহান্ন, একাত্তরে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসপর্ব আমাদের সুযোগ দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে তার আঞ্চলিক ও প্রামাণ্য-সহ সকল রূপকে মেলানোর, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বহুস্তরী অন্তররূপটিকে দেখার, বোঝার। আমরা সে সুযোগ কতটুকু নিলাম, তার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।
বীরভূমের বাংলাও বাংলা, দিনাজপুরের বাংলাও বাংলা, চট্টগ্রামের বাংলাও বাংলা, সিলেট, ২৪ পরগনার দক্ষিণ ভাগ, কোচবিহারের বাংলাও বাংলা। একইভাবে 'চান' ও 'গোসল' বাংলা, 'জল' ও 'পানি' বাংলা। 'আব্বা' ও 'বাবা' এবং 'আম্মা' ও 'মা', 'আপা' বা 'দিদি' ব্যবহারিক ্ বাংলা। শুধু কলকাতা বা ঢাকার বাংলা হল আসল বাংলা, অন্যটা নয় --- এটা ভাবার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে, এই মৌলবাদ বাংলাভাষায় বিপদ বাড়াবে ও ভাষাকে সঙ্কুচিত করবে।
প্রায় দেড়শো বছরে বাংলা ভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যভাষা যে রং-রূপ-গতি আয়ত্ত করেছে তা শতমুখে বলবার মতো। কত নবীন লেখক বাংলা ভাষা ফুল ফোটাচ্ছেন। কবিতায়, কথাসাহিত্যে প্রবন্ধে, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলা ভাষা অসীমান্তিক বাঙালির মনে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখার বিষয় যে, ভাষা শুধু লেখক-কবি-গবেষকের চর্চার বিষয় নয়, সাহিত্যের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ না-থাকা মানুষটির কাছেও তার কিছু দাবি আছে।
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, 'বায়ান্ন থেকে বাঙালি তার অশ্রুকে অবিনশ্বর করতে শিখেছে: শিখেছে এক নতুন স্থাপত্যকলা, যাতে অশ্রু রূপান্তরিত হয় শহীদ মিনারে।' বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বা একষট্টির উনিশে মে শিলচরের বরাক উপত্যকায় ইতিহাস হয়ে আছে এইজন্য যে, সেদিন নিতান্ত সাধারণ মানুষেরা বাংলা ভাষার দাবিতে এগিয়ে এসেছিলেন। মানুষের ভাষাপ্রেম বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। আজকের বাঙালির দায়িত্ব বাংলা ভাষার সেই নিরাপত্তা, অর্জন ও আশ্রয়টুকু রক্ষা ও বিকশিত করা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম