বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে গতিশীল করবে



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে নাফ নদী। এই নদীপথ পাড়ি দিয়ে অত্যাচারিত, নির্যাতিত, বিতাড়িত ও প্রাণভয়ে জীবন বাজী রেখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ এই নদী পথেই চলতে পারে দুদেশের মধ্যকার ব্যবসা বাণিজ্য, দুদেশের নদী বন্দরে ভিড় করতে পারে পণ্যবাহী জাহাজ। নদীতে ভেসে বেড়াতে পারে পর্যটক ভরা নৌযান যেগুলোতে করে পর্যটকরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে পারে। বাংলাদেশের এই প্রতিবেশী দেশের সাথে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা একটা বাধা হিসেবে থাকলেও দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ চলমান রাখতে হবে।

বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। দুই দেশ ঐতিহাসিক ও সামাজিকভাবে একে অন্যের কাছাকাছি হলেও দুই দেশের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভাব রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বার্মা (বর্তমানের মিয়ানমার) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিক দিয়ে বার্মার স্থান প্রথমসারির দেশগুলোর মধ্যে। এর পরপরই ১৯৭২ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সফল কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট নে উইন বাংলাদেশ সফরে আসে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নে উইনের সাথে আন্তরিক ও ফলপ্রসূ সময় কাটান। একটা সফল ও উষ্ণ নৌ ভ্রমনের মধ্য দিয়ে বার্মা-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রিভার ক্রুজ ডিপ্লোমেসি নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বিদায় বেলায় যৌথ ইশতেহারে উভয় নেতা ‘বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্ত সব সময় শান্তি ও শুভেচ্ছার সীমান্ত হিসেবে বজায় থাকবে এবং তাতে দুই দেশের জনগণের চিরস্থায়ী মৈত্রীই প্রতিফলিত হবে’ বলে তাদের আশাবাদ ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নে কৌশলগত, কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, জনকূটনীতিসহ সমন্বিত বহুমুখী দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির উপর জোর দিতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নের মহাসড়কে স্থান করে নেয়া বাংলাদেশের পেছনে ফিরে না তাকিয়ে সামনের দিনগুলোতে প্রতিবেশী দেশ, আঞ্চলিক দেশ ও সংস্থাগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাণিজ্য, যোগাযোগ, কূটনীতি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতেই হবে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে আসিয়ান দেশগুলো ও চীনের মধ্যে যেমন যোগাযোগের বন্ধন স্থাপন করতে পারে তেমনি ভারতের সেভেন সিস্টারস এর সাথেও বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়াতে সাহায্য করবে। এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে একমাত্র বাধা মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এবং বহু বছর ধরে চলা জাতিগত সংঘর্ষ। এই সহিংসতা বন্ধ করতে পারলে মিয়ানমার উন্নয়নের পথে অনেক এগিয়ে যেতে পারবে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও দুদেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও যোগাযোগের উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ২০ টির মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক থাকলেওসেসবের তেমন কোন অগ্রগতি নেই যা দুর্ভাগ্যজনক।বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক যোগাযোগ মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, এবং চীনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য ২০০৭ সালে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে অগ্রগতি ধীর। পারস্পরিক সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য মিয়ানমারের সাথে সংযোগ উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং মিয়ানমারের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের জন্য চীন ও ভারত উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে।বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মিলে চকোরিয়া থেকে আলীকদম ও মদক হয়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কালেতোয়া পর্যন্ত একটা সড়ক নির্মিত হলে তা কিউকতাও-পালতোয়া সংযোগকারী সড়কের সাথে যুক্ত হবে। কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের এই সড়কটি ভারতের মিজোরামকে চীন এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেছে। সড়কটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সহজ হবে। এতে বাংলাদেশ ও চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় কমবে এবং রাস্তা নির্মাণের ফলে এই এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হবে।

এশিয়ান হাইওয়ে চালু হলে তা দুই দেশের মধ্যে স্থল সংযোগ উন্নত করবে ওএই পথে সার, প্লাস্টিক, সিমেন্ট, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য প্রসারে ভুমিকা রাখবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দোহাজারী- কক্সবাজাররেললাইন খুব শীঘ্রই চালু হবে। এই রেললাইন নেপাল, ভুটান এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে সম্প্রসারন করে আন্তঃ দেশীয় যোগাযোগ উন্নত করা সম্ভব। প্রস্তাবিত ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে যদি এই রুটটি চীন থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের গুন্দুম হয়ে তিন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারে এতে পুরো অঞ্চল লাভবান হবে।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সংযোগে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়,উন্নত বাণিজ্য যোগাযোগের মাধ্যমে দুই দেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিমসটেক) সদস্য।বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়াতে পারলে চীন ও ভারতের ওপর তাদের নির্ভরতা কমে যাবে এবং ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা,থাইল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।বাংলাদেশ আসিয়ান এবং সার্কের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে আসিয়ান সদস্য হিসেবে মিয়ানমার বাংলাদেশের মাধ্যমে সার্ক মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চলে বাণিজ্য বাড়াতে পারবে।বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে বিশেষভুমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশকে ট্রানজিটহিসেবে ব্যবহার করে মিয়ানমার ভুটান, নেপাল এবং ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে। রাখাইনের কৃষিপণ্যের একটি টেকসই বাজার প্রয়োজন এবং বাংলাদেশ একটা আদর্শ বাজার হতে পারে।

বাংলাদেশের পোশাক ও কৃষি শিল্পে অভিজ্ঞতারয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে মিয়ানমার উপকৃত হতে পারে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিয়মিত বিরতিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা রেঙ্গুনে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করতে পারে। মিয়ানমার উন্নত উৎপাদন সুবিধা সম্পন্ন প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বাংলাদেশ থেকে ইলেকট্রনিক্স ও ফার্মাসিউটিক্যালস আমদানির মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগ কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতেও কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় ভূমিকা রাখছে এবং বাংলাদেশেরঔষধ শিল্প রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে গৌরব অর্জন করেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৪০টি দেশে এই ঔষধ রপ্তানি হয়েছে এবং সবচেয়ে বেশী রপ্তানি হয়েছে মিয়ানমারে। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ২.৭৬মিলিয়ন ডলারের ওষুধ রপ্তানি হয়েছে যা মোট ওষুধ রপ্তানির প্রায় ১৫শতাংশ। রোহিঙ্গা ইস্যু ও জান্তা সরকারের অধীনে সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চলা স্বত্বেও মিয়ানমারে ঔষধ রপ্তানি বেড়েছে। মিয়ানমারের ঔষধের মোট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ মাত্র বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির মাধ্যমে পূরণ হয়েছে, মিয়ানমারের ঔষধ খাতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার জন্য অন্যান্য সম্ভবনাময় ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মিয়ানমারে কাঠ টিন, দস্তা, তামা, টংস্টেন, কয়লা, মার্বেল, চুনাপাথর, প্রাকৃতিক গ্যাস, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদির প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে।বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে জ্বালানি সহযোগিতা পেতে পারে এবং প্রয়োজনীয় খনিজদ্রব্য আমদানি করতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর চুনাপাথর ও বাঁশ রয়েছে, বাংলাদেশ মিয়ানমারে সিমেন্ট কারখানা ও কাগজের মিল স্থাপন করতে পারে। মিয়ানমারও বিশ্বের প্রাকৃতিক কাঠের প্রধান সরবরাহকারী। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার যৌথ ভাবে মাছ, কাঠ প্রক্রিয়াকরণ, ক্লিংকার শিল্প, গ্যাস ও খনিজ আহরণ, বস্ত্র এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে।মিয়ানমার কৃষিপণ্যেরও বড় উৎপাদক। ২০১৯ সালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের পেঁয়াজ সংকটের সময়, মিয়ানমার বাংলাদেশকে পেঁয়াজ সরবরাহ করেছিল। বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন হলেএসবক্ষেত্রেপরনির্ভরশীলতা কমেযাবে।মিয়ানমার বাংলাদেশে বৈধ ভাবে গবাদি পশু পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে এবং এতে উভয় দেশ উপকৃত হবে।বাংলাদেশে মিয়ানমারের পণ্য বার্মিজ পণ্য হিসেবে পরিচিত, এদেশে এই পণ্যের ক্রেতা আছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উচিত সীমান্ত হাট প্রতিষ্ঠা করলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে ও বাণিজ্য সম্প্রসারন হবে।

বাংলাদেশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় বৌদ্ধ মন্দির, বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র, তীর্থস্থান, বৌদ্ধ ধর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনএবং ঐতিহাসিক স্থানআছে।বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সাথে মিলে একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় এসব নিদর্শন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছে। বান্দরবান জেলার স্বর্ণ মন্দিরবাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বৌদ্ধের উপস্থিতির চিহ্ন বৌদ্ধ উপাসক এবং পর্যটকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। বাংলাদেশী বৌদ্ধদের জন্য মিয়ানমারে ধর্মীয় পর্যটন এবং মিয়ানমারের জনগণের জন্য বান্দরবনের স্বর্ণমন্দির, ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, রামু ইত্যাদি পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পর্যটন খাতে ও উন্নয়নের ব্যপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সৈকত দেশী ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করা যায়। এক দেশে বেড়াতে এসে তারা দুদেশের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে।পর্যটনের উন্নয়নে দুই দেশ নিজেদের মধ্যে কার্যকর চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে।

দুই দেশের জনগণের মধ্যেকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ছাত্র বিনিময়, শিক্ষা বৃত্তি,ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা গেলে বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্কক্রমান্নয়ে উষ্ণ ও আন্তরিক হবে।মিয়ানমার ও রাখাইনের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের মধ্যে যোগাযোগ দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কএবংবিশ্বাসের ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাবিদ, ছাত্র, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মধ্যে সম্পৃক্ততা জোরদার হলে উভয় দেশ নানাভাবে উপকৃত হবে।

বাংলাদেশমিয়ানমারের মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারে এবং একই সাথে ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নে একসাথে কাজ করতে পারে।রাখাইন অঞ্চল উন্নত হলে বাংলাদেশও উপকৃত হবে এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এন জি ও’গুলো মিয়ানমারে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষন দেয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারের মানবসম্পদ উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে।বাংলাদেশের দুর্যোগ ও ত্রান কার্যক্রমে বহু বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় মিয়ানমার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।আন্তঃসীমান্ত এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার,অস্ত্র ও মাদক পাচার সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন দৃঢ় করতে পারে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে জলদস্যু নিয়ন্ত্রন, মাদক ও মানব পাচার, সন্ত্রাসবাদ এবং পরিবেশ নিরাপত্তার নিশ্চিতের মত অপ্রচলিত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করতে পারে।

মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি, দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি তিনি চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানায়।মিয়ানমারের স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের জনগণ মিয়ানমারের জনগণকে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে এবং তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অনেক উত্থান-পতন থাকলে ও পারস্পরিক সুবিধার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করার জন্য উভয় দেশেরই মনোযোগী হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ মিয়ানমার উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং জনগনের মধ্যে যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটিয়ে উভয় দেশ উপকৃত হতে পারে। বহু বছর ধরে উভয় দেশের মধ্য এ ধরনের নিবিড় যোগাযোগ বিভিন্ন কারনে স্থাপিত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান রোহিঙ্গা সংকটে মধ্যেও এই যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসলে এ ধরনের উদ্যোগ এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এটাই প্রত্যাশা।

   

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;