বেঙ্গল রেজিমেন্টের গৌরবদীপ্ত ৭৫ বছর



মেজর নাসির উদ্দিন আহমেদ (অব:) পিএইচডি
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদেশের ঐশ্বর্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে গানের বাণীতে লিখেছেন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি ------ এই দেশেরই ধুলায় পড়ি - মানিক যায়রে গড়াগড়ি, বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙালো এই দেশেরই জীয়ন কাঠি’। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই এই গানের প্রতিফলন ঘটেছিল বর্তমান বাংলাদেশ ও সংলগ্ন এলাকায়। ফুল, ফসল, মাছ কিংবা পশু সম্পদে ভরপুর ছিল এই অঞ্চল, যেখানে সুখী মানুষেরা শিক্ষা সংস্কৃতিতেও এগিয়ে ছিল। বহু মূল্যবান ধন-সম্পদ এদেশের ধুলা মাটিতে গড়াগড়ি খেত, যা বিশ্ববাসীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আর এই সম্পদের লোভেই বারবার এই দেশে বহি:শত্রুরা আক্রমণ চালায় ও দখলদারিত্ব বজায় রাখে। নিজ সম্পদ রক্ষা কিংবা শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে গিয়েই এ দেশের শান্তি প্রিয় মানুষেরা নিজের অলক্ষে যেন অস্ত্র হাতে যোদ্ধা হয়ে ওঠে। এই যোদ্ধারাই একে একে লাঠিয়াল, বর্গী , মোঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিবাহিনীসহ বহু অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের সামর্থের প্রমাণ দিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি, রণকৌশল, পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত কারণে তারা মোগল, ব্রিটিশ, জাপানি বা পাকিস্তানিদের সাথে মিলে অস্ত্র ধরেছে তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে।

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও ব্রিটিশ ভারত তথা গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এই যুদ্ধে যোগ দেয় ৪ আগস্ট তারিখে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) জমিদার, রাজা ও মহারাজারা ১৪ই আগস্ট ১৯১৪ তারিখে কলকাতায় এক সভায় মিলিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা অর্থ, লোকবল ও যুদ্ধক্ষেত্রে একটি চিকিৎসা দল পাঠিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের পাশে থাকবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৬ মাসের মধ্যেই শতাধিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সহকারী ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর’ পরিচয়ে দেশের গন্ডি ছেড়ে তাবু ফেলে ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন মরু অঞ্চলে। সেখানে তারা সাফল্যের সাথেই গড়ে তোলে বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতাল। আর এভাবেই সে যুগের বাঙালি যোদ্ধাদের নতুন যুদ্ধ যুগে প্রবেশ ঘটে। পরবর্তীতে নানাভাবে ভারতীয় যোদ্ধারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয়। একাধিক সূত্র মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৫ লক্ষ ভারতীয় পুরুষ অংশ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে কয়েক হাজার ছিল শ্রমিক পর্যায়ে।তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের মাঠে যায় এবং সৈন্য ও তাদের ব্যাবহৃত পশুদের জন্য খাবার, জল এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে। তাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল হাসপাতাল, ব্যারাক, বন্দর, রাস্তা, রেলপথ এবং রানওয়ে। এই ভারতীয়দের একটা বড় অংশ ছিল এই অঞ্চলের বাঙালি, যাদের অনেকেই আর ঘরে ফিরেনি।

১৯১৮ সালের শেষ ভাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামার পাঁচ বছরের মধ্যে মূলত যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ-ভারতের সৈন্যদের নিয়ে ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে দুইটি লাইট ক্যাভালরি , দুইটি পাঞ্জাব ও একটি করে মারাঠা, রাজপুত, হায়দারাবাদ ও মাদ্রাস রেজিমেন্ট বা প্রতি দলে প্রায় ৮০০ সেনা নিয়ে ৮টি সেনাদল গড়ে ওঠে। কিন্তু বাঙ্গালীদের নিয়ে নিজস্ব কোন রেজিমেন্ট জন্ম না হওয়ায় এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয় বাঙালি সৈনিকদের প্রাপ্য সম্মান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ২১ বছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞদের পাশাপাশি তরুণ বাঙালিরা সাহসিকতার সাথে সম্মুখ সমরে এবং নানাভাবে নেপথ্যে থেকে অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতীয় কমান্ড বা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রনে থাকা একটি বিহার রেজিমেন্ট মূলত বাঙালিদের নিয়ে গড়া ১২৫৬ ও ১৪০৭ নাম্বার পাইওনিয়ার কোম্পানি (প্রতিটি কোম্পানিতে প্রায় ২০০ জন সৈন্য) প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। আরেক দোল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাপানিদের পক্ষে যোগ দেয় এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। ১৯৪৭ সালের ২সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ আর্মির তৎকালীন বাঙালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুল গনি এই

১২৫৬ ও ১৪০৭ নাম্বার পাইওনিয়ার কোম্পানির সেনাদের নিয়ে পৃথক বাঙালি ইউনিট বা রেজিমেন্ট করার জন্য ২০ পৃষ্ঠার লিখিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। উল্লেখ্য, ততদিনে ভারতের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রেজিমেন্ট বা সেনাদল গড়ে উঠেছিল, যেমন বেলুচ রেজিমেন্ট। মেজর গণির তৎপরতায় মোম্বাই থেকে এই দুটি কোম্পানিকে ১৯৪৭ সালে বিশেষ ট্রেন যোগে ঢাকায় আনা হয় এবং তারই নেতৃত্বে বর্তমান ঢাকা সিএমএইচ এর উত্তরে তাঁবু খাটিয়ে রাখা হয়। এরই মাঝে নানা চড়াই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ই আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত হয় ও স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ অংশ এরফলে পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের সম্মতি আদায়ে যুগপৎ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান মেজর গনি। তিনি ও তার সহযোগীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সদর দপ্তর থেকে বাঙালি সেনাদের নিয়ে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট গঠনের আদেশ জারি হয়, যার নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। অন্যদিকে ব্রিটিশরা ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ে উভয় দেশকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই পেটারসান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম অধিনায়ক নিযুক্ত হন।

পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ক্যাপ্টেন গণিকে ভালোভাবে চিনতেন এবং তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ফলে তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে নারায়ণগঞ্জে রিক্রুটিং অফিসার হিসাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন এবং নবগঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য বাঙালি যুবকদের সৈনিক পদে ভর্তি করার দায়িত্ব প্রদান করেন। মেজর গনি তখন সমগ্র দেশ ঘুরে ঘুরে লম্বা-সুস্বাস্থ্যবান যুবকদের বেছে বেছে সৈনিক পদে ভর্তি করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। এসব নবীন সৈনিকদের পরে ঢাকার কুর্মিটোলায় কঠোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে দাপ্তরিকভাবে ক্যাপ্টেন গণি ও ক্যাপ্টেন এস ইউ খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে এ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব পান মেজর মুহাম্মদ তোহাম্মল হোসেন। সৈনিকদের উপদল (কোম্পানি) অধিনায়ক করা হয় মেজর এ ডব্লিউ চৌধুরী ও মেজর সাজাউয়াল খানকে। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাকার কুর্মিটোলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন কতৃক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন বা প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা ‘সিনিয়র টাইগারস’ নামে আজ ইতিহাসের অংশ ও বিশ্বনন্দিত। সামরিক কায়দায় জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নবাব হাবিবউল্যাহ, হাসান আলী, নূরুল আমীন, হাবিবুল্লাহ বাহার, আবদুল হামিদ খান, আফজাল খান, সামরিক বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।

পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান ও কুচকাওয়াজ শেষে সামরিক ঐতিহ্য অনুসারে আমন্ত্রিত অতিথিরা চা-চক্রেমিলিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান এসময় কথা প্রসঙ্গে বলেন যে, নতুন এই রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাংলা নয় , উর্দুতে কথা বলবে। চা চক্রে যোগ দেয়া বাঙালি অফিসারগণ বিশেষত: মেজর মুহাম্মদ তোহাম্মল হোসেন আইয়ুব খানের এই বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন এবং যুক্তি দিয়ে বলেন অন্যান্য রেজিমেন্টের সৈন্যরা নিজ নিজ ভাষায় (যেমন: পোসতু, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি) কথা বলতে পারলে বাঙালি সৈন্যরাও তা পারবে । ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানকে জানিয়ে দেন যে বাঙালি সৈন্যরা কখনো উর্দুতে কথা বলবে না। এই চা চক্রের কিছুদিন পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইউনিট ও ব্যারাকে উর্দুতে কথা বলার নির্দেশ জারি হলে মেজর এম টি হোসেন ও ক্যাপ্টেন গণি তা অমান্য করেন । এজন্য তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। তবুও পৃথক স্বত্বা নিয়ে বাঙালিদের আরো রেজিমেন্ট গড়ে তোলা এবং বাংলায় কথা বলার দাবিতে অনড় থাকেন ‘টাইগার গনি’ খেতাব প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গনি ও তার সাহসী সহচরবৃন্দ।

১৯৪৭ সালের আগস্টে পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও উভয় দেশের মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তসহ নানা বিষয়ে শত্রুতা লেগেই ছিল। বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত সংঘর্ষের বাইরে ১৯৬৫ সালে উভয় দেশের মধ্যে বড় ধরণের যুদ্ধ হয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে জম্মু - কাশ্মীর সীমান্তে একমাসের ছোট-খাটো যুদ্ধের পর পাকিস্তানের সৈন্যরা ভারতের দিকে বড় অভিযান শুরু করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ভারতীয় সৈন্যরা লাহোর দখলের জন্য অগ্রসর হয়, যার জন্য পাকিস্তানিরা প্রস্তুত ছিল না। এসময় লাহোর শহর রক্ষার জন্য দ্রুত মোতায়েন করা হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। মূলত বাঙালিদের নিয়ে গড়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাম্বাওয়ালি-রাভি-বেদিয়ান (বিআরবি) খালের ধারে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে ও প্রাণপণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় তাঁরা ভারতীয়দের একাধিক আক্রমণ রুখে দেয় এবং কাশ্মীর ও অন্যান্য রণক্ষেত্র থেকে থেকে পাকিস্তানিদের অতিরিক্ত সৈন্য না আসা পর্যন্ত লাহোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার এবং সদস্যদের সতর্কতা, সময়োচিত পাল্টা জবাব এবং বুনো সাহসিকতার ফলে ১৯৬৫ সালে লাহোর রক্ষা পেয়েছিল মর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই যুদ্ধে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের জন্য সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল সেনাদল, উপদল বা রেজিমেন্টের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্ব সূচক পদক লাভ করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা ‘সিনিয়র টাইগার্স’;। যুদ্ধে ভারতীয়দের কাছ থেকে দখল করা একটি ট্যাংক আজও চট্রগ্রাম সেনানিবাসে স্মৃতি হিসাবে সংরক্ষিত আছে।

কালের পরিক্রমায় ঘনিয়ে আসে একাত্তর। ততদিনে একথা আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ব্রিটিশ বেনিয়া আর পাকিস্তানী শাসকরা মূলত একই মুদ্রার দুই পিঠ। বাঙালিদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ধারাবাহিকতায় শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মোট ৮টি ইউনিট (প্রথম থেকে অষ্টম বেঙ্গল) গড়ে উঠেছিল। এরমধ্যে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম বেঙ্গল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আর অবশিষ্ট ৫টি ব্যাটেলিয়ানের বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই গুলি চালিয়ে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষায় জানান দেয় যে, আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও অষ্টম বেঙ্গল যথাক্রমে যশোর, জয়দেবপুর, রংপুর - সৈয়দপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরুতেই প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও ছোট ছোট অভিযানের মধ্য দিয়ে শত্রুর মাঝে বিভীষিকা তৈরি করে। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এই ৫টি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, পুনর্গঠন, নতুন সৈন্য সংগ্রহ এবং অফিসারদের সমন্বিত নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে নিজেদের নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত করে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং মিত্রবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে ঢাকার দিকে যাত্রা করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ভারতে গঠিত হয় নবম, দশম ও এগারোতম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে যশোরে জন্ম নেয় বারতম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যার সদস্যরা সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের উপর দিয়ে বাংলাদেশের যশোহর পর্যন্ত পৌঁছে। পারস্পরিক সমন্বয়, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং সুনির্দিষ্ট সীমারেখা বা অক্ষরেখা মেনে আগের ৫টি এবং নতুন ৩টি ব্যাটেলিয়ান শত্রুর কামানের গোলা, বিমান আক্রমণ, মাইন্ড ফিল্ড অতিক্রম এবং মেশিন গানের তপ্ত গুলিকে উপেক্ষা করে বীর দর্পে এগুতে থাকে। তাদের এই অগ্রযাত্রা ছিল বীরত্ব, সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের এক গৌরব দীপ্ত অধ্যায় এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রার আশীর্বাদ স্বরূপ। অফিসারদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ লে: আনোয়ার এবং শেষ প্রহরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ লে: সেলিম শাহাদাত বরণ করেন। ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে সেনা সদস্য ছিলেন ৪জন, যাদের ৩জনই বেঙ্গল রেজিমেন্টের গর্বিত সদস্য। ৩জন ফোর্স কমান্ডারও (শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ) ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের গর্বিত সেনা অফিসার। বীর উত্তম, বীর বিক্রম, কিংবা বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের অধিকাংশ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসাবেই যুদ্ধে সাহস ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের বড় পুত্র শেখ কামাল দাপ্তরিকভাবে প্রথম বেঙ্গল এবং দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল কার্যকর ভাবে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

ছোট পুত্র শেখ রাসেলও প্রায়ই বলতো বড় হলে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টই হবে তাঁর কর্মক্ষেত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান রোধ, খাদ্য সংকট নিয়ন্ত্রণ, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন এবং আইন - শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা আজও অব্যাহত আছে।

আশির দশকে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় মাথা চাড়া দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এসময় নানাদাবিতে অস্ত্র তুলে নেয় একদল উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। দুর্গম পাহাড়ী এলাকা থেকে পরিচালিত তাদের গেরিলা আক্রমণের মুখে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সেখানে প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যান্ত্রিক বহরের বদলে নিজ পায়ে চলে আপন শক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় শত্রুর নিকটবর্তী হওয়া ও শত্রুকে ধ্বংস করার মন্ত্রে দীক্ষিত অর্ধ শতাধিক বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাজার হাজার সেনা সদস্য তখন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি অপেরেশনে বছরের পর বছর পাহাড়ে- পর্বতে ও বনে - জঙ্গলে ক্যাম্পে অবস্থান করে এবং মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। পার্বত্য চট্রগ্রামে অস্ত্র সমর্পন, শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, বাস্তবায়ন ও দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া উপজাতি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে পুনর্বাসনের গুরু দায়িত্ব বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈন্য আহত ও নিহত হয় ও পঙ্গুত্ব বরণ করে। মরণঘাতী ম্যালেরিয়ার কারণে অন্ধত্বসহ নানা জটিলতায় আজ ভুগে সেদিনের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা।

১৯৯০ - ৯১ সালে দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে পবিত্র মক্কা-মদিনা রক্ষা ও অধিকৃত কুয়েত পুনরুদ্ধারে আমেরিকাসহ বহুজাতীয় বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে লড়াই করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা। ১৯৯২ সাল থেকে টানা ২ বছর দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল যুদ্ধ বিধস্ত কুয়েত পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখে। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল থেকে পরবর্তী প্রতিটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট একাধিকবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ও গণতন্ত্র চর্চার নির্বাচনে জনগণ ও সরকারের আস্থার নাম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭৫তম প্রিতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে এই বাহিনীতে যোগ দেয়া ও ইতোমধ্যে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া সবার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। সুস্বাস্থ কামনা করি অবসর নেয়া সেনাদের। এযুগের অফিসার ও অন্যান্য ইস্ট বেঙ্গল সেনা, যাদের হাতে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজ এই রেজিমেন্টের রক্তস্নাত ও গর্বের পতাকা, তাদের জন্য রইলো শুভ কামনা।

লেখক: ; প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন অফিসার ও বর্তমান কলম যোদ্ধা
email: [email protected]

   

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;