বেঙ্গল রেজিমেন্টের গৌরবদীপ্ত ৭৫ বছর
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদেশের ঐশ্বর্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে গানের বাণীতে লিখেছেন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি ------ এই দেশেরই ধুলায় পড়ি - মানিক যায়রে গড়াগড়ি, বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙালো এই দেশেরই জীয়ন কাঠি’। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই এই গানের প্রতিফলন ঘটেছিল বর্তমান বাংলাদেশ ও সংলগ্ন এলাকায়। ফুল, ফসল, মাছ কিংবা পশু সম্পদে ভরপুর ছিল এই অঞ্চল, যেখানে সুখী মানুষেরা শিক্ষা সংস্কৃতিতেও এগিয়ে ছিল। বহু মূল্যবান ধন-সম্পদ এদেশের ধুলা মাটিতে গড়াগড়ি খেত, যা বিশ্ববাসীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আর এই সম্পদের লোভেই বারবার এই দেশে বহি:শত্রুরা আক্রমণ চালায় ও দখলদারিত্ব বজায় রাখে। নিজ সম্পদ রক্ষা কিংবা শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে গিয়েই এ দেশের শান্তি প্রিয় মানুষেরা নিজের অলক্ষে যেন অস্ত্র হাতে যোদ্ধা হয়ে ওঠে। এই যোদ্ধারাই একে একে লাঠিয়াল, বর্গী , মোঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিবাহিনীসহ বহু অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের সামর্থের প্রমাণ দিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি, রণকৌশল, পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত কারণে তারা মোগল, ব্রিটিশ, জাপানি বা পাকিস্তানিদের সাথে মিলে অস্ত্র ধরেছে তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও ব্রিটিশ ভারত তথা গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এই যুদ্ধে যোগ দেয় ৪ আগস্ট তারিখে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) জমিদার, রাজা ও মহারাজারা ১৪ই আগস্ট ১৯১৪ তারিখে কলকাতায় এক সভায় মিলিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা অর্থ, লোকবল ও যুদ্ধক্ষেত্রে একটি চিকিৎসা দল পাঠিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের পাশে থাকবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৬ মাসের মধ্যেই শতাধিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সহকারী ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর’ পরিচয়ে দেশের গন্ডি ছেড়ে তাবু ফেলে ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন মরু অঞ্চলে। সেখানে তারা সাফল্যের সাথেই গড়ে তোলে বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতাল। আর এভাবেই সে যুগের বাঙালি যোদ্ধাদের নতুন যুদ্ধ যুগে প্রবেশ ঘটে। পরবর্তীতে নানাভাবে ভারতীয় যোদ্ধারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয়। একাধিক সূত্র মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৫ লক্ষ ভারতীয় পুরুষ অংশ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে কয়েক হাজার ছিল শ্রমিক পর্যায়ে।তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের মাঠে যায় এবং সৈন্য ও তাদের ব্যাবহৃত পশুদের জন্য খাবার, জল এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে। তাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল হাসপাতাল, ব্যারাক, বন্দর, রাস্তা, রেলপথ এবং রানওয়ে। এই ভারতীয়দের একটা বড় অংশ ছিল এই অঞ্চলের বাঙালি, যাদের অনেকেই আর ঘরে ফিরেনি।
১৯১৮ সালের শেষ ভাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামার পাঁচ বছরের মধ্যে মূলত যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ-ভারতের সৈন্যদের নিয়ে ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে দুইটি লাইট ক্যাভালরি , দুইটি পাঞ্জাব ও একটি করে মারাঠা, রাজপুত, হায়দারাবাদ ও মাদ্রাস রেজিমেন্ট বা প্রতি দলে প্রায় ৮০০ সেনা নিয়ে ৮টি সেনাদল গড়ে ওঠে। কিন্তু বাঙ্গালীদের নিয়ে নিজস্ব কোন রেজিমেন্ট জন্ম না হওয়ায় এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয় বাঙালি সৈনিকদের প্রাপ্য সম্মান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ২১ বছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞদের পাশাপাশি তরুণ বাঙালিরা সাহসিকতার সাথে সম্মুখ সমরে এবং নানাভাবে নেপথ্যে থেকে অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতীয় কমান্ড বা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রনে থাকা একটি বিহার রেজিমেন্ট মূলত বাঙালিদের নিয়ে গড়া ১২৫৬ ও ১৪০৭ নাম্বার পাইওনিয়ার কোম্পানি (প্রতিটি কোম্পানিতে প্রায় ২০০ জন সৈন্য) প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। আরেক দোল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাপানিদের পক্ষে যোগ দেয় এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। ১৯৪৭ সালের ২সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ আর্মির তৎকালীন বাঙালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুল গনি এই
১২৫৬ ও ১৪০৭ নাম্বার পাইওনিয়ার কোম্পানির সেনাদের নিয়ে পৃথক বাঙালি ইউনিট বা রেজিমেন্ট করার জন্য ২০ পৃষ্ঠার লিখিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। উল্লেখ্য, ততদিনে ভারতের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রেজিমেন্ট বা সেনাদল গড়ে উঠেছিল, যেমন বেলুচ রেজিমেন্ট। মেজর গণির তৎপরতায় মোম্বাই থেকে এই দুটি কোম্পানিকে ১৯৪৭ সালে বিশেষ ট্রেন যোগে ঢাকায় আনা হয় এবং তারই নেতৃত্বে বর্তমান ঢাকা সিএমএইচ এর উত্তরে তাঁবু খাটিয়ে রাখা হয়। এরই মাঝে নানা চড়াই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ই আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত হয় ও স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ অংশ এরফলে পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের সম্মতি আদায়ে যুগপৎ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান মেজর গনি। তিনি ও তার সহযোগীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সদর দপ্তর থেকে বাঙালি সেনাদের নিয়ে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট গঠনের আদেশ জারি হয়, যার নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। অন্যদিকে ব্রিটিশরা ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ে উভয় দেশকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই পেটারসান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ক্যাপ্টেন গণিকে ভালোভাবে চিনতেন এবং তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ফলে তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে নারায়ণগঞ্জে রিক্রুটিং অফিসার হিসাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন এবং নবগঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য বাঙালি যুবকদের সৈনিক পদে ভর্তি করার দায়িত্ব প্রদান করেন। মেজর গনি তখন সমগ্র দেশ ঘুরে ঘুরে লম্বা-সুস্বাস্থ্যবান যুবকদের বেছে বেছে সৈনিক পদে ভর্তি করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। এসব নবীন সৈনিকদের পরে ঢাকার কুর্মিটোলায় কঠোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে দাপ্তরিকভাবে ক্যাপ্টেন গণি ও ক্যাপ্টেন এস ইউ খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে এ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব পান মেজর মুহাম্মদ তোহাম্মল হোসেন। সৈনিকদের উপদল (কোম্পানি) অধিনায়ক করা হয় মেজর এ ডব্লিউ চৌধুরী ও মেজর সাজাউয়াল খানকে। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাকার কুর্মিটোলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন কতৃক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন বা প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা ‘সিনিয়র টাইগারস’ নামে আজ ইতিহাসের অংশ ও বিশ্বনন্দিত। সামরিক কায়দায় জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নবাব হাবিবউল্যাহ, হাসান আলী, নূরুল আমীন, হাবিবুল্লাহ বাহার, আবদুল হামিদ খান, আফজাল খান, সামরিক বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।
পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান ও কুচকাওয়াজ শেষে সামরিক ঐতিহ্য অনুসারে আমন্ত্রিত অতিথিরা চা-চক্রেমিলিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান এসময় কথা প্রসঙ্গে বলেন যে, নতুন এই রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাংলা নয় , উর্দুতে কথা বলবে। চা চক্রে যোগ দেয়া বাঙালি অফিসারগণ বিশেষত: মেজর মুহাম্মদ তোহাম্মল হোসেন আইয়ুব খানের এই বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন এবং যুক্তি দিয়ে বলেন অন্যান্য রেজিমেন্টের সৈন্যরা নিজ নিজ ভাষায় (যেমন: পোসতু, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি) কথা বলতে পারলে বাঙালি সৈন্যরাও তা পারবে । ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানকে জানিয়ে দেন যে বাঙালি সৈন্যরা কখনো উর্দুতে কথা বলবে না। এই চা চক্রের কিছুদিন পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইউনিট ও ব্যারাকে উর্দুতে কথা বলার নির্দেশ জারি হলে মেজর এম টি হোসেন ও ক্যাপ্টেন গণি তা অমান্য করেন । এজন্য তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। তবুও পৃথক স্বত্বা নিয়ে বাঙালিদের আরো রেজিমেন্ট গড়ে তোলা এবং বাংলায় কথা বলার দাবিতে অনড় থাকেন ‘টাইগার গনি’ খেতাব প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গনি ও তার সাহসী সহচরবৃন্দ।
১৯৪৭ সালের আগস্টে পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও উভয় দেশের মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তসহ নানা বিষয়ে শত্রুতা লেগেই ছিল। বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত সংঘর্ষের বাইরে ১৯৬৫ সালে উভয় দেশের মধ্যে বড় ধরণের যুদ্ধ হয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে জম্মু - কাশ্মীর সীমান্তে একমাসের ছোট-খাটো যুদ্ধের পর পাকিস্তানের সৈন্যরা ভারতের দিকে বড় অভিযান শুরু করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ভারতীয় সৈন্যরা লাহোর দখলের জন্য অগ্রসর হয়, যার জন্য পাকিস্তানিরা প্রস্তুত ছিল না। এসময় লাহোর শহর রক্ষার জন্য দ্রুত মোতায়েন করা হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। মূলত বাঙালিদের নিয়ে গড়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাম্বাওয়ালি-রাভি-বেদিয়ান (বিআরবি) খালের ধারে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে ও প্রাণপণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় তাঁরা ভারতীয়দের একাধিক আক্রমণ রুখে দেয় এবং কাশ্মীর ও অন্যান্য রণক্ষেত্র থেকে থেকে পাকিস্তানিদের অতিরিক্ত সৈন্য না আসা পর্যন্ত লাহোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার এবং সদস্যদের সতর্কতা, সময়োচিত পাল্টা জবাব এবং বুনো সাহসিকতার ফলে ১৯৬৫ সালে লাহোর রক্ষা পেয়েছিল মর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই যুদ্ধে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের জন্য সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল সেনাদল, উপদল বা রেজিমেন্টের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্ব সূচক পদক লাভ করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা ‘সিনিয়র টাইগার্স’;। যুদ্ধে ভারতীয়দের কাছ থেকে দখল করা একটি ট্যাংক আজও চট্রগ্রাম সেনানিবাসে স্মৃতি হিসাবে সংরক্ষিত আছে।
কালের পরিক্রমায় ঘনিয়ে আসে একাত্তর। ততদিনে একথা আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ব্রিটিশ বেনিয়া আর পাকিস্তানী শাসকরা মূলত একই মুদ্রার দুই পিঠ। বাঙালিদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ধারাবাহিকতায় শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মোট ৮টি ইউনিট (প্রথম থেকে অষ্টম বেঙ্গল) গড়ে উঠেছিল। এরমধ্যে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম বেঙ্গল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আর অবশিষ্ট ৫টি ব্যাটেলিয়ানের বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই গুলি চালিয়ে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষায় জানান দেয় যে, আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও অষ্টম বেঙ্গল যথাক্রমে যশোর, জয়দেবপুর, রংপুর - সৈয়দপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরুতেই প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও ছোট ছোট অভিযানের মধ্য দিয়ে শত্রুর মাঝে বিভীষিকা তৈরি করে। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এই ৫টি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, পুনর্গঠন, নতুন সৈন্য সংগ্রহ এবং অফিসারদের সমন্বিত নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে নিজেদের নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত করে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং মিত্রবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে ঢাকার দিকে যাত্রা করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ভারতে গঠিত হয় নবম, দশম ও এগারোতম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে যশোরে জন্ম নেয় বারতম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যার সদস্যরা সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের উপর দিয়ে বাংলাদেশের যশোহর পর্যন্ত পৌঁছে। পারস্পরিক সমন্বয়, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং সুনির্দিষ্ট সীমারেখা বা অক্ষরেখা মেনে আগের ৫টি এবং নতুন ৩টি ব্যাটেলিয়ান শত্রুর কামানের গোলা, বিমান আক্রমণ, মাইন্ড ফিল্ড অতিক্রম এবং মেশিন গানের তপ্ত গুলিকে উপেক্ষা করে বীর দর্পে এগুতে থাকে। তাদের এই অগ্রযাত্রা ছিল বীরত্ব, সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের এক গৌরব দীপ্ত অধ্যায় এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রার আশীর্বাদ স্বরূপ। অফিসারদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ লে: আনোয়ার এবং শেষ প্রহরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ লে: সেলিম শাহাদাত বরণ করেন। ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে সেনা সদস্য ছিলেন ৪জন, যাদের ৩জনই বেঙ্গল রেজিমেন্টের গর্বিত সদস্য। ৩জন ফোর্স কমান্ডারও (শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ) ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের গর্বিত সেনা অফিসার। বীর উত্তম, বীর বিক্রম, কিংবা বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের অধিকাংশ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসাবেই যুদ্ধে সাহস ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের বড় পুত্র শেখ কামাল দাপ্তরিকভাবে প্রথম বেঙ্গল এবং দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল কার্যকর ভাবে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
ছোট পুত্র শেখ রাসেলও প্রায়ই বলতো বড় হলে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টই হবে তাঁর কর্মক্ষেত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান রোধ, খাদ্য সংকট নিয়ন্ত্রণ, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন এবং আইন - শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা আজও অব্যাহত আছে।
আশির দশকে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় মাথা চাড়া দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এসময় নানাদাবিতে অস্ত্র তুলে নেয় একদল উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। দুর্গম পাহাড়ী এলাকা থেকে পরিচালিত তাদের গেরিলা আক্রমণের মুখে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সেখানে প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যান্ত্রিক বহরের বদলে নিজ পায়ে চলে আপন শক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় শত্রুর নিকটবর্তী হওয়া ও শত্রুকে ধ্বংস করার মন্ত্রে দীক্ষিত অর্ধ শতাধিক বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাজার হাজার সেনা সদস্য তখন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি অপেরেশনে বছরের পর বছর পাহাড়ে- পর্বতে ও বনে - জঙ্গলে ক্যাম্পে অবস্থান করে এবং মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। পার্বত্য চট্রগ্রামে অস্ত্র সমর্পন, শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, বাস্তবায়ন ও দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া উপজাতি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে পুনর্বাসনের গুরু দায়িত্ব বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈন্য আহত ও নিহত হয় ও পঙ্গুত্ব বরণ করে। মরণঘাতী ম্যালেরিয়ার কারণে অন্ধত্বসহ নানা জটিলতায় আজ ভুগে সেদিনের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা।
১৯৯০ - ৯১ সালে দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে পবিত্র মক্কা-মদিনা রক্ষা ও অধিকৃত কুয়েত পুনরুদ্ধারে আমেরিকাসহ বহুজাতীয় বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে লড়াই করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা। ১৯৯২ সাল থেকে টানা ২ বছর দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল যুদ্ধ বিধস্ত কুয়েত পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখে। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল থেকে পরবর্তী প্রতিটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট একাধিকবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ও গণতন্ত্র চর্চার নির্বাচনে জনগণ ও সরকারের আস্থার নাম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭৫তম প্রিতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে এই বাহিনীতে যোগ দেয়া ও ইতোমধ্যে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া সবার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। সুস্বাস্থ কামনা করি অবসর নেয়া সেনাদের। এযুগের অফিসার ও অন্যান্য ইস্ট বেঙ্গল সেনা, যাদের হাতে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজ এই রেজিমেন্টের রক্তস্নাত ও গর্বের পতাকা, তাদের জন্য রইলো শুভ কামনা।
লেখক: ; প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন অফিসার ও বর্তমান কলম যোদ্ধা
email: [email protected]